অরিন্দম এক দশকের ওপর হল দেশ ছেড়েছে। প্রথম গন্তব্য ছিল সৌদি আরবের জেদ্দা ৷ তারপর গত দেড় বছর হল সেখান থেকে দুবাই - এ ৷ জেদ্দাতে থাকাকলীন আমরা যেতে পারিনি ৷ ওখানে প্রবেশ নিষেধ ছিল। তারপর দুবাইতে আসার পর থেকেই আমাদের যাওয়ার জন্য বলেই চলেছে। নানান প্রতিবন্ধকতা কাটানোর পর ঠিক হয়েছিল এবার পুজোর ছুটিতে ঘুরে আসব ৷
এদিকে বাবার বয়সজনিত সমস্যা বাড়ছে। কিছুদিন আগেই নার্সিংহোম থেকে ফিরেছেন ৷ সকালে একরকম থাকেন তো বিকেলে আর একরকম৷ সে সমস্যা পুজোর আগে বাড়বে বই কমবে না। পুজোর সময়ে বুমের কলেজেও ছুটি নেই সেভাবে ৷ ফিফথ সেমিস্টার শুরু হওয়ার আগে এখন মাস খানেক ব্রেক পাবে৷ অরিন্দমদের এর কাছে গেলে মিনিমাম দশদিনতো লাগবে। পুজোতে ও-ও খুব লম্বা টানা ছুটি পায় না। কিন্তু ঈদ উপলক্ষ্যে ওর হাতে দিন আষ্টেকের ছুটি। সব ভেবে চিন্তে দেখা গেল বুমের ফোর্থ সেমের ফাইনাল শেষ হওয়ার পরদিনই বেরিয়ে গেলে সব দিক রক্ষা হয়। সে ক্ষেত্রে যা রক্ষা হবে না তা হল বহুকষ্টে জমানো টাকা ৷ আমাদের যে অনেক আছে তা নয়। তার ওপর নেহাতই খরচার হাত। তবু কুড়িয়ে বাড়িয়ে যতটুকু আছে তার ওপরেই যা যতটুকু মায়া। ছোটবেলায় একজন হাত দেখে বলেছিলেন, "অর্থ-সম্পদ অনেক থাকবে তা নয়, তবে অভাব কোনোদিন হবে না।" তাই-ই একমাত্র বল ও ভরসা।
তারপর আবার গত ছয় মাসের একটি মাসে চারজনের মৃত্যু আমাকে সবদিক থেকে বেশ নাড়িয়ে দিয়েছে। আরও দু'জনের মৃত্যুসংবাদ আরো ক'মাসে ৷ অর্থ থেকেও অনর্থ যখন হচ্ছে, তখন জমিয়ে লাভ কি! কাল কি হবে কে জানে! তাই অর্থের দিকে না তাকিয়েই আমরা ঠিক করলাম যে ঘুরেই আসি ৷ তারপর যা হবে দেখা যাবে।
চৈতালী -অরিন্দমকে সে খবর জানাতেই ওরা তো সাজ সাজ রবে আমাদের পৌঁছানোর জন্য যাবতীয় রিসার্চ ও সাহায্য করতে থাকল ৷ শুরু হল খোঁজ খবর |
দেশের বাইরে যেতে গেলে সবচেয়ে শুরুত্বপূর্ণ হল সঠিক ফ্লাইট পছন্দ ও স্থির করা। দেখা গেল, মুম্বাই থেকে দুবাই এর ফ্লাইট সবচেয়ে সস্তা। কিন্তু মুম্বাই পর্যন্ত ট্রেনে করে যেতে হবে। ট্রেন-এ টিকিটএবং ধকল সব যোগ করে দেখা গেল কলকাতা থেকে নো-ট্রানসিট ফ্লাইটে করে গেলে সেই হরে দরে হাঁটুজল। আর এক উপায় যে, ট্রানসিটে গেলে দিল্লী হয়েও যাওয়া যেতে পারে ৷ কিন্তু সেই মুম্বাই হোক বা দিল্লী, অনেক ঘন্টা ওয়েটিং। এর পর আছে ভিসার ঝামেলা। বেশ কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স স্টাডি করে দেখা গেল এমিরেটস এয়ারলাইন্স-ই সব দিক থেকে ভাল ৷ ভিসার অ্যাপ্লিকেশন ওদের পোর্টাল থেকেই অনায়াসে করা যায়। শুধুমাত্র ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডে টাকা দিতে হবে এবং সেটা ইন্টারন্যাশনাল কার্ড হওয়া বাধ্যতামূলক ৷
