Desert Safari - র গাড়ি এসেছে।
সেই বহু প্রতীক্ষিত desert safari...
গাড়িতে করে একটা বিশেষ জায় গায় নিয়ে গিয়ে sand dunes এর চড়াই-উতরাই তে নাগরদোলার মত ভ্রমণ ৷ সেই ভ্রমণের শেষে সূর্যাস্তের সময়ে মরুভূমির মাঝে একটি ক্যাম্পে গিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়৷ সেখানে নানারকম এন্টারটেইনমেন্টের শেষে ডিনার ৷
শুনতে যতটা সরল মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা অতটা সরল যে নয় সেটা ধাপে ধাপে বুঝলাম।
বাড়ির সামনে থেকে আমাদের ছজনকে একটা তাগড়া টয়োটা SUV গাড়ি তুলে নিয়ে চলল শারজার মরুভূমির দিকে ৷ যেখানে dune bashing করাবে সেই জায়গাটা শারজায় ৷ বাড়ি থেকে লোকেশন ঘন্টা খানেকের ৷ যাবার পথে একটা পাম্পে দাঁড়িয়ে প্রথমে গাড়িটা fuel rechage করল তারপর ড্রাইভার নৌফেল জানালেন যে আরও একটি গাড়ি আমাদের সঙ্গে যাবে। পেট্রোল পাম্পে সেই গাড়িটা আমাদের সঙ্গে যোগদান করলে আমরা একসাথে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম ৷ রাস্তার মিনিমাম গতিবেগ ১২০ কিঃমিঃ / ঘন্টা ৷ বাজছে হিন্দি গান - দিন ইয়ে বেচৈয়ন ওয়ে / রাস্তে পে নয়ন ওয়ে...তাল সে তাল মিলা... দূরে দিগন্তে শারজার পাহাড় ৷
পাহাড়ের কাছাকাছি গিয়ে গাড়িটা হঠাৎ জনমানবহীন পাথুরে একটা পথ ধরল ৷ লালচে হলুদ পাথুরে সে রাস্তা ৷ হাইটেনশন পাওয়ার টাওয়ার আর পাহাড় ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ডানদিকে একটা বাঁক নিয়ে হঠাৎ গাড়ি টা দাঁড়িয়ে পড়ল ৷ পাশে আমাদের সঙ্গী গাড়িটাও ৷
আমি গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে তাকাতেই প্রকৃতির বিশালত্বের মাঝখানে কেমন যেন নিজেকে ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র এক অস্তিত্ব বলে মনে হতে লাগল। ক্যামেরায় খানিকটা ধরার চেষ্টা করলে কি হবে, ওই বিশালত্ব কিছুতেই ধরা গেল না। আপ্রান ছবি তোলার চেষ্টা করছি, হঠাৎ কানে এল গাড়ির চাকা থেকে হাওয়া বের হওয়ার ফসসসস করে শব্দ | এই কেলো করেছে বলে দৌড়ে গিয়ে দেখি ড্রাইভার নৌফেলনিজেই হাওয়া বের করে দিচ্ছেন ৷ কোনো সমস্যা কি না জানতে গিয়ে আবার অবাক ৷ বেয়াল্লিশের এয়ার প্রেশরকে নামিয়ে আঠেরোতে করতে হবে। The tyres needed to be flattened for better grip on the sand. এমনিতেই ওই গাড়ির চাকা বেশ মোটা দেখলাম ৷ তারপরেও better grip! ঢোঁক গিললাম... যাঁদের গাড়ির চাকার air pressure ও grip সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা আছে তাঁরা বুঝবেন যে এই ধরণের ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে চোখের সামনে দেখলে পরে অদূর ভবিষ্যতে যে হাড় হিম করা কিছু হতে চলেছে তা বুঝে উঠতে অসুবিধা হয় না।
গাড়িদুটো খুব নিষ্পৃহ ভাবে রওনা দিল। দুমিনিটের মধ্যে এমন দৃশ্য দেখলাম যা অসম্ভব সুন্দর ৷ অনেক বালির টিপির ওপর হাওয়ার দাগে ছোট ছোট ripples তৈরী হয়েছে। আর পুরো virgin জায়গা। না আছে কোনো চাকার দাগ না আছে কোনো পায়ের ছাপ ৷ দু একটা dune কে bash করার পর মালুম হতে শুরু করল ড্রাইভার কি করতে চলেছে ৷ মরুভূমির গভীর থেকে গভীরতর জায়গায় যেতে থাকল গাড়ি ৷ একটা প্রায় চল্লিশ ফুট গভীর খাদে আড়া আড়ি স্কিড করে করে নামতে থাকল গাড়ি ৷ চাকাটা মাটি কামড়ে ধরতে চাইছে কিন্তু শুকনো মিহি বালিতে কিছু করতে পারছে না। সরসরিয়ে খাদে নেমে যাচ্ছে আর সেই ঘর্ষণের ফলে গাড়ির একটা পাশ ছিটকে আসা বালির ছটায় অন্ধকার ৷
ইন্দ্রানীর এমনিতেই গাড়ির স্পিডিংএ সমস্যা আছে ৷ এরকম ডিউন ব্যাশিং এর ছিরি দেখে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল যে
- ইঁহাসে নিকালনেকা রাস্তা কাঁহা হ্যায় ভাইসাব?
