Friday, 22 December 2023

"কাঞ্চনগড়ের কোকিল" নাটক নিয়ে একটু 'কুহু':

1990 সাল। আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র৷ যে স্কুলে পড়তাম সেটি খুব সাধারণ মানের একটি বাংলা মিডিয়াম স্কুল ৷ আর তার ওপর আমি আমি আবার অতি সাধারণ মানের ছাত্র।  আমার বাবা-মা আমাকে রকেট সায়েন্টিস্ট হিসেবে প্রাইমারী ক্লাস থেকে দেখতে চান নি। ফলত: ওই স্কুলে স্যারেদের মার্-ধর খেয়েও শৈশব-কৈশোর সবই বেশ দিব্বি কেটেছে। কারণ সেই মার-ধর গাধা-পিটিয়ে মানুষ করার সামিল। তাঁদের নিজেদের সন্তান যদি গাধা হত, আমাদের-ই মত, ফেলে দিতে পারতেন কি? ফলে সে সব মার-ধরের আড়ালে ছিল স্নেহ-মমতা ও গভীর ভালবাসা।

স্কুল ছুটি থাকলে মন খারাপ হয়ে যেত।  তখন আমাদের স্কুলে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল হয় পদব্রজে, না হলে বাসে। আমরা তখন সালকিয়ায় থাকি। আর স্কুল ছিল বেলুড়ে। তাই আমাকে রোজ বাসে করেই স্কুলে যেতে হতো। যেদিন বাস্-ভাড়া দিয়ে ঘুগনি-ফুচ্কা বা চুরণওয়ালার থেকে ছোটকুল খেয়ে ফেলে পয়সা শেষ হয়ে যেত, তখন চার কিলোমিটার পথ হেঁটেই ফিরতে হত। 

হাওড়া থেকে বালিখাল পর্যন্ত চলত ৫৪ রুটের বাস। তাতে করেই রোজের যাতায়াত। বালিখাল হচ্ছে হাওড়া জেলার শেষ প্রান্তে অবস্থিত দক্ষিণেশ্বরের ঠিক উল্টোদিকে অবস্থিত একটি খাল যা হাওড়া আর হুগলী জেলাকে যোগ করে। ওই খালটি পেরোলেই শুরু হয়ে যায় হুগলি জেলা। ব্রীজ থেকে অপর প্রান্তে হুগলী জেলার দিকে নামলেই রয়েছে বিখ্যাত জেলা স্কুল-- উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুল। স্কুলটি হুগলীতে হলেও, হাওড়া জেলা থেকে বহু ছাত্র সেখানে পড়তে যেত। ফলে আমার থেকে বড় বা ছোট, মানে দু -এক ক্লাস উঁচু-নিচুতে পড়ে এরকম অনেকেই ওই ৫৪ নম্বর বাসে করে রোজ উত্তরপাড়া স্কুলে যেত।

তখন সরাসরি সরকারি ইস্কুলের ব্যাপারই ছিল আলাদা।  যেমন হাওড়া জেলা স্কুল, উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুল, কলকাতার হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল, বেথুন কলেজিয়েট স্কুল, ও আরও অনেক বিদ্যালয় ছিল আমাদের রাজ্যের প্রাঈম ইন্সটিটিউটগুলোর মধ্যে অন্যতম ও এ রাজ্যের গর্ব। ফলে এই স্কুলের ছাত্রদের দেমাক-ও ছিল বেশ। ওরা কোথাও যেন একটা আমাদের মত সাধারণ সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের নিচু চোখে দেখতো। এই নিচু চোখে দেখার মধ্যে একটি বিষয়, যখন স্কুলের রেজাল্ট বের হতো, বেশ প্রকট হত, প্রত্যেকবার। প্রায়ই শুনতাম গর্ব করে তারা বলে, 
-- হ্যাঁ তোরা তো অংকে নব্বই একশো কত কিছু পাস! আর আমাদের স্কুলের ফার্স্ট বয় অঙ্কে  ১০-১৫-র বেশি তুলতে পারে না। 
-- সে কি রে? কেন? 
-- জানিস আমাদের অংকের স্যার হচ্ছেন ম্যাথস অলিম্পিয়ডের কোয়েশ্চেন সেটার। -- তবে তো তোদের আরো চিন্তারই কোনো কারণ নেই। তোরাও অঙ্কে দারুণ হবি। 
-- আরে দূর!  ওনার প্রশ্ন এমনই কঠিন হয় যে তাতে ১০ এর বেশি যে পায়, তাকে লোকে দেবতা-জ্ঞানে পুজো করে। আর ২০-র বেশি যদি কেউ পেয়ে যায়, তখন তার জন্য আবার আলাদা পরীক্ষা...
-- বলিস কি রে! 
-- হ্যাঁ রে যতক্ষণ না তাকে দশের নিকে নামাচ্ছে, ততক্ষণ ওনার মনে শান্তি নেই। এখন এমন অবস্থা যে কেউ আর ভয়ে বেশি প্রশ্নের উত্তর দেয় না, যাতে দশের বেশি না ওঠে। 

গল্প করে বললাম বটে। কিন্তু এর ভালো-খারাপ, অনেক দিক আছে।

এখন আমি নিজে পেশায় শিক্ষক।  অনেক কথা বলতেই পারি।  কিন্তু সত্যি বলতে তখনও আমার মনে একটাই কথা ভাসতো। বলতে সাহস পেতাম না -- যে হতে পারে উনি খুবই প্রতিভাবান কিন্তু শিক্ষক হিসেবে উপযুত্ক নন।  ছাত্রদের হীন-দুর্বল প্রতিপন্ন করা ওনার মানসিক রোগ। উনি গণিতের শিক্ষক হয়ে যদি ওনার ছাত্রকুল ওনার বিষয়ে পাশ না করে, তা হলে উনি যে যোগ্য শিক্ষক হিসেবে একজন আদ্যন্ত ফেলিওর, তা ওনাকে কে বোঝাবে!  

মনে হত, এ কি রকম শিক্ষক যে খুব ভালো মেধাবী ছাত্রদের এই রকম শিক্ষা প্রদানের নীতি নেন সবসময় এটা বোঝানোর জন্য যে -- তুমি কিছুই জানো না,  আর তোমার দ্বারা কিছুই হবে না।   

যখন 'থ্রি ইডিয়টস' তৈরি হয়েছে তখন সারা ভারতবর্ষের লোক মনে করেছেন যে হ্যাঁ এই ধরনের শিখন পদ্ধতি ঠিক নয়। কিন্তু ওই মনে হওয়া পর্যন্তই। তা সত্ত্বেও শুধু ডাক্তারী ইঞ্জিনিয়ারিং এর চান্স পাওয়ার জন্য কোটা শহরে কি চলছে, তা সবাই দেখছেন, শুনছেন, আর ভাবছেন যে ও সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সারা ভারতে প্রত্যেক বছরে শুধু ৩০ হাজারের কাছাকাছি ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে পড়াশোনার চাপে। 

যখন কোন বাবা-মা খুব আক্ষেপের সুরে বলে বসেন যে,
-- জানো আমার ছেলে বা মেয়ে অমুক স্কুলে পড়ে। সেখানে কি চাপ, কি বলবো!  মাথা তোলার সময় নেই। সারাদিন শুধু পড়া আর পড়া!  আমরা তো বিয়েবাড়ি-টিয়েবাড়ি যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছি। 

আসলে ওই আক্ষেপের মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন গর্বের ফানুস লুকিয়ে আছে তা কি আর বলে বুঝিয়ে দিতে হয়! ঐ চাপ-টা যদি অভিভাবক্-রা চান্, তাহলে স্কুল-ও সৈ মতই চলবে। ছেলে বা মেয়ে কোন স্কুলে পড়ে সেটা এখন একটা স্টেটাস-সিম্বলের মধ্যে পড়ে। 

ফলে সরকারী নিয়ম-নীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। 

সমগ্র শিক্ষা মিশন এবং যত শিক্ষাবিদ পরে এসেছেন সারা পৃথিবীতে এখন মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ও প্রাথমিক শিক্ষা অবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদের স্ট্রেস কমানোর জন্য বইয়ের ব্যাগের ওজন কমাতে বলেছেন।সরকারি বিদ্যালয় সেগুলোর প্রয়োগ করছে, কিন্তু এর ফলে বেস লাইন এত নীচে নেমে গিয়েছে যে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা ও তাদের বাবা-মায়েরা সরকারী স্কুল বিমুখ হয়ে পড়ছে। বেসরকারি স্কুলে ব্যাগের ওজন কমানোর কোনো চিহ্ন্মাত্র নেই।উল্টে বরং ছাত্রদের যে পরিমাণ বইপত্র দেয়া হয় তাতে তাদের ব্যাক-প্যাকও যথেষ্ট নয়; ছোটখাটো স্যূটকেস দিলেই ভালো হয়।

ফলে একদিকে বেসরকারি ব্যবস্থায় চলছে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসার রমরমা আর অন্য দিকে সরকারি স্কুলের দৈন্যদশা। ক্লাস এইট পর্যন্ত পাশ ফেল তুলে দেওয়া হয়েছে। যে পড়ছে, আর যে পড়ছে না, তাদের কোন ফারাকই থাকছে না। ফলে যারা ভালো, তাদের মধ্যে থেকে নিজেদের মেধা ধরে রাখার তাগিদ যাচ্ছে হারিয়ে। তারা আর ভালোবেসে পড়ছে না। তারা দিশা হারাচ্ছে। ভেবে পাচ্ছে না কিভাবে নিজেদের মানকে ধরে রাখতে পারবে। শিক্ষা ব্যবস্থার পুরোটাই যখন শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়াকে তুলে ধরার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে, তখন সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বঞ্চিত হয় মেধা ও মেধার প্রাপ্য উপযুক্ত সম্মান। দেশটি ধীরে ধীরে নিজেকে মেধাহীনতার সাম্রাজ্যের দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে, যাতে অশিক্ষিত রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতার যাদুদণ্ড-টি থাকে।

আজকের নাটক "কাঞ্চনগড়ের কোকিল" আমাদের সেই একই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।  এই নাটকে এক গণিতের  শিক্ষক মশাইকে দেখানো হচ্ছে যিনি ছাত্রদের  ওই উত্তরপাড়া স্কুলের গণিতের স্যারের মত সবাইকে এক্শো তে দশ-পনেরো দেন আর মনে করেন যে স্কুল আওয়ার এর মধ্যে যতগুলি পিরিয়ড হয় তার মধ্যে সব পিরিয়ডের পাঁচটা পিরিয়ড শুধুমাত্র গণিতের জন্যই থাকা উচিত। বাকি বিষয়গুলো না পড়ালেও চলে। আগেকার দিনে ইংরেজি এবং অংকের শিক্ষকরা বেশিরভাগই এই ধরনের হতেন। তার কারণ এই দুটি বিষয় সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে কঠিনতম বলে মনে হতো।  ইংরেজি এবং অঙ্কের শিক্ষকদের একটি উন্নাসিকতা চিরকাল প্রত্যেক বিদ্যালয় মধ্যে বজায় থাকতো। তাঁরা ভাবতেন যে অন্যান্য বিষয়গুলি যেন কোনো পাঠযোগ্য বিষয়-ই নয়। শুধু ইংরেজি আর অঙ্ক দুটো বিষয়ে পড়লেই তা একজন শিক্ষার্থীর মানুষ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। 

শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে এই নীতি বা ধারণার সর্বই ভাবে ভুল হওয়া সত্বেও এই ধরনের মানসিকতা থেকে বেশ কিছু শিক্ষক আজ পর্যন্ত বেরোতে পারেননি। প্রচেত গুপ্ত তাঁর গল্পের মাধ্যমে সেটাই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন| এই হাসির গল্পের সার্থক নাট্যরূপ দিয়েছেন রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী মহাশয়।  'শিল্পীসংঘ' আমাদের সকলের সামনে নাটকটিকে আপাত ভাবে একটি হাস্যরসাত্মক নাটক হিসেবে মেলে ধরলেও নাটকটির মধ্যে রয়েছে গূঢ় বার্তা।  শিক্ষা-ব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করার চেষ্টায় এক গভীর আবেদন।  শেষ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই গণিতের শিক্ষক মহাশয় নিজের মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ছাত্রদের প্রিয় হয়ে উঠছেন। তিনি বুঝতে পারছেন শিক্ষা একটি সামগ্রিক ব্যাপার। সেখানে গণিত ছাড়াও বাকি বিষয়গুলো অধ্যয়নের প্রয়োজন আছে।  শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলাই শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।

