Monday, 7 August 2023

দুদ্ধর্ষ দুবাই: সপ্তম পর্ব

Dune Bashing শেষ ৷ পড়ন্ত সূর্যের সাথে সাথে মরুভূমির মাঝখান দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটছে। বেশি গতি তোলা সম্ভব নয়। ঢাকার হাওয়া সেই যে ১৮তে নামানো হয়েছে তারপর তো ওরকম পাণ্ডববর্জিত খাণ্ডব মরুভূমিতে তাণ্ডব মাচানোর পর আর ভরার কোনো সুযোগ নেই। সেই ক্যাম্পে গিয়ে তারপর ৷ 

গাড়ি প্রায় সমতল মরুভূমি দিয়ে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগে ধাবিত হওয়া সত্ত্বেও ইন্দ্রানী পুরো চুপ। Dune Bashing এর মত দুদ্ধর্ষ অভিজ্ঞতার ফলেই বলে মনে হল। আমরা কথাবার্তা বলতে থাকলাম ৷ যেখান দিয়ে গাড়িটা যাচ্ছে সেটা গাড়ির ম্যাপে দেখলাম দিকশূন্যপুরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ৷ একেই বলে ম্যাপের বাইরে ৷ তবে অদ্ভূতভাবে বালির রং মাঝে মাঝেই কালো ৷ ড্রাইভার নৌফেল জানালেন যে এখানে পাঁচ রকমের বালি আছে, এটা তারমধ্যে অন্যতম৷ কালো বালির অর্থ হল ও গুলো কোনো না কোনো নদীগহ্বর বা river bed I বুঝলাম যে বালির সঙ্গে খানিকটা পলি মিশে আছে বলে ওরকম কালচে রঙ হয়েছে ৷ এখানকার বর্ষাকালে বেড়াতে এলে তখন কিন্তু আর এসব দেখাই হত না। কারণ বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে উঠলে এই সব স্থানে অনেক অনেক বহমান নদী। যদিও গভীরতা কম, তবে স্রোতস্বিনী ৷ আর সারা বর্ষাকাল ধরে এইসব অঞ্চলে আসাই নিষিদ্ধ ৷ বন্ধ থাকে Dune bashingl 

অর্থাৎ আসলে আমরা তখন মরুভূমির বুক চিরে নদীগর্ভের মধ্যে দিয়ে চলেছি তো চলেছি তো চলেছি ৷ শারজা থেকে দুবাই যাওয়ার এটাই শর্টকাট ৷ শারজা অঞ্চলের মরুভূমি থেকে দুবাই অঞ্চলের মরুভূমিতে প্রবেশ করলে বেশ বোঝা যায় ৷ শারজার বালির লালচে আভা আর থাকে না। ফিকে হলুদ হয়ে যায় ৷ 

গাড়িটা এসে দাঁড়ালো মরুভূমির মধ্যে একটা ঘেরা জায়গার সামনে। ঘেরা জায়গাটা একটা ক্যাম্প | আর তার বাইরে চলছে দুটো ব্যাপার --
এক, উটের পিঠে চড়া
দুই, স্যান্ড সার্ফিং

উট যে সোনার কেল্লার মত রাজস্থানের পোখরান বা রামদেওরাতে নিয়ে চলে যাবে এরকম নয় ৷ উটে ওঠার একটা অভিজ্ঞতা মাত্র ৷ সেই সামনের পা - পিছনের পা থিওরী। ওখানকার উটচালক তো আর সোনার কেল্লা দেখেন নি। তাই ভাঙা ভাঙা হিন্দি ভাষায় সওয়ারীদের সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছেন ৷ আমাদের দল থেকে প্রথম সওয়ারী হল বুম আর ছোটু ৷ তারপর আমি আর ইন্দ্রানী৷ মানুষ ছাড়া অন্য যে কোনো জ্যান্ত প্রাণীকে ছুঁতে বেশ ভয় পায় ইন্দ্রানী ৷ তবে লালমোহন বাবুর মত এই অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানিকে উপেক্ষা করতে পারল না। সমস্ত ভয় কাটিয়ে উটের পিঠে উঠল ৷ উঠেই কোলোর কীর্তি : দুদিকে পা ঝোলাতেই  উটের পেটের শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত ওঠানামা অনুভব করার পরেই দুপা দুদিকে স্ট্রেচ করে পুরো ফুল আউর কাঁটে -র অজয় দেবগণ ৷ ছোটু তো ইন্দ্রানীর মুখের দিকেই ক্যামেরা তাক করিয়ে রেখে দিল আর ইন্দ্রানীর হাবভাব দেখে বলেই ফেলল,

- তা বলে কি উট নিশ্বাস নেবে না!

