এবারে আমরা এসেছি নালন্দার তৃতীয় পর্বে।
(এবার নিচের পুরোটাই আমাদের গাইড সাহেবের বলা হিন্দি কথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বঙ্গানুবাদ)
সাধারণ ভূমিকা:
**********
“পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের স্বাগতম।
(World’s First International Residential University)
আমি কমলা সিং, আপনাদের আজকের মার্গদর্শক।
আমরা চলেছি বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে।
নালন্দা শব্দের ব্যূৎপত্তিগত অর্থ হল (Etymological meaning):
‘নালম দধাতি ইতি’ হল ‘নালন্দা’| ‘নালম’ মানে ‘পদ্মের নাল’| আর, যে ভূমিতে পদ্মের জন্ম হয় তা হল ‘দা’। ‘পদ্ম’ হল জ্ঞানের প্রতীক -- জ্ঞানের পদ্মসম ফুল যে স্থানে ফোটে তাই-ই ‘নালন্দা’ – জ্ঞানপীঠ।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আনুমানিক আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর পুরোনো।
প্রথম কুমারগুপ্ত 427 CE (common era) তে নালন্দার গোড়াপত্তন ঘটান। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ শুধুমাত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য “জ্ঞাণ ও প্রজ্ঞার স্বর্ণযুগ ও পবিত্রভূমি” হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল।
*****
এই পর্যন্ত বলে আমাদের গাইড সাহেব এগিয়ে যেতে লাগলেন, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব প্রবেশ দ্বার পেরিয়ে। আমরা পিছনে পিছনে। কমলা সিং-জি কে আমদের মার্গদর্শক হিসেবে নেওয়ার আগে আরো এক্জনের সঙ্গে কাজল বাবু প্রায় কথাবার্তা শেষ করে এনেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে নাকচ করে দিয়ে সিং-জি কে সাথে নেওয়া হয়। সেই নিয়ে বিড়বিড় করে আলোচনা চলছিল অনন্তর সঙ্গে। সিং-জির সজাগ কান তা এড়িয়ে গেল না। অনন্ত-কে বললেন,
- বহুত সারে হ্যায়্, মেরা লায়ক্, ইহাঁ পে...আপ জিসে চাহে চুন সখ্তে হ্যায়্...
অনন্ত বলে উঠল,
- মে বি দেয়ার আর মেনি গাইড্স্, বাট দে মে নট বি অ্যাজ নলেজেবেল অ্যাজ য়্যু। রাইট্?
- কৌন কাহা?
- ম্যাঁয় বোলা। আপকা বাল -কা কলর দেখ কে হাম বোলে হ্যাঁয়্।
- আরে বাল কা কলর তো....ক্যায়া বোলে, হাম পিছ্লে ছব্বিশ সাল সে ইয়ে কাম কর রাহা হ্যায়।
- ওহি.... ওহি... হ্যায় না....এজ ইজ এক্স্পিরিয়েন্স, অ্যান্ড নলেজ ইজ পাওয়ার...
বুলবুলি বলে উঠ্ল্,
- বাল দেখ্কেই হাম ঠিক আদমি পেহচান লিয়া...
চারপাশে সবাই হেসে উঠল।
এ তো আচ্ছা মুশাকিলের কথা। বুলবুলি যা ই-ই বলে তাতে সবার এত হাসির কি আছে!! কই, অনন্ত যখন বলছিল, তখন তো কেউ ওরকম করে হেসে উঠল না!! সব হাসি যেন বুলবুলির কথায়! অকারণে।
কিন্তু তাতে বুলবুলি রাগ করে না। এটা ওর মহত গুণ। এখানেই একজন বিজ্ঞ মানুষের সাথে সাধারণদের পার্থক্য।
কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে। সিং-জি হাসির শেষে বললেন,
- তা হলে বলা শুরু করি?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ...
