কাচের ব্রিজ থেকে বেরিয়ে, আমরা সোজা চলতে থাকলাম নালন্দার উদ্দেশ্যে। ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটা। তখন লাঞ্চ করতে গেলে নালন্দায় সময় কমে যাবে। কোনো অবস্থাতেই সেটা তো করা যাবে না। গতকাল বিচ্ছিরি মিস হয়েছে। ঢুকতেই পারিনি। এই যে এত পথ ভ্রমণ করে রাজগীরে আসা, তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য নালন্দা দর্শণ। বাকি সব কিছু উপলক্ষ্য মাত্র -- এই 'বিশ্ব শান্তি স্তুপ' বা 'গ্লাস ব্রিজ' বা অন্যান্য আরো যা কিছু, সব শুধু টাইম পাস। তাই লাঞ্চ পিছিয়ে গেলে কোনো আপত্তি নেই। তবে লাঞ্চ না করে গেলে আবার পিছুটান থেকে যাবে। ফলে একটা দোটানা ও মতভেদ রয়েই গেল।
আমার সাথে যাঁরা ছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই যথেষ্ট শিক্ষিত, এবং শিক্ষার মর্যাদাকে কখনো অসম্মান বা উপেক্ষা করেন না। সেখানে যখন জানতে পারা যায় যে ভারতবর্ষে এমন একটা জায়গা ছিল যেখানে পৃথিবীতে প্রথম হোস্টেল ফেসিলিটি ছিল এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়- এর তকমা পাওয়া উপাধিধারীদের পৃথিবীব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তখন আর কিছু না, গর্ব বোধ হয়। একদিনের একবেলার লাঞ্চ সেখানে খুব ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ।
কিন্তু ভাবলেই দুঃখ হয় যে আজ সেই শিক্ষার মান কোথায় নেমেছে – সেই ভারতবর্ষেই যখন ক্লাস এইট পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দেওয়া হয়েছে। এই বিহার রাজ্যেরই কোনো এক মুখ্যমন্ত্রী আবার নিরক্ষর ছিলেন – তখন সবটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। আরো কষ্ট হয় যে আমরা সেই ভারতেই বাস করি যেখানে আড়াই হাজার বছর আগে নালন্দা পৃথিবীর সর্বপ্রথম বৃহত্তম রেসিডেন্সিয়াল ইউনিভার্সিটি ছিল। উৎকর্ষের মান তো প্রশ্নাতীত। এখানে দাঁত ফোটাতে গেলে উচ্চ মানের মেধা, বিদ্যা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন ছিল। (পরের পর্বে সে নিয়ে আরো বিশদে আলোচনা করা যাবে) শুধু ভারতের নয় পৃথিবীর সমস্ত মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল যে তাঁরা কি করে নালন্দার মত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করবেন।
নালন্দার বিশাল ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে এটুকুই শুধু মনে হচ্ছিল: কি ছিলাম, আর কি হয়েছি!
সব থেকে বড় কথা বুলবুলিও বেশ বিদুষী। যথেষ্ট মেধা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী। যে ধরণের প্রশ্ন বুলবুলি আমাদের গাইড্কে করছিল, তাতে তার জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সহজেই অনুমেয়। তাই নালন্দায় দাঁড়িয়ে আমি অন্তত বুলবুলিকে নিয়ে মজা করাটুকু ছেড়ে দিই কিছুক্ষণের জন্য। সব জায়গায় সব কিছু খাপ খায় না। গৌতম-বুলবুলির মধ্যে এই নালন্দা পর্বে কিছু ঘটে নি তা নয়। শুধুমাত্র গুনগত উৎকর্ষের খাতিরে নালন্দায় দাঁড়িয়ে সেই হালকা মজাটুকু এক্কেবারে এড়িয়ে গেলাম। কারণ, মানবসভ্যতার উন্নততম প্রাচীন জ্ঞান ও বিদ্যার পীঠস্থানে দাঁড়িয়ে অন্তত এত সস্তা মজা ঠিক মানানসই লাগে না।
