বাড়িতে ঢুকেই আমাদের দেখা হল ছোটুর সঙ্গে | দুবাই এয়ারপোর্টে নেমে বুম ছোটুকে দেখতে না পেয়ে, আমার কানে কানে চৈতালী - অরিন্দম কে দেখিয়ে মস্করা করে বলল,
![]() |
| Art IX: Tiwaries' Home |
সেই বেচারী মেয়েটার কাছ থেকে ওর ঘরটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, আমরা সেখানে থাকব বলে। তবে তাতেও ছোটুর যে খুব একটা হেল- দোল আছে, তা দেখলাম না। সে বরং বেজায় খুশি যে সেদিন রাত থেকে হলটা নাকি ওর, আর ও বসে বসে পা ছড়িয়ে সারা রাত ধরে টিভি দেখবে। আমি যখন হাঁপ ছেড়ে ঘরে ঢুকে অরিন্দম-কে বললাম, "অবশেষে তুই এখানে এসেছিস বলে আমাদের আসা হল", তাতে ছোটু তীব্র প্রতিবাদ করে ওর সেই বিখ্যাত স্টাইলে বলল, "না, আসলে আমি এখানে পড়্তে এসেছি বলে বাবা-মা তোমরা সবার আসা হল।
![]() |
| BITS Pilani Dubai |
কথাটা সত্যি, ও যদি BITS Dubai তে চান্স না পেত্, তা হলে তো সত্যি-ই আমরা দুবাই-এ এসে পৌঁছাতাম কি! এয়ারপোর্ট থেকে ওদের বাড়ি আসার পথে আমরা ছোটুর কলেজ ও বুমের কলেজের দুবাই-শাখা Amity University, Dubai ঘুরে এলাম। ওদের বাড়ি থেকে দুটো কলেজই মানে BITS Dubai আর Amity University, Dubai, কাছাকাছি। আর অদ্ভুতভাবে প্রায় উল্টোদিকে। আমরা ছোটুর ঘর দখল করে লাগেজ রেখে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেলাম। বাড়িটা অসম্ভব সুন্দর ও সাজানো গোছানো ৷ আমরা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে চেঞ্জ করতে না করতেই চলে এলো লাঞ্চ -- চিকেন কষা আর সাউথ ইন্ডিয়ান পোলাও।
![]() |
| Amity University Dubai |
আরব দেশে খাবার বেড়ে দেওয়ার একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে, সে টেবিলেই হোক বা মেঝেতে৷ পরিবার-বন্ধুদের একসাথে খাওয়া দাওয়া যে একটা বন্ডের সৃষ্টি করে তা মুসলিমদের থেকে শেখার বৈকি! ওরা একটা প্লাস্টিকের শিট টেবিলে বা মেঝেতে পেতে দেয়, (যেমন টেবিল ক্লথ হয় বা নেমন্তন্ন বাড়িতে যেরকম এখন ডিস্পোসেবল টেবিল কভার পাওয়া যায় ) আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে যে সেই শিট -টার ওপরে সবার খাবার একসঙ্গে ঢেলে নেওয়া হয় ৷ চারিদিক থেকে প্রয়োজনমত খাবার প্রত্যেকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে খেতে থাকেন৷ যাঁদের ইফতারের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা সহজেই বুঝবেন ৷ এক্ষেত্রে প্রত্যেকের আলাদা বাসনপত্রের কোনো বালাই নেই ৷ নিজের খাবার শুধু নিজের দিকে টেনে নাও এবং খাবারের অবশিষ্ট অংশ, যেমন মাংসের হাড়, ছিবড়ে, খোসা, মাছের কাঁটা ইত্যাদি যা কিছু ফেলার জিনিস, সেগুলো তার মধ্যে ওর মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট স্থানে সবাই ফেলতে থাকে ৷ খাওয়ার শেষে ওই শিটেই সব একসাথে মুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। এই শিটকে বলে "সুপ্রা" ৷ সুপ্রা পাতা মানেই খানাপিনার আয়োজন। তবে আমাদের ক্ষেত্রে টেবিলে সুপ্রা পাতার উদ্দেশ্য, সহজে পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, টেবিল পোঁছার ঝামেলা এড়ানো, থালা-বাটি-গেলাস বিহীনতা নয়৷
এই সূত্রে একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেল ৷ আমাদের ঝাঊতলার লোকাল ঘোঁটবাজিতে প্রকাশ যে আমরা যেখানে থাকি সেখানে একটি বিশেষ বাড়িতে কাজের লোককে দিয়ে কাজ করানো উসুলের উদ্যোগের পদ্ধতি রীতিমত বিস্মিয়কর৷ সে একদিন কাজ করতে গিয়ে অবাক, কারণ বাড়ির মালকিন তাকে দিয়ে বাসন মাজানো যাতে মিস না হয় তাই খেতে খেতেই প্লেট থেকে ডালভাত তরকারী সব ফাঁকা টেবিলের ওপর ঢেলে নিয়ে সেখান থেকেই খেতে শুরু করেন ও এতক্ষণ যে প্লেট ও বোল থেকে খাচ্ছিলেন সে সব টেবিলের ওপরে খালি করে মাজার জন্য নামিয়ে দেন। বাসন-পত্তর ধুয়ে -মেজে না গেলে মাইনে করে কাজের লোক রেখে কি লাভ! তবে শেষে সেই টেবিল কে পরিস্কার করেছিল তা অজ্ঞাত ৷ যেহেতু এই ঘটনার কোনো স্পেসিফিক অথেন্টিক সোর্স নেই, তাই এটাকে একটা রটনা বলে ধরে নেওয়া যায়।
![]() |
| Burj Khalifa |
সুপ্রা ও তার ব্যবহার দেখে মনে হল, আসলে সুপ্রার প্রাথমিক আইডিয়াটা আমাদেরই ছিল। ও দেশে এর আবিষ্কার সেই জুতা আবিষ্কারের গল্পের মত, "কেমনে ব্যাটা পেরেছে সেটা জানতে !"
