রোপওয়ের পর লাঞ্চ করে আমরা বাসের ড্রাইভারের কথায় নেচে নালন্দার বিখ্যাত ধ্বংসস্তূপ দেখতে গেলাম। কিন্তু তখন বাজে প্রায় বিকেল পাঁচটা। টিকিট তো দূরস্ত, তখন ঢোকার গেটও বন্ধ হয়ে গ্যাছে | সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে | আমরা বিফল ও ব্যর্থ মনোরথে হোটেলে ফিরে এলাম |
এ হেন পরিস্থিতিতে মন ভালো করার উপায় হল, হয় দার্জিলিং চা,সেকেন্ড ফ্লাশ, না হয়, বুলবুলির আশেপাশে ঘোরা| বুলবুলি যেভাবে ইনসট্যান্ট গল্পের জন্য কনটেন্ট তৈরী করে হাতে তুলে দিতে পারে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে| আর সবথেকে বড় গুন হল বুলবুলি কিছু তৈরী করার উদ্দেশ্যে কনটেন্ট তৈরী করে না, ও গুলো জাসট হয়ে যায় | লালমোহন গাঙ্গুলীর মত| তবে বুলবুলির সঙ্গে ফেলুদার পার্থক্য হল কন্টেন্টের জন্য কোনো বুলবুলির কোনো জটায়ু বা তোপসেকে লাগে না।
সন্ধ্যায় হোটেলে ছিল স্ন্যাকস আর চা-কফি যাকে আজকাল কায়দাবাজি করে বলি হাই টি। তাতে এল অঢেল পটেটো ওয়েজেস এবং ভেজ পাকোড়া। অবেলায় পেট ভরে লাঞ্চ করার হয়েছে। আবার ডিনারে রয়েছে বিরিয়ানি। ফলে আমরা হাই টিয়ে একটু লাগাম দিলাম। যতটুকু প্রয়োজন তার থেকে বেশি আমরা খেতে পারলাম না। এরপর চলল আমাদের ঘরে বসে নিপাট আড্ডা সঙ্গে চা আর কফি ।
ইদানিংকালে আমার একটা বিশেষ রোগ হয়েছে যেখান সেখানকার চা মুখে খুব একটা মুখে রোচে না। তাই আমি নিজের চা আর কফি দুটোই নিজের সাথে বয়ে বেড়াই। আর সেই চা কফি খেয়ে আমার বন্ধু-বান্ধবেরা বেশ মুগ্ধ হয়ে যায়। ফলে আজকাল যখন যে কোন গ্রুপেই বেড়াতে যাই তখন সবাই জানে সে আমার কাছে এলে খুব ভালো চা কফি পাওয়া যাবে। আমারও খুব ভাল লাগে যে এই ছুতোয় আড্ডাটা আমাদের ঘরেই বসে। আর আমাকে অন্য কোথাও যেতে হয় না। সবটা নিজের ঘরে বসেই উপভোগ করি।
এ হেন হাই টি এর পরে কি?