গল্পটিকে আকর্ষক করতে যখন নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছে তখন বেশ কিছু জায়গায় নিছক হাস্যরস উৎপাদনের উদ্দেশ্যে নাটককার আদিরসাত্মক কথাবার্তা রেখেছেন। কোকিল স্যারের ভূমিকায় কমল চট্টোপাধ্যায়ের মত কমেডি-অভিজ্ঞ মানুষের হাতে চরিত্রটি অসামান্য হয়ে উঠেছে। সে সব মোটা দাগের ডায়ালগে অডিটোরিয়াম হাততালিতে ফেটে পড়েছে  বটে, কিন্তু একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এই ধরনের আচরণ আমার সস্তা মনে হয়েছে। সেই শব্দগুলিকে হ্যামার করে যাওয়া আমার কাছে একটু অসভ্যতা বলে মনে হয়েছে, কারণ সেগুলি কোথাও একজন শ্রদ্ধেয়  শিক্ষকের ইমেজ্-কে মানুষের মনে ছোট করে বৈ কি! হাস্যরস ও ভাঁড়ামোর পার্থক্য এখানে বোঝা দরকার। একজন শিক্ষক মহাশয় এই ধরনের ভাঁড়ামোয় নামবেন না, এটাই অভিপ্রেত।  স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তিনি স্পণ্ডোলিসিস্-এর কলার লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু উত্তেজনার মুহূর্তগুলিতে তাঁর শারীরিক সাবলীল অভিব্যক্তি এই সন্দেহের উদ্রেক ঘটায় যে, আদৌ ওনার ওই রোগ-টি আছে তো? হয়ত সবার চোখে পড়বে না। কিন্তু আমার চোখে পড়েছে। নাটকের শেষে ছাত্রদলের বয়স বড়ই বেশি। আর কোকিল স্যারের ধোপদুরস্ত জামাকাপড় যেন আরো খানিকটা মালিন্যের দাবি রাখে। আলোক প্রক্ষেপণেও কিছু জায়গা বেশ কাঁচা। 

তবে যে গল্পটি নিয়ে নাটকটি বাঁধা হয়েছে, তা সময়োপযোগী। বিশেষত: যারা স্কুল স্তরের ছাত্র-ছাত্রী, তাদেরকে নাটকটি অবশ্যই দেখানো উচিত। আর যাঁরা খুব কড়া শিক্ষক, তাঁদের এবং যে সমস্ত বাবা-মায়েরা নিজের সন্তান-কে শিক্ষিত করে তোলার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে নিজেদের অজান্তে তাদের বাস্তবের সাগরে  অতলে তলিয়ে দেন, তাঁদেরকেও আমার অনুরোধ, একবার "কাঞ্চনগড়ের কোকিল" দেখে আসুন!

পরিশেষে, একজন শিক্ষক হিসেবে বলে যাই যে, কোন জিনিসের মান ধরে রাখার জন্য কিন্তু কাঠিন্যের প্রয়োজন আছে।  তবে সেই কাঠিন্য, অত্যাচার নয়, বরং শিক্ষার্থীর মনে তা একটি ডিসিপ্লিন তৈরি করে দেবে, এমন। এমন হবে সেই ডিসিপ্লিন ছাত্রছাত্রীরা যাতে নিজেরাই তা মানতে ইচ্ছুক ও পারদর্শী হয়ে ওঠে! সেই ডিসিপ্লিন তারা যাতে বয়ে নিয়ে চলতে পারে তার জন্য সার্বিক ভাবে তাদের প্রস্তুত করে দেওয়া হচ্ছে একজন প্রকৃত আধুনিক শিক্ষকের কাজ। 

সবশেষে জানাই আমার ভ্রার্তৃপ্রতিম মিলন (মিলন ধাড়া)- Milan Dhara কে ধন্যবাদ। কারণ যেদিন থেকে ওকে পেয়েছি, আমি আর আমার ক্যামেরা নিয়ে নাটক দেখতে যাই না।  সব জায়গাতেই ওর সাথে আমার দেখা হয়। ও কিন্তু এক কথায় আমাকে ওদের 'সৃষ্টি বাংলা' চ্যানেলের তোলা ছবি পাঠিয়ে দেয়।  সৃষ্টি বাংলার উপর নির্ভর করে আমার 'নাট্য সমালোচনা'-ধর্মী লেখাগুলো সম্পূর্ণতা লাভ করে। 

ধন্যবাদ জানাই, অয়ণ-কে, (যাকে লোকে 'সাহেব' বলে চেনে)। তার বার বার নিজের কাজের কোথায় খুঁত আছে তা জানার জন্য আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের মতামত-কে পাত্তা দেওয়ার জন্য।

আর সর্বোপরি ধন্যবাদ জানাই 'শিল্পীসংঘ' Shilpi Sanghaপরিবার ও শঙ্কর-দাকে Shankar Ghosh আমাকে নাটক দেখার জন্য নেমন্তন্ন করার জন্য।

নাটকের নির্দেশক-অভিনেতা কমল-দা কে অনুরোধ, আপনার সৃষ্ট এই প্রডাকশন-টার নামে চারটে কু-কথা একটু 'কুহু' করলাম বলে কিছু মনে করবেন না যেন!

Sunday, 17 December 2023

Ulyssian Meteors: 2


His vision was smoggy as his lungs were full of weed-smoke. With lips circled, he locked them against the cloth-veiled clay-pot and wheezed in a gush so hard that both of his inner cheeks almost kissed one another in the middle of his mouth leaving a slit to let the puff in and swept down straight to the lungs. In his levitational glide his senses were benumbed to those boys with nothing to do but jumping into the river and swimming against its flow. As they performed the stunts that will shock the best trained actions heroes of silver screen around the world, his eyes induced a trance-like rage as blood rose into its sleek veins and they appeared his look alone would suffice the whole world to turn apocalyptic. The great universal villains and heroes in the realm of acting should come to him and learn how to strike that look in the eyes. To speak of those unknown boys, swimming relentlessly without any purpose, just to kill some time, had six and eight packs naturally without any trainer -- something to adrenalise the suicidal impulses in the greatest fitness freaks out of sheer jealousy.

Ulyssian Meteors: 1


 In the inconspicuous, chariot winged dream was a camouflaged, sylvan nymph that could not play me, as my fingers were never crossed so that I can write--write not about her poignancy, not about the fatal maze that she is lost in, not about all the things that she wishes to change. not about the reticence that she cannot follow, but about a queer minstrelsy that, like the one lurking deep within you and me, around the unknown pits of our hearts, she pretends, not to perceive, when she becomes the real one with her real voice and her truth that darkness is equivalent to the democracy people talk about, and freedom is the crime she commits to save it. She wakes up. All her skin is full of sweat. Through the dust and smoke she can see in the bubbles of light outside her window pane that people are having meat-bowls and soup in the rain.

Wednesday, 15 November 2023

অপুর হিরো যেমন কর্ণ, আমার, সুকুমার (রবীন্দ্রনাথের নোবেলের একশো-দশ বছর যাপনে)


কিছু সত্য থাকে সব সময়ই অপ্রিয় হয় সে রকমই এই সত্য সকলের কাছে প্রিয় নাও হতে পারে। কিন্তু সত্য তো সত্যই। তা জানতে দোষ কি? 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল নন্-ইউরোপীয়ান হিসেবে সাহিত্য-কীর্তিতে দেশের প্রথম নোবেল ৷ অবশ্যই গর্বের। সে গর্বকে খর্ব করার জন্য এই লেখা নয় ৷ তবে তাঁর নোবেল পাওয়ার পিছনে যে মানুষটির অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল, যাঁর জন্য আসলে প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে, যাঁর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম প্রথম ভারতবর্ষ পেরিয়ে সাগর পারের ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংরেজদের কাছে পরিচিত হয়, তিনি আর কেউ নন - আমাদের গর্বের আর একজন মানুষ, যাঁকে নিয়ে চর্চার বড়ই অভাব বটে, সেই সুকুমার রায়, আর সেই আক্ষেপে এই লেখা।

ঘটনা হলো এই যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন ব্যবসায়ী। তাঁদের ছিল প্রিন্টিং হাউস বা প্রেস৷ সেই প্রেসকে আরো উন্নত মানের করার জন্য উপেন্দ্রকিশোর চাইলেন, যে তাঁর সুপুত্র সুকুমার একদম খোদ বিলেত গিয়ে প্রিন্টিং টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করুক৷ আসল ফোকাস পাশ্চাত্যের চালু হওয়া তৎকালীন লেটেস্ট প্রিন্টিং টেকনোলজি হাফটোন কে রপ্ত করে (হাফটোন: অনেকগুলো ডটের সমাহারে একটা গোটা আস্ত ছবি তৈরি করে ফেলা যায় অনেক কম কালি খরচ করে)। 


সুকুমার পাড়ি দিলেন লন্ডনের উদ্দেশ্যে। আর ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙ্গে। উনি সেখানে গিয়েই একটা  লিটারারি ক্লাব গঠন করে ফেললেন ৷ তৎকালীন লন্ডনের প্রথিতযশা সাহিত্যিক,  কবি এবং বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে তাঁর ওঠাবসা ছিল।  এনারা একসাথে বসে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা তর্ক-বিতর্ক করতেন৷ এই সাহিত্য সভাতেই যখন বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ এল তখন সুকুমার সে সুযোগ হেলায় হারান নি। বেঙ্গল রেনেসাঁ-র ঢেউ-কে আছড়ে ফেললেন ইংল্যাণ্ডের হৃ‍দ্পিণ্ডে, রবীন্দ্রনাথের কাজ দিয়ে ৷ যখন বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করা হতো, তখন সুকুমার রায় নিজের নাম বা তাঁর বাবার নাম বলেননি। সেখানে তিনি মেলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথের নাম৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি ধরনের কাজ করেন, তাঁর জীবনের ফিলোজফি কি, তাঁর লেখার মধ্যে কি অমূল্য ধনরাজি লুক্কায়িত আছে, সেই সমস্ত কিন্তু সুকুমার রায়ই চোস্ত ইংরেজিতে ইংরেজদের শোনাতেন ৷  

এটা একেবারেই ভুল ধারণা যে আমাদের ব্রিটিশ সরকার রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে, তাঁকে জেনে নোবেল কমিটিকে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাম সুপারিশ করেছিলেন৷ না।এক্কেবারেই, না। ইংল্যান্ডের লোক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচিত হয় সুকুমার রায়ের হাত ধরে। আর এ কথা অনেকেই জানেন না। না আছে সে ই মানুষটিকে এই নোবেল প্রাপ্তির জন্য ন্য়ূনতম সম্মান দেওয়ার কোনো ন্যূনতম উদ্যোগ। অবাক হতে হয়!

সুকুমার রায় 1911 সালের শরৎকালে ইংল্যান্ডে আসেন এবং প্রথমে 21 ক্রোমওয়েল রোডে নর্থব্রুক সোসাইটিতে বসবাস করেন। তিনি লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল দ্বারা পরিচালিত বোল্ট স্ট্রিটের লন্ডন স্কুল অফ ফটো এনগ্রেভিং এবং লিথোগ্রাফিতে মুদ্রণ অধ্যয়ন করেন এবং তারপর ম্যানচেস্টারে যান এবং ম্যানচেস্টার স্কুল অফ টেকনোলজিতে অধ্যয়ন করেন। বলাই বাহুল্য যে, তিনি লন্ডনের স্কুল অফ ফটো-এনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফিতে ইংল্যান্ডে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, এবং ভারতে ফটোগ্রাফি এবং লিথোগ্রাফির অগ্রদূত ছিলেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা নিয়ে লেক্চারও দিয়েছিলেন।  সুকুমার চিত্রকর হিসেবে বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। একজন প্রযুক্তিবিদ হিসাবে, তিনি হাফটোন ব্লকমেকিংয়ের নতুন পদ্ধতিও তৈরি করেছিলেন এবং এই বিষয়ে প্রযুক্তিগত নিবন্ধগুলি ইংল্যান্ডের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। পেনরোজ অ্যানুয়াল সুকুমার রায়ের দুটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। ইউনাইটেড কিংডমে থাকাকালীন, তিনি 1912 সালে রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটিতে যোগদান করেন এবং 1922 সালে সেখান থেকে ফেলোশিপ লাভ করে আমৃত্যু তার সদস্য ছিলেন।


1912 সালে সুকুমার সেখানে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে যান। সুকুমার এমনিতেই  রবীন্দ্রনাথের অন্ধ ভক্ত ছিলেন, সঙ্গে পিতা উপেন্দ্রকিশোরের কাছের বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের লণ্ডনে আসা তাঁকে আরো উদ্বুদ্ধ করে।  সুকুমার রায়ের রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা নিয়ে লণ্ডনে দেওয়া লেকচারগুলো সেখানে আলাদা মাত্রা তৈরী করে।রবীন্দ্রনাথের কাজ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মানুষরা জানলেন, শুনলেন। তাঁর প্রেম ও ঈশ্বরচিন্তা যখন উপলব্ধি করলেন ইংরেজরা, তখন তাঁদের মুগ্ধতার শেষ রইলো না। কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যে বাংলার তো আর আলাদা করে তো কোন স্থান নেই তাই জন্য নোবেল পেতে প্রয়োজন হয়ে পড়ল গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার৷

