সেদিন সকালে উঠে লেট-দাকে ডেকে দিতে হল। ওনার ঘুম বেশ গভীর। কোনো অ্যালার্ম কাজ করে না। ঘুম থেকে উঠে চা খাওয়া অভ্যেস। খেতে খেতে ফর্সা ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বেগ আনার চেষ্টা করতে করতে বললেন,
কিসের অসুবিধা?
আমি নাক ডাকি তো তাই…
হ্যাঁ, সে তো বেশ জোরেই ডাকেন দেখলাম। তবে আমিও আপনার থেকে কম যাই না বলে শুনেছি। কারণ নিজের নাসিকা নিনাদ তো আর নিজে শোনা যায় না। তবে আপনার ঘুম তো বেশ গভীর, তাই আর আমার নাক ডাকায় আপনার বিশেষ অসুবিধা হয় নি।
হ্যাঁ ঘুম গভীর হলেও কাল রাতে আমি যখন টয়লেটে উঠলাম তখন তোমারও নাক ডাকার শব্দ বেশ জোরেই শোনা যাচ্ছিল্।
হা হা হা হা আমি কখনো অস্বীকার করেছি যে আমার নাক ডাকে না! তবে একটা জিনিস দারুন হলো…
কি?
নাক ডাকা নাক ডাকায় কাটাকুটি হয়ে গেল।
হা হা হা হা ব্যাপারটা কিন্তু বোঝার আছে...আর চা-টা দারুণ!!!
এই বলে লেটদা হাসতে হাসতে প্রাতকৃত্য সারতে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। আমি আগে উঠেছিলাম। ফলে আমার সব সারা হয়ে গিয়েছিল। ব্যাগ আর ক্যমেরা গুছিয়ে আমি ওনাকে বলে নিচে ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম।
আটটায় কল টাইম দেওয়া ছিল। সাড়ে আটটার মধ্যে বেরোনোর কথা। কিন্তু বুলবুলিকে দেখতে পচ্ছি না। ব্রেকফাস্ট সেরে জানতে পারলাম যে বুলবুলি নাকি সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ব্রেকফাস্ট এর জন্য ওখানে ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু ব্রেকফাস্ট তো আর আটটার আগে দেবে না। তাই বিফল মনোরথে বুলবুলি আবার নিজের রুমে ফিরে গেছে। আর এখন যখন ব্রেকফাস্ট দেয়া হচ্ছে, তখন কিন্তু বুলবুলির কোন পাত্তা নেই।
তবে মিহিরদার কথা এবারে ফেল করে গেল। উনি যাওয়ার আগে ঝাউতলায় বার বার বলেছিলেন, বিশেষ বিশেষণ সহযোগে, যে, যদি দেরী কেউ করে, তাহলে একমাত্র কাজলদা। কাজলদা সবার আগে রেডি-স্টেড-অন ঈয়ো'মার্কস হয়ে পুরো মিহিরদার মুখে ঝামা ঘষে দিলেন।
মিহিরদা খুব দুরন্ধর এক ব্যক্তি। দেখে ঠিক বোঝা যায় না। কাল্টিভেট করলে, বোঝা যায়, সত্তর পেরিয়েও কি জিনিস। আর যখনি দেখেন যে লুজ বল ফেলেছেন, তখন ব্যাপারটা খুঁচিয়ে তুললেও উনি অদ্ভূত ভাবে নিজেকে নিরুত্তর রাখেন। স্নায়ুর লড়াই-এ শিক্ষনীয়।