আর তা না হলে কলকাতার রেনে টাওয়ারস -এ সব জরুরী ডকুমেন্টস (পোসপোর্ট , আধার, ফ্লাইট টিকিট উইথ রিটার্ন, প্যান ও পাসপোর্ট ফটো) অরিজিন্যাল নিয়ে গিয়ে সকাল সকাল লাইন দিতে হবে ৷ ওখান থেকে দুবাই এর ট্যুওরিস্ট ভিসা করাতে হলে মাথাপিছু আলাদা করে টাকা লাগে ভিসা চার্জেস ছাড়াও।
আমাদের সে সব করতে হয়নি। এমিরেটস এয়ারলাইন্স-এই খুঁজে-পেতে যাওয়া-আসার টিকিট একসঙ্গে বুক করলাম। টিকিট ফাইনাল হল । দিন তিনেক পরে সব ডকুমেন্ট স্ক্যান করে ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করা হল অনলাইনে, ওই এমিরেটস এয়ারলাইন্স এর পোর্টাল থেকেই ৷ মিনিমাম এক মাসের জন্য (৩০ দিন) ট্যুওরিস্ট ভিসা হয়, সংযুক্ত আমীর শাহিতে (UAE)৷
তিনদিনের মধ্যে ভিসার কপি অ্যাপ্রুভড হয়ে ই-মেইলে চলে আসে, কোনো ডিসপিউট না থাকলে।
তার পরের ধাপ কারেন্সি একচেঞ্জ৷ যে কোনো এয়ারপোর্ট এ অনেক কারেন্সি এক্সচেঞ্জ আছে ৷ অথেনটিকও৷ কিন্তু সেলিং রেট অনেক বেশি। তাই যতটা দরকার সেইমত একটা হিসেব রাফলি করে নিয়ে সেটা এখান থেকে একচেঞ্জ করে নিয়ে যাওয়াই ভাল ৷
বাড়িতে বসে একচেঞ্জ পেতে হলে সরাসরি যে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে তাদের সাহায্য নিতেই পারেন ৷ আর না হলে কলকাতার আমেরিকান লাইব্রেরীর (USIS) পাশের রাস্তায় একটি এক্সচেঞ্জ কাউন্টার আছে, যাঁরা ভাল রেট দেন।
HUBERT MONEY CHANGER PVT LTD
Contact No: +9198306 56748
এক্সচেঞ্জের জন্য যা যা hard copies লাগবে:
Passport, PAN, Aadhar, Visa, Ticket
এখানে বলে রাখা ভাল money exchanger রা whatsapp বা ই-মেইলে উপরের নথি ও তথ্যগুলি চাইলেও না দেওয়াই ভাল ৷ টাকা এক্সচেঞ্জের সময়ে হার্ড কপি দিয়ে দেবেন বলে জানিয়ে দেবেন।
এক একটি পাসপোর্ট আর ভিসা প্রতি এক্সচেঞ্জ লিমিট হল টাকা ৫০,০০০/- | অর্থাৎ ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে দ্যিহ্রাম পেতে গেলে তিন জনের পাসপোর্ট ও ভিসা লাগবে। আইনতঃ এটাই এখান থেকে ম্যাক্সিমাম নিয়ে যাওয়া যায় ৷ তার বেশি প্রয়োজন হলে ওখানে গিয়ে সেদেশে বেশি রেটেই ভাঙ্গাতে হবে ৷
আস্তে আস্তে আমাদের যাওয়ার দিন চলে এল। দুবাইতে ভাল রেওয়াজী মাটনের ভারি আকাল ৷ তাই কয়েক কেজি মাটন এখান থেকে রেঁধে ফ্রোজেন অবস্থায় কেবিন লাগেজে নেওয়া হল। এমিরেটস এয়ারলাইন্স জন প্রতি ২৫ কেজি চেকড ইন আর আরও ৭ কেজি কেবিন লাগেজ হিসেবে অনুমোদন করে। অন্যান্য এয়ারলাইন্স অনেকেই টিকিট সস্তা দেখালেও লাগেজের জন্য আলাদা করে চার্জ করে এবং সেটা বেশ অনেকটাই ৷ সঙ্গে হঠাৎ করে নিয়ম বের করে কনফিউশন ও হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হয। আবার ওজনের আপার লিমিট পয়সা দিয়েও জন প্রতি অনেক কম। এমিরেটস এয়ারলাইনস বেছে নেওয়ার এটা একটা অন্যতম কারণ ছিল যে, এদের এত হিডেন কস্ট নেই।