তারপর সেই আইকনিক সিন- যেটা সত্যজিত রায় জীবদ্দশায় দেখলে হয়ত সন্তাষ দত্তের মৃত্যুর পর তৃতীয় ফেলুদাটা বানানোর কথা একবার হলেও ভাবতেন ! হয়ত সেটাই হত কোনো মহিলা চরিত্র সম্বলিত প্রথম ফেলুদা ৷ কিন্তু বড় দেরীতে ঘটল সে ঘটনা।

উট বাবাজি একপাক ঘুরে এসে সেফ ল্যান্ডিং দিয়েছে কি দেয় নি, ইন্দ্রানী টকাস করে নেমেই উটকে ঠকাস করে পেন্নাম ঠুকে দিল -  একেবারে অন্তর থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধা ও ভক্তি মিশ্রিত, Aldous Huxley র ভাষায় awe and veneration থেকে । 

সেই পেন্নামের জেরে video টা হেব্বি হিট৷ নিচে লিঙ্ক দেওয়া রইল৷ 


উটচালক ভদ্রলোক খুবই বেরসিক। তিনি হাসেন না। ছবি তোলার সময়ে হাসতে বলা হয়েছিল। তাতে তিনি সোনার কেল্লার মুকুলের মত বলেই ফেললেন তাঁর ভাঙা হিন্দীতে,

- হাসব কেন! আমার তো হাসি পাচ্ছে না।


এরপর ঘেরা ক্যাম্পের মধ্যে ঢুকে সবে বসব , দেখি পাশেই বাইরে বালির চূড়ার পর একটা বিরাট স্কেটবোর্ড হাতে বুম দাঁড়িয়ে ৷ স্কেটবার্ডে পা গলিয়ে sand surfing করতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একাক্কার কাণ্ড ৷ ধারণা ছিল যে ধূলোর মত মিহি বালির চূড়ায় উঠে স্কেটবোর্ড পায়ে পরে ঢালের দিকে দাঁড়ালেই সাঁ করে নেমে আসবে ৷ নেমে আসা তো দূর, অনেক লম্ফঝম্প করেও এক ইঞ্চি নড়াতে পারল না নিজেকে ৷ ও ছাড়া আরও যাঁরা চেষ্টা করছিলেন তারাও দেখলাম খানিকটা নেমেই হত্যে দিয়েছেন। অবশেষে স্কেটবোর্ড হাতে ছবিতে মারিতং জগৎ মার্কা ইনস্টা পোজ দিয়ে সেখান থেকে নেমে এসে ঘামে চুবচুবে হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-...... জঅঅল"
অরিন্দম বুম কিছু ঘটালেও ঘটাতে পারে এরকম আশায় কেজি তিনেকের ক্যামেরা অনেকক্ষন তাক করে ছিল। সে ও সব গুটিয়ে ব্যর্থ মনোরথে ক্যাম্প অভিমুখে যাত্রা করল।


ক্যাম্পে ওয়েলকামে ছিল একটা করে ভেজ র‍্যাপ আর সফট ড্রিঙ্ক। খাবার জল আর সফট ড্রিঙ্ক  যতক্ষণ থাকব - মানে সেই ডিনার অব্দি, আন্লিমিটেড। ক্ষিদে ভালই পেয়েছিল৷ আর তেষ্টার কথা বলাই বাহুল্য ৷ তারপর সে সব মিটিয়ে আমরা ক্যাম্পের মধ্যে থাকা বিভিন্ন স্টলে ঘুরতে লাগলাম। সেখানে আরবের একটা drink খেলাম৷ লোকাল হার্বল টি, নাম "Qawah" ( 'Q' এর উচ্চারণ 'ক' এবং 'গ' এর মাঝামাঝি),  সঙ্গে খেজুর ৷ তারপর গড়গড়া, বা Sheeshaa৷ পথের পাঁচালীর ট্রেনের মত কালো ধোঁয়ার বদলে ভসভসিয়ে সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দেখি ইন্দ্রানী হাতে বাজপাখি বসিয়ে ছবি তোলার জন্য ডাকছে। 