যাই হোক, এলাহী লাঞ্চ করে তারপর খানিকটা জেট ল্যাগ কাটিয়ে ওঠার পর চৈতালি আমাদেরকে বলল যে বসে বসে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না! ঈদের ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই অরিন্দমকে আমরা যারপরনাই ব্যবহার করে নেব ৷ ওখানে আমি ড্রাইভ করতে পারব না। শুনলাম ওখানকার ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার ৷ অরিন্দম গত কুড়ি বছরের বেশি গাড়ি চালায়৷ তারপরেও ওখানে লাইসেন্সের পরীক্ষায় দু'বার অকৃতকার্য হয়ে তৃতীয়বারে অবশেষে ওখানকার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে ৷ সুতরাং ওখানে আমার ড্রাইভ করার কোন প্রশ্নই উঠে না ৷ ট্রাফিক রুলস যথেষ্ট কড়া ৷ মানে গাড়ি যদি ফুটপাতের পাশে এমনি দাঁড়িয়ে থাকে তাহলেও পুলিশের নজরে থাকে ৷ কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু নজরদারী থাকে ৷ ওখানে খুব ছোট রুল ব্রেকিং বা বড়, কোনোটাতেই "সোর্স" চলে না।
তা যা বলছিলাম, আমরা বেরোলাম ঘুরতে কারণ অরিন্দমকে ম্যাক্সিমাম ব্যবহার করে নিতে হবে ৷ আমাদের গন্তব্য হলো প্রথমেই পৃথিবীর সব থেকে বড় শপিং মল, দুবাই মল ৷ সর্ববৃহৎ মলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে দুবাই ফাউন্টেনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমরা মানুষের তৈরী পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থাপত্যকর্ম বুর্জ খলিফার একদম পাদদেশে গিয়ে পৌঁছেছি ৷ সেখানে কিছুক্ষণ বাদে ফাউন্টেন শো হবে সেই অপেক্ষায় প্রচুর লোক সেখানে জড়ো হয়েছে ৷ বুর্জ খলিফার গায়ে মোলায়েম রঙীন আলো খেলা করছে নানান বাহার ও বিজ্ঞাপনরূপে । Emaar হচ্ছে ওখানকার সব থেকে বড় সংস্থা৷ এই বুর্জ খলিফার কন্সট্রাকশনও তাদের তৈরি করা ৷ Emaar এর বিজ্ঞাপন বুর্জ খলিফার গা দিয়ে ওঠা নামা করছে। পয়সা দিয়ে যে কেউ তার প্রিয়জনের জন্মদিন বা অ্যানিভার্সারি উইশ করতে পারেন বুর্জ খলিফার গায়ে লিখে ৷ শাহরুখ খানের জন্মদিনের দিন "হ্যাপি বার্থডে টু শাহরুখ" এই কথাটা বুর্জ খালিফার গায়ে লেখা হয় বলে আমরা শুনলাম ৷
![]() |
| Burj Khalifa &.... |
সব মিলিয়ে যে বিশালত্ব ও অপূর্ব দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম তা ভাষায় অবর্ণনীয় ও ক্যামেরায় অধরা ৷ বুর্জ খলিফার পাদদেশে - দুবাই ফাউন্টেনে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো শুরু হলে মুগ্ধতার চরম সীমায় পৌঁছালাম আমরা ৷ শুধু দুজন নিরুত্তাপ -- ছোটু ও বুম্। সবার চোখ ও ক্যামেরা যখন বুর্জ খলিফার বিস্ময়কে ধরে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত তখন দেখা গেল ছোটু আর বুম এই পুরো শো-টা থেকে খুব নির্লিপ্ত, কারণ তারা দুই বন্ধুতে মিলে ইনস্টাগ্রামে যে ধরনের ছবি পোস্ট করা হয়, নিজেদের সেই ধরনের ছবি তুলতে ব্যস্ত ৷ ইতিমধ্যে আমি যে ছবিগুলো তুলেছি বা