কলকাতা ইমিগ্রেশনএ রান্না করা মাটনকে কোনো পাত্তাই দিল না। কিছু না জিজ্ঞেস করেই ছেড়ে দিল। বুমকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন অবশ্য, অন্য প্রসঙ্গে - কেন যাচ্ছ ? আগে বিদেশে গেছ কি না ইত্যাদি ৷
বোয়িং বিমানে এই প্রথম উঠলাম ৷ বিশাল বড় ৷ অনেক সীট ফাঁকা পড়ে রইল। আমরা পছন্দের সীট পাওয়ার জন্য আলাদা করে গাঁটের কড়ি খরচ না করলেও সীট আমাদের এরা দিতই ৷ দিতে ওরা বাধ্য ৷ হয়ত পছন্দের হত না। কিন্তু দিত তো ! প্রতি সারিতে দশটি করে সীট৷ ভরপুর ইনফোটেইনমেন্টের আয়োজন। প্রত্যেকের সামনে ১০ ইঞ্চির টিভি স্ক্রিন ৷ সাথে হেডফোন ৷ গান -সিনেমা -খবর -খেলা- পডকাস্ট , সব আছে। আছে পোর্টেবেল গেমিং কনসোলও৷ তার সাথে লাইভ ফ্লাইট ডিটেইলস উইথ ক্যামেরা ৷এমিরেটস এর টিকিট বুক করার সময়ে এমিরেটস এর ফ্রি মেম্বারশিপে সাবস্ক্রাইব করলে ফ্লাইটে থাকাকালীন on air wifi ও পাওয়া যায়।
বোয়িং বিমানে এই প্রথম উঠলাম ৷ বিশাল বড় ৷ অনেক সীট ফাঁকা পড়ে রইল। আমরা পছন্দের সীট পাওয়ার জন্য আলাদা করে গাঁটের কড়ি খরচ না করলেও সীট আমাদের এরা দিতই ৷ দিতে ওরা বাধ্য ৷ হয়ত পছন্দের হত না। কিন্তু দিত তো ! প্রতি সারিতে দশটি করে সীট৷ ভরপুর ইনফোটেইনমেন্টের আয়োজন। প্রত্যেকের সামনে ১০ ইঞ্চির টিভি স্ক্রিন ৷ সাথে হেডফোন ৷ গান -সিনেমা -খবর -খেলা- পডকাস্ট , সব আছে। আছে পোর্টেবেল গেমিং কনসোলও৷ তার সাথে লাইভ ফ্লাইট ডিটেইলস উইথ ক্যামেরা ৷এমিরেটস এর টিকিট বুক করার সময়ে এমিরেটস এর ফ্রি মেম্বারশিপে সাবস্ক্রাইব করলে ফ্লাইটে থাকাকালীন on air wifi ও পাওয়া যায়।
দিনের ফ্লাইটে অনেক কিছু জানলা দিয়ে দেখা যায়। ফলে মন স্ক্রিন থেকে বারবার জানলায় চলে যাচ্ছিল। চল্লিশ হাজার ফুট ওপরে মাইনাস 39 ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে দিয়ে ওড়ার অভিজ্ঞতার থ্রিলই আলাদা ৷সেই নেশা কে আরও গভীর করার জন্য এল লাঞ্চ উইথ আনলিমিটেড ড্রিঙ্ক চয়েজেস। লাঞ্চে ছিল:
Sweet Corn Potato Chaat, Prawn Roast, Vegetable Kofta Curry, Gulab Jamun (3 pcs each), Chocolate,
With a choice of wines (Red and white, beers, spirits, fruit juices, soft drinks, followed by tea and coffee)
সোয়া চারঘন্টার উড়ানে একজন মানুষ আর কি পেতে পারত, আমার জানা নেই ৷
দুবাই এয়ারপোর্টে নামার মিনিট পনেরো আগে থেকেই সমুদ্র আর স্থলভাগের মেশার লাইন থেকেই দৃশ্যত: বিস্ময়ের শুরু৷ বার্ডস আই ভিউ ফ্লাইট থেকে - যেখানে আইল্যান্ড কেটে কেটে কোলাজ করে একটা ওয়ার্ল্ড ম্যাপ তৈরী করা হয়েছে, সেখান থেকে ৷ নাম Dubai World Map | যা দেখেছি তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাই ছবি দিলাম।