যেহেতু ইংরেজিতে অনুদিত কাব্যগ্রন্থটি একদম ইংরেজদের পড়ার জন্য তৈরি করা হবে সেহেতু বাংলা গীতাঞ্জলির সমস্ত কবিতা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ইংরেজি ট্রান্সলেশন এ রাখলেন না ৷ বাছাই করা কিছু শ্রেষ্ঠ কবিতা অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ থেকে গ্রহণ করা হলো নতুন ইংরেজী গীতাঞ্জলির জন্য ৷ মূল বাংলা গীতাঞ্জলি-র সঙ্গে ইংরেজী  গীতাঞ্জলির অনেকটাই ফারাক।  এটিতে মূল বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে 53টি কবিতার অনুবাদ রয়েছে, সেইসাথে 50টি কবিতা যা তাঁর নাটক অচলায়তন থেকে এবং আটটি কবিতার বই - প্রধানত গীতিমাল্য (17টি কবিতা), নৈবেদ্য (15টি কবিতা) এবং খেয়া (11টি কবিতা)।


রবীন্দ্রনাথ যে খুব ভাল ইংরেজি লিখতে পারতেন তা নয় ৷ সেক্ষেত্রে তাঁর বাংলা কবিতা গুলির ইংরেজি তর্জমা করার জন্য, সেন্স আর গভীর গূঢ় অর্থকে ট্রান্সলেশনে ধরে রাখার জন্য দু-এক জন বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ মানুষদের সহায়তা নিতেই হল । তাঁদের মধ্যে কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস একজন ৷ ইংরেজী গীতাঞ্জলির মুখবন্ধ ইয়েটস এর-ই লেখা।

সাহিত্য-কীর্তিতে নন-ইউরোপীয়ান প্রথম প্রবাদ পুরুষ হিসেবে নোবেল পাওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৷ কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ-কে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিজের নয়। ঠিক যেমন করে স্বামী বিবেকানন্দ একসময় হিন্দু ধর্মকে একটি ফিলোজফি-মাত্র রূপে শিকাগোর ধর্ম মহাসভার মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে হিন্দু ধর্মের স্থান করে দেন, ঠিক সে রকম ভাবেই যদি বাংলা সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথের কাজের আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে প্রথম যদি কেউ পৌঁছে দিয়ে থাকেন, তিনি হলেন সুকুমার রায় ৷

গত 13ই অক্টোবর, 2023-শে  রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার ১১০ বছর কাটলো ৷  সেই প্রসঙ্গে তাঁর এই নোবেল প্রাপ্তির কৃতিত্বের কোনো ভাগই কি সুকুমার রায়ের উপর বর্তায় না? নাকি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্স থাকার জন্য তিনি কোনোদিনই সাহিত্যক্ষেত্রে কল্কে পাবেন না,  একজন শুধু ননসেন্স কমেডিয়ান হয়ে ই থেকে যাবেন! 


Friday, 27 October 2023

দুদ্ধর্ষ দুবাই: নবম পর্ব

২৮ শে অগাস্ট, ২০২৩ - সেই যে '(চলবে)' বলে লিখে ফেটে গিয়েছিলাম (না ভুল টাইপিং নয়, ঠিকই পড়েছেন আর আমিও ঠিকই লিখেছি কারণ এটাই 'কেটে পড়া' র আধুনিক চলতি বাংলা) তারপর পুরো 'তোমার দেখা নাই রে/তোমার দেখা নাই' ৷ আসলে পুজোর বাজারে অপ্সরার নিজের হাতে চমরী গাইয়ের দুধ দিয়ে রান্না করা ব্রহ্মকমলের রেণুর পায়েসের সে-ই স্বপ্নের রেশ কাটতে মাস দুয়েক লেগে গেল। ইতিমধ্যে ঘটনার ঘনঘটায় সে স্বপ্নের ব্যাঘাত ঘটেছে বটে, কিন্তু আবার সেই স্বপ্নে ফিরে যাওয়া যাচ্ছিল ৷ আজ সে স্বপ্নের অবসান ঘটল। 


যাই হোক তার পরে যা ঘটেছিল দুবাই-এর মাটিতে, তা ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্ন নয় - বাস্তবে দেখা।  কিন্তু এক্কেবারে স্বপ্নের মত। 

অরিন্দমের অফিসে ছুটি চলছিল পবিত্র ঈদ উপলক্ষ্যে ৷ সেই উপলক্ষ্য কে লক্ষ্য করে চৈতালী - অরিন্দম প্ল্যান করেছিল যে বড়সড় সময় ধরে যা কিছু দেখার তা ওর ছুটির মধ্যে শেষ করতে হবে। না হলে ওদের গাড়ি পাওয়া যাবে না। ওখানে তো আর আমি ড্রাইভ করতে পারব না। আর ভাড়ার গাড়ির যা রেট তা আকাশচুম্বী। 

বড়সড় বলতে যা দেখার ছিল তা হল দুবাই গ্র্যান্ড মস্ক আর দুবাই প্যালেস ৷ দুটোই টিকিট কেটে দেখতে হয়। অনলাইনে বুক করা যায় ৷ কিন্তু সমস্যা হল, আগে গ্র্যান্ড মস্ক দেখে তারপর প্যালেসে যাওয়ার টাইমলাইন মেলানো ৷ প্যালেসে প্রবেশের শেষ সময় ওখানকার লোকাল টাইমে সাড়ে চারটে ৷ মস্ক থেকে প্যালেস পৌঁছাতে তো খানিকটা সময় লাগবেই ৷ কিন্তু এই দুটো আলাদা দু'দিনে করলে অন্য প্ল্যান চৌপাট! ঠিক হল আমরা বাড়িতে ব্রাঞ্চ (এর মানে আশা করি এখন সবাই জানে) সেরে তাড়াতাড়ি বেরোবো। দুগ্গা দুগ্গা বলে দুটো টিকিটই কেটে ফেলা হল, একই দিনে। 


চিকেনের দক্ষিণ-ভারতীয় ঝোল-ভাত খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। পৌঁছালাম গ্র্যান্ড মস্ক-এ।  সেখানে পৌঁছেই আমরা প্রবেশ করার পথে অনেকটা ঘুরে যখন মেইন এন্ট্রান্সে পৌঁছালাম সেখানে স্বভাবতই বেশ কড়া চেকিং। আমাদের বেল্ট-ঘড়ি-পার্স ইত্যাদি সমস্ত কিছুই ঠিক যেরকম ভাবে এয়ারপোর্টে চেক করা হয় সেরকম ভাবে চেক করা হল। তারপর হঠাৎ দেখা গেল যে ইন্দ্রানীকে আটকে দেওয়া হয়েছে।  তার কারণ কি, না ওখানে ঢোকার যে ড্রেস কোড তা ইন্দ্রানী ফলো করেনি -- চিকনের যে সালোয়ার কামিজ পরে এসেছিল সেটা নাকি সেমি-ট্রান্সপারেন্ট এবং তার হাতাটা  নাকি ছোট (থ্রি-কোয়ার্টার ছিল, ওদের নিয়মানুসারে সেটা ফুল স্লিভস হতে হবে) ফলে একটি গোটা আবায়া, যাকে আমরা বোরখা বলি তাই কিনে পরে ইন্দ্রানীকে  ঢুকতে হবে। কোথায় পাব দোকান!! জানা গেল বাইরেই নাকি পাওয়া যায়। চৈতালি-ইন্দ্রানী দৌড় লাগালো ।এমনিতেই সেদিন সময়ের অভাব তারপর আবার এইসব! আমরা মিনিট দশেক অপেক্ষা করলাম তারপর ইন্দ্রানী একটি বোরখা পরিহিত অবস্থায় আমাদের সামনে উপস্থিত হল। ছোটু-বুম দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল। ইন্দ্রানীর নামকরণ হল 'যাদু'। অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত গ্র্যান্ড মস্কে আমরা প্রবেশ করলাম ।


প্রবেশ করার সাথে সাথে যে দৃশ্য আমরা দেখলাম তা সত্যি নয়নাভিরাম এবং অদৃষ্টপূর্ব। এরকম আগে কোনদিন দেখিনি। একটা মসজিদ যে এত সুন্দর হতে পারে আমার কোন ধারণা ছিল না। প্রবেশ করার সাথে সাথে আমাদের সঙ্গে একজন গাইড দেওয়া হলো।  মহিলা। বয়স চব্বিশ পঁচিশের বেশি নয়। তাঁর সাথে আমরা ঘুরতে থাকলাম। যেখানে সেখানে দাঁড়াতে থাকলাম আর উপভোগ করতে থাকলাম দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর, যার পরতে পরতে শুধু স্বপ্ন। এ দৃশ্য ভাষায় ব্যক্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কয়েকটি ছবি রাখলাম। কিন্তু এই ছবি যেহেতু একটি ফ্রেমে বন্দী অবস্থায় রয়েছে তা থেকে এই স্থানটির সামগ্রিক বিশালত্ব ও মাহাত্ম্ বোঝা অসম্ভব। ঘুরতে ঘুরতে যখন একেবারে মসজিদের অভ্যন্তরের কেন্দ্রে,মানে গর্ভগৃহে, পৌঁছালাম, জানলাম যে পুরো মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে মোট ১৯৯৮ টি পিলারের ওপরে আর যে মেঝেতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেটা পৃথিবীর বৃহত্তম সিঙ্গেল-পিস কার্পেট। আর মাথার ওপরে ঝুলছে এক বিশাল ঝাড়্লন্ঠন। ভেবে পাচ্ছিলাম না যে মাথার উপরের দিকে দেখব না পায়ের দিকে।


এখানে উল্লেখ্য যে, যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আমরা এই অংশটিতে পৌঁছেছি এখানে সবাই পৌঁছাতে পারে না। শুধুমাত্র যাঁরা গাইড পান তাঁরাই এই অংশটিতে প্রবেশ করতে পারেন। কোন গাইড ছাড়া এই অংশে প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধু বাইরে থেকে দেখে চলে যেতে হয়। যাই হোক, আমরা গাইডের মুখে শুনছিলাম মস্ক সম্পর্কে নানান তথ্য। আর প্রতি পদে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমাদের সাথে ছিলেন এক গ্রীক ভদ্রলোক। তিনি এই স্থানটির টানে তৃতীয়বার এখানে এসেছেন। ১৯৯৮ সালে এই গ্র্যান্ড মস্কের উদ্বোধন হয় -- এইটা জানার পর ওই গ্রীক ভদ্রলোক একটি সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছিলেন যে ১৯৯৮ সাল এবং ১৯৯৮ টি স্তম্ভ কি কোনোভাবে সিম্বলিক্যালি কানেকটেড কি না! গাইড মেয়েটির কাছে এর কোন সদুত্তর ছিল না। তবে তিনি অপ্রতিরোধ্য। তাঁকে যখনই কিছু প্রশ্ন করা হয় মিষ্টি করে বলেন "দ্যাত ইজ এ গুড কোয়েশ্চেন!" এবং সর্বান্ত:করণে চেষ্টা করেন যাতে প্রশ্নকর্তাকে উত্তর দিয়ে তুষ্ট করা যায়। এক্ষেত্রেও তাই-ই ঘটলো। তুষ্ট করার চেষ্টা করলেন বটে। কিন্তু আমরা কেউই সন্তুষ্ট হলাম না।

গ্র্যান্ড মস্কের গ্র্যান্ড কার্পেটের উপর দাঁড়িয়ে গ্র্যান্ড ঝাড়বাতি -- তার ছবি যখন তুলছি ততক্ষণে অরিন্দম তাড়া লাগাতে শুরু করেছে 

-- চল চল না হলে ওদিকে মিস হয়ে যাবে। 

আমি যেই বেরোতে যাচ্ছি দেখি ও নিজেই দু-পা পিছিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে আবার ছবি তুলতে আরম্ভ করছে। আমাদের কারোরই ওখান থেকে যাবার কিছুমাত্র ইচ্ছে নেই, তখন। কিন্তু যেতেই হবে। তাও মন মানছে না।  সুবিধার যেটা হলো সেটা হলো আমাদের সাথে যে গাইড মেয়েটি ছিলেন তিনি হঠাৎ বললেন যে তাঁর একটু তাড়া আছে। আমরা যেন একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে তাঁর সাথেই বেরিয়ে আসি। এই কথাটা বেশ কাজ দিল। আমরা তাঁর পিছনে পিছনে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু ছবি তোলার কোন বিরাম নেই। ওই হাঁটতে হাঁটতেই তুলতে থাকলাম।  কারণ এ তো একটা লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স! যতটা লেন্স বন্দি করে রাখা যায়, আর কি।  কারণ সময়ের নিরিখে একদিন আসবে যখন আরও অনেক দৃশ্য এই দৃশ্যকে ঝাপসা করে দেবে। তখন যখন এই অ্যালবাম খুলবো আবার ঝাপসা হওয়া দৃশ্য মনের আঙ্গিনায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে।


কোন রকমে জুতো পরে সবাই পড়ি-মরি করে দৌড়ালাম গাড়ির দিকে।  ঘড়ির কাঁটায় চারটে বাজতে দশ। গ্র্যান্ড মস্ক থেকে পৌঁছাতে হবে প্যালেসে। সময় লাগবে কুড়ি মিনিট তারপর গাড়ি পার্কিং করে হেঁটে পৌঁছাতে হবে প্রবেশদ্বারে। আমাদের কাছে কোন আইডিয়া নেই যে গাড়ির পার্কিং থেকে প্রবেশদ্বার কতটা।  এখানে অনেক জায়গা আছে যেখানে পার্কিং থেকে লক্ষ্য স্থলে পৌঁছাতে হলে দশ মিনিটও হাঁটতে হতে পারে।আমরা ধরে নিলাম দশ মিনিট হাঁটতে হবে। সেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে সবাই একটা মিলিটারি কায়দায় তৈরি থাকলাম। আর এর সাথে ভরসা রইল দুবাইয়ের রাস্তার প্রতি কারণ এখানে কোন ট্রাফিক জ্যাম এখনো পর্যন্ত দেখিনি আর গাড়ির স্পিড লিমিট আশির নিচে তো নয়ই!


রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে আমরা পৌছালাম গ্র্যান্ড প্যালেসের পার্কিং-এ। সেখানে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। প্রবেশদ্বার পার্কিং থেকে দেখা যাচ্ছে। বেশি দূর নয়। আর লোকজন তখনো প্রবেশ করছে। জানলাম ওটাই শেষ লট। তবে প্রবেশদ্বারে প্রবেশ করলেই যে প্যালেস পর্যন্ত পৌঁছানো যায় তা নয়। প্রবেশ দ্বার থেকে প্যালেসের দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। সুতরাং যাবতীয় চেকিং এর পরে আমরা একটি বাসে উঠলাম। সেটি আমাদের পৌঁছে দেবে প্যালেসের সদর দরজায়। এখানে বলে রাখা ভালো যে জিনিসপত্র চেকিং এর সময় যদি কারো কাছে কোন ফটোগ্রাফি স্ট্যান্ড থাকে তাহলে সিকিওরিটি স্টাফরা সেটা নিয়ে নেবেন।ফিরত যাবার সময় সেটা আবার রিসেপশন থেকে কালেক্ট করে নিতে হবে। কোনো রকম ফটোগ্রাফি স্ট্যান্ড নিয়ে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। কেন তা বুঝতে পারলাম না ৷ আমার ব্যাগে অরিন্দমের গো প্রো ক্যামেরাটা ছিল সেটা অবশ্য স্ট্যান্ডের সাথেই লাগানো ছিল। সেটা কিন্তু নিল না ৷

প্যালেস জীবনে অনেক দেখেছি। তবে এরকমটা দেখিনি। আবার যেন একটা স্বপ্নের স্বর্গ রাজ্য! কি করে তৈরি করেছে কে জানে!!!!! আবার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। প্যালেসটা ঠিক কি রকম তা ভাষায় অবর্ণনীয়৷ তবে অরিন্দমের ভাবনা থেকে খানিকটা ধারনা করা যেতে পারে : মহাভারতে ময় দানবের হাতে তৈরী পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থ৷ এবার বোধহয় খানিকটা বোঝাতে পেরেছি ৷ 

প্যালেসের সেন্ট্রাল জায়গাটাতে এসে যখন দাঁড়ালাম, নিজেকে একটা  পিঁপড়ে মনে হচ্ছিল।  তারপর আমরা হানা দিলাম প্যালেসের আনাচে কানাচে। সেখানকার মিউজিয়াম, সেখানকার লাইব্রেরী, সেখানকার কনফারেন্স হল, সেখানকার ডাইনিং হল, আরো অনেক কিছু। বাসে করে আসার সময় ভয়েস ওভারে আমরা প্যালেস সম্পর্কে যে ব্রিফটা পেয়েছিলাম,  তা অনুযায়ী এটাই দুবাইয়ের ওয়ার্কিং প্যালেস। এখানেই রাজারাজড়ারা যাবতীয় মিটিং কনফারেন্স ইত্যাদি করে থাকেন । এটা শুধু দেখার জায়গা নয় কাজেরও জায়গা। কাজের জায়গা কারো যে এরকম হতে পারে এই সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না।


আমরা সেখানে যা ঘুরলাম তাতে সময় শেষ হয়ে গেল। সিকিউরিটি এসে বলল, 

-- এবার আপনাদের বেরোতে হবে। 

ঠিক সেই সময় আমি দাঁড়িয়ে একটি বাদ্যযন্ত্র যার নাম রবাব, তা দেখছিলাম ৷ রবাব যন্ত্রটি যে কি, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল এবং শব্দটি প্রথম শুনেছিলাম ছোটবেলায় কাজী নজরুলের একটি গানে। 

এই প্রথম চাক্ষুষ হলো, তাও একদম সত্যিকারের আরবি যন্ত্র। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। সেই সময় চটক ভাঙলো সিকিউরিটির ডাকে,

-ই য়োর টাইম ইজ আপ! প্লিজ্....

আমরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে এলাম।  বাইরে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার আর ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমরা একটা করে রোল খেলাম।  

না এখনই শেষ নয়। এর পরে আছে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না ব্যাপারটাতে -- কি আর হবে, নানা রকম রঙিন লাইট জ্বলবে আর তার পিছনে থাকবে একটা ভয়েস ওভার। এর বেশি আর কি!!!!

সবাই হেঁটে গিয়ে একটা গ্যালারিতে বসলাম একদম পিছনের দিকে ৷ যেরকম যাই হোক না কেন ছবি তো তুলতে হবে। গো প্রোটাকে স্ট্যান্ডের ওপর সেট করে রাখলাম যাতে পুরোটা ধরা যায়। ভাবছিলাম কেউ না এসে কিছু বলে। তা দেখলাম বিশেষ কেউ কিছু গা করল না। শুরু হলো লাইট এন্ড সাউন্ড শো।


যা হলো তা অবিশ্বাস্য ৷  লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো যে এরকম হতে পারে আমার ধারণার বাইরে ছিল। পুরো প্যালেস টা হয়ে গেল একটা জায়ান্ট স্ক্রিন। তার ওপর পড়তে লাগলো আলো, তার উপর খেলতে লাগলো ঢেউ। প্রতিফলিত হতে লাগলো কিভাবে দুবাই শহর গড়ে উঠেছে, কিভাবে সেই প্যালেসের প্ল্যান করা হয়েছে, তার ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং থেকে আরম্ভ করে তার সামগ্রিক রূপ পাওয়া পর্যন্ত ইতিহাসের বর্ণনা তুলে ধরা হলো সেই লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো-তে। আর যে ভাবে তুলে ধরা হল, তা অকল্পনীয়। আমরা মুগ্ধ্।


মুগ্ধতাকে বেশি টানতে নেই। তাতে মুগ্ধতার গভীরতা নষ্ট হয়। তাই ১৫ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে গেল লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। আর মনের মধ্যে এখনো গেঁথে আছে সেই দৃশ্য যেখানে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দিয়ে একটা গোটা প্যালেসের গায়ে তার প্রত্যেকটা অংশকে যেভাবে ভার্চুয়ালি ডিস্ম্যান্টেল করে আবার সেখানে সেটাকে সেগুলোকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। মনে পড়ে যায়, নজরুলের লেখা সে ই লাইন:

"খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে/ বিরাট শিশু, আনমনে"

সাথে রবীন্দ্রনাথ,

"বিস্ময়ে, তাই জাগে, জাগে আমার প্রাণ..." 

এবার বাসে উঠে ফিরে যাওয়ার পালা লাইনে দাঁড়িয়ে যখন পিছন দিকে ঘুরে তাকালাম ৷ তখনো বিরাট সেই প্রাসাদের গায়ে খেলে চলেছে নীল সমুদ্রের ঢেউ...

একটা স্বপ্ন আর একটা স্বপ্নের বদলে...

যদি এটা ঘুম হয় তাহলে এই ঘুম যেন না ভাঙ্গে, এই ঘোর যেন না কাটে...

(চলবে)

Link to Episode 8

Monday, 28 August 2023

দুদ্ধর্ষ দুবাই: অষ্টম পর্ব

আগের দিনের মরুভূমির স্মৃতি এতই প্রবল যে আমাদের পরের দিন সেই স্বপ্ন দেখতে দেখতে উঠতে বেশ দেরী হয়ে গেল। অরিন্দম চৈতালীদের রাধুনী রত্নাকর সেদিন চিকেনের যে দক্ষিণ ভারতীয় পদটি রান্না করেছিল, সে অতি উপাদেয়। আমরা পেট ভরে ব্রাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়লাম। 

দুবাই- এ আর কিছু থাকুক না থাকুক, শপিং মলের কোনো অভাব নেই। তার মধ্যে একটি মল বেশ অন্য রকমের। নাম হল 'ঈবন বতুতা' মল। 'ঈবন বতুতা' হলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রাক-আধুনিক যুগে পৃথিবীর বুকে সবথেকে বেশি দুরত্ব ভ্রমণ করেছিলেন। ঈবন বতুতার কথা সেই কবে ছোটবেলায় ইতিহাসের পাতায় পড়েছিলাম ৷ তারপর কোনোদিন কোনো প্রয়োজন বা আগ্রহ হয় নি পৃথিবীর চিরকালের এই সবচেয়ে বেশি ভ্রমণকারী গ্লোব ট্রটারের সম্পর্কে জানতে ৷ এই মলটির নাম ও থীমের সজ্জা মনের মধ্যে সেই ইচ্ছেকে জাগিয়ে তুলল ৷ 

এনার পুরো নাম হল, আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ঈবন বতুতা (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৩০৪– ১৩৬৪/৬৫)। তিনি ছিলেন একজন মাগরেবী  অভিযাত্রী এবং পণ্ডিত। ১৩২৫ থেকে ১৩৫৪ সাল পর্যন্ত ত্রিশ বছরের সময়কালে ঈবন বতুতা উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন, আইবেরিয়ান উপদ্বীপ এবং পশ্চিম আফ্রিকা সফর করেন। তার জীবনের শেষের দিকে, তিনি তার ভ্রমণের একটি বিবরণও লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল "A Gift to People Who Contemplate the Wonders of Cities and the Marvels of Travelling"। কিন্তু সাধারণভাবে এটি "The Rihla" নামে পরিচিত। আচ্ছ কেন বলুন তো, ঈবন বতুতা প্রাক-আধুনিক ইতিহাসে চিরকালের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ অভিযাত্রীর স্থান পেয়েছেন? কারণ - যে কোনো অভিযাত্রীর চেয়ে তিনি বেশি ভ্রমণ করেছেন, সর্বসাকুল্যে মোট প্রায় ১১৭,০০০ কিমি (৭৩,০০০মাইল)। মানে, তিনি ঝেং হে-র প্রায় ৫০,০০০ কিমি (৩১০০০ মাইল) এবং মার্কো পোলোর ২৪০০০ কিমি (১৫০০০ মাইল) ভ্রমণ  ছাড়িয়ে গেছেন।
 

