আমরা এবার এসেছি নালন্দার চতুর্থ পর্বে।
সোজাসুজি কথোপকথনে চলে যাওয়া যাক।
আমাদের গাইড কমলা সিং বললেন, আমাকে ডেকে
– এই যে, টেপ রেকর্ডিং-সাহেব, আপনি সামনে আসুন
এলাম।
তখন উনি বললেন,
– তাহলে এবার বলতে শুরু করি।
সবাই সমস্বরে উত্তর দিল,
– হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন
– ওই সামনের যে বিল্ডিং বা মনুমেন্টটা যেখানে আছে ওটাই হল নালন্দার মূল রেফারেন্স পয়েন্ট। সমস্ত জায়গায় এটারই ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এর নাম সারিপুত্র স্তূপ। সারিপুত্র ছিলেন ভগবান গৌতম বুদ্ধের প্রধান শিষ্য। তিনি নালন্দার ভূমিপুত্র। এই নালন্দাতেই জন্মগ্রহণ করেন এবং এখানেই ওনার মৃত্যু হয়। ভগবান বুদ্ধ বলতেন, “যেখানে সারিপুত্র গেছে সেখানে আমার আর যাওয়ার প্রয়োজন কি!" ভগবান বুদ্ধের এতটাই ভরসাযোগ্য ও বিশ্বস্ত ছিলেন সারিপুত্র। আর এই হল সেই পবিত্র স্থান যেখানে মৌর্য সম্রাট অশোক সারিপুত্রের সমাধির উপরে এই স্তূপ নির্মাণ করেন। সম্রাট অশোকের পরে সুঙ্গ-যুগ, পাল-যুগ, কুষাণ-যুগ ও গুপ্ত-যুগেও এই স্তূপের অনেক অংশ বিভিন্নভাবে নির্মিত হয়েছিল।
মোট চারটে কাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক আগেই স্থাপিত হয়েছিল সেগুলো এই ধ্বংসস্তূপের নিচে ঢাকা পড়ে গেছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তাহলে তা হল তিনটি লাইন বরাবর তিনটি দিক বা অংশ। আর ঐ তিনটি লাইন হল বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়কালের।
সব থেকে নিচে যে ছোট লাইনটি দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে গুপ্ত যুগের। এর চার কোণে চারটি স্তূপ ছিল যেগুলি দ্বারা বোঝাই যাচ্ছে যে এই অংশটি ঘেরা ছিল। আর ওগুলোর দেওয়ালে যে ভাঙ্গা মূর্তি ছিল তা গৌতম বুদ্ধের ও বোধিসত্ত্বের। এই সমস্ত মূর্তি দেড় হাজার বছর পূর্বের গুপ্ত যুগের স্থাপত্য ও শিল্পকলার অসাধারণ নিদর্শন। সেগুলির সাথে আবার সারনাথ স্তূপের শিল্পকলার অনেক মিল পাওয়া যায়।
আচ্ছা এবারে বলি যে পঞ্চম কাঠামোটি ছিল গুপ্তযুগের পঞ্চায়তনের মত। ‘পঞ্চায়তন’ শব্দের অর্থ হলো ‘পাঁচ'। চার কোণে চারটি স্তূপের কথা আগেই বলা হয়েছে। আর মদ্যিখানে যা ছিল তাই নিয়ে 'পাঁচ'। কিন্তু মদ্যিখানের সেই অংশটি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
আর সেই মদ্যিখানের আকৃতি কেমন ছিল তা সম্পর্কে পার্সি ব্রাউন একটা কনজেক্চর (conjecture) দিয়েছিলেন যে ওটি একটি 'চৈত' বা মন্দির ছিল। জাস্ট সেটা দেখলে ওই পঞ্চম অংশটি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা যেত। সেটার ফটোগ্রাফ পরে দেওয়ালে লাগানো হয়েছিল। সেটাও পরে ভেঙে যায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর সেই ফটোগ্রাফ ওখানে লাগানো হয়নি। পার্সি ব্রাউন ওই অংশটিকে পঞ্চম কাঠামো হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর মত অন্যান্য তাবড় ইতিহাসবিদ ও আর্কিওলজি বিভাগের বিদ্বান লোকজনও মেনে নিয়েছিলেন যে পঞ্চম কাঠামোটি কোন শুধুমাত্র কোনো স্তূপ বা স্তম্ভ ছিল না, ছিল একটি 'চৈত' বা মন্দির।
এবারে ঐ মাঝের যে লাইনটা দেখছেন তা হলো ষষ্ঠ স্তর। আর সব থেকে উপরেরটি হল সপ্তম স্তর। সপ্তম স্তরের যে অবশেষ এখানে পড়ে আছে, সেখানে ছিল উত্তর দিকে মুখ করে থাকা একটি বুদ্ধমূর্তি।
তাহলে কি বুঝলেন?
এই হল সপ্তম
তার নিচে ষষ্ঠ,
তার নিচে পঞ্চম,
আর বাকি চারটি স্তর রয়েছে একেবারে নিচে।
প্রত্যেকটির উপরের কাঠামো ওভার এন্ড রাউন্ড ভাবে গঠিত হওয়ার ফলে এর ব্যাপ্তি এতটাই যে তা অত্যন্ত এক্সটেনসিভ। আর যত ছোট স্তুপ আছে তা ধরেই নেওয়া হয় সম্রাট অশোকের তৈরি। এর আশেপাশে যে গোলাকৃতি বিভিন্ন রকমের কাঠামো দেখা যাচ্ছে, তা তিনটি ভিন্ন রকমের।
প্রথম ধরণ হল্, ছোট ছোট পূজাগৃহ ও বুদ্ধমূর্তি।
দ্বিতীয় ধরণ, গোল গোল ছোট ছোট স্তূপ আছে সেগুলো ‘বটিকা’ নামে পরিচিত। ওইগুলো হচ্ছে মানুষের মানত বা মানসিক পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ঈশ্বরের প্রতি দান হিসেবে তৈরি করা স্তূপ।
আর তৃতীয় রকমের হচ্ছে যে সব গোল গোল বড় স্মারক দেখা যাচ্ছে সে রকম আবার বিভিন্ন দ্বারের ওপরেও তৈরি করা হয়েছে। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিদ্যার্থীদের জ্ঞান লাভের উদ্দেশে তৈরী করা হয়েছিল।
তবে মোদ্দা কথা হল্, এই তিন রকমের কাঠামো চারিদিকে যে আছে আর প্রধান ও মূল অংশটি হল 'সারিপুত্র স্তূপ', সম্রাট অশোকের তৈরী করা। আগেই বলেছি যে সম্রাট অশোক নিয়মিত এখানে আসতেন পুজো দিতে।
এই লাইনে বাকি যা আছে তা হচ্ছে ১২-১৩-১৪ নম্বর চৈত বা মন্দিরের অবশেষ। এগুলি দুবার নির্মিত হয়েছিল প্রথমবার গুপ্ত যুগে। তারপর সেগুলো সব খারাপ হয়ে যাবার পর পাল যুগে বিভিন্ন রাজা আবার এগুলি নির্মাণ করেন। গুপ্ত যুগের যত রাজা ছিলেন তাঁরাও এখানে পুজো দিতেন আর এর পাশেই দেখতে পাচ্ছেন যে আরও মানসিক বা মানত করার স্তূপ আছে। যেগুলি প্রস্তর্-নির্মিত, সেগুলি পাল যুগের আর যেগুলি ইঁট দিয়ে তৈরি, সেগুলি হচ্ছে গুপ্ত যুগের। ১২-১৩-১৪ নম্বরের চৈতগুলির শুধুমাত্র পাদদেশ দেখা যাচ্ছে। এখানে অনেকগুলি মূর্তি ছিল। মূর্তিগুলো এখন আর এখানে নেই। উন্মুক্ত স্থান তো! যে সমস্ত মূর্তি এই ১২-১৩-১৪ নম্বর মন্দির থেকে পাওয়া গেছে তার সবকটিই সংগ্রহশালায় রাখা।
তাহলে এই চারটি মন্দির হল এই লাইনে, আর দুটি বিহার লাইনের পিছনে। আর ওই মধ্যের লাইনে এগারোটা বিহার পাওয়া গেছে।
শুনলে আশ্চর্য হবেন যে পৃথিবীর সমস্ত বিখ্যাত সংগ্রহশালায় নালন্দার কোন না কোন অংশ রক্ষিত আছে।
আচ্ছা, নালন্দার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ধাতু কি ছিল বলুন তো?
শেষ ইতিহাস পড়েছি মাধ্যমিকে। লিখে যা নম্বর পেয়েছিলাম, তা জনসমক্ষে বলতে লজ্জা হয়। ভাগ্গিস মৌখিকটুকু ছিল!
তাই আমি তো কিছু বলতেই পারলাম না।
কিন্তু যারা নম্বর পেয়েছিল, ঐ সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের স্মৃতিও আজ দুরবল বলে মনে হল।
তাই আমরা সবাই চুপ করে রইলাম।
অগত্যা সিং-জি উত্তর দিলেন নিজেই।
- ব্রোঞ্জ
- এখানকার মিউজিয়ামে তাই আলাদা করে ব্রোঞ্জের গ্যালারি আছে। শুধু এখানেই নয়, বিদেশের বিভিন্ন মিউজিয়ামে নালন্দার ব্রোঞ্জ রাখা আছে। ওরকম হাই কোয়ালিটি ব্রোঞ্জ রেয়ার্।
এই বলতে বলতে উনি আমাদের সাথে নিয়ে হাঁটতে রইলেন।সঙ্গে দিলেন একটি ছোট্ট ট্রিভিয়া।
- একবার এক আমেরিকান মহিলা পর্যটককে এখানে ঘোরাচ্ছিলাম। বললাম ওনাকে যে এখানকার ব্রোঞ্জ তো আমেরিকার বস্টনেও রয়েছে। কিন্তু সেই মহিলা তখনই জবাব দিয়েছিলেন যে,
- না নেই। এই তথ্য অর্ধসত্য।
- মানে?
- মানে…. হ্যাঁ একসময় সেই ব্রোঞ্জ বস্টনে ছিল বটে। কিন্তু পরে আমেরিকা তা ভারত সরকারকে হস্তান্তরিত করে দেয়।
(চলবে)




No comments:
Post a Comment