সেদিনের প্ল্যান অনুসারে ব্রেকফাস্টের পরে বাসে করে আমরা প্রথমে যাব গ্লাস ব্রিজে। ভারতের দ্বিতীয় কাচের সেতু। দৈর্ঘ্য পঁচিশ ফুট, প্রস্থ ছ'ফুট, একসাথে জনা পঁচিশের ভার নিতে পারে। সেতুটি পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসে একটি বিশাল ও গভীর উপত্যকায় ঝুলন্ত। জাস্ট নাক গলিয়ে বেরিয়ে আছে। এপার আছে, ওপার নেই। শুরু আছে, শেষ নেই। হূট করে মাঝখানে শেষ হয়ে যাওয়া একটা ব্রিজ। যেহেতু এটার নাম কাচের সেতু, বোঝাই যাচ্ছে যে এটার ফ্লোর বা মেঝে ও বেড়া, পুরোটাই কাচের। ব্রিজটা যেখানে মাঝপথে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে সেখানে একটা গোলাকৃতি প্রশস্ত স্থান। অনেকটা চিকেন ড্রামস্টিকের মত। ওই গোলাকার মুণ্ডটিতে সবাই গোল করে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করবেন, সে ভাবেই তৈরী করা।
খানিক দূরেই পুরনো হ্যাঙ্গিং ব্রিজ। সেটাতে এখন আর বিশেষ কেউ যায় না। বোধ হয় বিপজ্জনক হয়ে ওঠার জন্য সেটিতে ওঠা ও যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। । হ্যাঙ্গিং ব্রিজটা গ্লাস ব্রিজ থেকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। দুটি ব্রীজই রাজগীরের নেচার পার্কের অংশ বিশেষ। ২০২১ সালে বিহার সরকার গ্লাস ব্রীজ্টিকে সবার জন্য উনমুক্ত করে দেয়। প্রবেশের টিকিট ওয়েব সাইট থেকে কাটা যায়। তাহলে আর অযথা টিকিট কাটার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট হয় না।
এই অনলাইনে টিকিট কাটা নিয়ে একটা ছোট গল্প আছে। আমাদের বন্ধুরা আগে থেকেই অনলাইনে চেষ্টা করছিল টিকিট কাটার। যে যে জায়গাগুলো আমরা ঘুরতে যাব, সেখানে যেন টিকিট কাটার লাইনে কোন সময় অযথা নষ্ট না হয়। ঐ সময় বাঁচনোর জন্য পাঁচ ছয় জন একসাথে উঠে পড়ে লেগেছিল। কিন্তু কিছুতেই সে টিকিট কাটা আর যায় না! টিকিট আছে কিন্তু কাটা যাচ্ছে না। দিনের বেলা সার্ভারের সমস্যা ধরে নিয়ে কেউ কেউ মাঝ রাতে টিকিট কাটার চেষ্টা করল। কিন্তু হায়, কেউই টিকিট পেল না; উল্টে আবার কারোর কারোর এমনও হয়েছে যে টাকা কেটে নিল, কিন্তু টিকিট পেল না। সে সব টাকা অবশ্য পরে ফেরত পাওয়া গেছে।
বেড়াতে যাওয়ার হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে যখন এরকম একটা অবস্থা চলছে, কাজলদা হঠাৎ লটারী পাওয়ার মত সবার টিকিট কেটে পাঠিয়ে একটা জয়ের হাসি হাসলেন, সেখানে। কিন্তু হায়! সে টিকিট কোথাকার? গ্লাস ব্রীজের নয়। ওয়াইল্ড লাইফ সাফারির। রাজগীর নেচার পার্কে জীবজন্তু দেখার ওয়াইল্ড লাইফ সাফারিও হয়। কিন্তু তার টিকিট আলাদা। আর আমাদের কেউই সেই সাফারীতে আগ্রহী নই। কাজলদা বেমক্কা সেটার টিকিট কেটেই যার পর নাই আহ্লাদিত। আমাদের স্থির গন্তব্য গ্লাস ব্রিজ। বেশিরভাগ ওয়াইল্ড লাইফ সাফারির অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কোন কালেই 'ওয়াইল্ড' পশুদের দেখা যায় না। শেষমেশ একটা গরু, বা চারটে বনমোরগ আর তা না মিললে পথের কুকুর ছাড়া কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। তাই জন্য এবারেও ওয়াইল্ড লাইফ সাফারিতে খুব