- নালন্দার সবথেকে গুরুত্ব্পুর্ণ প্রবেশ দ্বার, পূর্ব প্রবেশ দ্বার দিয়ে আমরা ভিতরে এলাম। আর আমাদের কোনো পরীক্ষা দিতে হল না।
তবে এই বিহারের (এখানে 'বিহার' মানে রাজ্য নয়, আগের পর্বে এর অর্থের সময়ানুপাতিক ব্যাখ্যা করা আছে) সীমানার বিস্তার ওই দূরের গাছটা অব্দি। এখানে (নালন্দায়) মোট এগারোটি বিহার আছে। আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে এগারোটা বিহার যদিও দেখা যাচ্ছে না। আরো একটু এগিয়ে গেলে দেখা যাবে।
যেটা এখানে বলার, যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সাত্শো বছরের কিছু বেশি দিন চলেছিল। তাই অতগুলি শতক ধরে একটা মাত্র ভবন-ই যথেষ্ট ছিল না। কখনো পুরোনো ভবন খারাপ হত, কখনো আবার রাজবন্দীরাও থাকতেন। কখনো আক্রমনে নষ্ট হয়েছে। এবারে যেহেতু সমগ্র প্রতিষ্ঠাণটি চলত ধর্মীয় ফিলজফির ওপরে ভিত্তি করে, তাই নষ্ট হয়ে যাওয়া ভবনগুলিকে কখনই সম্পূর্ণরূপে ধূলিসাথ করে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। আগের পুরোনো জায়গাটাকে ধ্বসিয়ে দিয়ে সেটাকে ভিত করে তার ওপরে নতুন কাঠামো গড়া হত। প্রত্যেক যুগে এরকম হয়েছে। ফলে নতুন স্তর (লেভেল) তো গঠিত হবে, এটাই স্বাভাবিক।
এবারে যা দেখছেন, তা হল একজন বিদ্যার্থীর থাকার ঘর। আগেই বলা হয়েছে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে প্রত্যেক বিদ্যার্থীকে নিজস্ব ঘর দেওয়া হত (সিঙ্গল অক্যুপ্যান্সি)। শেয়ার করার কোনো ব্যাপার ছিল না। ওটা ছিল হোস্টেলের প্রবেশের দরজা, যা পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আর ঐ লাইন বরাবর সব বিদ্যার্থীদের থাকার ঘর, তারপরে দেখছেন, ওই করিডোর আর এর পরে আছে লেক্চার হল। লেক্চার হল এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। ওদিকে বেঁকলে তবে পাবেন। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে সেটা হল বিহার সংখ্যা পাঁচ। এর প্রথম লেভেল হল যেখানে আমাদের পা। দ্বিতীয় লেভেল , ওই যে। তৃতীয় লেভেল নালীর পাশে। আর চতুর্থ লেভেল হল ওই ওপরে।
চার লেভেল চার রাজত্বকাল (আওয়াদী/অক্যুপেশন্)। সবটা খুব স্পষ্ট। দ্বিতীয় লেভেল ওব্দি একটা সিঙ্গল ব্লকের বিল্ডিং ছিল যা ভবনের প্রবেশদ্বার ওব্দি বিস্তৃত ছিল। তার এন্ট্রান্স কিন্তু নীচে ছিল না। কিন্তু পরের দুটি যুগে যখন এখানকার ছাত্র সংখ্যা বাড়ল, তখন এই একটা ব্লক-কে দু-ভাগে ভাগ করে দেওয়া হল। তখন এটাকে মাঝখান থেকে কেটে দেওয়া হল। তার আগে এখানে কোনো সিঁড়ি ছিল না। এখন এটা পঞ্চম স্তর, আর ওপরের টা চতুর্থ। এটা কোনো স্বতন্ত্র বিহার ছিল না। এটা চতুর্থ বিহারের এক্স্টেনশন মাত্র, যাকে মোনাস্টিক অ্যানেক্স বলা হয়। আবার ভাল করে দেখুন: ওই হল পাঁচ্, আর এই হল চার।
আরো দেখুন দেওয়াল কি রকম চওড়া: আট ফুট। (জাস্ট ভাবুন্, আট ফুট চওড়া দেওয়াল, মানে ছিয়ানব্বই ইঞ্চি। আমার হাইট ছ্’ফুট দুই ইঞ্চি। আমাদের ফ্ল্যাটের দেওয়াল কোথাও কোথাও দশ ইঞ্চি ম্যাক্সিমাম)। এরকম চওড়া দেওয়াল হওয়ার কারণ হল, বহুতল বিল্ডিং-এর লোড অনেকটা। পাইলিং সিস্টেম তো সেকালে ছিল না। ফলে ফাউন্ডেশন-ই সব। দেওয়ালকেও ওই ভিত্তি বা ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ধরা হত। তাই অত চওড়া দেওয়াল। আর এত চওড়া দেওয়ালের আর একটা সুবিধা ছিল যে তা ন্যাচারাল এ-সি র কাজ করত।
তাহলে দাঁড়াল কি!
