এবারে আমরা এসেছি নালন্দার দ্বিতীয় পর্বে।
(এবার নিচের পুরোটাই আমাদের গাইড সাহেবের বলা কথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বঙ্গানুবাদ)
সাধারণ ভূমিকা: (মানে, আগে যা ঘটেছে)
**********
“পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের স্বাগতম।
(World’s First International Residential University)
আমি কমলা সিং, আপনাদের আজকের মার্গদর্শক।
আমরা চলেছি বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে।
নালন্দা শব্দের ব্যূৎপত্তিগত অর্থ হল (Etymological meaning):
‘নালম দধাতি ইতি’ হল ‘নালন্দা’| ‘নালম’ মানে ‘পদ্মের নাল’| আর, যে ভূমিতে পদ্মের জন্ম হয় তা হল ‘দা’। ‘পদ্ম’ হল জ্ঞানের প্রতীক -- জ্ঞানের পদ্মসম ফুল যে স্থানে ফোটে তাই-ই ‘নালন্দা’ – জ্ঞানপীঠ।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আনুমানিক আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর পুরোনো।
প্রথম কুমারগুপ্ত 427 CE (common era) তে নালন্দার গোড়াপত্তন ঘটান। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ শুধুমাত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য “জ্ঞাণ ও প্রজ্ঞার স্বর্ণযুগ ও পবিত্রভূমি” হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল।
*******
প্রথম পর্বের পরে….
আমরা পুরোপুরি তখন আমাদের গাইড কমলা সিং-জি এর ম্যাজিক স্পেলের কন্ট্রোলে। যেন একটা হিপ্নোটাইজড অবস্থা, ড: হাজরা আর মুকুল। উনি আমাদের নালন্দার পূর্ব প্রবেশ দ্বারের কাছে নিয়ে এলেন। তারপর উনি যা বললেন, তাতে আমরা, স্থানটির প্রতি মনে মনে শ্রদ্ধাবনত না হয়ে পারলাম না।
******
কমলা সিং-এর ভাষ্যের অনুবাদ:
(নালন্দার কমপ্লেক্সে ঢুকে খানিকটা এগিয়ে এসে যখন আসল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারে উপস্থিত হলাম....)
“আমরা দাঁড়িয়ে আছি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে পুরোনো প্রবেশ দ্বারগুলির একটিতে। এটি নালন্দার পূর্ব প্রবেশ দ্বার। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দিকে চারটি প্রবেশদ্বার ছিল। প্রত্যেক প্রবেশদ্বারে থাকতেন একজন দুঁদে দ্বার-পন্ডিত যাঁকে আধুনিক ইংরেজি ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ডীন অফ অ্যাডমিশন’ বলা চলে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর শিক্ষা ও রিসার্চের বিশ্বখ্যাত কেন্দ্র ছিল। সেখানে অধ্যয়্ণের জন্য প্রবেশের অনুমতি পাওয়া অত সহজ ছিল না। আর আরো ইন্টারেস্টিং হল এই যে, এখানে যে কোনো স্তরেই শিক্ষা লাভ সম্পূর্ণ করার কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল বা সীমা ছিল না। আর কোনো স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ করলে না দেওয়া হত তার জন্য কোনো বিশেষ শংসাপত্র। সহজ কথায় নালন্দায় পাঠ অর্জণ করে কোনো সার্টিফিকেট পাওয়া যেত না। যাঁরা এখানে আসতেন, তাঁরা কেউই ডিগ্রী পাওয়ার আশায় আসতেন না। আসতেন নিজেদের জ্ঞানার্জনের অকৃত্রিম নেশার টানে। বিদ্যার মাধ্যমে প্রজ্ঞার আহরণই ও আত্মতুষ্টিই ছিল নালন্দায় অধ্যয়নের একমাত্র উদ্দেশ্য। কেউ নালন্দায় পাঠরত, বা সেখান থেকে বিদ্যার্জন সম্পুর্ণ করেছে, এ খবর সব জায়গায় এমনিই ছড়িয়ে যেত। আর তাঁদের ছিল বিশ্বব্যাপী সম্মান।