আমি ভাবতেই পারছি না যে আমি দ্বিতীয়বারের জন্য দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর প্রাচীনতম ও বৃহত্তম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, যার অস্তিত্ব সবাইকে, পৃথিবীর তৎকালীন সমস্ত ক্ষমতাকে রীতিমতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। কারণ নালন্দা ছিল জ্ঞান, বিদ্যা ও প্রজ্ঞার একমাত্র আধার যা সমস্ত শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অনায়াসে খর্ব করতে পারে।
“ নালন্দা, স্যালুট!” – মনে মনে এই কথা বলে পোড়া ইঁটের গায়ে স্পর্শ করতেই মনে হল আমার জীবন সার্থক |
যত বয়েস বেড়েছে, বেড়েছে ইতিহাসের প্রতি কৌতূহল। ইস্কুলে পড়ার সময়ে খালি সাল মুখস্থ আর অমুক পাতা থেকে তুসুক পাতা ওব্দি ঝাড়া মুখস্থ – পড়তে বসলেই ইতিহাস বিষয়ের নামে গায়ে জ্বর আসত। আর প্রচলিত ভুল ধারণা ছিল, যে যত পাতা উত্তর লিখতে পারবে, সে তত নম্বর পাবে। ফলে কোনো আগ্রহ-ই তৈরী হয় নি। এখন যা-ই দেখি শুনি শিখি, তাতে ইতিহাস ব্যাপারটা অনিবার্য কারণে হলেও অবধারিত ভাবে চলেই আসে।
তাই নালন্দার সামনে দাঁড়িয়ে আমার জীবন ধন্য কেন মনে হল, তা কিছুই না, নালন্দার ঐতিহাসিক স্থান-মাহাত্ম, ও শিক্ষাক্ষেত্রে তার গুরুত্ব। খুব গভীর উপলব্ধির ব্যাপার।
এখানে বলে রাখি, এই লেখায় নালন্দা সম্পর্কে তথ্যগত কোনো ত্রুটি থাকলে তার দায় আমার নয়। আমাদের সাথে যিনি গাইড ছিলেন, তাঁর বয়স সত্তরের ওপরে। তিনি পান-সুপুরি চিবোনো মোটা জিবে শুদ্ধ হিন্দিতে যা যা বললেন তা আমি মোবাইলে রেকর্ড করে নিতে থাকলাম। এক একটি স্থানে দাঁড়িয়ে উনি যা যা বললেন সবটাই আমি মোবাইলে বন্দী করে নিয়ে এলাম। সেগুলোর বাংলা তর্জমা এখানে করছি। তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুবাদ রাখলাম। সেই হিসেবে তথ্যে কোনো গরমিল থাকলে তা আমাদের শ্রদ্ধেয় গাইড সাহেবের।
অনুবাদ করার সময়ে গাইড সাহেবের বলা কিছু জায়গায় সন্দেহ থাকার দরুন, সে সব নিরাময়ের উদ্দেশ্যে আমাকে দু'জনের সাহায্য নিতে হয়েছে। এক, সুমন্ত নালন্দা সম্পর্কে যে গাইড বুকটা কিনেছিল, সেটার। আর দুই, অবশ্যই, আন্তর্জালের। তাতেও মনে হয় না সবটা একদম সঠিক করা গেল। তবু মোটামুটি ধারণা গঠনের জন্য যথেষ্ট।
আজ রইল নালন্দার প্রথম পর্ব।
(এবার নিচের পুরোটাই আমাদের গাইড সাহেবের বলা কথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বঙ্গানুবাদ)
**********
“পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের স্বাগতম।
(World’s First International Residential University)
আমি কমলা সিং, আপনাদের আজকের মার্গদর্শক।
আমরা চলেছি বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে।
নালন্দা শব্দের ব্যূৎপত্তিগত অর্থ হল (Etymological meaning):
‘নালম দধাতি ইতি’ হল ‘নালন্দা’| ‘নালম’ মানে ‘পদ্মের নাল’| আর, যে ভূমিতে পদ্মের জন্ম হয় তা হল ‘দা’। ‘পদ্ম’ হল জ্ঞানের প্রতীক -- জ্ঞানের পদ্মসম ফুল যে স্থানে ফোটে তাই-ই ‘নালন্দা’ – জ্ঞানপীঠ।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আনুমানিক আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর পুরোনো।
প্রথম কুমারগুপ্ত 427 CE (common era) তে নালন্দার গোড়াপত্তন ঘটান। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ শুধুমাত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য “জ্ঞাণ ও প্রজ্ঞার স্বর্ণযুগ ও পবিত্রভূমি” হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল।
