ভোট ভোর তখন সাড়ে ছ’টা হবে। ট্রেনটা গয়া স্টেশনে ঢুকছে।আমাদের এবারের গন্তব্য রাজগৃহ বা রাজগীর। আঠাশ জন। গয়া স্টেশনে ঢোকার আগে ঘুম চোখে লাগেজ গুছিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। সবাই নামব। স্টেশনে ঢোকার ঠিক আগেই একটা জায়গায় ট্রেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কামরার গেট খোলা। লাগেজ সমেত নামতে পাঁচ মিনিট সময় দেবে ট্রেন। কিন্তু মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়ল। নামার কোনো উপায় নেই।
সামনে সামনে কয়েকটা মোষ একটা খাটালে তাদের ব্রেকফাস্ট সারছে, চোখ বুজে জাবর কাটতে কাটতে। এই অঞ্চলে শুনেছি জলের থেকে দুধ সহজলভ্য। যাই হোক, এই সব ভাবতে ভাবতে আমি কামরার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। সাথে সেই অনন্ত। আর তার পিছনে ঘুম চোখ খুলে ব্রাশ না করা অবস্থাতেই লিপস্টিক-সজ্জিত আমাদের দলের কিছু মহিলা। তাদের মধ্যে বুলবুলি সবার আগে দাঁড়িয়ে।
আগেরবারের ক্রিসমাস ট্রিপে ট্রেন থেকে নামার স্মৃতিটা সবে একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, তার আগেই
বুলবুলি সে দিনের প্রথম বাউন্সারটা ছেড়ে দিল।
আগের বারের দেজা ভু। আর এবারেও ঠিক ট্রেন থেকে নামার সময়েই গৌতমকে কিন্ত আশেপাশে দেখতে পাওয়া গেল না। খবর এল কামরার অপর প্রান্তের গেটে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। বলাই বাহুল্য, বুলবুলিকে নামানোর দায়িত্ব আবার আমাদের হাতেই এসে পড়ল।
গয়া স্টেশনে ঢুকে ট্রেনটা যেখানে দাঁড়ালো সেখানে বুলবুলির নামতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। টপাস করে দিব্বি নেমে পড়ল।
সেখান থেকে আমরা বাসে করে সোজা হোটেলে। হোটেলটি দারুন। যেমন সুন্দর ঘর, তেমন প্রসাধনক্ষ ও স্নানঘর। নাম রাজগীর রেসিডেন্সি।
রুমে গিয়ে ফ্রেশ হবার পরে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বৌদ্ধ বিশ্ব শান্তি স্তূপের উদ্দেশ্যে। ঐ জায়গাটি ‘রোপ-ওয়ে’ নামে বেশি পরিচিত।
কলকাতার লোকেদের খুব গর্ব যে “পঁচিশে ডিসেম্বর রাস্তায় পিলপিল করে যত লোক বের হয়, তাতে সে দিন বেড়াতে যাওয়া যায় না। চিড়িয়াখানা জাদুঘর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নিকো পার্ক ইকোপার্ক বিশ্ববাংলা গেট ডায়মণ্ড হার্বার এমনকি বেলুড়মঠ -- এই সমস্ত জায়গায় তিল ধরনের স্থান হয় না। শপিং মলগুলোরও তথৈবচ দশা।"
কিন্তু কে জানত বিহারের মত রাজ্যে থরে ধরে, কাতারে কাতারে লোক এই দিন দলবেঁধে এসে একটা শান্তি স্তূপে এমন করে হামলে পড়বে যে কলকাত্তাই ভিড় পুরো গো-বেড়েন হেরো।
মূল গেট থেকে আর রোপ ওয়ের লঞ্চিং স্টেশন পর্যন্ত যেতেই প্রায় দেড় ঘন্টা। তার মধ্যে আবার আছে কিছু বেহেড হুজুগে মানুষ যারা নিয়ম ও শৃঙ্খলা ভেঙে অদ্ভূত পরিতৃপ্তি পায়। মানুষকে এভাবে যন্ত্রণা দেওয়াতেই মজা । এরা নিয়ম ভাঙ্গাকে একটা খেলার মত নিছক বিনোদন বলে মনে করে।
যা হোক, চ্যাংড়ামি সহ সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আমরা কেবল কার-এ উঠলাম। এক-একটা ক্যাপস্যুলে আট জন। সাড়ে তিন মিনিটের জার্নি, পাহাড়ের পাদদেশ থেকে একেবারে মাথায়। বুলবুলি গৌতমকে খামচে ধরে বসে রইল। ওপরে উঠে দেখলাম ঐ সব এলাকা যারা দখল করে থাকে, সেই হনুমানগুলিও মানুষের বিভিন্ন রকমের বাঁদরামী দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাদের থেকে ইতরতর জাতিকে কোনো প্রতিযোগীতায় না গিয়ে, ওয়াক ওভার দিয়ে দিয়েছে। ওখানে আমাদের বিশেষ কিছু করার ছিল না, উপত্যকাটাকে এই পাহাড় থেকে জমিয়ে দেখে নেওয়া ছাড়া। কিন্তু ভাগ্য ভাল না। চারিদিক কেমন একটা কুয়াশাচ্ছন্ন, মলিন। আকাশ, ম্যাড়ম্যাড়ে। আমাদের দলের সবাই ওই ভিড়ে ছিটকে ছড়িয়ে গেল। ওই ভিড়ে ফটো শেসনের কোনো অবকাশ নেই । ব্যক্তিগত ভাবে যার যতটুকু ইচ্ছে হল, তুলল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, ওখানে আসার জন্য যে পরিমাণ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে নষ্ট হল, জায়গাটি ঠিক তার উপযুক্ত নয়। আমরা যতটুকু ছবি-টবি তোলার সব তুলে নেমে আসার জন্য জড় হলাম।
আগে বলা হয়নি যে এখানে ওঠার এবং নামার দু'রকমের রাস্তায় আছে। এক রোপ-ওয়ে আর দ্বিতীয় পদব্রজে, সিঁড়ি দিয়ে। আমি এর আগে একবারই এখানে এসেছিলাম, বাবা-মায়ের সঙ্গে। তখন আমি একাদশ শ্রেণির ছাত্র। অর্থাৎ ১৯৯২ সাল। তখন চেয়ারের রোপ-ওয়ে চলত আর পায়ে হেঁটে। আজ চেয়ারের রোপ-ওয়ে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। বেশির ভাগ যে ধরণের মানুষের সমাগম হয়েছে দেখলাম, তাতে সিঙ্গল-চেয়ার রোপ-ওয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারত, যে কোনো সময়ে। তাই বন্ধ রাখা হয়েছে, মনে হল। তবে আমরা ওঠা-নামা করলাম, কেবল কারে। নামার সময় আমাদের দলের কিছু জন সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাঁরা পায়ে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নামবেন। যাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই নিয়মিত পাহাড়ে চড়েন। ওটাই তাঁদের নেশা। আর তাঁদের সাথে হঠাৎ বার খেয়ে কয়েকজন সেই হেঁটে নামার দলে সামিল হলেন। সেই হঠাৎ বার খাওয়া লোকেদের মধ্যে গৌতমও একজন। কথা নেই বার্তা নেই, গৌতম, ধাঁ।
কিন্তু শোকসন্তপ্ত হয়ে বসে থাকলে তো আর চলবে না! নামতে তো হবেই। তাই বুলবুলি আবার আমাদের সাথেই ক্যাপস্যুলে উপবিষ্ট হবে বলে নামার লাইনে দাঁড়াল। হঠাৎ বুলবুলির দিকে তাকিয়ে দেখি সানগ্লাসের ঠিক নীচ দিয়ে বুলবুলির গাল বেয়ে দু’ফোঁটা জল বেয়ে পড়ছে।
খুব ড্রামটিক্যালি বললাম,
-- তুমি কাঁদছো বুলবুলি!!! গৌতম নেই তো কি হয়েছে, এই তো আমি আছি।
বুলবুলি সানগ্লাসটা কপালে তুলে, আঙুল দিয়ে জল মুছে বলল
কাঁদছি না কাঁদছি না, ঘামছি।
কিন্তু ঘাম ওরকম মেপে ঠিক চোখের তলা দিয়ে দু’ফোঁটা.... এটা কি খুব বিশ্বাসযোগ্য কথা হলো...
এতে বুলবুলি খুব ক্ষেপে গিয়ে বলল
-- তুমি কি শুধু আমার চোখের নিচে জল টুকুই দেখতে পেলে, অ্যাঁ!!!
এরপরে আমি যদি আবার কোন পাল্টা প্রশ্ন করি, শরীরের অন্য্যন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জমা শ্বেদবিন্দুর ব্যাপারে, তখন সেটা খুব অশ্লীল জায়গায় পৌঁছাবে বলে থেমে গেলাম।
তারপর পেছনে ঠিক অনন্ত দাঁড়িয়ে ছিল। এসব শুনতে পেলে খুব বিপদ হবে। এক্ষুনি এগিয়ে এসে বলবে
-- হ্যাঁ হ্যাঁ, গতবছরে এই দিনে বুলবুলিকে ট্রেন থেকে নামানোর বুলবুলিকে ক্যাচ করতে গিয়ে বুলবুলির গায়ের ঘামের গন্ধ এখনো আমার হাতে লেগে আছে। শত ধুয়ে এবং পার্ফিঊম দিয়েও যায় নি।
একে গৌতম নেই, তার ওপর আবার গোদের উপর বিষফোঁড়া!
রোপ-ওয়ে চলতে চলতে মাঝখানে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এখানে বলে রাখা জরুরী ২০২২ সালে দেওঘরে ত্রিকূট পাহাড়ে রোপওয়েতে আটকে পড়েছিলেন ৪৭ জন মানুষ | আড়াই দিন ধরে ভারতবর্ষের তাবড় তাবড় বিভাগ ডিসাস্টার ম্যানজেমেন্টে ‘ঙ’ পেয়েছিল। দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছিল তিনজনের মৃত্যু | ওখানে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে হিমসিম খেয়ে গিয়েছিল ndrf এর মত সংস্থা।
এ ঘটনা সকলের মনে এখনো তাজা। সুতরাং ভয় তো পাওয়ারই কথা, সে যে যাই বলুক না কেন। যতই প্রযুক্তির উন্নতি হোক, এরকম ঘটনা ঘটলে আশঙ্কা তো হবেই। ভরসা এটাই যে ওই ঘটনার পরে সরকার সচেতন হয়েছে, এবং প্রযুক্তিগত উন্নতিও ঘটেছে | ইতিহাস থেকেই তো মানুষ নিজের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে! কিন্তু মন কি আর মানে! সাথে " পড়বি পড় মালির ঘাড়ে" | ঝপাস করে রোপ ওয়ে চলতে চলতে মাঝপথে থেমে দাঁড়িয়ে গেল | ভিতরে গৌতমহীন বুলবুলি |
কিন্তু রোপ -ওয়ে মাঝাপথে থামল কেন?
আমার বদ্ধমূল ধারণা যে আমরা যে ক্যাপসুলটাতে চড়েছিলাম সেটা ওভারলোডেড ছিল | অতটা ওজন টানার জন্য যত কিলোওয়াট বিদ্যুৎ লাগে, তা ওই পরিমাণ লোড টানার জন্য যথেষ্ট ছিল না | ফলে সিস্টেম জবাব দিয়ে দিয়েছিল। সমস্যার সোর্স খুঁজতে সময় লাগবে | কর্তৃপক্ষ সে সব ঝামেলায় না গিয়ে লোড অনুপাতে বিদ্যুৎ দিতেই মিনিট পাঁচ-সাতেকের মধ্যে আবার রোপওয়ে সরসরিয়ে চলতে থাকল |
রোপওয়ে থেকে নেমে তবে স্বতি | এযাত্রা আমরা বেঁচে গেলাম। আর গৌতম আমাদের অনেক আগেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছিল।
জানি না কেন বুলবুলি আর গৌতম দুজনে দুজনকে পেয়ে কোনো ঝগড়ার দিকে গেল না।
বুঝলাম বিশ্ব শান্তি স্তূপে গিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও নিজেদের মনের মধ্যে একটা বড় বিবর্তন ঘটে গিয়েছে |

No comments:
Post a Comment