তখন চলছিল মধ্যান্তর। চা খেতে বেরিয়েছি।
আমার আর দেবিকার মধ্যে এই পুরনো নাটকটা নিয়ে অত্যন্ত ব্যক্তিগত আলোচনায় হঠাৎ এক অচেনা অজানা ব্যক্তি কাঁটাতার পেরিয়ে প্রবেশ করে বললেন,
-- এটা আসলে ওই নাটকটা নয় !!! এটা নতুন একটা নাটক নামিয়েছে, ওই পুরোনো নামে...
আমরা নিরুত্তর ....চেঞ্জ সবাই নিতে পারেন না।
আমরা জানি কিছু জিনিস নামে কাটে -- 'ফেলুদা' 'ব্যোমকেশ' তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই ওনার কথাটা নেহাত ফেলনা নয়। তবে তা আংশিক সত্য আবার আংশিক মিথ্যাও বটে।
এই নাটকটির যখন একটা লোকাল ভার্শন তৈরী করে আমরা স্টেজ করেছিলাম, (আমি কোনো থিয়েটার ব্যক্তিত্ব নই। তবে ভালবেসে অভিনয় করি। সাথে কিছু মানুষ আমাকে সসম্মানে মেনেও চলেন) তখন নাটকটিকে টেনে হিঁচড়ে, কেটে ছেঁটে, সময়োপযোগী করে মোটামুটি এক ঘন্টা কুড়ি মিনিটে নামানো গিয়েছিল। আর কাট-ছাঁট করলেও মূল নাটকে যা আছে তা থেকে খুব বেশি সরে যাই নি। বেশ ভালই হয়েছিল।
এখানে নাটকটির দৈর্ঘ্যের প্রতি সৎ থাকতে গিয়ে অভিজ্ঞ পরিচালক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় একটু ভুলই করে ফেলেছেন বলে মনে হয়। আরো মেদহীন করা যেত, অনায়াসে।
আমরা বসে ছিলাম 'বি'-রো তে। আমাদের ঠিক পিছনে এক ষাঠোর্ধ ভদ্রলোক (পরিচিত নাট্যব্যক্তিত্ব) দিব্যি নাক ডাকছিলেন। সে নাসিকাগর্জণের তীব্রতা এমন যে মাঝে মধ্যে আমি গুলিয়ে ফেলছিলাম যে কোনটা স্টেজের নাটকের ব্রহ্মার নাক ডাকার শব্দ আর কোনটা ওনার।
হ্যাঁ, তা যে কথায় ছিলাম -- ভদ্রলোক সত্য কথা বলেছেন এই জন্য এই নাটকটির বহুলাংশে সময়োপযোগী করতে গিয়ে তার মূল ভাব থেকে সরে যাওয়ার একটা ঝোঁক দেখা গিয়েছে। যদিও তা আবার সাবলীল ভাবে ফিরে এসেছে, কিন্তু ফাঁকটা দৃশ্যত ভরাট হয়নি।
আবার ওই দর্শকের কথাটি একাধারে মিথ্যাও এই কারণে যে ওনার বোধহয় আশানুরূপ হয় নি। মনে হয় নিজের যৌবনকালে নাটকটি দেখে যেভাবে উপভোগ করেছেন তার তিরিশ বছর পরে আবার এই নাটকটি দেখে যে ভাবে চেয়েছিলেন সে ভাবে হয় নি। সেই আশানুরূপ মজাটুকু আর পান নি। কারণ আমার বদ্ধমূল ধারণা যে ওনার নিজেরই মনে নেই আসল নাটকে কি ছিল। কারণ বিপ্লববাবুর মত অভিজ্ঞ পরিচালক নাটকটি নামানোর সময় এইটুকু মাথায় রেখেছিলেন যে এই নাটক নিয়ে এপাশ ওপাশ করা যায় বটে কিন্তু বেশি সরা যায় না। তাহলেই ধপাস। ঘোরতর বিপত্তি। তাই আদি নাটকের মূল থেকে তিনি একবারের জন্যেও সরে আসেননি।
নাটকটিতে বিভিন্ন ব্যক্তির অভিনয় সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার নেই। কারণ নাটকটির গল্পই স্যাটায়ার নির্ভর। গোদা ভাষায়, কমেডি। যে কোনো কমেডির প্রাণ হল, timing and expression। সেদিক থেকে রিহার্সাল এবং স্টেজ দুটো দেখেই মনে হয়েছে যদি নাটকটির প্রতি সবথেকে অনেস্ট কেউ থেকে থাকেন তিনি হলেন ব্রহ্মার চরিত্রে রজত গাঙ্গুলী মশাই, ব্রহ্মার চরিত্রে।
গৌতম হালদার নারদের ভূমিকায় এবং পার্থিব ডন বাঁটুলের চরিত্র চিত্রণে সমুজ্জ্বল| উনি ওনার প্যাটার্ন খুব একটা ভেঙে বেরিয়েছেন বলে মনে হলো না। বোধহয় ওই বিশেষ প্যাটার্নটার জন্যই ওনাকে এই নাটকটিতে ওরকম চরিত্রে ভাবা হয়েছে।