ভাইসাব এক গাল হেসে বললেন
- কুছ নেহি পতা...
ব্যাপারটা কি দারুন অ্যাডভেঞ্চারাস ছিল তা আমার পক্ষে ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব, তাই ওই অবস্থায় যে ভিডিওটা তুলতে পেরেছি তার লিঙ্ক দিলাম ৷ আর সঙ্গে রইল কিছু ছবি।
প্রায় মিনিট ১৫ ধরে এইভাবে ডিউন ব্যাশিং করার পর আমাদেরকে ড্রাইভার নৌফেল এনে ছেড়ে দিল মরুভূমির মাঝখানে একটা বিরাট টিলার ওপরে৷ সেই উচ্চতা থেকে মরুভূমিটাকে পুরোটাই দেখতে পাওয়া যায় ৷
অসাধারণ দৃশ্য! অসাধারণ অভিজ্ঞতা!
অনন্ত মরুভূমির মাঝখানে লালচে হলুদ বালির ওপর আমরা ছবি তুলতে আরম্ভ করলাম, বিভিন্ন রকম ভাবে বিভিন্ন রকম পোজে। তখন প্রায় সূর্যাস্তের সময়। তবে এদেশে সূর্যের আলো চলে যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। বিকেলবেলাটা তাই বেশি লম্বা। আমাদের ছায়া তখনও বেশ স্পষ্টভাবেই বালিকে ছুঁচ্ছে ৷ ছবি তোলার সময় বিভিন্ন পোজ দিতে গিয়ে সবথেকে ইন্টারেস্টিং যে পোজটা হলো, সেটা হচ্ছে চৈতালির বালিকেলি ('জলকেলি' শব্দের অনুপ্রেরণা থেকে নেওয়া) | আমাদের ফটোগ্রাফারদের মান রাখতে যে কত রকম ভাবে চৈতালী কে দিয়ে বালি ছোঁড়ানো হল তার ইয়ত্তা নেই ৷ তবে ওর এর আগে আবির ছুঁড়ে পোজ দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে ৷ ফলে খুব অসুবিধা হল না। ও ও শূন্যে বিভিন্ন ভাবে বালি ছুঁড়তে থাকল থাকলো আর আমরাও সেই খুব কম শাটার স্পিডে সেই বালুকণার গতিপ্রকৃতি ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা করলাম। তার কিছু নমুনা এখানে রইল।
ইন্দ্রানী-কে শান্তি দিয়ে ডিউন ব্যাশিং শেষ হল। কিন্তু যে রাস্তা ধরে চলতে থাকলাম সেখানেও ছোট ছোট অনেক বালিয়াড়ি ছিল। সেই বালিয়াড়িগুলো পেরোনোর সময় ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তায় জানতে পারলাম যে অন্যান্য ট্রাভেল এজেন্টরা এই সমস্ত ছোট ছোট বালিয়াড়িতেই ডিউন ব্যাশিং করায়। আমরা মরুভূমির যে গভীর অঞ্চলে গিয়েছি সেখানে সবার যাওয়ার অনুমতি নেই ৷ মাত্র দুটি ট্রাভেল এজেন্সির সেখানে যাওয়ার অনুমোদন আছে ৷ তাদের মধ্যে, আমরা যাদের সাথে গিয়েছি, সেই ওরিয়েন্ট ট্রাভেলস হল একটি ৷ কিছু সিলেক্টেড স্পেশালি ট্রেইনড ড্রাইভার ছাড়া এখানে গাড়ি নিয়ে আসার ছাড়পত্র অন্য কারোর নেই কারণ এই ড্রাইভিং স্কিল সবার থাকে না ৷ সেই লেভেলের ড্রাইভিং স্কিল না থাকলে এখানে যে কোন রকমের দুর্ঘটনা যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে এবং এক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটা মানে এখানে মৃত্যু নিশ্চিত ।