আর সাধারণ বিভাগে যাও বা অধ্যয়ণের সুযোগ পাওয়া যেত, কিন্তু 'স্কুল অফ ডিসকাশনস/ডিবেট' মানে যাকে আমরা বাংলায় বলি ‘তর্কশাস্ত্র’, সেখানে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। অতি প্রতিভাবান, এমনকি বাঘা বাঘা পণ্ডিতদেরও ঐ স্তরে অ্যাড্মিশনের প্রোব্যাবিলিটি ছিল দশ জনের মধ্যে মেরে কেটে দু'থেকে তিন জন। বাকিরা বিফল মনোরথে ফিরত চলে যেতেন। নালন্দার দ্বার পণ্ডিতদের পাণ্ডিত্যের পরিধি ও গভীরতা এখান থেকে সহজেই অনুমেয়।
এবারে নালন্দার দ্বারপণ্ডিত কারোর অ্যাড্মিশনের যে পরীক্ষা নিতেন তা কেমন ছিল জানা যাক।
যে কোনো স্তরে প্রবেশের জন্য প্রথমেই থাকতে হবে ত্রিপিটক সম্পর্কে সম্যক ও গভীর জ্ঞান। তারপরে বাকি সবটা বিষয়ভিত্তিক।
বিষয়ভিত্তিক প্রথম স্তরে পাশ করতে হত বিশেষ বিষয়ে, যে বিষয় নিয়ে ক্যান্ডিডেট এখানে পড়তে চান।
তার পরের স্তরে থাকত পার্সোনালিটি টেস্ট।
ঐ দুটো উতরোলে তার পরে আবার পার্সোনাল ইন্টারভিউ।
আর প্রত্যেকটা স্তর ছিল মারাত্মক কঠিন।
লিপি থেকে জানা যায় একাদশ শতাব্দীতে এই পূর্ব প্রবেশ দ্বারের দ্বার পণ্ডিত ছিলেন শেরোন্যায়। দক্ষিণ দ্বারে কৃষ্ণাচার্য, পশ্চিমে নাত্রশান্তি ও উত্তরে নারোপা।
![]() |
| Our Respected Guide Sri Kamla Singh |
(আমার ধারণা কোন দরজায় কোন পণ্ডিত থাকতেন, সেটা কল্পণা-প্রসূত। গল্প-কে বাড়ানো ও মনোগ্রাহী করে তোলার স্বার্থে বহু জায়্গায় গাইডরা এভাবে বলে থাকেন। কৃষ্ণাচার্য ও নারোপার অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু বাকি দুই জনের নাম আমি কোথাও খুঁজে পাই নি।)
এখানে বলে রাখা ভাল যে, যে ‘হিউ-এন সাং’-এর বিবরণ থেকে আমরা নালন্দা সমপ্র্কে এত কিছু জানতে পারছি, তাঁর আসল নাম ছিল ‘Xuanzang’। নালন্দায় পাঠ নেওয়ার সময়ে তাঁর নামকরণ করা হয় 'মোক্ষদেব'। তাঁর সময়ে নালন্দা মনাস্ট্রিজের প্রধাণ ছিলেন শীলভদ্র।
যে গঠন এখন আপনারা দেখছেন, তা খনন করে বের করা হয়েছে। এর বাইরের দিকের যে অংশ এত বছর ধরে জল ও বায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কিন্তু কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ পুনরুদ্ধার (রেস্টোরেশন) করা হয়েছে। ভিতরের অংশ একেবারে আসল, ও আদি। দেওয়াল সেখানে আট থেকে দশ ফুট চওড়া।
খারাপ হওয়া অংশগুলির পুনরুদ্ধার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজারা করেছেন বটে কিন্তু তা সবই ওপরে ওপরে। ভিতরের আসল খাঁচাটি এখনও একই আছে, সেই যখন স্থাপন করা হয়েছিল, তখনকার মত। তাতে এখনো ওব্দি কোনো হাত পড়ে নি।
আসুন আমার সঙ্গে….
********
আমরা প্রবেশ করলাম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব প্রবেশদ্বার দিয়ে। অনায়াসে।
কেউ আট্কালো না। শুধু কমপ্লেক্সের প্রবেশদ্বারে নামমাত্র প্রবেশমূল্যের টিকিট লেগেছে ।
আর সেখানে দ্বাররক্ষী মেরে কেটে উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ।
(চলবে)


No comments:
Post a Comment