নাটকটির অভিঘাত, একদম লিনিয়ার ও এন্টারটেনমেন্ট ভিত্তিক। গভীর ভাবে ভাবার মত কিছু নেই। স্যাটায়ারের কশাঘাত সবার পূর্ব পরিচিত। শুধুমাত্র নির্মল হাসির উদ্রেকের জন্য যা যা করার প্রয়োজন সব করেছেন পরিচালক, মাত্র এগেরোটি রিহার্সালে।
তবে পুরো নাটকটাতে একমাত্র যে দৃশ্যটি সব পেরিয়ে, মনকে ছুঁয়ে গেল, তা মানিকের ফলিডল খেয়ে আত্মহত্যার দৃশ্য। মানিকচাঁদের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত, ওরফে, তাজু।
শুনলে মনে হবে যে আমি বোধহয় ওর খুব কাছের বন্ধু বলে এই প্রশংসাটা করলাম। আদপেই বিষয়টা তা নয়। আমার বিভিন্ন বন্ধু-বান্ধবরা, যাঁরা নামকরা শিল্পী, বা শিল্প জগতের সাথে যুক্ত আছেন, তাঁদের কাছে আমি আমার সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিটা সাহস করে তুলে ধরি, সে ভালো হোক বা খারাপ। আমি একজন কিছু না-জানা সাধারণ মানুষ। আমার তাঁদের সৃষ্টি ভালো লাগল না খারাপ, সেটা তাঁদের শিল্পী হিসেবে জানা সবথেকে আগের কর্তব্য বলে আমার মনে হয়। সিচুয়েশনটা বাইনারি -- হয় হ্যাঁ, না হলে, না; মধ্যবর্তী কোন যুক্তি এখানে খাটে না।
পুরোনো চালের কথায় একটা কথা না বললেই নয় যে, হ্যাঁ ফ্যাশন থেকে আরম্ভ করে এন্টারটেইনমেন্ট, সমস্ত কিছুই একটা ‘সার্কেল অফ লাইফ’ মেনে চলে, যেখানে ঘুরেফিরে সেই পুরোনোতেই ফেরত আসতে হয়। তা বলে কি আর ডাইনোসর ফেরত পাব ? আর পেলেও হয়ত কয়েক কোটি বছর পরে। সে প্রসঙ্গ আলাদা।
কিন্তু যে মানুষ ওপেন মাইন্ডেড, তিনি বুকে হাত রেখে দেখতেই পাচ্ছেন, বুঝতেও পারছেন, যে গত ১৫ বছরে পুরোনোকে টেক্কা দেওয়ার মতো নতুন কিছুই তৈরি হয়নি । নতুন শিল্পীরা যতই বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ডের তকমা নিয়ে নিজেদের বগল বাজিয়ে বাজার গরম করেন না কেন, সে সবই ট্রানজিয়েন্ট, ক্ষণস্থায়ী। টাইমলেস হতে পারার মত আভ্যন্তরীন গভীরতার খুব অভাব। সবাই একটা মোমেন্টারী প্লেজারের দিকে দৌড়াচ্ছে, অন্ধ হয়ে। তার পরে যখন উপলব্ধি করছে যে পুরো দৌড়টা এক পরম শূন্যতার দিকে, তখন ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে নিজেরাই শূন্যতার দিকে ধাবমান হচ্ছে।
যখন কারো কাছে শুনি যে
-- ব্রায়ান অ্যাডামসের নাম আর ক’জন জানে! দলজিত তার থেকে অনেক বড় স্টার… ওই তোমার জেনারেশনের কিছু লোক ওকে (ব্রায়ান অ্যাডামস)-কে নিয়ে নাচানাচি করে। দলজিতের নামবার অফ ফলোয়ার্স দেখ আর ব্রায়ান অ্যাডামসের দেখ। ওখানেই সব দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে যাবে।
-- তখন অন্তঃসার শূন্যতাটা প্রকট হয়ে ওঠে|
ঠিক একই রকম ভাবে দেখতে পাই যে আধুনিক বিভিন্ন গায়ক গায়িকারা সেই বেগম আখ্তারের 'জোছনা করেছে আড়ি' র মত গানটিকে নিজেদের মতো গাওয়ার চেষ্টা করছেন। চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগের ইচ্ছে হচ্ছে বেগম আখতার-কে টেক্কা দিয়ে দেবেন। আর সে বৈতরণী পার করবে কে? না, ফলোয়ার্স। কমেন্ট বক্সে লেখা থাকে, “ওয়াও even bather then the original…” কিংবা “যা গেয়েছেন, তাতে আসলটির থেকেও ভাল হয়েছে।"
আর আমার স্থির বিশ্বাস যে আসল গানটি তাঁদের মধ্যে শুনেছেন ক’জন!
রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নাতনী স্বয়ং অনায়াসে বলে দিচ্ছেন, ওনার দাদুর সময়ের থেকে আধুনিক সময়ের অনেক তফাত্, তাই পুরাতনী গানে একটু হার্মোনিয়ামের বদলে সিন্থেসাইজার, তবলার বদলে প্যাড, এসব ব্যবহার করলে, তবেই সময়োপযোগী হওয়া যাবে।
সত্যিই খুব কঠিন সময়!! যখন মানুষ তার ঐতিহ্য-কে ভুলতে বসে, তখন তার এমন অধ:পতন হয় যে সেখান থেকে ফেরার পথ থাকে না। আজকাল আকচার দেখাই যায় যে মূল্যবোধ শিখতে মানুষ বিজ্নেস স্কুলে মোটা টাকা দিয়ে কোর্স করতে যায়। এবং সেটা আবার অনেক স্কুলের ইউ-এস্-পি।
এই সার্বিক ও সর্বজনীন ক্ষণস্থায়িতার প্রসঙ্গে আমার ভাই ঠিকই বলেছে। মানুষের ডেপ্থ অফ থিংকিং নিয়ে যখন ওর সাথে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ করে আমাকে বলল,
- দেখ অত ভেবে লাভ নেই। এখন লাইফ হলো গিয়ে রিলজ-এর মত -- হাতে এক মিনিট সময়…তার মধ্যে চেটেপুটে নাও ও নেওয়াও।
কথাটা আমার বেশ মনে ধরেছে।
কিন্তু পুরনোতে ফেরত যেতে গেলে তো আর এক মিনিটে হবে না। সেখানে দরকার ইচ্ছার, ধৈর্যের, স্থৈর্যের, নিরন্তর শেখার মানসিকতার, শিক্ষার আর রিসার্চের। আর এগুলোর জন্য দরকার অনুভূতির গভীরতার। এটা সত্যি যে উপরের যে কটি সফ্ট স্কিলের কথা বললাম, সেগুলো সবই ডাইনোসরের যুগের বলেই মনে হবে। এখনকার যুগে এসব কথা অচল। এখন ট্রেন্ডিং হতে গেলে, ইম্প্যাক্টফুল হতে, গেলে ফলোয়ার বৃদ্ধি করতে গেলে একটাই রাস্তা -- নিজেকে একটা প্যাকেজ হিসেবে বাজারে বেচে ফেলা।
এই প্যকেজের ধারাকে অতিক্রম করতে পারে নি বাংলার থিয়েটার মহলও। বেশির ভাগ দলই আর নতুন অভিনেতা গড়ে না। নামকরা যাঁরা কিছু করে খাচ্ছেন, তাঁদের ভাড়া করে এনে টিকিট বিক্রি করার মার্কেটিং চলে।
বাংলা থিয়েটারের ক্ষেত্রেও তাই নতুন কোনো বলিষ্ঠ নাটক গত পাঁচ বছরে দেখেছি কি না মনে পড়ে না। পুরনো বিখ্যাত যা কিছু ছিল দেবেশ চট্টোপাধ্যায় মশাই সেগুলোকে ছেঁকে নিয়ে নতুন মোড়কে মানুষের কাছে তুলে ধরছেন। তাতেই হাউস ফুলের পর হাউস ফুল। নতুন নাটকের বিক্রি কোথায়!