দুবাই এয়ারপোর্টে নামার পর অতি সহজ ইমিগ্রেশন | ইমিগ্রেশন শেষ হলে ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকেই du নামক মোবাইল কোম্পানি ফ্রিতে একটি সিমকার্ড দেয়, এক ১০ মিনিট কল আর এক জিবি ডেটা সমেত ৷ এর ভ্যালিডিটি ২৪ ঘন্টা ৷ তারপর প্রয়োজনে কেউ রিচার্জ করতে পারেন ৷ ওখানে সব শপিং মলেই du এর কাউন্টার আছে। তবে ঐ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে, আমি শুধুমাত্র আমার ফোনটা আমাদের এখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল প্রিপেড রোমিং রিচার্জ করে নিয়ে গিয়েছিলাম ৷ এয়ারটেল ১০ দিনের জন্য ১০০ মিনিট ভয়েস কল (incoming+outgoing মিলিয়ে) আর ১.৫ জিবি ডেটার জন্য আলাদা করে ৮৯৯ টাকা নেয়। এই প্যাক বিদেশের মাটিতে পা রাখলে সেই দিন ও সময় থেকে অ্যাকটিভেটেড হয়। সুতরাং দু'তিন দিন আগে রিচার্জ করে রাখাই যায়। ভয়েস কল ও ডেটা সার্ভিস খুবই ভাল ৷ আর ওখানে যেহেতু সর্বত্র ওয়াই ফাই এর ছড়াছড়ি, তাতে এই মিনিমাম রোমিং প্যাক যথেষ্ট ৷ তবে ওখানে হোটেল বাদ দিয়ে সব জায়গায় ওয়াই ফাই কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য ফ্রি হলেও, সবসময়ের জন্য ফ্রি নয়।
দুবাইতে হোয়াটস অ্যাপ কলস (ভয়েস ও ভিডিও) ব্যবহার বে-আইনি ৷ ভয়েস নোটস ও টেক্সট পাঠানো যায় ৷ ভয়েস ও ভিডিও কলের জন্য ওখানকার মোস্ট ইউজড লিগ্যাল প্ল্যাটফর্ম হল BotIM (বট আই এম , চলতি ভাষায় 'বটিম') | যিনি যোগাযোগ করবেন ও যাঁকে যোগাযোগ করবেন, দুপক্ষকেই এই অ্যাপ ইন্সটল করে রেজিস্টার করতে হবে। দেশ ছাড়ার আগে এটা করতে ভুলবেন না। কখন কোথায় দরকার হয় কে বলতে পারে!
সিঙ্গাপোরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট পৃথিবীর সর্বশ্রষ্ঠ এয়ারপোর্টগুলোর মধ্যে একটি। সেখানেও গিয়েছি ৷ চাঙ্গি সর্বশ্রেষ্ঠগুলোর অন্যতম হলেও দুবাই-এর মত এমন চোখধাঁধানো নয় ৷ আর সবথেকে বড় কথা, গত ন'বছর ধরে World's busiest airport তকমা ধরে রাখা সত্ত্বেও এখানে কাউকে সেভাবে কোনো লাইনে দাঁড়াতে হয় না। মিনিট পাঁচেক যা লাগে শুধু ইমিগ্রেশনে।
লালমোহন বাবুর মত অবাক হয়ে হাঁ করা অবস্থাতেই লাগেজ নিয়ে চললাম অপেক্ষারত চৈতালী - অরিন্দমের সঙ্গে ওদের গাড়ির দিকে ৷
বাইরে তেতাল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রার মধ্যে দিয়ে ছুটছে গাড়ি, ওদের বাড়ির দিকে৷ গাড়ির গতিবেগ ১১০ কিমি/ঘন্টা ৷ দুপাশে মরুভূমি ৷ তাতে ছোট ছোট ঝোপ ৷ মনে একটা কথাই ভেসে উঠল...
"ওরা কি কাঁটা বেছে খায়?"









No comments:
Post a Comment