সোনায় সোহাগা।
কারণ, ডিনারে সেদিন ছিল মাটন বিরিয়ানী।
আমাদের দলের মধ্যে যে বহু রত্নের সমাহার, তার জুড়ি মেলা ভার। ওই সব অমূল্য রত্নরাজির মধ্যে অন্যতম আমাদের সকলের প্রিয় হলেন কাজল বাবু। সেই আগের গল্পের কচি পাঁঠার নলি খ্যাত কাজল বাবু। রান্নাবান্না দেখার দায়িত্ব উনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ওনার সব গুণের মধ্যে সবথেকে বড় যেটা, সেটা হল ওনার খাদ্য রসনা। আর ঐ একটি ব্যাপারে উনি খুবই পার্ফেকশনিস্ট । খাবারের গুন, মান বা পরিমাণ কোনোটাআর সাথে উনি কোনোরকম সমঝোতা করতে রাজী নন। খেতে আর কে না ভালবাসে! কিন্তু যারা দুর্জন, তারা খামোখা ওনাকে খাদ্য বিলাসী বলে অপপ্রচার করে ও বদনাম রটায়। বলে কী না উনি নাকি একাই একটা গোটা পাঁঠা সাবাড় করে দিতে পারেন। কে নাকি একবার কবে ওনার প্লেটে খাবার শেষে যে পরিমাণ হাড় দেখেছিল, তাতে তাই মনে হয়। আবার তার পর থেকে নাকি উনি সচেতন হয়ে ক্ষেপে ক্ষেপে গিয়ে হাড় ফেলে আসেন, যাতে কারোর নজর না পড়ে। আচ্ছা একজন মানুষ খাদ্যরসিক, তিনি স্বীকার করেন। তাই বলে কি ওভাবে তাঁর পিছনে কি লাগা উচিত! মানুষের সারল্যের কোনো দাম নেই, আজকাল। জটিল হওয়াটাই যেন দস্তুর। আর পারলে তোরাও খা না বাবা, আটকিয়েছে কে! নিজেরা পারে না বলে অন্য যে পারে টাকে এভাবে ছোট করলে পাপ হয়। আর কিছু না হোক, এটা ভুললে চলবে না যে, কাজলদার অযাচিত উদ্যোগের দরুণই সেদিন একটি অন্য ধরণের বিরিয়ানী আমরা ডিনারে পেয়েছিলাম। আর সে মাটনের কোয়ালিটি উনি নিজে চেক করে এসেছেন। বিরিয়ানীর মাংস থেকে হাড় ধরে টেনে বের করতে কোনো আলাদা চেষ্টা বা বলপ্রয়োগ করতে হচ্ছে না । এমনিই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তুলে ধরলে তুলতুলে নরম মাংস নিজের ভার রাখতে পারছে না, থপ করে পড়ে যাচ্ছে। এরকম পলান্ন ডিনারের শেষে আবার গরম পান্তুয়া। পেটে আর তিলধারণের জায়গা নেই কারোর। কিন্তু ওই গরম পান্তুয়ার লোভে যেন একটা আলাদা ছোট্ট স্টমাক তৎক্ষণাৎ গজিয়ে উঠল। পেট ভরে খাওয়ার পর সকলের চোখ বুজে এল অসামান্য তৃপ্তিতে দুপুরে তো আর বিছানায় পিঠ ঠেকানোর সুযোগ হয় নি! ফলে রাতের ভাতঘুম, থুড়ি, বিরিয়ানি ঘুম কেমন যেন চারিদিক থেকে আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলল। তাই বিশেষ কথা না বাড়িয়ে যে যার ঘরে চলে গেলাম।