তার মধ্যেও দেবাশীষ, অর্ণ (মুখোপাধ্যায়) আর সৌরভ (পালোধি) নতুন কিছু করে দেখানোর চেষ্টায় আছেন। তবে অর্ণ-র দলের (নটধা) নাটক যদি দুটো তিনটে কেউ দেখে থাকেন তাহলে তার পরেরটাই একটা প্যাটার্ন মনে হবে। সেখান থেকে সরে আসার মত দৃষ্টিভঙ্গি কিছু নেই। গৌতম হালদারের অভিনয়ের যেমন একটি বিশেষ ধরণ আছে, অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের দলেরও একেবারে ভিন্ন হলেও একটি বিশেষ অভিনয়ের ধরণ আছে, যা খুবই ফিজিক্যাল ফিটনেস নির্ভর বা স্টান্ট বেসড বললে ভুল হবে বলে মনে হয় না। ফলে অভিনয়শৈলীর সূক্ষতার অভাব বেশ প্রকট। তাই প্রথমে বেশ ভাল লাগে। কিন্তু নটধার দু-- তিনটে নাটক দেখার পরেই মনে হয়, আবার!!!.... এ আর নতুন কি!!!
ঘুরে ফিরে দেখুন নতুনের হুজুগে ফিরে এলো সেই পুরোনো এল.পি.। এখনও যাঁরা গান শুনতে ভালোবাসেন, গানের কালেকশন রাখতে ভালবাসেন, তাঁরা সবাই এলপিতে ফিরে গিয়েছেন। সিডি ডিভিডিতে ধুলো পড়ে।
আর আন্কোরা নতুনের বালাই শুনুন -- আমাদের সালকের পুরোনো বাড়িতে সনি-র একটি পুরোনো বক্স টিভি আছে। বয়স, কুড়ি বছরের বেশি। তখনও যেমন ছিল এখনো তেমন। ভার্জিন্, মেকানিকের হাত পড়ে নি। কিন্তু ‘নতুন’ ফ্ল্যাট টিভি যখন থেকে বাজারে এসেছে, তারপর থেকে এই কুড়ি বছরে এখন দেয়ালে যেটা ঝোলে, সেটা চার নম্বর।
আগের খারাপ হওয়া ফ্ল্যাট টিভিটা যাঁকে বিক্রি করলাম তিনি পুরনো ইলেকট্রনিক গুডস এর ব্যবসায়ী। বললেন
- পরেরবার যখন টিভি কিনবেন স্যার, আমি বলে দেবো যে কোন ব্র্যাণ্ডের কোন মডেলটা কিনলে অন্তত আগামী পাঁচ বছর আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। কারণ আমরা মার্কেটে থাকি, আমরা জানি যে কোনটার বয়স দু’ বছর আবার কোনটার বয়স ছ’ বছর। আট দশ বছরের ধরে একই ফ্ল্যাট টিভি ব্যবহার করছেন, এরকম রেয়ার। এখনকার টিভির অ্যাভারেজে লাইফ ম্যাক্সিমাম চার থেকে পাঁচ বছর। হয় বেশি দিন টেঁকে না, নয় টেকনোলজি এমন পাল্টে যায় যে আমরা নতুন কিনতে বাধ্য হই |
যে নাটক নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম তা হল সদ্য প্রয়াত নাট্যজগতের প্রবাদপ্রতীম মানুষ মনোজ মিত্র মহাশয় রচিত 1976 সালে স্টেজ হওয়া 'নরক গুলজার'। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর দল সুন্দরম্, মাঠে নেমেছে তাঁর হিট নাটক ‘নরক গুলজার’-কে আবার রস্টেজে নামানোর জন্য। প্রযত্নে সেই বিলু দত্ত মহাশয়। নাটকের শেষ তিনটে রিহার্সাল চলছিল ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল, কলেজস্ট্রিটে। কলেজ্স্ট্রিটে এমনিই ঘুরতে যাই মঝে মাঝে।
সেদিনও গিয়েছিলাম। তাজু বলল, “আমি ওখানে রিহার্সালে আছি, দেখা করে যা।" দিলখুশা থেকে একটা থামস আপ সহযোগে ফিস কবিরাজি খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে যখন তাজুর সাথে দেখা করব বলে হলের দিকে এগোচ্ছি, একটা এক কামরার ট্রাম ঝকর ঝকর করতে করতে ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কলকাতার বুক থেকে ঐতিহ্যবাহী ট্রাম তুলে দেওয়া হয়েছে --একথা ওই দর্শকের মন্তব্যের মত আংশিক সত্য আবার আংশিক মিথ্যা। মিথ্যা এই কারণে যে মোটেই সম্পূর্ণরূপে তুলে দেওয়া হয় নি। কিছু রুট এখনও আছে, যেগুলোতে ট্রাম যেমন নিয়মিত চলছিল, তেমনিই চলছে। আর ‘নরক গুলজার’-এর কথা কি আর বলি! নাটকের প্রোমোতেই বলা হচ্ছে“সুন্দরমের নতুন নাটক”।