অরিন্দম যে ছবিগুলো তুলেছে, ওরা দু'জনে দেখে বলেছে, সেগুলো কোনো ছবির পর্যায়ে পড়ে না। আমাদেরকে বলা হয়েছে যে আমরা নাকি ছবি তুলতেই জানি না ও আমাদের শেখা উচিত কিভাবে ছবি তুলতে হয়। ওদের তোলা ছবিতে এক অদ্ভুত প্রপোরেশনের ব্যাপার আছে ৷ সাথে আবার কেউ কারো মুখ সহজে দেখায় না - পিঠ ঘুরিয়ে থাকে, মুখ নিচু করে থাকে, উল্টো হয়ে থাকে, আরও বেশ অদ্ভুত সব কান্ডকারখানা যা আমাদের সঙ্গে মেলে না। এটাই নাকি এখন চলতি ফটোগ্রাফি ৷ আমরা ভীষণ বিরক্ত হয়ে তাই জন্য ব্যাপারটা ওদের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলাম ৷ ওরা যা পারে করুক ৷
মুগ্ধ হয়ে বুর্জ খলিফার সেই দৃশ্য দেখার সম্মোহন কাটতে না কাটতেই এসে দাঁড়ালাম দুবাই মলের ভিতর অবস্থিত পৃথিবীর সবথেকে বড় অ্যাকোয়ারিয়াম এর এর পাশে ৷ অবিশ্বাস্য ! সেখানে রীতিমতো হেলেদুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা ধরনের হাঙর, শংকর মাছ , সেই সাংঘাতিক স্টিং রে, আরো কত রকমের সামুদ্রিক প্রাণী যেসবের নাম আমার জানা নেই ৷
![]() |
| Dubai Aquarium |
দুবাই মল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মল ৷ আমরা মজা করে বলতে শুরু করলাম যে এটা একটা পুরো জেলা কারণ এই দুবাই মল একদিনে পুরোটা ঘোরা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না ৷ এটার একটা ক্ষুদ্র অংশটুকু ঘুরে দেখে সম্পূর্ণ করতেই আমাদের প্রায় কয়েক ঘন্টা কেটে গেল ৷ যে যে অংশে গেলাম সেখানে আমরা দেখতে পেলাম একটা বিশাল ডাইনোসরের কঙ্কাল, বস্তা বস্তা কফি রাখা একটি কফিশপ এবং আরো অনেক ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডের শো রুমস যেগুলো কলকাতায় নেই ৷
![]() |
| Coffee Shop |
অদ্ভূত ব্যাপার হল, মলটি শুধু সাজানো নয়, অত্যন্ত প্ল্যান করে এমন করে তৈরি করা হয়েছে যাতে লোকে সেখানে ইউনিকনেসের আকর্ষণে আসতে বাধ্য হয় ৷ ফলতঃ মলটির বিভিন্ন জায়গা বিভিন্ন ধরনের - তার ডিজাইন, তার আর্কিটেকচার, তার অ্যামবিয়েন্স - সবকিছুই এক একদিকে এক এক রকম ৷
ও হ্যাঁ! বলতে ভুলে গেলাম যে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখি ভার্জিন রেকর্ডস-এর স্টোর৷ গ্লোবাল ডিমান্ডে তা এখন ভার্জিন মেগা স্টোরে পরিণত হয়েছে ৷ এই সেই ভার্জিন রেকর্ডস ৷ ছোটবেলা থেকে ভার্জিন বলতে জানি মাইকেল জ্যাকসন, জর্জ মাইকেল, ম্যাডোনা, এল্ভিস, বিটলস, ফ্রাঙ্ক সিনেন্ট্রা, জানি আরো অনেক আন্তর্জাতিক তারকাদের নাম যাঁরা আমাদের মনে সংগীতের স্বপ্ন বুনে সম্মোহন সৃষ্টি করতেন।
আমরা পৃথিবীর সবথেকে বড় মলের একটি ভগ্নাংশ ঘোরার পরে মনের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রীতিমতো টায়ার্ড হয়ে গিয়ে সেদিনের মতো ওখানেই ইতি টানলাম৷
বাড়ি ফিরে ডিনার্। সেদিন ডিনারে ছিল হাওড়া শানপুর থেকে আনা পাঁঠার মাংস ও রুটি ৷
(চলবে....)







.png)
No comments:
Post a Comment