একটা আগ্রহী কেউই ছিল না। ওয়াল্ড লাইফ সাফারি আর গ্লাস ব্রিজের জায়গাটা একই স্থানে, ওই নেচার পার্কের মধ্যে। রাস্তা শুধু আলাদা। ব্রিজের রাস্তায় যাতে বন্য জন্তুরা চলে না অসতে পারে, সে জন্য উঁচু পাঁচিল দিয়ে দুটো জায়গাকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে। সরকার জায়্গাটিকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে তুলেছে। আর এখনও পর্যন্ত ভালভাবেই মেন্টেইন্ড।
নেচার পার্কে ঢুকে প্রথমে যেতে হয় বাসস্ট্যান্ডে। ওখানে শুধুমাত্র নেচার পার্কের বাসই চলে। তাতে করে অনেকটা ভিতরে গিয়ে একটা পয়েন্টে বাস সবাইকে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে বাকিটা হাঁটা পথে। আমরা নেচার পার্কে ঢোকার পরেই অনেকটা সাজানো পথ পেরিয়ে বাসের লাইনে গিয়ে পৌঁছালাম। মনে হল, যে আগের দিনের মতো হয়তো রোপ ওয়েতে ওঠার মত দেড় ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমাদের আগে মোটামুটি কুড়ি পঁচিশ জন রয়েছেন মাত্র। আর একটা এক একটা বাসে ২৬ জন করে তোলা হচ্ছে। ফলে আমাদের বাস পেতে খুব একটা দেরী হবে না।
বাসে উঠে স্বভাব অনুযায়ী ড্রাইভারের সাথে আলাপ জমালাম, আমি আর অনন্ত। আর তাতে উঠে এল মারাত্মক তথ্য –
– আপ্ লোগ জল্দি যাঈয়েগা…
– ক্যিঊ?
– ওয়া পে অল্রেডি দো’শো আদমী লাইন মে খড়া হ্যায়।
– ওঃ ! খালি দো'শো আদমী!!!
– একসাথ জানে নহি দেতা। পন্দ্রা পন্দ্রা লোগ এক এক ওয়ারী মেঁ।
– ক্যায়া বোল রহে হো!! তব ওহ্যাঁ পৌঁছনে মে কিতনা টাইম লগ জায়েগা?
– মানিয়ে কি সওয়া এক সে দেড় ঘন্টা!
বলে কি! আবার দেড় ঘন্টার চক্কর, লাইনে? টিকিট কাটার সময় বাঁচিয়ে তবে লাভ কি হল!
– আপ্লোগ তো বচ গয়ে!
– আগর টিকট ওন্লাইন না লিয়া হোতা তো খালি পাঁচ মিনিট কে লিয়ে গ্লাস বিরিজ মেঁ চড়্নে কে লিয়ে সারাদিন লগ যাতা।
– ক্যিঊ?
– ক্যিঊ কি, টিকটকা কাউন্টার আভি আভি খুলা হ্যায়।
যাক বাবা! তবু একটা ভাল কাজ তো করা আছে, নাহলে এ ক'টা দিনের মধ্যে পুরো এক দিন গ্লাস-ব্রিজ, তা-ও আবার মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য, জাস্ট পোষাত না।
সবাই বাস থেকে নামার পরে আমরা যখন ড্রাইভারের বলা এস্টিমেটেড টাইমের কথা ঘোষণা করলাম, প্রথমে কেমন একটা ত্রাহী ত্রাহী রব উঠল। তারপর থিতিয়ে গেল, সবাই গুটি গুটি লাইনে এসে দাঁড়ালাম্। ড্রাইভার মিথ্যে বলে নি। লাইনের হাঁসুলী বাঁক আর তার ধীর লয়ে এগোনো সবটাই অসহ্য। শুধুমাত্র পরিবারের ক'জন বেড়াতে এলে, মোটামুটি বেড়াতে আসার মুডের ওখানেই ইতি। ঝগড়া হয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ভাগ্গিস বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পরিবারেরা আসা!