কিন্তু নালন্দায় একদম প্রথমে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়-ই ছিল না। 399-412 CE তে নালন্দায় এক চৈনিক পরিব্রাজক এলেন। নাম ছিল ফ্যাক্সিয়ঁ, সবাই যাঁকে ‘ফং’ বলে জানেন। দশ বছর তিনি নালন্দায় ছিলেন। তাঁর লেখা ভ্রমণবৃত্তান্ত অনবদ্য ও ইতিহাস হিসেবে এক অমূল্য লিখিত দলিল। সেখানে তাঁর বর্ণনায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তাঁর বর্ণনা অনুসারে নালন্দা তখন শুধুমাত্র এক বর্ধিষ্ণু বৌদ্ধ তীর্থক্ষেত্র ছিল। পালি ভাষায় লিখিত বৌদ্ধ সাহিত্য থেকেও জানা যায় যে তখন নালন্দা এক উন্নত উপনগরী ছিল মাত্র। ভগবান বুদ্ধ নালন্দাতে বহুবার এসেছেন। সেখানে ছিল “পাবারিক” নামে একটি আম্রকুঞ্জ (ম্যাংগো গ্রোভ্)। যখনই তিনি রাজগৃহ থেকে পাটলীপুত্র যেতেন, তখনই পাবারিক আম্রকুঞ্জে থাকতেন। রাজগৃহ থেকে নালন্দা এক যোজন দূরত্বে অবস্থিত ছিল। ভগবান বুদ্ধ প্রত্যেকবারই ঐ পথ একবারে, কোথাও না থেমে, হেঁটে অতিক্রম করতেন। পরে পাবারিক আম্রকুঞ্জ বুদ্ধকে দান করে দেওয়া হয়। মহাপরিনির্বাণের ঠিক পূর্বে রাজগৃহ থেকে কুশিনগর যাওয়ার পথে ভগবান বুদ্ধ শেষবারের মতো নালন্দায় এসেছিলেন। ভগবান বুদ্ধের সবথেকে কাছের দুই শিষ্য সরিপুত্র ও মৌদ্গলিয়ান বা মহামৌদ্গলিয়ান এই নালন্দা অঞ্চলেরই অধিবাসী ছিলেন। গৌতম বুদ্ধের ঐ দুই প্রধান শিষ্য ছাড়াও বুদ্ধের অনেক শিষ্য ও বিভিন্ন মগধরাজ ও সম্রাটদের জন্মস্থান ছিল এই নালন্দা।
আগেই বলা হয়েছে, বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায় যে নালন্দা একটি প্রধান উপনগরী ছিল। ভগবান বুদ্ধের মত, সেখানে ছিল ভগবান মহাবীরেরও প্রায়ই যাতায়াত। বৌদ্ধ সাহিত্য অনুসারে ভগবান মহাবীরের নাম ছিল ‘নিগন্ঠ নটপুত্র’ (অর্থাত ‘জাতক’ বংশের নগ্ন স্থপতি’)। নালন্দাতে তাঁরও অনেক ভক্ত ছিল। তাঁদের মধ্যে উপালি, দ্বিঘাতপর্শী, অসিবন্ধকপুত্র ছিলেন অন্যতম। মহাবীর বর্ষাঋতুতে নালন্দাতে থাকতে পছন্দ করতেন বলে জানা যায়। এরকম তিন বার তিনি বর্ষায় নালন্দাতে আশ্রয় নেন – দু’বার তাঁর সন্ন্যাস জীবনে আর একবার ‘তীর্থঙ্কর’ রূপে।
320 খ্রীষ্টপূর্বে মৌর্য সম্রাট অশোক নালন্দায় একটি স্তূপ নির্মাণ করেন। এই নালন্দার গুরুত্ব আরো বাড়লো যখন 427 CE তে, বুদ্ধের এক হাজার বছর পরে, মগধ সম্রাট কুমারগুপ্ত এখানে প্রথম এক বিহার নির্মাণ করলেন। বিহারের ততকালীন নাম ছিল ‘পাটলীপুত্র’। কিন্তু বিহার নির্মাণ করা ওখানকার রাজা-রাজড়াদের একটা বিলাস ব্যাসন ও শখের মধ্যে পড়ত। ‘বিহার’ শব্দের অর্থ ‘বৃক্ষের আবাসস্থল’, ‘বিহার’ শব্দের অর্থ ‘ভ্রমণ’। কুমারগুপ্তের উত্তরসুরিরা পরে আরো অন্যান্য বিহার স্থাপন করেন। 700 CE তে হর্ষবর্ধনও বিহার স্থাপন করেন। 900 CE তে পূর্ব ভারতের পাল রাজারাও বেশ কিছু বিহার তৈরি করেন। সুমাত্রার রাজা বালপুত্রদেবও বিহার নির্মাণে যোগদান করেন। 500 CE তে শ্রীবিজয় ছিল একটি হিন্দু রাজ্য। শ্রীবিজয় থেকে আসা নালন্দায় পাঠরত ছাত্রদের সুবিধার্থে সুমাত্রারাজ বালপুত্রদেব নালন্দায় একটি মনাস্ট্রি নির্মাণ করেন।