এরকম আবহে যখন একটা শপিং মল তৈরী হয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে যে এটা একটা থিম মল। তাই মলটি ছয়টি অংশ নিয়ে গঠিত, যার প্রতিটি ডিজাইন ইবন বতুতা দ্বারা পরিদর্শন করা কিছু দেশ থেকে অনুপ্রাণিত। এগুলোকে এক একটা কোর্ট বলা হয়ঃ
আন্দালুসিয়া কোর্ট, 
চায়না কোর্ট, 
মিশর কোর্ট,
ইন্ডিয়া কোর্ট, 
পারস্য কোর্ট 
এবং 
তিউনিসিয়া কোর্ট।
আর সব ক'টা কোর্ট ওই একবেলায় ঘুরতে গিয়ে আমাদের দশাও ওই ঈবন বতুতার মত। তা যাই হোক, আমাদের ওখানে সেরকম কিছু করার ছিল না। ঘুরে ঘুরেই কেটে গেল। সময় কাটানোর উদ্দেশ্য একটাই -- সন্ধ্যে ছ'টা বাজিয়ে দেওয়া কারণ সেদিনের আইটিনারারী (কথাটা 'আইটেনারী' নয়)তে অরিন্দম-চৈতালী ঠিক করেছিল যে Dhow Cruise-এ যাওয়া হবে। Dhow Cruise মানে পাতি বাংলায় নৌকা ভ্রমণ৷ দুবাই মারিনা মলের গায়ে যে ক্রিকটা আছে তার পাশ থেকে Dhow Cruise এর যাত্রা শুরু হয়। ওদের ভাষায় 'ঢাও' মানে হল 'পাল তোলা নৌকা'। কিন্তু যুগের সঙ্গে সঙ্গে সে নৌকা ভ্রমণের ধরণও বদলে গেছে৷ এখন যে সব নৌকায় চড়ে  Cruise-এ যাওয়া হয় সে সব এলাহী কান্ড, প্রলাহী ব্যাপার ৷ 

টাইম কিল করার জন্য যখন আমরা ঈবন বতুতা মলে ঘুরছিলাম তখন চোখে পড়ল একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান ৷ আমার আর বুমের জামাকাপড় ইত্যাদি প্রভৃতি -- মানে একটা শপিং মলে সাধারণতঃ যা সব পাওয়া যায় -- সে সবে খুব যে কোনো আগ্রহ আছে তা নয় ৷ ফলে এই দোকানটিতে আমরা ঠেক মারলাম। বুম দিব্বি একটা গিটার নিয়ে বসে পড়ল ৷ 
সেখানে যা লেভেলের কালেকশন তাতে চোখ জুড়িয়ে যায় ৷ মন ভরে যায়। কিন্তু সে সব কেনা আমাদের নাগালের বাইরে ৷ বুম প্রাণ ভরে গীটার বাজিয়ে আশ মিটিয়ে নিল ৷ তারপর আমাকে ডেকে বলল একটা গান গাইতে৷ আমিও লোভ সামলাতে না পেরে রুপম ইসলামের গান ধরলাম। গান শেষ হলে চক্ষুলজ্জার খাতিরে বুম ওর ইলেকট্রিক গীটারের জন্য এক সেট স্ট্রিং কিনল। বেরোনোর সময়ে চোখে পড়ল Guns n' Roses এর Slash এর Gibson Lespol গীটার। 

ঐ আপাত নিরীহ যন্ত্রটা ওই ব্যক্তিটির হাতে প‌ড়্লে কি হয় তা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, November Rain এর ভিডিও-র মরুভূমির মাঝ্খানে চার্চের পাশের সেই দৃশ্য। আমি আর বুম আলোচনা করতে করতে সেই স্যুক (Souk) বা দোকান থেকে বেরোলাম। গল্প করতে করতে আমরা একটা ব্যাটম্যান পার্ক এর সামনে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে ব্যাটম্যানের নানান কস্টিউমস রাখা যা পরে শিশু কিশোরদের স্বপ্নকে বেশ খুঁচিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সে সবই ভাড়ায় ৷ ক্রয়যোগ্য নয়। সেখান থেকে একটু এগোতেই পড়লাম এক তুখোড় পারফিউম সেলসম্যানের খপ্পরে ৷ আমাদের তিনি আরবের বিখ্যাত  সুগন্ধী বিক্রি করেই ছাড়বেন। ইংরেজি ভাল জানেন না। ভাঙা হিন্দিতেই যে ভাবে অত্যন্ত ভদ্র ও মার্জিত ভাবে আমাদের চেপে ধরলেন তাতে আমাদের যঃ পলায়তি সঃ জীবতি অবস্থা ৷ অনেক কষ্টে তাঁর খপ্পর থেকে বেঁচে আমরা সবাই চললাম দুবাই মারিনা মলের উদ্দেশ্যে ৷ 

দুবাই এর হাই প্রোফাইল মলগুলোর মধ্যে মারিনা মল অন্যতম। আধুনিক স্থাপত্য ও প্রযুক্তির উন্নতির এক একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ওখান্কার প্রত্যেকটি শপিং মল ৷ এর সাথে রয়েছে ওখানকার মানুষের সিভিক সেন্স ও পরিচ্ছন্নতা ৷ লক্ষ্যনীয় এই যে আপামর জনসাধারণ উচ্চশিক্ষিত না হয়েও কিভাবে যৌথ সামাজিক জীবনের প্রাথমিক রীতিনীতিগুলো সর্বান্তঃকরণে মেনে চলে৷ আইন প্রনয়ণ করে, তা চাপিয়ে দিয়ে জন জীবনের শৃঙ্খলা আনা যায় না। ওটা সমাজ আর পরিবেশ ছেলেবেলা থেকে তৈরী করে দেয় ৷ তাই যেখানে সেখানে থুতু ফেলা, খাবার খেয়ে প্যাকেট ফেলে দেওয়া, গাড়ির জানলা দিয়ে ঝড়তি পড়তি জিনিস ফেলতে ফেলতে যাওয়া, রাস্তার ধারে যেখানে জায়গা পেলে নেমে একটু ছোটবাইরে করে ফেলা - এসব নেই। সত্যিই, দেখে শুনে  মনের মধ্যে অনেকবার কথাটা এসেছে - গনতন্ত্রের চেয়ে বরং রাজতন্ত্রই ভাল ৷

নাঃ আলোচনার মোড় ঘুরে যাচ্ছে। মারিনা মলে ফিরে যাই। মারিনা মলের গায়ে যে ক্রিক টা আছে তার দুপাশেই অসাধারণ ব্যান্ড স্ট্যাণ্ড ৷ বসে সময় কাটানোর অঢেল জায়গা ৷ আর টলটলে কালো জলের ওপর ভেসে রয়েছে অসংখ্য ঢাও, মানে অত্যাধুনিক ছোট জাহাজ এবং ইয়ট। আমরা মারিনা মলে ছবি টবি তুলে হাঁটতে থাকলাম মারিনা ওয়্ক-ওয়ে ধরে, খুঁজে বের করতে হবে যে আমরা যে Dhow Cruise এ যাব, তার জন্য নির্ধারিত জাহাজ কোনটি ! তার আগে বলে রাখি যে দুবাই মারিনা ব্যাপারটা আসলে কি: দুবাই মেরিনা (আরবি ভাষায়, মার্সা দুবাই) হল সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর দুবাইয়ের একটি জেলা। এটি একটি কৃত্রিম খাল-শহর যা পারস্য উপসাগরের উপকূলরেখার তিন কিলোমিটার (দু’ মাইল) বরাবর নির্মিত। ২০১৮ সালের হিসাবে, এর জনসংখ্যা ৫৫,০৩২ জন। উন্নয়ন সম্পূর্ণ হলে আবাসিক টাওয়ার এবং ভিলা মিলিয়ে মোট ১২০,০০০ জনেরও বেশি লোকের বাসযোগ্য হবে এই অঞ্চলটা। এটি ইন্টারচেঞ্জ ৫-এ, মানে, জেবেল আলী বন্দর এবং দুবাই ইন্টারনেট সিটি, দুবাই মিডিয়া সিটি এবং দুবাইয়ের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ঘেরা এলাকার মধ্যে অবস্থিত। 

এ প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ শেষ হয়েছে। দুবাই মেরিনা আসলে ভ্যাঙ্কুভার, বিসি, কানাডার ফলস ক্রিক বরাবর কনকর্ড প্যাসিফিক প্লেস -- এসব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।  কিন্তু দুবাই মারিনার কাজ শেষ হলে ওটাই পৃথিবীর বৃহত্তম মারিনায় পরিণত হবে। মনুষ্য-নির্মিত মেরিনা তৈরি করার জন্য ডেভেলপাররা পারস্য উপসাগরের জল দুবাই মেরিনার সাইটে নিয়ে আসে; একটি নতুন ওয়াটারফ্রন্ট তৈরি করে। আশ্চর্যজনক ভাবে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই কেন্দ্রীয় জলপথের পুরোটাই মরুভূমি থেকে খনন করা। সাইটের মোট জমির ১২%  এরও বেশি কেন্দ্রীয় পাবলিক স্পেসে দেওয়া হয়েছে। যদিও এই এলাকার বেশিরভাগ অংশ মেরিনা জলভূমি, তবে এটিতে প্রায় আট কিমি ল্যান্ডস্কেপ ও পাবলিক ওয়াকওয়েও রয়েছে। অবাক হতে হয় যে, মেরিনা সম্পূর্ণরূপে মনুষ্যসৃষ্ট এবং সংযুক্ত আরব আমীরশাহীতে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট ফার্ম Emaar Properties দ্বারা তৈরি এবং এটির ডিজাইন করেছে HOK  কানাডা। সমাপ্তির পরে, এটি বিশ্বের বৃহত্তম মানবসৃষ্ট মেরিনা বলে দাবি করা হয়। এর আগে বিশ্বের বৃহত্তম মানবসৃষ্ট মেরিনা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মেরিনা দেল রে। আর সবথেকে মজার ব্যাপার হল, খোলা সমুদ্রের কাছাকাছি থাকার কারণে সামুদ্রিক বন্যপ্রাণী (বিশেষ করে তিমি এবং হাঙ্গর) মেরিনায় প্রবেশের অনেক ঘটনা ঘটেছে।

(তথ্য ঋণ: চৈতালী-অরিন্দম ও উইকিপিডিয়া)
 
Dhow Cruise যাওয়ার জন্য মারিনা ধরে হাঁটতে হাঁটতে শেষে আমাদের জন্য নির্ধারিত একটি স্কার্লেট রেড বিশাল নৌকা খুঁজে পাওয়া গেল। ই-পাশ স্ক্যান করে আমরা ছ'জনে ঢুকলাম নৌকার পেটের মধ্যে। এ নৌকা তো আর নৌকা নয় - ছোটখাটো একটা জাহাজ বলা চলে। প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই বিশাল ডাইনিং হল৷ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত৷ আর তার ছাদে ওপেন ডাইনিং স্পেস। আমরা নিচেই বসলাম৷ এখানেও ডিনার সহযোগে গান-বাদ্যি আর পারস্য উপসাগর ছুঁয়ে আবার ফিরৎ আসা৷ মোটামুটি আড়াই থেকে তিন ঘন্টার ব্যাপার৷ আমরা নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই ঢুকেছিলাম কারণ সিট এর কোনো অ্যালোকেশন নেই। যে আগে আসবে সে আগে পাবে - এই ভিত্তিতে৷ মাঝামাঝি দুটো বিশাল জানলার পাশে গিয়ে বসলাম সবাই ৷ 

আগের দিনের ডেজার্ট সাফারির মত আনলিমিটেড জল ও সফট ড্রিঙ্ক | হার্ড ড্রিঙ্ক ওপরের তলায় আর তার জন্য আলাদা করে পয়সা দিতে হয় ৷ আমরা নানা রকম জুস আর এরিয়েটেড ড্রিঙ্ক নিয়ে গল্প করতে করতে জানলা দিয়ে দেখি আমাদের ঢাও পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানমেড ক্রিক ছাড়িয়ে  মূল সমুদ্রে এসে পড়েছে।

ততক্ষণে বুফে টেবিলে খাবার সাজানো হয়ে গেছে। আমরা এরকম শুভকাজে বিলম্বে দেরী না করে সোজা খাওয়া দাওয়া শুরু করলাম ৷ হতে পারে এর আগের দিনও ডেজার্ট ক্যাম্পে বুফে ডিনারই ছিল বটে, তবে মেনু কিন্তু একেবারেই আলাদা ৷ 

এখানে অনেক রকমের সালাড, কন্টিনেন্টাল, চাইনিজ্, আরবী খাবারের সঙ্গে বিরিয়ানীও ছিল। আর মিষ্টিমুখেও নানান পদ আর সবশেষে, ফল ৷ মিষ্টিমুখের আগে মেইন কোর্স প্রায় শেষের দিকে যখন, খবর পেলাম ওপরের তলায় বেলি ডান্স শুরু হয়েছে ৷ আমি ভিড় ঠেলে চক্রব্যুহের কেন্দ্রে দৃষ্টিপাত করে সুন্দরী নারীর নাচ যে দেখব, সে সুযোগ পেলাম না, এত ভীড়্! ৷ 
ব্যর্থ মনোরথে আশপাশের ছবি তুললাম কিছু মোবাইলে | আলো যেখানে কম, সেখানে যে কোনো ক্যামেরা ফেল ৷ ছবি তুললাম বটে, কিন্তু ঠিক মনোমত হল না। শাহরুখের 'পাঠান' ছবিতে একটি দৃশ্যে জন আব্রাহাম যে বিল্ডিং এর মাঝখানে থাকা চৌকো ফাঁক দিয়ে হেলিকপ্টারে করে  গলে পালিয়েছিলেন - সেই বিল্ডিংএর ছবি তুললাম। 
আর এক দিকে দুবাই আই জায়ান্ট হুইলের গায়ে খেলা করছে রঙীন আলো৷ ফুটে উঠছে বিজ্ঞাপনের লেখা ৷ সন্ধের পর আলো জ্বললে সব শহরের মতই এই শহরের রূপও বদলে যায় ৷ অনেক সাজানো জোনাকি নিয়ে এক অপূর্ব স্কাইলাইন দেখলাম ৷ 
Dhow টি তখন পারস্য উপসাগরের তীর বরাবর বড় বড় ঢেউয়ের দোলায় এমনই দুলছিল যে মাঝেমধ্যেই দাঁড়ানোর ব্যালেন্স হারিয়ে যাচ্ছিল। ওপরের তলায় এমনিতেই ততক্ষণে অনেকেই ব্যালেন্স হারিয়ে নিজেদের মত করে বেলি ডান্সে ব্যস্ত ৷ আমরা নিচে নেমে এলাম। সবে প্লেট ভর্তি করে খাবার এনে মিষ্টিমুখের সুখ অনুভব করতে যাব, আমাদের এক্কেবারে সামনেই শুরু হল আগের দিনের মত এক যুবকের whirlpool ডান্স আর তারপর এক যুবতীর বেলি ডান্স | সেদিন যাঁরা নাচলেন তাঁরা গত দিনের থেকে আরও বেশি পারদর্শী, বিশেষ করে বেলি ডান্সার মহিলা ৷ এখানে না বলে পারছি না যে, If this is an art-form of seduction, from the perspectives of Arabic ethnicity and traditional culture, I must say, she has mastered it. 