কিছুই না, এতক্ষণ লাইনে দাঁড়ানো কি মুখের কথা! তাই দলের মহারথীরা মুখ খুলল। তারপরে তাদের মুখনিসৃত যে সব বাণী ঝরে পড়তে লাগল, তাতে একটা নীল মলাটের বই হয়ে যায়। লাইনে থেকেও বিক্ষিপ্ত থাকায়, সুসজ্জিত বিরাট চেহারার সিকিওরিটি আমাদের ওয়ার্ণিং দিয়ে খানিকটা ওপরে উঠে গত তিন দিন পেট পরিষ্কার হয় নি, এরকম মুখ করে দাঁড়াতেই তার মুখটা ঠিক কিসের মত দেখতে ঐ নিয়ে বিস্তর গবেষণা, মন্তব্য ও মতান্তরের মাঝে, সমীর হঠাত অনন্তর কাছ থেকে জোয়ানের কৌটো চাইল। FYI অনন্ত ঐ জোয়ানের স্টকটা সবসময়ে ক্যারী করে। সেই কৌটো চাওয়ার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক কিচ্ছু ছিল না। আমরা যখন তখন চেয়ে খাই। কিন্তু সমীর সেটা নিয়ে নিজে না খেয়ে হঠাত সেই হুঁকোমুখো সিকিওরিটি স্টাফের দিকে তীরবেগে ধাবিত হল। সকলে দেখলাম শুনলাম। পেটের নীচ থেকে হাসির রোল মুখ দিয়ে বেরোতে চেয়েও বেরোচ্ছে না।
সমীর গিয়ে বলল্,
– ক্যা স্যারজী? ইতনা গোমড়া মুখ কর কে খাড়া ক্যিঊ হ্যায়্?
– আপ লাইন মে যাইয়ে….
– লাইনমে জায়েগা, জরুর জায়েগা...তুম থোড়া জোয়ান খা লো। ম্যায় ওয়াপিস চলা জায়েগা।
...বলে সমীরণ কৌটো খুলে তাকে জোয়ানের আরক দিতে গেল। কিন্তু ভীষণ বিরক্ত হয়ে সে বলল,
– লাইন মে যাইয়ে, হম খৈনী নহী লেতা।
– আরে ভাই, খৈনী হম ভি নেহী খাতা। ইয়ে জোয়ান হ্যায়, খৈনিকা বাপ। ইয়ে খানে সে সব কুছ হজম হো যাতা হ্যায়। আঊর খিদে বাড়্তা হ্যায়।
– ইয়ে খিদে কেয়া হ্যায়্?
– খিদে খিদে….খিদে নেহি জানতা?
– ওহি তো পুছ রাহা হ্যায়্? খিদে কেয়া চিজ হ্যায়…
– আরে খিদে খিদে...পেট কা খিদে, শরীর কা খিদে…জিসকে লিয়ে আদমি জিতা হ্যায়!....খা কে তো দেখো পইলে।
বলতে বলতে সমীর সিকিওরিটীর হাত ধরে টেনে খুলে তার তালুতে জোয়ানের দানা ঢালতে আরম্ভ করেছে। আর সে সমীরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কারো বুকের পাটা নেই যে তার সাথে এসে দুটো এক্স্ট্রা কথা বলে! আর এ কে রে? সোজা হয়ে দাঁড়াতে যার কোমরে ব্যাথা লাগে, ঘাড়ের সাথে সারা শরীরকে ঘোরাতে হয়, স্পন্ডোলিসিসের জন্য, তার কোনো ভয়-ডরের কোনো লেশমাত্র নেই! সারা মুখে-চোখে এক অজানা বিস্ময়। তবু মেজাজ নিয়ে বলল,
– ক্যায়া খিধে খিধে লগা রখ্খা হ্যায়্...সিধা লাইন মে যা কে খাড়া রহিয়ে।
সমীরও নাছোড়্বান্দা।
– আচ্ছা বাবা যাতা হ্যায়। তুম খা-কে বোলো পহলে, ক্যায়্সা লগা!