এবার এইখানে যেটা না বললেই নয়, তা হল হোটেল রুম নিয়ে চাপান উতর | যদিও এই সাইক্লোনের সৃষ্টি হল কৃত্রিম ভাবে কারণ ঘর ভাগের দায়িত্বে ছিলেন আমাদের মধ্যের আর এক রত্ন প্রদীপ্ত লেট- দা | সকালবেলায় যখন হোটেলে আমরা উঠছি, তখন একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল, যে কাকে কোন ঘর দেয়া হবে? এত বড় গ্রুপে ঘরের কথা কেউ আলাদা করে ভাবে না | হৈ হৈ করে আড্ডা দিয়ে কেটে যাবে, এটাই সকলের মূল লক্ষ্য | আর হয়ও তাই | হোটেলের ঘর কেমন সেটা বিচারের মূলতঃ দুটি দিক থাকে - এক, বিছানা আর দুই, বাথরুম | এই দুটো মোটামুটি হলেই চলে যায় | রাজগীর রেসিডেন্সিতে দুটোই ছিল অনবদ্য। বিশাল বিশাল ঘর। প্রমাণ সাইজের বিছানা। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন সুন্দর বড় বাথরুম | মানে হোটেলের ঘর নিয়ে কারোর কোনো রকমের অভিযোগ প্রকাশের অবকাশই ছিল না। হোটেলটি আপাদমস্তক যিনি সাজিয়েছেন এটুকু মেনে নিতে হবে যে তাঁর একটা সফিস্টিকেটেড এবং অ্যারিস্টোক্রেটিক রুচিবোধ আছে। যাই হোক হোটেলের ঘর ও তার মানের দিক থেকে কোথাও কোনো রকম অভিযোগ তো দূর, আমরা যার পর নাই খুশি হয়েছিলাম। এতটা ভাল অপ্রত্যাশিত ছিল। আর এর পুরোটার জন্য প্রশংসার দাবী রাখে নান আদার দ্যান অনন্ত।
কিন্তু লেট দা ঠিক এতটা মেনে নিতে পারল না। হোটেলের ঘর পাওয়া নিয়ে কিছু কূট কচালি হবে না, এরকম পানসে ব্যাপার ওনার সহ্য হল না। উনি ঘর বাছাইয়ের ক্রাইটেরিয়াকে একটা ফোর্থ ডাইমেনশনে নিয়ে গেলেন।
আমাদের পুরো টীমের জন্য বুক করা হয়েছিল দুটো ট্রিপল আর এগারোটা ডাবল বেডরুম। এই এগারোটার মধ্যে মাত্র দুটোতে জোড়া বিছানা, যাকে আমরা চলতি বাংলায় খাট বলি।
বিষয়টা এখানে বোঝার আছে। ডাবল বেড মানে দুজনে শোয়ার মত খাট। সব ঘরে ছিলও তাই। কিন্তু সেই থাকার একটা প্যাটার্ন আছে। কি রকম? না, কিছু ঘরে দুটো খাট জোড়া মানে দুটো সিঙ্গেল বেডকে একসাথে করে একটা ডাবল বেড করা হয়েছে। আর বেশির ভাগ ঘরে দুটো খাট আলাদা আলাদা রাখা, মাঝখানে বেড সাইড টেবিল।
আমাদের মধ্যে সবথেকে বয়োজ্যেষ্ঠ মেজদা অর্থাৎ মিহিরদার বয়স হলেও সেন্স অফ হিউমারটা বেশ সতেজ। উনি এই খাটের নাম দিলেন জরাসন্ধ খাট।
******
হঠাৎ জরাসন্ধ কেন!!! এর কারণ হলো, যারা জানে জরাসন্ধের জন্ম ও মৃত্যু কেমন ভাবে হয়েছিল, তারা জানে। সাথে আবার যে জায়গায় এসেছি, তা হল, মগধ। একসময় জরাসন্ধ ছিলেন সেখানকার অধিপতি, সারা মধ্য ভারতের একচ্ছত্র সম্রাট।