এর পরে এক চৈনিক পরিব্রাজক নালন্দায় এসে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে নালন্দা সম্পর্কে অনেক কিছু লিখলেন। উনি ছাড়াও নালন্দায় অনেক বিদেশী বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু সবার মধ্যে ওই চৈনিক পরিব্রাজক, যিনি সকলের নজর কেড়ে নেন তাঁর নাম ছিল হিউ-য়েন সাং। তিনি প্রথমে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পরে শিক্ষকও হন। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে এই সময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রের সংখ্যা ছিল দশ হাজার। শিক্ষকের সংখ্যা দু’হাজার। সারা পৃথিবীতে সেই সময়ে ভারতবর্ষের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একমাত্র আন্তর্জাতিক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞানের পীঠস্থান হিসেবে নালন্দার খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। নালন্দা থেকে লব্ধ জ্ঞানের মান ও উৎকর্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিল --
প্রথমটির নাম ‘রত্নদধি’
দ্বিতীয়টির নাম ‘রত্নরঞ্জক’
তৃতীয়টির নাম ‘রত্নসাগর’।
আবার জৈন সাহিত্য থেকে জানতে পারা যায় যে মহাবীর এখানে ১৪ টি বর্ষা ঋতু কাটিয়েছেন। বলাই বাহুল্য মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধের সময় নালন্দা ছিল খুবই উন্নত মানের একটি মন্দির উপনগরী। এখানে সবাই তীর্থব্রজে আসতেন। পরে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। কথিত আছে সম্রাট অশোক সরিপুত্র-র চৈতিতে (মন্দিরে) পুজো দিতে আসতেন।
তারানাথ নামক একজন তিব্বতী সাধুর বই ‘হিস্ট্রি অফ বুদ্ধিঈজিম ইন ইন্ডিয়া’ থেকে জানা যায় যে দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রখ্যাত মহাযান দার্শনিক নাগার্জুন নিজে ছিলেন নালন্দার ছাত্র। পরে তিনি আবার নালন্দার প্রধান পুরোহিত (হাই প্রিস্ট) রূপে অভিষিক্ত হন।
সুবিষ্ণু ছিলেন নাগার্জুনের সমসাময়িক এক বৌদ্ধ ব্রাহ্মন। বৌদ্ধ ধর্মের দুটি প্রধান বিভাগ 'হীনযান' ও 'মহাযান' প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি আবার ১০৮ টা মন্দির নালন্দায় স্থাপন করেছিলেন। চতুর্থ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রখ্যাত দার্শনিক আর্যদেব, পঞ্চম শতব্দীতে যোগাচার্য বিভাগের আরেক দার্শনিক অসঙ্গ ও তার ভাই বসুবন্ধু নালন্দার সাথে খুব নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিলেন।
খননকার্য থেকে গুপ্ত সম্রাটদের আগে নালন্দা কার অধিকারে ছিল, তা পরিষ্কার জানা যায় না। কুমারগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্তের সময়ের মুদ্রাই নালন্দা থেকে পাওয়া নালন্দায় প্রথম রাজত্বকালের একমাত্র ও আদিমতম প্রমাণ। হিউ-য়েন সাং এর বর্ণনা অনুযায়ী সক্রাদিত্য নালন্দাতে একটি বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করেন। তাঁর পরের প্রজন্মে বুদ্ধগুপ্ত, তথাগতগুপ্ত, বালাদিত্য ও বজ্র আরো কিছু বৌদ্ধমন্দির স্থাপন করেন। সক্রাদিত্যকে মহেন্দ্রগুপ্ত বা কুমারগুপ্ত নামেও অনেকে চেনেন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল 413 থেকে 455 CE |
পঞ্চম শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে ফা-হিয়েন যখন এই দেশে আসেন তখন কিন্তু ওই সময়ের বৌদ্ধ ধর্মের স্থাপনা নিয়ে খুব একটা কিছু উনি বলে যাননি। কিন্তু তাঁর লেখায় একটা ‘নালো' নামে এক গ্রামের কথা পাওয়া যায়। ঐ নালো-ই, তাঁর বর্ণনা অনুসারে, ছিল সরিপুত্রের জন্ম ও মৃত্যুস্থল। ইতিহাসবিদ-রা বলেন যে এই নালন্দা-কেই ফা-হিয়েন 'নালো' রূপে বর্ণনা করেছেন।
হিউ-য়েন সাং এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে রাজা পূর্ণবর্মণ একটা আশি ফুট উচ্চতার তাম্র মূর্তি নালন্দায় স্থাপন করেছিলেন। তিনি আরও লিখেছেন যে কনৌজরাজ হর্ষবর্ধন ৬০৬ থেকে ৬৪৭ সাল পর্যন্ত এখানে একটি বিশাল বড় পিতলের বৌদ্ধ মন্দির স্থাপণ করেছিলেন।কথিত আছে যে কোন যে যখনই কোনো ধর্মসভা হত, তখন নালন্দা থেকে প্রায় এক হাজার বৌদ্ধ সাধু সেখানে উপস্থিত হতেন।
দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণে নালন্দা ধ্বংস হয়ে যায়। আর সেইসঙ্গে বিশাল লাইব্রেরী উনি জ্বালিয়ে দেন। নালন্দাতে ওই সময়ে পরপর তিনবার আক্রমণ হয়েছিল। নালন্দা আক্রমণের পরে শেষ প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন নালন্দার তৃতীয় বর্ষের বিদ্যার্থী শ্রীভদ্র। ১২৩৫ সালে তিব্বতী তীর্থযাত্রী চ্যাঙ লোটসাওয়ার বর্ণনা থেকে জন্য যায় যে তিনি নালন্দার শেষ শিক্ষক রাহুল শ্রীভদ্র র সাথে সাক্ষাত করেন। তখন শ্রীভদ্রের বয়স নব্বই। তিনি তখনও নালন্দার একমাত্র জীবিত শিক্ষক হিসেবে সত্তর জান ছাত্রকে পাঠদান করে চলেছিলেন। নালন্দায় সবাই আক্রমনের সময় হয় নিহত হয়েছিলেন না হলে পালিয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীভদ্র আশ্চর্যভাবে ওখানে টিকে যান। ওনার বর্ণনা অনুসারে বখতিয়ার খিলজী চৌরাশি বিহার বা চৈত (অর্থাৎ মন্দির) নৃশংস ভাবে ধ্বংস করেন। এই ধ্বংসাত্মক আক্রমণের পরে আর নালন্দার আর মাত্র দুটি বিহার অবশিষ্ট ছিল।
দ্বাদশ শতাব্দীতে চোল রাজারা, আর তারপরে পাল রাজারা নালন্দার ধ্বংসাবশেষের যত্ন নিতে আরম্ভ করেন। নালন্দাকে মেরামত করে নতুন করে তৈরি করা আর সম্ভব ছিল না। কিন্তু যথাসম্ভব পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছিল।
এর পর চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত নালন্দার বিবরণ পাওয়া যায়। তার পরে এই স্থানে কোন জনপ্রাণীর বসবাস ছিল না। কারণ বৌদ্ধ ধর্মের জনপ্রিয়তা তখন ভীষণভাবে কমতে আরম্ভ করেছিল। নালন্দা অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য তৎকালীন রাজারা কোন অর্থসাহায্য দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বহু বছর ধরে অযত্নের ফলে এই অঞ্চল মাটির প্রলপে ঢাকা পড়ে যায়।
সোজা ১৮৬১-৬২ সালে ব্রিটিশ আর্কিওলজিস্ট স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই ধ্বংসাবশেষের খোঁজ পেলেন। তার খোঁজের সূত্র ছিল হিউয়েন সাং এর লোকসংস্কৃতি সম্পর্কিত লিপির পাঠোদ্ধার।
তারপরে ১৯১৫ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত ১২ বছর ধরে নালন্দার ধ্বংসাবশেষের খনন কার্য তিনি চালান। 1974 থেকে 1982 পর্যন্ত আবার নতুন করে খনন কার্য শুরু হয় ১৯৮২ সাল অবধি মোট উদ্ধার করা নালন্দার মোট ধ্বংসাবশেষের দৈর্ঘ্য হল এক কিলোমিটারের বেশি।
খনন কার্য এখনো চলছে। তবে খনন করতে গিয়ে দেখা গেল যে এই অংশের দুটি শাখা আছে: একদিকে বৌদ্ধ বিহার, যার মধ্যে মনাস্ট্রিগুলো পড়ে আর অপর দিকে হলো বিহার নগরের দিক।
আসুন সবাই এগিয়ে যাই।”
**********
আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত আমাদের মাননীয় গাইড-কে অনুসরণ কারতে লাগলাম।
কমলা সিং-জি তখন আমাদের সেই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মত।
(চলবে)

No comments:
Post a Comment