সেও দেখলাম, ওই কথায়, তার হাতের তেলোর জোয়ানের আরক গপ করে মুখে পুরে দিল। তারপর টম্ অ্যান্ড জেরী শো এর মত, কয়েক মুহূর্তে কয়েক’শো অভিব্যক্তি।
সমীরের তখন চুপ করে যাওয়া উচিত। কিন্তু তাতেও তার হয় না। আরও খোঁচাতে লাগল। সে কি আর থামে!
– কেয়া বোলা থা হাম্, আচ্ছা হ্যায় না? জোয়ান খানে সে জওয়ানী ভি বড়তা হ্যায়।
তাতে চক্ষু বিস্ফারিত করে সিকিওরিটি বলল,
– এইসা কেয়া! মগর ম্যায় শাদিশুদা নেহি হুঁ।
– তো ক্যায়া হুয়া, ইস সে শাদি কে লিয়ে ইচ্ছে চাঙ্গা হো জায়গা।
সিকিওরিটি তখন কেমন একটা সম্মোহিত চোখে আবার একবার সমীরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এক একটা হাসি-চাপা আগ্নেয়্গিরি। শুধু অবসর বুঝে ফেটে পড়ার অপেক্ষায়।
সমীর ফিরতেই তার পিঠটিঠ চাপড়ে সবাই একাক্কার কাণ্ড, যেন প্রায় হেরে যাওয়া টেস্ট ম্যাচে সেঞ্চুরী করা ব্যাটসম্যান। সমীর ডিক্লেয়র করে আমার হাতে ব্যাট দিয়ে বলল,
– বাকি টা খেলে দাও।
লোকটা বোধ হয় সমীরকে ধন্যবাদ জানাতে কয়েকটা সিঁড়ি নেমে আসতেই জিগ্গেস করলাম,
– ইয়ে ব্রীজ মে একসাথ মে কিতনে আদমি অ্যালাউড হ্যায়?
– পনদ্রা...ক্যিউ?
– হম চব্বিশ জন হ্যায় তো, একসাথ নেহী যা সখেগা?
– নহী! উতনা লোড একসাথ মে নহী লে পায়েগা।
– কিতনা কেজি কা লোড লেতা হ্যায়?
– বোলা না পনদ্রা আদমি কা!!!
– অউর ঔরত হোগী তো?
– এক হি...পন্দরা…
অনন্ত যোগ দিল
– হমারা টিম কা পন্দরা ঔরত একসাথ যা নে সে, আজ ইয়ে গ্লাস ব্রীজ কা আখরী দিন হোগা।
– অ্যাইসা কিঊ?
– আপ হামারা টিম কো গাঊর সে দেখিয়ে...পতা চল যায়েগা। ওহ যো দিখ রহা হ্যায়, দেখিয়ে ওঁহা...জিস পাত্থরকে উপর ওহ ব্য়ৈঠী থি, ওহ থোড়া নীচে দব গয়া।
বলে অনন্ত বুল্বুলির দিকে দেখাল।
লোকটা জোয়ান চিবোতে চিবোতে দেখতে লাগল। আর বিশ্বাসও করল।
– অনন্ত বলল,
– এক দো ছোড়কে বাকি সব এয়্সা হি হ্যায়্।
শুনে লোকটা খুব চিন্তায় পড়ে গেল, আর ছুট্টে তার বস কে রিপোর্ট করতে গেল।
ইতিমধ্যে চলতে লাগল ফটো শেশন। তাতে আমি বিকৃত অঙ্গভঙ্গী করে ব্যাক্গ্রাউণ্ড নষ্ট করতে থাকলাম।
অনন্তর বেটার হাফ দেবশ্রী এসে আমাকে বলল,
– এটা কি হচ্ছে? লোকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে আমাদের।
– ভাল, দেখ্ছে দেখুক না, কিছু বলার সাহস পাবে না।
– তারপর কিছু হলে কে সামলাবে?
– কাউকে কিছু করতে হবে না...এলেই কাম্ড়ে দেব।
– তোমরা জাস্ট হোপলেস।
তার মধ্যে আবার অনন্ত বলল জোয়ানে নাকি এমন ঝাঁঝ যে ওর জিভ মোটা হয়ে গিয়ে ছোট্দের মত হয়ে গ্যাছে। সব ধ্বণি ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারছে না। সব দন্ত-’স' মূর্ধাণ্য 'ষ' তালব্য 'শ' উচ্চারণ করতে গিয়ে 'চ' বেরিয়ে পড়ছে। কি সব্বোনেশে কাণ্ড! এ লোকটা তো কথা বলতে গেলে মার খেয়ে যাবে। তাই আমরা ঠিক করলাম, যতক্ষণ না অনন্ত-র জিভ ঠিক হয়, ততক্ষণ আমরা চার পাঁচ জন মিলে একটা একই রোগে ভোগা কমিউনিটি গড়ে তুলি, যাতে তেউ কিচু বোত্তে লে আম্লা নিদেলাই লুতে দাঁলাতে পালি!!! (কেউ কিছু বলতে এলে আমরা নিজেরাই রুখে দাঁড়াতে পারি!)
সেদিন সুদীপের ওপর অনেকটা দায়িত্ব দিয়েছিল অনন্ত। কিন্তু কিছুতেই অনন্ত সুদীপকে ডাকতে পারে না। এমনিতে স্নেহবশত: অনন্ত সুদীপকে শুধু 'সুদী' বলে ডাকে। তাই অবিলম্বে তার ডাককে লাগাম দিতে হল।
সমীরের আবার নাকি 'ধ' এর বদলে 'গ' বেরোচ্ছে। পাহাড়ী অঞ্চল। সত্যিই বার বার সবাইকে সাবধান করতেই হয়। 'ধারে যেও না' বলতেই হয়। কিন্তু সে তো অশ্রাব্য শোনাবে। আমি সমীরকে অনুরোধ করলাম, অন্তত: কিছুক্ষণের জন্য মৌনী নিতে। কিন্তু অভ্যাস যাবে কোথায়! মাঝে মাঝেই চিত্কার করে এক ওকে তাকে সাবধান করতে যায়। অবশেষে বললাম,
– ভাই ঠিক না হওয়া ওব্দি নিজের ছেলে-বৌ থেকে অন্তত: দূরে থাক।
এসব চলতে চলতে কখন আমরা গ্লাস ব্রীজের মুখে পৌঁছে গিয়েছি বুঝতেই পারি নি।
টেম্পারড গ্লাসের অনেকগুলো স্তরকে জুড়ে এই সেতু। সিকিওরিটি আমাদেরকে ১৩ জনের দু দলে ভাগ করে দিল। ওজন-জনিত যে প্রশ্নের কথা বলা হয়েছিল, তার উত্তরে জানা গেল মোট ২৫ জন অ্যাডাল্ট একসাথে ধরানো যায়। কিন্তু সেফ সাইডে থাকার জন্য, কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তার অর্ধেক ব্যবহার করা হয়।
কাচের গায়ে যাতে স্ক্র্যাচ না হয় সে জন্য জুতো খুলে যেতে হয়। ফীট্-কভারও আছে। ব্যবহার করে ফিরত দিতে হয়।
ব্রীজের ওপরে পা দিতেই বুলবুলির চোখ বন্ধ। গ্লাস ফ্লোরের নিচে অগাধ গভীর খাদ, সবুজ জঙ্গলে ঢাকা। পাশে যারা আছে, বুলবুলি তাদের হাত ধরে বলেই চলেছে
– আমাকে তোরা খুলতে বলিস না।
উত্তরে আস্ছে,
– কিছু হবে না…. খোল…
চোখ মেলে তাকালে সত্যিই নয়নাভিরাম দৃশ্য! একটা ধোঁয়াশার স্তর ভিজিবিলিটিকে খর্ব করেছে বটে, তবে পাহাড়ের বুকে এরকম অভিজ্ঞতা যে প্রথম, তা অনস্বীকার্য। বরং ওই হাল্কা ধোঁয়াশার চাদর একটা অদ্ভঊত রোম্যান্টিক ও মিষ্টি মিস্টিসিজম তৈরী করেছে।
ওখানকার কন্ট্রোলে যে সিকিওরিটি ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি সুদীপ চাটুজ্জে (বনশালীর প্রিয় সিনেমাটোগ্রাফার্)-কে হার মানিয়ে দেবেন। দু মিনিটের মধ্যে কাপল ফটো, গ্রুপ ফটো, ইন্স্টা ফটো এমন্কি রিল্জ বানিয়ে দিয়ে দিলেন, চার পাঁচ রকম অ্যাঙ্গেল থেকে। আর সব সিঙ্গল টেক-এই পার্ফেক্ট।
সোজা কথায় উনি জানেন, ওই পয়েন্টে মানুষ কি পেলে তাড়াতাড়ি বিদেয় হবে। ওখানে ছ্বি তোলাটাই মুখ্য। প্র্রাণ ভরে প্রকৃতির আস্বাদ নেওয়াটা গৌন। তাই উনি লোকে যেটা চায়, সেটা দিয়ে দিলে ভিড় তাড়াতাড়ি সরে যাবে বলে, he has mastered the art.
গ্লাস ব্রীজ থেকে নেমে দেখলাম অদূরে পুরোনো ঝুলন্ত ব্রিজে যাওয়ার আগ্রহ কারোরই খুব একটা নেই। এখানে এ জীবনে আর আসবো কিনা কোনো গ্যারান্টী নেই। তাই সবাইকে বলে হাঁটা দিলাম ঝুলন্ত ব্রীজের দিকে। মাত্র পাঁচ -ছ্'শো মিটার দূরে হবে। গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে দারুণ মেঠো রাস্তা। হাঁটা শুরু করতেই দেখি কচ আর তার দেবমিতা আমার সাথে। ওরা কথায় কথায় মনে পড়িয়ে দিল যে, ঠিক এরকম একটা ব্রীজ ছিল হ্যারিসন ফোর্ডের ইণ্ডিয়ানা জোন্স সিরিজের কোনো একটিতে। তখন মনে পড়ল না কিছুতেই। পরে হোটেলে ফিরে ধাঁ করে মনে পড়ে গিয়েছিল সবটা।
"টেম্পল অফ ডুম্"-এ ছিল, ওরকম ঝুলন্ত ব্রীজে ফাইটিং সিন। ভিলেন ছিলেন অমরেশ পুরী। পরিচালক স্পিলবার্গ উত্তর ভারতের কোনো এক অঞ্চলে দৃশ্যটি তুলতে চেয়েছিলেন। অনুমতি পান নি। অগত্যা শ্রীলঙ্কার ক্যাণ্ডি হাইল্যাণ্ডে দড়ির ঝুলন্ত ব্রীজে দৃশ্যটি তোলা হয়। অনেকে গাঁজাখুরী গপ্প বলে বদ্নাম করলেও, এটি আমার কাছে বাপু আইকনিক, তিনটে কারণে:
১. হ্যারিসন ফোর্ড
২. স্পিলবার্গ
৩. অমরেশ পুরী স্পিলবার্গের সিনেমায় (এটা কি গর্বের বিষয় নয়?)
তবে ঝুলন্ত ব্রীজে পৌঁছে দেখলাম, সেখানে যাতায়াত বন্ধ। নাকের বদলে নরুণ, তার পাশে একটা ছোট ঝুলন্ত ব্রীজ। সেটা দিয়ে যাতায়াত করা যায়্। তাই-ই সই!
ততক্ষণে আমাদের দলের সবাই-ই মোটামুটি এসেছে।
আর কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ঝুলন্ত ব্রীজের মাঝখানে বুলবুলি। পর পর খচাত খচাত ক্লিক, মোবাইলে, ক্যামেরায়, বিভিন্ন পোজে, বিভিন্ন আলোয়। হঠাত বুলবুলির ইচ্ছে হল, সানগ্লাস পরে গৌতমের সাথে ছবি তুলবে। বেশ। সানগ্লাস কোথায়? না, গৌতমের ব্যাকপ্যাকে। তা, আবার বেশ। বুলাও গৌতমকো।
গৌতম এল, কিন্তু ব্যাগ? নেই তো। কোথায় ব্যাগ?
লাস্ট দেখা গিয়েছে আসার সময়ে সাফারির বাসে। তারপর?
কেউ জানে না।
কিন্তু ব্যাগে রয়েছে সব – সানগ্লাস, টাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স, আরো অনেক কিছু।
ঝুলন্ত ব্রীজের ওপার থেকে বুলবুলি রাগে ছুটে নাম্তে গিয়ে দুলে উঠল ব্রীজ।
না। কিন্তু কিছু ঘটল না। সেফ ল্যান্ডিং।
ওখানে পোস্টেড সিকিওরিটিকে বলা হল হারানো ব্যাগের কথা।
মোবাইল ফোন ওখানে কাজ করে না। স্টাফেদের মধ্যে অনুমোদনও নেই। ওনারা ওয়াকিটকি ব্যবহার করেন, খুব দরকার হলে। কালে ভদ্রে ব্যবহার হয় বলে ব্য়াটারী নেই। সিকিওরিটির ভদ্রলোক পরের সিকিওরিটির পয়েন্টে চলে গেলেন, ব্যাগ হারানো রিপোর্ট করতে। সাথে গেল, গৌতম ও অনন্ত।
পাঁচ মিনিটে ফিরে এসে বললেন
– মেডাম, গেট মেঁ ব্যাগ রখ্খা হুয়া হ্যায়্। ২৩ নাম্বার বাস -সে মিলা হ্যায়।
ব্যাগটা যে পাওয়া গিয়েছে, এতে সবাই খুব নিশ্চিন্ত। বুলবুলি-গৌতম-ও।
দাম্পত্য জীবনে পঁচিশ বছর একসাথে কাটালে খুশির অভিব্যক্তিগুলো বদলে যায়, আর তা সব দম্পতির ক্ষেত্রে ধ্রুব সত্য। বুলবুলি-গৌতমেরটা নমুনা মাত্র।
– ব্যাগ্টা তোমাকে লক্ষ্য রাখতে বললাম। এটুকু পারলে না। কি কর!
– কখন বললে?
– বেশি বাজে বকলে আর কাজের কথাটা কানে ঢুকবে কোথ্থেকে? খালি হ্যা হ্যা হি হি...সিরিয়াস হও।
– ব্যাগটা তোমার। তোমার পিঠে ব্যাগ। আমি হঠাত বললেই খোঁজ রাখব কি করে?
– রাখতে হবে।
বুলবুলি ভীষণ রেগে বলল,
– আচ্ছা, ব্যাগের বদলে তুমি হারাও না কেন বলতো?
গৌতম কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলে বুলবুলির কি হাল হয়, সে আমরা আগেই দেখেছি।
চোখে হারানো কাকে বলে, সেই প্রথম চাক্ষুস করেছিলাম সবাই।
কাকতালীয় ভাবে ঘটনাস্থল, সেই বাস।



No comments:
Post a Comment