জরাসন্ধের বাবা বৃহদ্রথের সাথে কাশীরাজের দুই জমজ কন্যার বিবাহ হয়। বৃহদ্রথ দুই রাণীকেই সমান ভাবে ভালবাসতেন | কিন্তু তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। সন্তান হওয়ার জন্য ঋষি চন্ডকৌশিক একটি ফল দুই রাণীকে খেতে দিলে বৃহদ্রথ সেই ফল সমান দুভাগে আধাআধি কেটে দুই রানীকে দেন। দুই রানী সন্তান সম্ভবা হন। তাঁরা প্রত্যেকে যখন শিশুর জন্ম দেন তখন আধাআধি দুই মৃত শিশু ভূমিষ্ট হয় | দুটি ভাগেই কোন প্রাণ ছিল না | ফলে শোকে মূহ্যমান হয়ে রাজা বৃহদ্রথ ওই আধা শিশু দুটিকে জঙ্গলে নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দেন। আধা মৃত সেই দুটি টুকরো কুড়িয়ে পায় জরা নামে এক দানবী | কচি মানব শিশুর অর্ধেক দুটো টুকরো একসাথে গিলে ফেলার জন্য কাছাকাছি আনতেই টুকরো দুটি জুড়ে গিয়ে একটি সম্পূর্ণ শিশু তৈরি হয় এবং তাতে প্রান আসে। শিশুটি কেঁদে ওঠে। জরা ভয় পেয়ে যায়। আর ওই মৃত অবস্থা থেকে জুড়ে গিয়ে জ্যান্ত শিশুকে খাবার সাহস তার আর হল না। সে ছুটে ওই শিশুকে রাজা বৃহদ্রথের কাছে নিয়ে আসে। রাজা তো আনন্দে আত্মহারা, মৃত দ্বিধাবিভক্ত সন্তানকে জ্যান্ত স্বাভাবিক আসত গোটা অবস্থায় পেয়ে। তখন দানবী জরা যেহেতু ওই শিশুনকে প্রাণ দান করেছে এবং যেহেতু দুটি টুকরো জুড়ে (সন্ধি ঘটিয়ে) এই শিশু সৃষ্টি হলো তাই তার নাম রাখা হলো জরাসন্ধ।
পরবর্তীকালে উত্তর ভারতে মগধের সম্রাট হলেন জরাসন্ধ ভারতবর্ষের তাবড় বীরেরা জরাসন্ধের বীরত্বের নামে কেঁপে উঠতেন। জরাসন্ধের সাথে কনক্লিক্ট ছিল স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের। শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে রীতিমত নাচিয়ে রেখেছিলেন এই জরাসন্ধ। জরাসন্ধের বীরত্ব নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের মনে কোন দ্বিধা ছিল না। পান্ডবদের কূটনীতিবিদ হিসেবে তিনি বলেই দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে যে অশ্বমেধ যজ্ঞ ততদিন করা উচিত নয় যতদিন জরাসন্ধ জীবিত আছেন কারণ জরাসন্ধ জীবিত থাকা অবস্থায় কখনোই ওই যজ্ঞ সাফল্য পাবে না ।
জরাসন্ধ মোট ১৭ বার মথুর আক্রমণ করেন এবং সে আক্রমণ এতই তীব্র ছিল যে মথুরাবাসীরা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গিয়েছিল। জরাসন্ধের মথুরার প্রতি আলাদা আক্রোশের কারণ শুধুমাত্র মথুরা জয়ে নিহিত ছিল না। এর মধ্যে ছিল কৃষ্ণের সাথে প্রতিহিংসার চরিতার্থ করার এক বিরাট প্রতিজ্ঞা। জরাসন্ধ যাদব কুলকে শ্রীকৃষ্ণ সমেত নিশ্চিহ্ন করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
কিন্তু এই প্রতিহিংসাপরায়ণ ভীষন প্রতিজ্ঞা কেন?