সেদিন রাতে স্বপ্ন দেখলাম: আমি দেবরাজ ইন্দ্র, সামনে লাস্যময়ী অপ্সরার নৃত্য, আর স্বর্ণপাত্রে আমার সেবনের জন্য রাখা আছে চমরী গাই এর দুধে রান্না করা ব্রহ্মকমলের রেণুর পায়েস ...! 



(চলবে)



   

Monday, 7 August 2023

দুদ্ধর্ষ দুবাই: সপ্তম পর্ব

Dune Bashing শেষ ৷ পড়ন্ত সূর্যের সাথে সাথে মরুভূমির মাঝখান দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটছে। বেশি গতি তোলা সম্ভব নয়। ঢাকার হাওয়া সেই যে ১৮তে নামানো হয়েছে তারপর তো ওরকম পাণ্ডববর্জিত খাণ্ডব মরুভূমিতে তাণ্ডব মাচানোর পর আর ভরার কোনো সুযোগ নেই। সেই ক্যাম্পে গিয়ে তারপর ৷ 

গাড়ি প্রায় সমতল মরুভূমি দিয়ে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগে ধাবিত হওয়া সত্ত্বেও ইন্দ্রানী পুরো চুপ। Dune Bashing এর মত দুদ্ধর্ষ অভিজ্ঞতার ফলেই বলে মনে হল। আমরা কথাবার্তা বলতে থাকলাম ৷ যেখান দিয়ে গাড়িটা যাচ্ছে সেটা গাড়ির ম্যাপে দেখলাম দিকশূন্যপুরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ৷ একেই বলে ম্যাপের বাইরে ৷ তবে অদ্ভূতভাবে বালির রং মাঝে মাঝেই কালো ৷ ড্রাইভার নৌফেল জানালেন যে এখানে পাঁচ রকমের বালি আছে, এটা তারমধ্যে অন্যতম৷ কালো বালির অর্থ হল ও গুলো কোনো না কোনো নদীগহ্বর বা river bed I বুঝলাম যে বালির সঙ্গে খানিকটা পলি মিশে আছে বলে ওরকম কালচে রঙ হয়েছে ৷ এখানকার বর্ষাকালে বেড়াতে এলে তখন কিন্তু আর এসব দেখাই হত না। কারণ বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে উঠলে এই সব স্থানে অনেক অনেক বহমান নদী। যদিও গভীরতা কম, তবে স্রোতস্বিনী ৷ আর সারা বর্ষাকাল ধরে এইসব অঞ্চলে আসাই নিষিদ্ধ ৷ বন্ধ থাকে Dune bashingl 

অর্থাৎ আসলে আমরা তখন মরুভূমির বুক চিরে নদীগর্ভের মধ্যে দিয়ে চলেছি তো চলেছি তো চলেছি ৷ শারজা থেকে দুবাই যাওয়ার এটাই শর্টকাট ৷ শারজা অঞ্চলের মরুভূমি থেকে দুবাই অঞ্চলের মরুভূমিতে প্রবেশ করলে বেশ বোঝা যায় ৷ শারজার বালির লালচে আভা আর থাকে না। ফিকে হলুদ হয়ে যায় ৷ 

গাড়িটা এসে দাঁড়ালো মরুভূমির মধ্যে একটা ঘেরা জায়গার সামনে। ঘেরা জায়গাটা একটা ক্যাম্প | আর তার বাইরে চলছে দুটো ব্যাপার --
এক, উটের পিঠে চড়া
দুই, স্যান্ড সার্ফিং

উট যে সোনার কেল্লার মত রাজস্থানের পোখরান বা রামদেওরাতে নিয়ে চলে যাবে এরকম নয় ৷ উটে ওঠার একটা অভিজ্ঞতা মাত্র ৷ সেই সামনের পা - পিছনের পা থিওরী। ওখানকার উটচালক তো আর সোনার কেল্লা দেখেন নি। তাই ভাঙা ভাঙা হিন্দি ভাষায় সওয়ারীদের সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছেন ৷ আমাদের দল থেকে প্রথম সওয়ারী হল বুম আর ছোটু ৷ তারপর আমি আর ইন্দ্রানী৷ মানুষ ছাড়া অন্য যে কোনো জ্যান্ত প্রাণীকে ছুঁতে বেশ ভয় পায় ইন্দ্রানী ৷ তবে লালমোহন বাবুর মত এই অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানিকে উপেক্ষা করতে পারল না। সমস্ত ভয় কাটিয়ে উটের পিঠে উঠল ৷ উঠেই কোলোর কীর্তি : দুদিকে পা ঝোলাতেই  উটের পেটের শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত ওঠানামা অনুভব করার পরেই দুপা দুদিকে স্ট্রেচ করে পুরো ফুল আউর কাঁটে -র অজয় দেবগণ ৷ ছোটু তো ইন্দ্রানীর মুখের দিকেই ক্যামেরা তাক করিয়ে রেখে দিল আর ইন্দ্রানীর হাবভাব দেখে বলেই ফেলল,

- তা বলে কি উট নিশ্বাস নেবে না!

তারপর সেই আইকনিক সিন- যেটা সত্যজিত রায় জীবদ্দশায় দেখলে হয়ত সন্তাষ দত্তের মৃত্যুর পর তৃতীয় ফেলুদাটা বানানোর কথা একবার হলেও ভাবতেন ! হয়ত সেটাই হত কোনো মহিলা চরিত্র সম্বলিত প্রথম ফেলুদা ৷ কিন্তু বড় দেরীতে ঘটল সে ঘটনা।

উট বাবাজি একপাক ঘুরে এসে সেফ ল্যান্ডিং দিয়েছে কি দেয় নি, ইন্দ্রানী টকাস করে নেমেই উটকে ঠকাস করে পেন্নাম ঠুকে দিল -  একেবারে অন্তর থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধা ও ভক্তি মিশ্রিত, Aldous Huxley র ভাষায় awe and veneration থেকে । 

সেই পেন্নামের জেরে video টা হেব্বি হিট৷ নিচে লিঙ্ক দেওয়া রইল৷ 


উটচালক ভদ্রলোক খুবই বেরসিক। তিনি হাসেন না। ছবি তোলার সময়ে হাসতে বলা হয়েছিল। তাতে তিনি সোনার কেল্লার মুকুলের মত বলেই ফেললেন তাঁর ভাঙা হিন্দীতে,

- হাসব কেন! আমার তো হাসি পাচ্ছে না।


এরপর ঘেরা ক্যাম্পের মধ্যে ঢুকে সবে বসব , দেখি পাশেই বাইরে বালির চূড়ার পর একটা বিরাট স্কেটবোর্ড হাতে বুম দাঁড়িয়ে ৷ স্কেটবার্ডে পা গলিয়ে sand surfing করতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একাক্কার কাণ্ড ৷ ধারণা ছিল যে ধূলোর মত মিহি বালির চূড়ায় উঠে স্কেটবোর্ড পায়ে পরে ঢালের দিকে দাঁড়ালেই সাঁ করে নেমে আসবে ৷ নেমে আসা তো দূর, অনেক লম্ফঝম্প করেও এক ইঞ্চি নড়াতে পারল না নিজেকে ৷ ও ছাড়া আরও যাঁরা চেষ্টা করছিলেন তারাও দেখলাম খানিকটা নেমেই হত্যে দিয়েছেন। অবশেষে স্কেটবোর্ড হাতে ছবিতে মারিতং জগৎ মার্কা ইনস্টা পোজ দিয়ে সেখান থেকে নেমে এসে ঘামে চুবচুবে হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-...... জঅঅল"
অরিন্দম বুম কিছু ঘটালেও ঘটাতে পারে এরকম আশায় কেজি তিনেকের ক্যামেরা অনেকক্ষন তাক করে ছিল। সে ও সব গুটিয়ে ব্যর্থ মনোরথে ক্যাম্প অভিমুখে যাত্রা করল।


ক্যাম্পে ওয়েলকামে ছিল একটা করে ভেজ র‍্যাপ আর সফট ড্রিঙ্ক। খাবার জল আর সফট ড্রিঙ্ক  যতক্ষণ থাকব - মানে সেই ডিনার অব্দি, আন্লিমিটেড। ক্ষিদে ভালই পেয়েছিল৷ আর তেষ্টার কথা বলাই বাহুল্য ৷ তারপর সে সব মিটিয়ে আমরা ক্যাম্পের মধ্যে থাকা বিভিন্ন স্টলে ঘুরতে লাগলাম। সেখানে আরবের একটা drink খেলাম৷ লোকাল হার্বল টি, নাম "Qawah" ( 'Q' এর উচ্চারণ 'ক' এবং 'গ' এর মাঝামাঝি),  সঙ্গে খেজুর ৷ তারপর গড়গড়া, বা Sheeshaa৷ পথের পাঁচালীর ট্রেনের মত কালো ধোঁয়ার বদলে ভসভসিয়ে সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দেখি ইন্দ্রানী হাতে বাজপাখি বসিয়ে ছবি তোলার জন্য ডাকছে। 

দিনরাতের সন্ধিক্ষণে তখন সূর্যের আলো আর ক্যাম্পের বাল্বের আলো মিলে মিশে একাকার | চাঁদটাও পলিউশন ফ্রি আকাশে স্বপ্নের মত ৷ 

আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত পাঁচ নম্বর ক্যাম্পে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পরে আমাদের সামনে বুম-ছোটুর বয়সী একটি ছেলে ফায়ার জাগলারী দেখাতে আরম্ভ করল। তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। আমরা মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলাম। আগুনের আলোর রেখার সম্মোহনে কখন যে চারদিক অন্ধকার হয়ে সন্ধে হয়ে গেছে বুঝতে পারি নি। জানানো হল যে ডিনার রেডি ৷


এলাহী ডিনার ৷ সেখানে সবথেকে লোভনীয় ছিল ভেড়ার পাঁজর - কাঠকয়লার আঁচে ঝলসানো ৷ এছাড়া অনবদ্য বীফ  ৷ বন্ধু প্রীতম পরে জানিয়েছিল যে এখানে বছর পনেরো আগে পঞ্চাশ দিরহাম -এর বিনিময়ে বার্বি কিউ করা বাছুরের জিভ পাওয়া যেত | নাকি, অনবদ্য স্বাদের। তবে আমরা সে জিনিস পাই নি। আর পেলেও অমন অবলা জীবের জিভ আমি খেতে পারতাম না। 


ডিনার শেষ হতে না হতেই শুরু হল নাচ | আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন পূর্ণিমার আশেপাশে হবে। মরুভূমির মাঝখানে পূর্ণচন্দ্র আর খেজুর গাছে ঘেরা স্টেজ ৷ আরবি ঢঙের সঙ্গীতের তালে তালে শুরু হল এক পুরুষের অপূর্ব জাগলারী। তারপরে এক রূপসীর নাচ - বেলি ডান্স | শরীরের প্রত্যেকটি পেশীকে ক্ষিপ্রতায় সঙ্গীতের তালে তালে কিি দৃশ্যমাধুর্য্য তৈরী করা যায় তা নিজে চোখে এত কাছ থেকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। Vulgar বলে শারজায় banned এ রকমের বেলি ডান্স | কেন vulgar তা আমার মাথায় ঢোকে নি ৷ দুটো কারণ হতে পারে: এক, লাস্যময়ী নারীর স্বল্পবাস যৌবন আমাকে আর আকৃষ্ট করে না, আর দ্বিতীয়তঃ আমাদের মন ও দৃষ্টিভঙ্গী একবিংশ শতাব্দীর এক চতুর্থাংশের শেষের কাছাকাছি পৌঁছে অনেক বেশি উদার ও উন্মুক্ত হয়েছে ৷ 


নাচের শেষে নাটকীয়ভাবে দিনের শেষে একজন আরবী উটওয়ালা কেমন করে রোজ ঘরে ফেরেন তার দৃশ্য তৈরী হল উঁচু একটা বালিয়াড়ীর টিলায় ৷ 

সে দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে পড়ল জয়বাবা ফেলুনাথে রুকুবাবুর শিশুমনের প্রশ্ন
- এ সব কি সত্যি?
- মিথ্যে কি করে বলি রুকুবাবু ....