সেদিনও গিয়েছিলাম। তাজু বলল, “আমি ওখানে রিহার্সালে আছি, দেখা করে যা।" দিলখুশা থেকে একটা থামস আপ সহযোগে ফিস কবিরাজি খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে যখন তাজুর সাথে দেখা করব বলে হলের দিকে এগোচ্ছি, একটা এক কামরার ট্রাম ঝকর ঝকর করতে করতে ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কলকাতার বুক থেকে ঐতিহ্যবাহী ট্রাম তুলে দেওয়া হয়েছে --একথা ওই দর্শকের মন্তব্যের মত আংশিক সত্য আবার আংশিক মিথ্যা। মিথ্যা এই কারণে যে মোটেই সম্পূর্ণরূপে তুলে দেওয়া হয় নি। কিছু রুট এখনও আছে, যেগুলোতে ট্রাম যেমন নিয়মিত চলছিল, তেমনিই চলছে। আর ‘নরক গুলজার’-এর কথা কি আর বলি! নাটকের প্রোমোতেই বলা হচ্ছে“সুন্দরমের নতুন নাটক”।
আর বিভিন্ন নাট্যদলের অভিনেতাদের কৌলিন্য নিয়ে তো আগেই বলেছি। এখানেও সেটা বিদ্যমান। রজত গাঙ্গুলী, গৌতম হালদার, দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত কেউ-ই সুন্দরমের অংশ নন। থিয়েটার ফ্রেটার্নিটির স্বার্থে এবং মনোজ বাবুর চলে যাওয়ার ফলে ট্রাঙ্ক খুলে হাতড়িয়ে এই পুরোনো দলিলকে ল্যামিনেট করে তার পরে তাকে রিক্রিয়েট করে বলা, ‘সুন্দরমের নতুন নাটক’ – কিছু না, গাট্স লাগে, আদি স্রষ্টাকে এমন ট্রিবিউট দিতে। তবুও প্রাপ্তি অনেকটাই যে, যে ফর্ম্যাটেই হোক না কেন, পুরোনো গুলোই ঘুরে ফিরে আসছে। ডিরেক্টর প্রোডিউসার সবাই জানেন, পুরোনোই একমাত্র সম্পদ, যা দিয়ে বাজারে কিছু করে খাওয়া যাচ্ছে।
লেখাটা খুব ছড়ানো। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত যা বক্তব্য তা হল, পুরনো বলে ফেলে দিলে একদিন কিন্তু ফিরে আসবেই যেদিন ওই পুরোনোকে খুঁজতে হবে। কিন্তু তখন আর তারা সহজলভ্য থাকে না। হয়তো অনেক খুঁজেও আর পাওয়া যাবে না। অথচ ভাবুন ওই পুরোনোগুলোই একসময় অবলীলায়, অক্লেশে, অবহেলায় আপনার কাছেই পড়েছিল ধুলোধূসরিত হয়ে। সেই পুরনোর মূল্য সেদিন আপনি বোঝেন নি, তাই তা হয়ে উঠেছিল আপনার বোঝা যা থেকে চেয়েছেন নিষ্কৃতি ও মুক্তি। আর আজ এমন দিন ঘুরে এসেছে যে সেই পুরনো কে ফিরত পেতে জীবন পণ করেছেন, সর্বস্ব উজাড় করে দিতে চাইছেন, পৃথিবী তোলপাড় করে ফেলছেন, কিন্তু সে সব আপনার সমস্ত সামর্থ্যের বাইরে চলে গিয়েছে। আপনার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে আজ আপনার ফেলে দেওয়া সেই পুরনো এমন বিশাল এবং বিপুল আকার ধারণ করেছে যে তা এক নিমেষে আপনার আধুনিকতার গর্ব এবং দম্ভকে অনয়াসে পিষে মেরে ফেলতে পারে।
তাই পুরনোকে যাঁরা অশ্রদ্ধা করেন তাঁরা সবাই কালিদাস মাত্র -- গাছের যে ডালে নিজে বসে আছেন, বোকার মত সেই ডালটিকেই নিরন্তর কেটে চলেছেন।
পার্থক্য শুধু এই যে, কালিদাসের পায়ের নিচে মাটি ছিল এখন ওই ডালের নিচে অন্ধকার অতল খাদ।
********
১. যে সব পুরোনো বন্ধুরা এক হলে, প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে ‘নরক গুলজার’ করে তোলা যায় আশ-পাশ, তাদের ছবিও সাথে রইল।
২. আরো রইল সেই মায়াময় কিছু জনের ছবি, যারা না বুঝেই যে কোনো মুহূর্তে চারপাশ-কে শুধু আহ্লাদে নরক গুলজার করে তুলতে পারে।





No comments:
Post a Comment