কারণ মধুরা রাজ কংসের সাথে জরাসন্ধের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। জরাসন্ধ কংসকে নিজের জামাতা রূপে গ্রহণ করে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ কংসকে হত্যা করার পরে ফলে জরাসন্ধের কন্যা অত্যন্ত অল্প বয়সে বিধবা হন। ফলে জরাসন্ধের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে শ্রীকৃষ্ণের ওপর । ২৭ অক্ষৌহিনী সেনা নিয়ে জরাসন্ধ আক্রমণ করেন মথুরা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের কূটনীতিবিদ্যার পারদর্শিতার ফলে মথুরা সে যাত্রা জরাসন্ধর আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। এরপর জরাসন্ধ মোট ১৭ বার মথুরা আক্রমণ করেন। কোনোবারই জরাসন্ধ জিততে পারেন নি। কিন্তু শান্তি বার বার বিঘ্নিত হওয়ায়, শ্রীকৃষ্ণ প্রমাদ গুনলেন। স্বয়ং বিশ্বকর্মাকে বললেন, সকলের অলক্ষ্যে নিজের রাজধানী ও নগর দ্বারকায় প্রস্তুত করতে। বিশ্বকর্মা একদিনের মধ্যে তৈরি করে ফেলেন দ্বারকা। শ্রী কৃষ্ণ ও বলরাম প্রজা সমেত সবার অলক্ষ্যে মথুরা থেকে দ্বারকায় চলে আসেন। শেষবার জরাসন্ধ মথুরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেন। ওনার স্থির বিশ্বাস ছিল যে শ্রীকৃষ্ণ ওই আক্রমণে নিশ্চিত নিহত হয়েছেন। সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় যখন শ্রী কৃষ্ণ কৌরবদের সভায় আত্মপ্রকাশ করেন। তখন উনি প্রথম জানতে পারেন যে কৃষ্ণ বহাল তবিয়তে জীবিত। উনি শুধুমাত্র তার রাজধানী বদল করেছেন মথুরা থেকে দ্বারকায়।
জরাসন্ধের মৃত্যুও আর এক গল্প। ঠিক যেভাবে জরাসন্ধকে জন্মের সময় দুটি ভাগে পাওয়া গিয়েছিল ঠিক সে রকম ভাবেই মল্লযুদ্ধে জরাসন্ধকে চিরে দুভাগ করে দিয়েছিলেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম। শ্রীকৃষ্ণ পরিস্থিতিকে এমন জায়গায় পৌঁছে দিলেন যে জরাসন্ধ রেগে আগুন। কৃষ্ণ মল্লযুদ্ধে জরাসন্ধের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বেছে নিতে বললেন, হয় তাঁকে, না হলে ভীমকে। জরাসন্ধ বাছলেন ভীমকে। শুরু হল মল্লযুদ্ধ। ২৮ দিন ধরে চলল যুদ্ধ। এক টানা। পাঁচ মিনিট অন্তর এখানকার যে কোনো টিভি অনুষ্ঠানের মত ব্রেক না নিয়ে। দু'জনের কেউ কাউকে হারাতে পারছে না। শেষের দিকে জরাসন্ধ শক্তিক্ষয় করতে থাকেন। এই সময় শ্রীকৃষ্ণ আড়াল থেকে একটি গাছের পাতাকে মাঝখান থেকে দুদিকে চিরে ভীমকে সংকেত দেন কিভাবে জরাসন্ধকে মেরে ফেলা সম্ভব। কিন্তু ভীম যতবারই তাঁকে চিরে দু ভাগ করে দেন, ততবারই আবার চেরা দুটি খন্ড জুড়ে জরাসন্ধ বেঁচে ওঠেন। চুম্বকের মতোই দুটি খন্ড পরস্পরকে টেনে জুড়ে গিয়ে আবার পূর্ণাঙ্গ জরাসন্ধে পরিণত হয়। এরপর শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারেন যে ভুল হচ্ছে। তখন তিনি আরেকটি গাছের পাতা তুলে নিয়ে ঠিক মাঝখান থেকে চিরে ক্রস করে দুটি বিপরীত দিকে ফেলার সংকেত দেন ভীমকে। ভীম এবারে সেই সংকেত অনুসারে জরাসন্ধকে চিরে জরাসন্ধের শরীরের দুভাগ কে বিপরীত দিকে ছুঁড়ে দেন। এবারে টুকরো দুটি জোড়া লাগে না এবং জরাসন্ধের এখানেই মৃত্যু ঘটে।
কিন্তু ইতিহাসের অংশ হিসেবে এটুকু ভুললে চলবে না যে উত্তর ভারতে সর্বশক্তিমান মগধ সম্রাটদের মধ্যে জরাসন্ধের নাম চিরদিন থেকে যাবে আর শ্রীকৃষ্ণ না থাকলে জরাসন্ধ একাই মহাভারতের ইক্যুয়েশন বদলে দিতে পারতেন।
*****
এখন ঘটনা হলে যে আমাদের গ্রুপে অ্যালট করা সব রুমের মধ্যে মাত্র দুটো রুম ছিল যেগুলোর খাট জোড়া অর্থাৎ কিনা সিঙ্গেল ইউনিট ডাবল বেড আর বাকিগুলোর সবকটাই ডাবল ইউনিট ডাবল বেড| আমাদের লটারিতে উঠল জোড়া খাট।
আমি সবে আমাদের রুমে লাগেজ নামিয়ে সব গোছগাছ করে রাখছি, লেট দা এসে আমাকে বললেন,
- আর এই ঘরটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো রুম দিলে কি তোমার খুব অসুবিধা হবে।
- না একেবারেই না।
- তাহলে এরা (বলে এক দম্পতিকে দেখিয়ে) একটু বেড়াতে এসে একই কম্বলের নিচে গরম হবে বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। বড্ড ঠান্ডা তো!