..... আমারও সেদিন ঠিক তাইই মনে হল - যে সব সত্যি
আলিবাবা সত্যি, মরজিনা - আবদাল্লা সত্যি, আলাদিনের দৈত্য সত্যি, সিন্দবাদের রকপাখির ডিম সত্যি....আর সহস্র এক আরব্য রজনীর অ্যাডাল্ট গপ্পগুলোও.....


 

Saturday, 5 August 2023

দুদ্ধর্ষ দুবাই - পঞ্চম পর্ব

আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে ঠিক এই দিনে সকালবেলায় উঠেই ফ্রেশ হয়ে বাড়িতে রাঁধুনি রত্নাকরের বানানো দারুণ ইউলি খেয়ে ব্রেকফাস্ট করে কি করব কি করব একটা ভাব আসতেই অরিন্দম বলল

- চ'... আশেপাশে ঘুরে আসি ৷ আজ তো বিকেলে আমরা desert safari তে যাবই ৷ কিন্তু সেটা হল গিয়ে একটা স্পেশাল লোকেশন ও সিলেক্টেড ইউনিক প্লেস ৷ কিন্তু তার আগে এখানকার লোকাল মরুভূমি কেমন তার একটা feel নিয়ে আসবি চল ৷ কম্পারেটিভ স্টাডি করতে সুবিধা হবে।

বাইরে গরমের চোটে অরিন্দমের অফারে কেউই সেরকম উৎসাহিত বোধ করল না দেখলাম; যেন, 'সেই  তো বিকেলে একই জিনিস দেখতে যাব! এখন আর সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করে কি লাভ!' - এর মত ভাব করে ভাবলেশহীন হয়ে রইল সবাই ৷ 


তখন অরিন্দম চৈতালীকে বলল,

- Spinneys থেকে কি সব আনতে হবে বলছিলে...

- এখন যাবে? 

- যাই... সেরে ফেলি...

- সাড়ে বারোটা বাজে কিন্তু... গাড়ি আমাদের সাড়ে তিনটে নাগাদ নিতে আসবে... এখনও সবার চান-খাওয়া বাকি ৷ বেশি দেরী কোরো না...

- না না এই যাব আর আসব..

কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দেখলাম বুম এই আপাত- নিরীহ বাজারে যাওয়ার পিছনে একটা গভীর ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পারল ও আমাদের দুজনের সঙ্গে ঝুলে পড়ল।

আমরা প্রথমে ওদের বাড়ির নিচের শপিং মার্টের বাইরে সবথেকে কাছের আর একটু বড় মার্ট Spinneys এ পৌঁছালাম ৷ এমন সব ফ্রেশ ফল ও সবজি যে দেখে যেন একটা fb - র ভাষায় 'feeling খাই খাই' হয়। তার পাশেই একটা liquor store l সেটাতে ঘুরে যা বুঝলাম যে ওখানকার লোকজন মোটামুটি বেশিরভাগই হয় বিয়ার না ওয়াইন পান করে ৷ ওয়াইনের বিরাট সম্ভার | হুইস্কির নানা রকমের ব্র্যান্ড আছে বটে, তবে বিয়ার-ওয়াইনের মত চলে না। তবে পান না করলেও ওন্ড মঙ্ক -এর বিরাট ভান্ডার দেখে বেশ আহ্লাদিত হলাম। পানের কথা যখন উঠলই তখন এখানে বলে রাখা ভাল যে এ দেশে লোকে খেতে বসলেই লাবান নামক এক দুগ্ধজাত পানীয় পান করেন। সবার শপিং কার্টে আর কিছু থাকুক না থাকুক লাবান থাকেই৷ দুধ থেকে বানানো ঝাঁঝালো পানীয় ৷ তাতে Sprite জাতীয় সফট ড্রিঙ্ক মিশিয়ে খেলে অনবদ্য স্বাদের হয়ে ওঠে। আমি আর অরিন্দম দুতিন বেলা রোজ এক গেলাস করে তো খেতামই ৷  অরিন্দমের যা কেনার ছিল, মানে যা কেনার অছিলায় আমরা বের হয়েছিলাম তা হল এই লাবান ৷  সেটা spinneys থেকে কিনে আমরা চললাম স্থানীয় মরুভূমির উদ্দেশ্যে ৷ 


কিছুই না... রাস্তা এক জায়গায় যেখানে শেষ, তার সামনে আর দুপাশে ধূ ধূ মরুভূমি ৷ গাড়ি থেকে নামার সময় দরজা খুলতেই যে গরম হলকা টা মুখে এসে লাগল তাতে টের পেলাম সত্যিই মরুভূমি কারে কয় ! বেরিয়ে দু মিনিট কাটানোই খুব কঠিন। মোবাইলে ছবি তুলব কি , চড়া রোদ্দুরে স্ক্রীণের ব্রাইটনেস ম্যাক্সিমাম করেও কিস্যু দেখতে পেলাম না। আন্দাজে দু একটা ছবি তুলে গাড়িতে উঠে জানলার কাচ নামিয়ে যা যতটুকু পাওয়া যায় তুললাম ৷ মরুভূমি একদম সোনার কেল্লার আদলের ৷ সত্যিই যে ছবির মত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

- বিকেলে আমরা যেখানে যাব তার সঙ্গে এই মরুভূমির খুব একটা মিল পাবি না ৷

অরিন্দম জানাল ।

মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করছি যে মরুভূমি আবার অন্য কেমনতর হতে পারে ! এখন যা দেখছি তাইই তো দারুণ- মরুভূমি হো তো এ্যাইসা !! 

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা মরুদ্যানের সামনে এনে গাড়িটা দাঁড় করালো অরিন্দম ৷ বলল,

- এগুলো এখানকার নার্সারী ৷

আমি তো দেখে থ! বলেই ফেললাম 

- নার্সারী কি রে! এতো post doctorate ...


গোটা গোটা বিশাল সাইজের গাছের সম্ভার | ছোট, মানে আধ ফুটের গাছ থেকে, বিশাল বড়, মানে কুড়ি ফুটের গাছ বা তার থেকেও বড় গাছ বিক্রির জন্য থরে থরে সাজানো ৷ কোনো জায়গা পার্মানেন্টলি নতুন সবুজ দিয়ে সাজাতে হলে ওখানকার লোকজন এইসব গাছ কিনে নিয়ে গিয়ে সোজা সেখানে পুঁতে দেয় ৷ এমনভাবে সেটা করে যে সেই জায়গাটা কদিন আগেই যে ঊষর মরুভূমি ছিল, তা বিশ্বাস করাই কঠিন।

প্রথম দিন থেকেই অরিন্দম সুযোগ পেলেই আশ-পাশ দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আসত ৷ সেরকম নার্সারী থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে পড়ল একটা pet market | বাড়ির পোষ্যদের শপিং মল। সেখানো পোষ্যদের তো পাওয়া যাবেই সঙ্গে তাদের জন্য খানাপিনা ও খেলধূলার সাজ সরঞ্জাম ৷ নানা ধরনের কুকুর বেড়াল পাখ পাখালি ছাডাও আছে কচ্ছপ, খরগোশ ইত্যাদি। চিড়িয়াখানার মত সুন্দর করে সাজানো সব দোকান। সবটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।


আর যদি সে সব কুকুর বেড়ালের অভিব্যক্তি যদি কেউ দ্যাখে - আহ্লাদে আটখানা তারা৷ সবথেকে ভয় পেয়েছি আমরা সবাই এক বিশাল কুঁদো হুলোকে দেখে ৷ শরীরের দৈর্ঘ্য ফুট দেড়েক হবে। যে গাম্ভীর্য ও দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছিল তাতে ওই দিনের বেলাতেই সে খাঁচাতে থাকা সত্ত্বেও আমাদের বুক শুকিয়ে যাচ্ছিল। তার ইতিবৃও নিয়ে খোঁজ নিতে  জানা গেল যে উহা বিক্রির জন্য নহে ৷ জীবনে এই প্রথম নিজের ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করলাম যে শীতলা মাতার এই বিশেষ বাহনকে কেন বাঘের মত প্রাণীরও গুরুজন অর্থাৎ 'মাসী' বলা হয়৷

তবে কুকুরগুলো যেভাবে সব ভেঙেচুরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল আদর খাবে বলে তাতে ওদের এই বন্দীদশায় বেশ মন খারাপ হয়ে গেল ৷ 

যাওয়া আসার পথে একটা জায়গায় দেখলাম দিগন্তবিস্তৃত যতদূর চোখ যায় শুধুই গাড়ি ৷ প্রথমে ভেবেছিলাম স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড | গাড়ির চেহারা দেখে ভাবলাম সেকেন্ডস এর মার্কেট ৷ তারপর দেখলাম বড় বড় করে এক জায়গায় লেখা Emirates Parking l বিস্ময় আর বিস্ময় ৷ কেউ ভাবতেও পারবে না যে বছর তিরিশ আগে এই শহরের সেভাবে কোনো অস্তিত্বই ছিল না। কেউ পুঁছতোও না সেভাবে ৷

ফিরে এসে আমরা সবাইকে বললাম

- মিস করলে কিন্তু...

তাতে উত্তর এল 

- দুটো বাজে... কিন্তু এখনও স্নান খাওয়া কোনোটাই হয় নি। 

বুঝলাম সবাই desert safari র প্রত্যাশায় মশগুল হয়ে আছে ৷

এখানে কেন জানি না এত গরম হওয়া সত্ত্বেও বেলায় বেলায় বেশ খিদে হয়। সকালের অতগুলো ইডলি যে পেটের কোথায় গিয়ে সেঁধিয়েছে কে জানে! দুপুরে লাঞ্চে ছিল সাউথ ইন্ডিয়ান রাইস অ্যান্ড চিকেন উইথ এরিয়েটেড লাবান ৷ খেয়ে উঠে ঢেকুর তুলতে তুলতে দেখলাম তখনও হাতে আধঘন্টা আছে ৷ ব্যাকপ্যাকে নেওয়ার জন্য ঠান্ডা জলের ব্যবস্থা করে ও ক্যামেরা এবং মোবাইলের ব্যাটারীতে ঠিকঠাক চার্জ আছে কি না দেখে নিয়ে ভাবলাম যে এরপর যদি না এখুনি খাওয়া অনবদ্য দক্ষিণ ভারতীয় মুরগীর আত্মার স্মৃতিতে শোক পালনের উদ্দেশ্যে চোখ বন্ধ করে মিনিট কুড়ির শবাসন না করি তাহলে নেহাতই ব্যাপারটা অমানবিক হয়ে যাবে।


সঙ্গে শরীরের সমস্ত এনার্জি কে প্রস্তুতও করতে হবে ৷ যা শুনেছি তাতে এখানকার desert safari এক অনন্য ও অনবদ্য অভিজ্ঞতা ৷ ফলে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে, জুতো মোজা পরা ছাড়া, মিনিট কুড়ির দিবানিদ্রায় মগ্ন হলাম ৷

(চলবে...)

Local Desert Video Link

দুদ্ধর্ষ দুবাই - ষষ্ঠ পর্ব

 Desert Safari - র গাড়ি এসেছে।

সেই বহু প্রতীক্ষিত desert safari...

