মিউজিয়াম অফ দ্য ফিউচর থেকে বেরিয়ে সেদিন আমরা প্ল্যান করেছিলাম যে মেট্রোতে চেপে দুবাই মল পর্যন্ত যাব। পাব্লিক ট্রানসপোর্টে একটা অভিজ্ঞতা লাভ করার জন্য। সেখান থেকে বিকেলে আমদের নিয়ে নেবে অরিন্দম-চৈতালী ৷
বাইরে তখন ৪৩ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রা ৷ হিট যে ড্রাই তা নয়। যথেষ্ট হিউমিড৷ তার সঙ্গে সারাদিনই হালকা বালির ঝড় চলতেই থাকে ৷ ফলে একটা ঝাপসা ফিল্মের মত কিছু থেকেই যায় যা আবহাওয়াকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার হতে দেয় না। তবে তা কখনই তা সূর্যের দাবদাহকে আটকাতে পারে না। ভরসা এই যে সে তাপ চামড়াতে চিড় বিড়ানি জ্বলন সৃষ্টি করে না আর মিউজিয়াম থেকে মেট্রো স্টেশন একটুখানি হাঁটা পথ - এক্সাইডের মোড় থেকে এলগিন রোডের মোড় অব্দি যতটা, মোটামুটি ততটাই ৷ ওখান থেকে দুবাই মল দুটো স্টেশন৷ ড্রাইভারবিহীন ট্রেন ৷ ড্রাইভিং এর সেই প্রথম কেবিনের অভিজ্ঞতা লাভ করতে হলে মাথাপিছু মিনিমাম ভাড়া এমনি ভাড়ার আড়াই গুণ ৷ কলকাতা মেট্রোর নতুন রেকগুলো যেমন সুদৃশ্য , সেরকমই৷ মেট্রোর জার্নি অকল্পনীয় কিছু ছিল না। অকল্পনীয় ছিল মেট্রোর বাইরেটা। তবে মেট্রোর স্পিড ৪০ থেকে ৬০ কি.মি প্রতি ঘন্টা আর পাশের রাস্তায় ভরা শহরে গাড়ি ছুটছে ১২০ কি.মি. প্রতি ঘন্টায় ৷
নানারকম দুবাই স্কাইলাইন দেখতে দেখতে পৌঁছালাম আমরা দুবাই মল স্টেশনে ৷ স্টেশন থেকে দুবাই মলে যেতে খোলা রাস্তায় নামতে হল না। এয়ারকন্ডিশনড স্কাইওয়াক ৷ ধারণার বাইরে ছিল যে এরকম স্কাইওয়াক দিয়েই মিনিট পনেরো টানা হাঁটতে হবে ৷ তবে সেখানেও সুবিধা যে তাড়া না থাকলে হাঁটার প্রয়োজনই নেই। পর পর ওয়কিং বেল্ট ৷ একটা ছেড়ে আবার পরেরটাতে উঠে পড়লেই হল। এরকম মোট পাঁচটা বেল্ট পেরিয়ে দুবাই মলে প্রবেশের পথে এসে পৌঁছালাম ৷
আগেই বলেছি যে ঈদের মরশুম বলে শহরের চারিদিকে মানুষের বেশ ভিড় ৷ প্রবেশের পথেই পর পর ছোট ছোট 'স্যুক ' | 'স্যুক ' মানে যেখানে শপিং-সুখ পাওয়া যায়, অর্থাৎ কিনা 'দোকান' | প্রবেশের পথে থাকা দোকানগুলো দেখে মনে হল যে ওই অংশটা আধুনিক ও সভ্য ধর্মতলার ফুটপাত ৷ অনায়াসে দরদস্তুর করা যায় ৷ ছোটু যেহেতু আমাদের থেকে এই শহর ও তার বাজার সর্ম্পকে বেশ অভিজ্ঞ, আমরা ওর মতামতের ওপর ভরসা করলাম। একটি বুমের বয়সী ছেলে আমাদের তার দোকানে ঢোকাল ৷ তারপর আরবের পারফিউম অফারে ভালই দাম বলল ৷ আমরা আর একটু মার্কেট ঘুরে বুঝে তারপর সবার জন্য কেনাকাটি শুরু করব স্থির করেছিলাম। হাসিমুখে 'না' বলে বেরিয়ে আসব, ইন্দ্রানী একটা যুক্তিযুক্ত কথা বলল (যেমন বেশিরভাগ স্ত্রী রা শপিং-এর সময়ে বলে থাকে)
- পৃথিবীর সবথেকে বড় মলে আবার ঠিক এই জায়গায় পরে ফিরে আসতে কিন্তু বেশ মুশকিল হবে।
ততক্ষণে দোকানের ছেলেটি আবার আমাদের দিকে ফিরে বলে কি না
- হোয়াত হ্যাপেন্দ ... ইউ আর ফ্রোম হোয়্যার?