আমি আর কি বলি। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য।
তারপরে বললাম
- নিশ্চই নিশ্চই ... আমার কোনো অসুবিধা নেই।
জোড়া খাটের ঘর ছেড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আবার হাঁটা দিলাম চেরা খাটের ঘরের উদ্দেশ্যে |
ঘর বদলে যে ঘরে এলাম তাতে চেরা খাট ছাড়া সবএকই | বরং উপরি পাওনা হল যে আমাদের ঘরের উল্টো দিকেই বুলবুলি- গৌতমের ঘর |
বুলবুলির সাথে দেখা হতেই বলল
- ও তুমি আমার উল্টোদিকে?
- হ্যাঁ...আমি চেষ্টা করেছিলাম দূরে থাকতে...কিন্তু দেখ, বিধি-ও চান না, এরকম হোক।
- কেন কি হল?
- কি আর হল...আমাদের যে ঘরটা দেওয়া হয়েছিল, আমাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
- সে কি কথা, কেন...
- আমাদের মধ্যে কোনো এক দম্পতির প্রেম করার জন্য জোড়া বিছানা চাই, তাই।
- জোড়া বিছানা মানে?
- মানে বোঝানো যাবে না। নিজে গিয়ে দেখে এস।
- চল, তুমিও...
- বেশ চলো....
এরপরে জোড়া খাট চাক্ষুস করে পুরো ব্যাপারটা বুঝে বুলুবুলি বলল,
- বাপরে!!!! তোমরা সবাই -কি মাত্রায় রোম্যন্টিক হয়ে উঠেছ।
- এর মধ্যে রোমান্সের কি দেখলে আবার!!!
- তোমরা হঠাত সবাই মিলে একে অপরকে নতুন করে চিনতে চাইছ, ঐ বয়েসে। ওকে! আমি বলছি, লেটদা কে, যদি আরেকটা জোড়া বেডের ঘরের ব্যবস্থা করতে পারে। ঊঈশ ইউ গুড লাক। শুধু যা কর, কর, কিন্তু মনে রেখো, এই বয়সে আবার এর জেরে মাস দুয়েক পরে বোলো না, 'আর্য, সুখবর আছে। রাতে নিচে আড্ডায় মিষ্টি খাওয়াবো।'
বুলবুলি, খ্যাঁক করে বলে উঠল,
- আ মরণ, সে জন্য নয়...
দেখচ দু'জনে একসাথে বেশিক্ষণ কাছাকাছি থাকলে ঝগড়া ছাড়া আর কিছু হয় না...তাতে আবার ও সব...
আসলে আমি একবার একটা হোটেলে সিঙ্গল বেডে ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরতে গিয়ে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলাম। কোমরে এমন লেগেছিল যে সে যাত্রা আর বিশেষ কোথাও ঘোরা হয় নি। বাকি দিন গুলো তাই আমার জন্য ডাবল বেড-ই ভাল।
দেখলাম জরাসন্ধ খাট বিষয়ে বিশেষ কথা না বাড়ানোই ভাল।
(চলবে)



.jpeg)
No comments:
Post a Comment