যা বলছিলাম, ফেরার পথে ছোট ডিউনস প্রচুর৷ সেগুলো পেরানোর সময় আমরা লক্ষ্য করলাম সারে সারে গাড়ি দাঁড়িয়ে ৷ তার আশেপাশে অনেক ডিউন ব্যাশিং চলছে ৷ আর পাশে রয়েছে অনেক ছোট ছোট ক্যাম্প ৷ সেখানে এত লোক যে তিল ধারনের ঠাঁই নেই ৷ শুধু গাড়িতেই নয়, আবার quad bike - এও বাইকেও ডিউন ব্যাশিং হচ্ছে। আমাদের ড্রাইভার আমাদেরকে জানালো যে সাধারণত খুব সাধারণমানের ডিউন ব্যাশিংগুলো এখানেই হয়ে থাকে ৷ আমরা যে ডিউন ব্যাশিং করলাম সেটা একটা রেয়ার এক্সপেরিয়েন্স | এটা সবাই পায়না ৷ আমরা ওর কথায় বিশ্বাস করতাম না ৷ কিন্তু যেহেতু অরিন্দম চৈতালিরাও আগে এরকম ডেসার্ট সাফারিতে এসেছে, অন্য কোনো এজেন্সির মাধ্যমে, ওদের সেই অভিজ্ঞতা খুব একটা মধুর নয় ৷ তাতে টাকা হয়তো অনেকটাই কম লেগেছিল কিন্তু আজ এই ড্রাইভারের মাধ্যমে এখনো পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা আমরা সঞ্চয় করলাম, আগেরটা তার ধারে কাছেও সেই ছিল না বলে ওরা স্বীকার করল ৷ এরপর আমরা গাড়িতে করে ফিরতে রইলাম শারজা থেকে আবার দুবাইয়ের দিকে ৷ ডিউন ব্যাশিং শারজাতে হলেও ক্যাম্পিং হবে দুবাইয়ের মরুভূমিতে।
আসলে শারজা হল খুব রক্ষণশীল এমিরেট ৷ এখানে অ্যালকোহল এবং বেলি ডান্স অনুমোদিত নয় ৷ এর অনুমোদন রয়েছে দুবাইয়ে ৷ সুতরাং আমরা যত রকমের ফুর্তি করব সেগুলো হবে দুবাইয়ের মরুভূমির ক্যাম্পে ৷
ফুর্তির অঙ্গ হিসেবে এই ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ হবে একদল উটের ৷ আমাদের ড্রাইভার আমাদেরকে জানালেন যে এবার তিনি উটের খোঁজে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছেন ৷ মিনিট দশেক ধরে আবার তথাকথিত পাতি ডিউন ব্যাশিং করতে করতে করতে উটের দলের খোঁজ চলল। অবশেষে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ হলোএক দঙ্গল উটের ৷ সেই উটেরা সব একসাথে রয়েছে এবং এরা কারো প্রতিপালিত উটের দল ৷ যাতে বেশি দূর চলে না যেতে পারে দেখা গেল সেজন্য এদের প্রত্যেকেরই সামনের দুটো পা কাপড় দিয়ে বাঁধা ৷ আমার দাঁড়ালাম | ওদের কাছে গেলাম। এই উটেরা কিন্তু মানুষদের বিশেষ ভয় পায় না ৷ বুম যখনই একটা উটকে আদর করতে আরম্ভ করল সে ঝোপের কাঁটা বেছে বেছে খাওয়া থামিয়ে চোখ বুজে দিব্যি বুমের হাতের আদর নিতে থাকলো ৷ আমরা সেই উটটির নাম দিলাম 'মহেশ' ৷ তিনি একটি উট যাঁকে আদর করলে আহ্লাদে গলে পড়ার জোগাড়!
এই উটের দলের সঙ্গেও চলল খানিকক্ষণ ফটোগ্রাফি সেশন। তারপর পড়ন্ত রোদে আমরা উটদেরকে বিদায় জানিয়ে উঠলাম গাড়িতে ৷ এবার গন্তব্য ডেজার্ট ক্যাম্প ৷ শুনেছি সেখানে অন্য অনেক কিছুর সাথে উটের পিঠে চড়ার ব্যবস্থাও আছে ৷
(চলবে...)







No comments:
Post a Comment