বুম বলল
- ইন্ডিয়া
- ওওও.... ইন্দিয়াআ... মিস্তার নরেন্দ্র মোদী... ওয়েল আই গিফ ইউ আনাদার ওয়ান...
সত্যিই দুবাই মল আর হাওড়া জেলা বোধ হয় একই সাইজের ৷ আরও মিনিট দশেক লড়াইএর পর আমরা ফুড কোর্ট এবং অরিন্দম চৈতালীকে খুঁজে পেলাম ৷ ভিড়ের চোটে তিল ধারনের জায়গা নেই। চেয়ার ফাঁকা পেলেই অন্য লোকে টেনে নিয়ে চলে যাওয়ার তালে আছে ৷ আমরা সেখানে সারভাইভ করে বহুদিন ধরে বহুচর্চিত আল বেইক এর নানা রকম খাবার পরখ করে দেখতে লাগলাম ৷ আল বেইক হল গিয়ে ওখানকার কেন্টাকী ফ্রায়েড চিকেন (কে-এফ -সি ) র জাতভাই ৷ সবারই এত খিদে পেয়েছিল যে হুশ করে খাবার উদরস্থ হল। প্রথম একদিনেই বুঝেছিলাম ওখানে পানীয় জল বড্ড দামী৷ তাই আমার কাজ ছিল ভিস্তির ৷ ফ্রিজে ঠাণ্ডা করা তিন চার লিটার জল কাপড়ে মুড়িয়ে রোজ ব্যাকপ্যাকে নিয়ে বেরোতাম ৷ সঙ্গে থাকত ক্যাপ আর সানগ্লাস | শেষের দু'টো র প্রয়োজন সেভাবে না হলেও জলের আইডিয়াটা খুব কাজের বলে প্রমাণিত হয়েছে বারে বারে ৷
ওখান থেকে বেরিয়ে অরিন্দম চৈতালী আমাদের নিয়ে চলল পাম জুমেইরা তে ৷ পাম জুমেইরার তাল গাছের মত আকৃতির ম্যানমেড আইল্যান্ড শুধু এরিয়াল ভিউতেই পাওয়া যায় ৷ গ্রাউণ্ড লেভেল থেকে সেই ভিস্যুয়াল ওয়ান্ডার প্রত্যক্ষ করা অসম্ভব ৷ ফ্লাইট টা দুবাই এয়ারপোর্টে নামার আগে দুবাই ওয়ার্ল্ড ম্যাপ আইল্যান্ডের ওপর দিয়ে উড়ে এসেছিল বলে দেখতে পেয়েছিলাম ৷ কিন্তু পাম জুমেইরা আমরা জানলা দিয়ে দেখতে পাই নি।
পাম জুমেইরা যাওয়ার পথে আমরা গেলাম পৃথিবীর অন্যতম সেভেন স্টার হোটেল আটলান্টিসের পাশ দিয়ে৷ সারা পৃথিবীতে অন্যান্য প্রাইম হোটেল স্বঘোষিত সেভেন স্টার | কিন্তু আটলান্টিস ওসব দাবীর পথে হাঁটে না। এমনিতেই তাকে এই রেটিং দেওয়া হয়েছে। শাহরুখের হ্যাপী নিউ ইয়ারের লোকেশন ছিল এই আটলান্টিস ৷আটলান্টিস পেরিয়ে পড়ল আনডারগ্রাউণ্ড টানেল | আসলে সেটা আন্ডার সি টানেল, মানে সমুদ্রের নীচ দিয়ে চলে যাওয়া টানেল। পাম জুমেইরা ব্যাণ্ড স্ট্র্যান্ড টা ফাঁকাই বলা চলে ৷ জনমনিষ্যি কম । স্ট্র্যান্ডের একপাশে পরপর সুদৃশ্য লালচে বালির রঙের বাংলো আর একদিকে সমুদ্র ৷ আর সূর্যাস্তের আলোয় দূরে দেখা যাচ্ছে Marina স্কাইলাইন |
অরিন্দম-চৈতালী ওখানে থাকার সুবাদে আমাদের দুবাই শহরের এমন সব জায়গায় নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়েছে যেখানে ট্যুরিস্টরা সাধারণত সময়ের অভাবে গিয়ে উঠতে পারেন না। পাম জুমেইরা সবার কাছে প্রাইম স্পট নয় বটে, তবে আট্লান্টিস হোটেল দেখা, সমুদ্রের নীচ দিয়ে চলার সময়ে কান বন্ধ হয়ে যাওয়া, প্রাসদোপম বাংলোর সারির পাশে দাঁড়িয়ে পারস্য উপ সাগরের ভারিনোনা বাতাসে দরদরিয়ে ঘেমে ওঠা -- এ সবের মধ্যে আমরা একটা থ্রিল অনুভব করলাম বটে।
(চলবে)





No comments:
Post a Comment