গাড়িতে করে একটা বিশেষ জায় গায় নিয়ে গিয়ে sand dunes এর চড়াই-উতরাই তে নাগরদোলার মত ভ্রমণ ৷ সেই ভ্রমণের শেষে সূর্যাস্তের সময়ে মরুভূমির মাঝে একটি ক্যাম্পে গিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়৷ সেখানে নানারকম এন্টারটেইনমেন্টের শেষে ডিনার ৷ 

শুনতে যতটা সরল মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা অতটা সরল যে নয় সেটা ধাপে ধাপে বুঝলাম। 

বাড়ির সামনে থেকে আমাদের ছজনকে একটা তাগড়া টয়োটা SUV গাড়ি তুলে নিয়ে চলল শারজার মরুভূমির দিকে ৷ যেখানে dune bashing করাবে সেই জায়গাটা শারজায় ৷ বাড়ি থেকে লোকেশন ঘন্টা খানেকের ৷ যাবার পথে একটা পাম্পে দাঁড়িয়ে প্রথমে গাড়িটা fuel rechage করল তারপর ড্রাইভার নৌফেল জানালেন যে আরও একটি গাড়ি আমাদের সঙ্গে যাবে। পেট্রোল পাম্পে সেই গাড়িটা আমাদের সঙ্গে যোগদান করলে আমরা একসাথে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম ৷ রাস্তার মিনিমাম গতিবেগ ১২০ কিঃমিঃ / ঘন্টা ৷ বাজছে হিন্দি গান - দিন ইয়ে বেচৈয়ন ওয়ে / রাস্তে পে নয়ন ওয়ে...তাল সে তাল মিলা... দূরে দিগন্তে শারজার পাহাড় ৷ 

পাহাড়ের কাছাকাছি গিয়ে গাড়িটা হঠাৎ জনমানবহীন পাথুরে একটা পথ ধরল ৷ লালচে হলুদ পাথুরে সে রাস্তা ৷ হাইটেনশন পাওয়ার টাওয়ার আর পাহাড় ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ডানদিকে একটা বাঁক নিয়ে হঠাৎ গাড়ি টা দাঁড়িয়ে পড়ল ৷ পাশে আমাদের সঙ্গী গাড়িটাও ৷ 


আমি গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে তাকাতেই প্রকৃতির বিশালত্বের মাঝখানে কেমন যেন নিজেকে ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র এক অস্তিত্ব বলে মনে হতে লাগল। ক্যামেরায় খানিকটা ধরার চেষ্টা করলে কি হবে, ওই বিশালত্ব কিছুতেই  ধরা গেল না। আপ্রান ছবি তোলার চেষ্টা করছি, হঠাৎ কানে এল গাড়ির চাকা থেকে হাওয়া বের হওয়ার ফসসসস করে শব্দ |  এই কেলো করেছে বলে দৌড়ে গিয়ে দেখি ড্রাইভার নৌফেলনিজেই হাওয়া বের করে দিচ্ছেন ৷ কোনো সমস্যা কি না জানতে গিয়ে আবার অবাক ৷ বেয়াল্লিশের এয়ার প্রেশরকে নামিয়ে আঠেরোতে করতে হবে। The tyres needed to be flattened for better grip on the sand. এমনিতেই ওই গাড়ির চাকা বেশ মোটা দেখলাম ৷ তারপরেও better grip! ঢোঁক গিললাম... যাঁদের গাড়ির চাকার air pressure ও grip সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা আছে তাঁরা বুঝবেন যে এই ধরণের ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে চোখের সামনে দেখলে পরে অদূর ভবিষ্যতে যে হাড় হিম করা কিছু হতে চলেছে তা বুঝে উঠতে অসুবিধা হয় না। 


গাড়িদুটো খুব নিষ্পৃহ ভাবে রওনা দিল। দুমিনিটের মধ্যে এমন দৃশ্য দেখলাম যা অসম্ভব সুন্দর ৷ অনেক বালির টিপির ওপর হাওয়ার দাগে ছোট ছোট ripples তৈরী হয়েছে। আর পুরো virgin জায়গা। না আছে কোনো চাকার দাগ না আছে কোনো পায়ের ছাপ ৷ দু একটা dune কে bash করার পর মালুম হতে শুরু করল ড্রাইভার কি করতে চলেছে ৷ মরুভূমির গভীর থেকে গভীরতর জায়গায় যেতে থাকল গাড়ি ৷ একটা প্রায় চল্লিশ ফুট গভীর খাদে আড়া আড়ি স্কিড করে করে নামতে থাকল গাড়ি ৷ চাকাটা মাটি কামড়ে ধরতে চাইছে কিন্তু শুকনো মিহি বালিতে কিছু করতে পারছে না। সরসরিয়ে খাদে নেমে যাচ্ছে আর সেই ঘর্ষণের ফলে গাড়ির একটা পাশ ছিটকে আসা বালির ছটায় অন্ধকার ৷ 

ইন্দ্রানীর এমনিতেই গাড়ির স্পিডিংএ সমস্যা আছে ৷ এরকম ডিউন ব্যাশিং এর ছিরি দেখে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল যে

- ইঁহাসে নিকালনেকা রাস্তা কাঁহা হ্যায় ভাইসাব?

ভাইসাব এক গাল হেসে বললেন

- কুছ নেহি পতা...

ব্যাপারটা কি দারুন অ্যাডভেঞ্চারাস ছিল তা আমার পক্ষে ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব, তাই ওই অবস্থায় যে ভিডিওটা তুলতে পেরেছি তার লিঙ্ক দিলাম ৷ আর সঙ্গে রইল কিছু ছবি।

Desert Safari Video Link



প্রায় মিনিট ১৫ ধরে এইভাবে ডিউন ব্যাশিং করার পর আমাদেরকে ড্রাইভার নৌফেল এনে ছেড়ে দিল মরুভূমির মাঝখানে একটা বিরাট টিলার ওপরে৷ সেই উচ্চতা থেকে মরুভূমিটাকে পুরোটাই দেখতে পাওয়া যায় ৷ 

অসাধারণ দৃশ্য! অসাধারণ অভিজ্ঞতা! 

অনন্ত মরুভূমির মাঝখানে লালচে হলুদ বালির ওপর আমরা ছবি তুলতে আরম্ভ করলাম, বিভিন্ন রকম ভাবে বিভিন্ন রকম পোজে। তখন প্রায় সূর্যাস্তের সময়। তবে এদেশে সূর্যের আলো চলে যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। বিকেলবেলাটা তাই বেশি লম্বা। আমাদের ছায়া তখনও বেশ স্পষ্টভাবেই বালিকে ছুঁচ্ছে ৷ ছবি তোলার সময় বিভিন্ন পোজ দিতে গিয়ে সবথেকে ইন্টারেস্টিং যে পোজটা হলো, সেটা হচ্ছে চৈতালির বালিকেলি ('জলকেলি' শব্দের অনুপ্রেরণা থেকে নেওয়া) | আমাদের ফটোগ্রাফারদের মান রাখতে যে কত রকম ভাবে চৈতালী কে দিয়ে বালি ছোঁড়ানো হল তার ইয়ত্তা নেই ৷ তবে ওর এর আগে আবির ছুঁড়ে পোজ দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে ৷ ফলে খুব অসুবিধা হল না। ও ও  শূন্যে বিভিন্ন ভাবে বালি ছুঁড়তে থাকল থাকলো আর আমরাও সেই খুব কম শাটার স্পিডে সেই বালুকণার গতিপ্রকৃতি ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা করলাম। তার কিছু নমুনা এখানে রইল।


ইন্দ্রানী-কে শান্তি দিয়ে ডিউন ব্যাশিং শেষ হল। কিন্তু যে রাস্তা ধরে চলতে থাকলাম সেখানেও ছোট ছোট অনেক বালিয়াড়ি ছিল। সেই বালিয়াড়িগুলো পেরোনোর সময় ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তায় জানতে পারলাম যে অন্যান্য ট্রাভেল এজেন্টরা এই সমস্ত ছোট ছোট বালিয়াড়িতেই ডিউন ব্যাশিং করায়। আমরা মরুভূমির যে গভীর অঞ্চলে গিয়েছি সেখানে সবার যাওয়ার অনুমতি নেই ৷  মাত্র দুটি ট্রাভেল এজেন্সির সেখানে যাওয়ার অনুমোদন আছে ৷ তাদের মধ্যে, আমরা যাদের সাথে গিয়েছি, সেই ওরিয়েন্ট ট্রাভেলস  হল একটি ৷ কিছু সিলেক্টেড স্পেশালি ট্রেইনড ড্রাইভার ছাড়া এখানে গাড়ি নিয়ে আসার ছাড়পত্র  অন্য কারোর নেই কারণ এই ড্রাইভিং স্কিল সবার থাকে না ৷  সেই লেভেলের ড্রাইভিং স্কিল না থাকলে এখানে যে কোন রকমের দুর্ঘটনা যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে এবং এক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটা মানে এখানে মৃত্যু নিশ্চিত ।

যা বলছিলাম, ফেরার পথে ছোট ডিউনস প্রচুর৷ সেগুলো পেরানোর সময় আমরা লক্ষ্য করলাম সারে সারে গাড়ি দাঁড়িয়ে ৷ তার আশেপাশে অনেক ডিউন ব্যাশিং চলছে ৷ আর পাশে রয়েছে অনেক ছোট ছোট ক্যাম্প ৷  সেখানে এত লোক যে তিল ধারনের ঠাঁই নেই ৷ শুধু গাড়িতেই নয়, আবার quad bike - এও বাইকেও ডিউন ব্যাশিং হচ্ছে।  আমাদের ড্রাইভার আমাদেরকে জানালো যে সাধারণত খুব সাধারণমানের ডিউন ব্যাশিংগুলো এখানেই হয়ে থাকে ৷ আমরা যে  ডিউন ব্যাশিং করলাম সেটা একটা রেয়ার এক্সপেরিয়েন্স | এটা সবাই পায়না ৷ আমরা ওর কথায় বিশ্বাস করতাম না ৷ কিন্তু যেহেতু অরিন্দম চৈতালিরাও আগে এরকম ডেসার্ট সাফারিতে এসেছে, অন্য কোনো এজেন্সির মাধ্যমে, ওদের সেই অভিজ্ঞতা খুব একটা মধুর নয় ৷ তাতে টাকা হয়তো অনেকটাই কম লেগেছিল কিন্তু আজ এই ড্রাইভারের মাধ্যমে এখনো পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা আমরা সঞ্চয় করলাম, আগেরটা তার ধারে কাছেও সেই ছিল না বলে ওরা স্বীকার করল ৷ এরপর আমরা গাড়িতে করে ফিরতে রইলাম শারজা থেকে আবার দুবাইয়ের দিকে ৷  ডিউন ব্যাশিং শারজাতে হলেও ক্যাম্পিং হবে দুবাইয়ের মরুভূমিতে। 


আসলে শারজা হল খুব রক্ষণশীল এমিরেট ৷ এখানে অ্যালকোহল এবং বেলি ডান্স অনুমোদিত নয় ৷ এর অনুমোদন রয়েছে দুবাইয়ে ৷ সুতরাং আমরা যত রকমের ফুর্তি করব সেগুলো হবে দুবাইয়ের মরুভূমির ক্যাম্পে ৷ 

ফুর্তির অঙ্গ হিসেবে এই ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ হবে একদল উটের ৷ আমাদের ড্রাইভার আমাদেরকে জানালেন যে এবার তিনি উটের খোঁজে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছেন ৷ মিনিট দশেক ধরে আবার তথাকথিত পাতি ডিউন ব্যাশিং করতে করতে করতে উটের দলের খোঁজ চলল। অবশেষে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ হলোএক দঙ্গল উটের ৷ সেই উটেরা সব একসাথে রয়েছে এবং এরা কারো প্রতিপালিত উটের দল ৷ যাতে বেশি দূর চলে না যেতে পারে দেখা গেল সেজন্য এদের প্রত্যেকেরই সামনের দুটো পা কাপড় দিয়ে বাঁধা ৷  আমার দাঁড়ালাম | ওদের কাছে গেলাম। এই উটেরা কিন্তু মানুষদের বিশেষ ভয় পায় না ৷   বুম যখনই একটা উটকে আদর করতে আরম্ভ করল সে ঝোপের কাঁটা বেছে বেছে খাওয়া থামিয়ে চোখ বুজে দিব্যি বুমের হাতের আদর নিতে থাকলো ৷ আমরা সেই উটটির নাম দিলাম 'মহেশ' ৷ তিনি একটি উট যাঁকে আদর করলে আহ্লাদে গলে পড়ার জোগাড়!


এই উটের দলের সঙ্গেও চলল খানিকক্ষণ ফটোগ্রাফি সেশন। তারপর পড়ন্ত রোদে আমরা উটদেরকে বিদায় জানিয়ে উঠলাম গাড়িতে ৷ এবার গন্তব্য ডেজার্ট ক্যাম্প ৷ শুনেছি সেখানে অন্য অনেক কিছুর সাথে উটের পিঠে চড়ার ব্যবস্থাও আছে ৷

(চলবে...)