এই হল কামরা/ঘর; আর ওইটা হল চার নম্বর স্তর; এটা দুটি ব্লকের মধ্যের প্যাসেজ আর ওই হল নতুন গেট, যেখান দিয়ে আমরা হোস্টেলে ঢুকলাম।
আসুন আমার সঙ্গে....
******
এগোনোর আগে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এক একটা স্তর পেরোনো মানে এক এক শতাব্দী, এক এক রাজত্ব কাল। টাইম মেশিনে ভ্রমণ একেই বলে। বর্তমানে যখন হুঁশ ফিরে আসছে, তা যেন স্পিলবার্গের ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’!
মনে মনে ঘুরতে লাগল,
ভারতে মুসলিম রাজত্ব ছিল মোটামুটি পাঁচশ বছর। (1200-1700)
সে সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইমারত
ফতেপুর সিক্রীর বয়েস: সাড়ে চারশো বছর। স্থাপনকাল 1569
তাজ্মহলের বয়েস তিনশো পঁচাত্তর বছর। স্থাপনকাল 1639
আবার ইংরেজ রাজত্ব ছিল প্রায় দু’শো বছর। 1757 -1947 (1757-1857/1858-1947)
কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই ইংরেজরা এদেশে থাকত।
ফোর্ট ঊইলিয়াম স্থাপিত হয় তিন্শো আঠাশ বছর আগে। স্থাপনকাল 1696
রাইটার্স বিল্ডিং এর বয়েস দু’শো পঁয়তাল্লিশ বছর। স্থাপনকাল 1780
আমাদের সালকিয়ার পুরোনো বাড়ির বৈঠকখানার বয়েস একশো পঁচিশ।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে দেখতে গেলে:
বলোগানা: স্থাপনকাল 1088 (পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখনো চালু আছে)
অক্সফোর্ড: স্থাপনকাল 1096
কেম্ব্রিজ : স্থাপনকাল 1209
সেনেট অফ শ্রীরামপুর ইউনিভার্সিটি: স্থাপনকাল 1818 (ভারতে স্থাপিত প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়)
কলকাতা: স্থাপনকাল 1857
আর আমরা দাঁড়িয়ে আছি আজ থেকে দু’হাজার ছ’শো বছরের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ধবংসাবশেষে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
গায়ে জাস্ট কাঁটা দিল, যখন হোস্টেল রুমের ভিতরে প্রবেশ করে অনুমান করতে লাগলাম, সেই ঘরেই থাকতেন সে সময়ের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্যার্থীদের কোনো এক জন করে, বিভিন্ন সময়ে, সাত শো বছর ধরে....
তাঁরা কেউ নেই এখন পৃথিবীতে। কেউ তাঁদের নাম জানেন না, সে সময়ের শ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু তাঁদের আশ্রয়্দাতা সেই ইমারত, সেই বিদ্যা ও জ্ঞানের পীঠস্থান যেমন কে তেমন সেই, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পুড়িয়ে, গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরেও। মাটির তলায় চাপা পড়ে যাওয়ার পরেও।
একেই বলে
‘রাখে হরি, মারে কে’
না কি একেই বলে,
‘অমর’
না কি,
‘ফিনিক্স’!
না কি,
'মিঠুন চক্কোত্তি’,
একশো গুলিতেও যাঁর মৃত্যু নেই!!!
(চলবে)

No comments:
Post a Comment