দিনরাতের সন্ধিক্ষণে তখন সূর্যের আলো আর ক্যাম্পের বাল্বের আলো মিলে মিশে একাকার | চাঁদটাও পলিউশন ফ্রি আকাশে স্বপ্নের মত ৷ 

আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত পাঁচ নম্বর ক্যাম্পে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পরে আমাদের সামনে বুম-ছোটুর বয়সী একটি ছেলে ফায়ার জাগলারী দেখাতে আরম্ভ করল। তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। আমরা মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলাম। আগুনের আলোর রেখার সম্মোহনে কখন যে চারদিক অন্ধকার হয়ে সন্ধে হয়ে গেছে বুঝতে পারি নি। জানানো হল যে ডিনার রেডি ৷


এলাহী ডিনার ৷ সেখানে সবথেকে লোভনীয় ছিল ভেড়ার পাঁজর - কাঠকয়লার আঁচে ঝলসানো ৷ এছাড়া অনবদ্য বীফ  ৷ বন্ধু প্রীতম পরে জানিয়েছিল যে এখানে বছর পনেরো আগে পঞ্চাশ দিরহাম -এর বিনিময়ে বার্বি কিউ করা বাছুরের জিভ পাওয়া যেত | নাকি, অনবদ্য স্বাদের। তবে আমরা সে জিনিস পাই নি। আর পেলেও অমন অবলা জীবের জিভ আমি খেতে পারতাম না। 


ডিনার শেষ হতে না হতেই শুরু হল নাচ | আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন পূর্ণিমার আশেপাশে হবে। মরুভূমির মাঝখানে পূর্ণচন্দ্র আর খেজুর গাছে ঘেরা স্টেজ ৷ আরবি ঢঙের সঙ্গীতের তালে তালে শুরু হল এক পুরুষের অপূর্ব জাগলারী। তারপরে এক রূপসীর নাচ - বেলি ডান্স | শরীরের প্রত্যেকটি পেশীকে ক্ষিপ্রতায় সঙ্গীতের তালে তালে কিি দৃশ্যমাধুর্য্য তৈরী করা যায় তা নিজে চোখে এত কাছ থেকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। Vulgar বলে শারজায় banned এ রকমের বেলি ডান্স | কেন vulgar তা আমার মাথায় ঢোকে নি ৷ দুটো কারণ হতে পারে: এক, লাস্যময়ী নারীর স্বল্পবাস যৌবন আমাকে আর আকৃষ্ট করে না, আর দ্বিতীয়তঃ আমাদের মন ও দৃষ্টিভঙ্গী একবিংশ শতাব্দীর এক চতুর্থাংশের শেষের কাছাকাছি পৌঁছে অনেক বেশি উদার ও উন্মুক্ত হয়েছে ৷ 


নাচের শেষে নাটকীয়ভাবে দিনের শেষে একজন আরবী উটওয়ালা কেমন করে রোজ ঘরে ফেরেন তার দৃশ্য তৈরী হল উঁচু একটা বালিয়াড়ীর টিলায় ৷ 

সে দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে পড়ল জয়বাবা ফেলুনাথে রুকুবাবুর শিশুমনের প্রশ্ন
- এ সব কি সত্যি?
- মিথ্যে কি করে বলি রুকুবাবু ....


..... আমারও সেদিন ঠিক তাইই মনে হল - যে সব সত্যি
আলিবাবা সত্যি, মরজিনা - আবদাল্লা সত্যি, আলাদিনের দৈত্য সত্যি, সিন্দবাদের রকপাখির ডিম সত্যি....আর সহস্র এক আরব্য রজনীর অ্যাডাল্ট গপ্পগুলোও.....


 

No comments: