Tuesday, 28 January 2025

রাজগীর ভ্রমণ: পর্ব অষ্টম: নালন্দা ৫

আমরা ধীরে ধীরে পৌঁছালাম রাজগীর ভ্রমণের নবম অধ্যায়ে আর নালন্দা ভ্রমণের পঞ্চম পর্বে। 


আমাদেরকে গাইড সিং-জি বললেন

“ঐ যে সামনে বিশাল প্ল্যাটফর্ম দেখছেন, ওটি হলো উন্মুক্ত স্থানে ধ্যান ও উপাসনার জন্য। ওপেন এয়ার মেডিটেশন-এর উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। এ তো আপনারা জানেনই যে ধ্যান বা মেডিটেশনই হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের মূল কথা। নালন্দাতেও তাই ছিল।  নালন্দা তো বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পূর্বে আসলে ছিল বৌদ্ধ বিহার। এখানে ভিক্ষুকরা থাকতেন সাধনার জন্য। ওনাদের জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল ধ্যানের মাধ্যমে নির্বাণ প্রাপ্তি। যে জন্য ঐ উন্মুক্ত স্থানের নির্মাণ।

বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপণের আগে এখানে অধ্যয়ণ হত না তা নয়। ওই সময় নালন্দার শিক্ষণীতি তিন ভাগে বিভক্ত ছিল:

১) অধ্যায়ন 

২) অভ্যাস 

ও 

৩) অনুভূতি 

লার্নিং, প্র্যাকটিস এন্ড রিয়েলাইজেশন।  


এই ধরনের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য ছিল স্বাভাবিক মানুষের বাস্তব জীবনধারণের সময় যাতে ঐ আহরিত  বিদ্যার প্রত্যেকটির যথাযথ ফলিত প্রয়োগ ঘটে। মানে সহজ কথায় এই বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র জ্ঞান আহরণের জন্যই ছিল না, বাঁচতে গেলে চলার পথে ঐ বিদ্যার্জন জরুরী বলে এখানকার পণ্ডিতদের মনে হয়েছিল। পরে যখন এখানে ধীরে ধীরে আরো অনেক বিহার গড়ে উঠলো, তখন এর নাম হলো “নালন্দা মহাবিহার"। এই পুরো জায়গাটির আসল নাম কিন্তু এখনো “নালন্দা মহাবিহার"-ই  রয়ে গেছে।


বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পরে তখন তার আগে পর্যন্ত এখানে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছিল সেই সবই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে ঢুকে গেল। বিদ্যার যে সমস্ত বিভাগের চর্চা তখন বিশ্বখ্যাত ছিল, 

সেগুলি হল:  

Logic, Grammar, Medicines (Ayurveda), Arts, Fine-arts, Metaphysics, Astronomy, Vedas, Hinayan, Mahayan, and other Buddhist philosophies.

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রাধাকুমুদ মুখার্জির মতে 

‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রোজ একশোর মত লেকচারের আয়োজন করা হতো। বিভিন্ন বিষয়ের দর্শণ ও ধর্মের সাথে সে সবের যোগযোগ : আলোচনায় সেই দিকগুলি প্রধাণ ছিল। এছাড়া কলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত ছিল নালন্দা। মূর্তিনির্মাণকলা এখানকার বিশ্ববিখ্যাত এক শিল্প ছিল।' আশেপাশের দেওয়ালে তার নিদর্শণ স্পষ্ট। পড়াশোনার যে ধরন ছিল তাতে ফরমাল লেকচার ছাড়াও চলত learning by discussion and interrogation।  হিঊ-এন্- সাং তা নিজের লেখায় তা বর্ণনা করেছেন। দলাই লামা পরে একেই ‘সায়েন্স অফ মাইন্ড’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।


নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুলপতিরা ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞ ও পন্ডিতদের অন্যতম। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম না বললেই নয়, তাঁরা হলেন, নাগার্জুন, আর্যদেব, অসঙ্গ, বসুবন্ধু, দিঙনাগ, ধর্মপাল, শীলভদ্র, ধর্মকৃতি, শান্তরক্ষিত ও পদ্মসম্ভব।  যখন হিঊ-এন্- সাং এখানে বিদ্যার্থী ছিলেন তখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুলপতি ছিলেন শীলভদ্র স্বয়ং।ওনার কাছ থেকে হিঊ-এন্- সাং যোগশাস্ত্র ও ভূমি সংস্কার সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন।হিঊ-এন্- সাং কিন্তু অত্যন্ত প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন। উনি তখনকার প্রথম দশজন বিদ্বানদের মধ্যে ছিলেন একজন। আর ওনার শিক্ষক শীলভদ্র ছিলেন প্রখ্যাত সংখ্যাবিদ। সমস্ত সংখ্যাতত্ত্ব শীলভদ্র গুলে খেয়েছিলেন। সাথে আবার উনিই নালন্দার  highest authority of yoga shastra ছিলেন।


দেখতেই পাচ্ছেন যে এখানকার লাইব্রেরী তো শেষ, কিছু অবশেষ ছাড়া। কিন্তু শীলভদ্রের লেখা একমাত্র পুস্তক “আর্য বুদ্ধভূমি ব্যাখ্যা”-র তিব্বতি অনুবাদ নেপালে সুরক্ষিত আছে। এমনিতে এই অনুবাদ এখন তিব্বত ও চীনের বিভিন্ন মন্দিরে পাওয়া যায়। এখানে (নালন্দায়) তো সব নষ্ট হয়েই গেছে, তবুও আমাদের সৌভাগ্য যে খোদ আসল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টাই আমাদের দেশে রয়ে গিয়েছে, যা কেউ কোনদিন এখান থেকে নিয়ে চলে যেতে পারবে না। আর দুঃখের বিষয় হলো এই যে, আমাদের নিজেদের দেশের এরকম একটা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা ও তথ্য আমরা পাচ্ছি একজন বিদেশি চৈনিক বিদ্যার্থী হিউ-এন্-সাং-এর বিবরণ থেকে; আমাদের দেশের কোন ব্যক্তি সেই সময় নালন্দা করে আলাদা কিছু এবং সুচারুরূপে বর্ণনা করে যান নি, বা তার তাগিদ ও গুরুত্ব উপলব্ধি করেন নি।”

আমরা এগিয়ে গেলাম গাইড কমলা সিং জির সাথে। সবাই এবারে এমন এক জায়্গায় দাঁড়ালাম যে তা অবাক করা। কমলা জি বলতে লাগলেন। আমরা তাঁর বর্ণনা অনুসারে মনে মনে ছবি আঁকতে থাকলাম, যার যার নিজের মত করে। 

“এখন আমরা দেখছি নালন্দার ক্লাসরুম।”


শিহরিত হলাম্। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।  আজ যে যে যা হয়েছি,করছি, বা ভবিষ্যত কে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, সবের শিক্ষা ওই 'ক্লাসরুম'।

রবীন্দ্র্নাথ ঠাকুর যে বিদ্যালয়ে যেতেন (কিছুদিনের জন্য), যে ক্লাসরুমে বসতেন, ডিরোজিও-র ক্লাস, সুভাষচন্দ্রের প্রেসিডেন্সি কলেজের করিডোর দিয়ে সাহেব পিটিয়ে বুক চিতিয়ে হেঁটে যাওয়া, নিজেদের ক্লাসের বিভিন্ন পর্যায়, সবটাই ‘ক্লাসরুম’-ভিত্তিক। কথায় বলে 'মানুষ গড়ার কারখানা'...সেই ক্লাসরুম্!!! 

একেবারে অন্যরকম ক্লাসরুম, যেখানে ন'শো বছর ধরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলেছিল। 

গায়ে কাঁটা দিলে আমার কি দোষ! 

বলে চলেছেন কমলা সিং: 

‘Bihar means a residential building for the Buddhist’ and ‘monastery means college unit or residence.’ 

দেখতেই পাচ্ছেন দুদিকে আছে রক্ষক দেবতার মূর্তি| সামনের ঘরটি হল মুখ্য পূজা/উপাসনাগৃহ, যেখানে বুদ্ধমূর্তি থাকতো। তখনকার রীতি অনুযায়ী প্রচলিত নিয়ম ছিল যে ছাত্র শিক্ষক নির্বিশেষে এই স্থান দিয়ে যাওয়ার সময় বুদ্ধমূর্তিকে প্রণাম করবে আর বৌদ্ধমন্ত্র উচ্চারণ করে বলবে 

‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি 

ধর্মং শরণং গচ্ছামি 

সঙ্ঘম  শরণং গচ্ছামি’ 

এটা একবার নয়। তিন তিনবার বলবে। 


এখানে বলে দিই যে এখন যে বিহারটিতে  আমরা দাঁড়িয়ে আছি তা হল আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য। সেই সময় এখানে রাজা ছিলেন রাজা দেওরাজ/দেবরাজ। সুমাত্রার রাজা বালপুত্র দেব এই বিহার নির্মাণের যাবতীয় খরচ বহন করেন। সেই নির্মাণের কাহিনী একটি তাম্রলিপি থেকে পাওয়া যায়। সেই তাম্রলিপিটি কলকাতার জাদুঘরে সুরক্ষিত আছে।  তাতে লেখা আছেযে রাজার দেবরাজ পাল পাঁচটি বিহারের মেনটেনেন্স, মানে এই বিহারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। এখানকার সে ই সময়ের হস্তলিপির প্রতিলিপি থেকে ষড়দ্বীপরাজ বালপুত্রদেবের উল্লেখ পাওয়া যায়।

এটুকু বলতে পারি যে এটা হচ্ছে বিহার সংখ্যা এক। এই বিহারের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট হল এটি ন’বার নষ্ট হয়েছিল এবং ন'বার পুনর্গঠিত হয়। নালন্দায় এত বেশি বার আর কোন বিহার নষ্ট হয়নি। না অন্য কোনো বিহার এতবার পুনর্গঠিত হয়েছে। এই বিহার হচ্ছে সেই স্থানের নিদর্শন যেখানে সব থেকে বেশি প্রতিস্থাপনের চিহ্ন অবশিষ্ট আছে।

পুনর্গঠন ও ন'টি স্তর সম্পর্কে গল্প আছে। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, (আঙুল দিয়ে দেখিয়ে)  প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্তর রয়েছে। বাকি ছয়টি স্তর কিন্তু নিচে আছে।  যখনই নতুন করে কোন স্তর তৈরি করা হবে, তখন তার নিজস্ব অস্তিত্ব তো নষ্ট হবেই। কিন্তু ভিত তো আর ফেলে দেওয়া যাবে না।  ফলের প্রতিটা স্তরেই নিচের দিকের একটু একটু করে পড়ে আছে। এই যে স্তরটি দেখছেন (আবার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে) এর নিচে কিন্তু আর মাটি নেই। আছে পুরাণো স্তর। নি:সন্দেহে স্তরগুলিকে আলাদা করে বোঝা খুব কঠিন। কিন্তু আমি যখন গাইড হিসেবে আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, যতটা পারব বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

বিহার সংখ্যা এক-এর পুরোটাই আগুনে পুড়ে ঝলসে গিয়েছিল। ঘরের দেয়ালে সেই আগুনে ঝলসে যাওয়ার চিন্তা খুব স্পষ্ট। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন ঘরের জানালায় কোনো পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন নেই। কারণ এই জানালাগুলি তৈরি হয়েছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে। অথচ এই বিহার প্রথম তৈরি হয়েছিল নবম শতাব্দীতে। তখন ঐ জানালাগুলি ছিল না। টাইমলাইন অনুসারে তাই এই জানালাগুলো জ্বলার কথা নয়। যখন কিছু জ্বলবে, সেটা তার রানিং পিরিয়ডেই জ্বলবে। পরে তো আর জ্বলবে না,  তাই না!  



আমি একটা ঘরের মধ্যে এতগুলো শতাব্দীকে ধরে রাখার রোমাঞ্চ্কর ইতিহাসটকুই আপনাদের বোঝাতে চাইছি। 

আসুন আমরা এগিয়ে যাই।”

একটা কথা বুঝতে বাকি নেই, যে খ্রিসমাসের আবহে নালন্দায় যে mass-এর সমাহার হয়েছে, আর তাতে ৯৫ শতাংশ লোক যেরকম জায়গাটিকে একটি অ্যামিউজ্মেন্ট পার্ক হিসেবে ধরে নিয়েছেন্, তাতে আমাদের মত একটি গ্রুপ্-কে পেয়ে আমাদের গাইড সাহেব তাঁর সবটুকু উজাড় করে দিতে চাইছিলেন। 

(চলবে)


Sunday, 19 January 2025

The Murder of Lokka:

The whole team of Bat-tala experienced mental break-down after the members had gathered together to decide to kill a mad dog. Everyone had a sleepless night. The decision was not easy and didn’t come easy, though. It had to travel a long discourse to reach this verdict. 

Among the six juries the most garrulous was Sambhu. Sambhu was a little childish in his ways, though he was the oldest one among the six friends who were all indispensable to one another despite many differences from different perspectives from social belonging to taste, from education to, of course, finance. However, it was amply time-tested that they shall continue to remain friends, whatever it took. At Sambhu’s back everyone discussed in the locality that due to his too candid nature, his  least intention to apply diplomacy and perpetual innocence, he could not make his life the way it should have been.

Naturally during the discussion on what to do with the dog, Sambhu put it in the simplest of manner, straight away, having no sign of emotion on his face. 

- Kill him. There is no other choice.

Keshto remarked, with an expression of outraged anger turned into apt replication and mimicry, 

- Kill him….Is it that easy dude? 

- Why not? Don’t pretend to be a saint.

- What… why? 

Raghu tried to soothe Sambhu, 

- Well, even if we ARE going to kill him, and what is to do there with this ‘saint’ thing?

- Don’t just budge and don’t let me open my mouth to all. 

- Why?... What has Keshto done?

Asked Tulu

- Ehhh….No, I need not tell you here, because you won’t believe me.

Nadu said,

- Tell us, Sam, I’ll treat you to a Gold Flake king size.

- No, I am ok with my bidis. And you are a liar. Last time you made me steal the ripe mangoes from the Mukhujje House and never treated the biriyani you had promised me. 

Kamal remarked, 

- Well, let it go Samu, I’ll keep his promise this time for him…Just tell us what has Keshto done? 

With the gradual and steady swells of Sambhu’s eyeballs everyone straightened their spines to welcome the blows through Kesho’s story from Sambhu. Everyone knew it would be less to remark on them as ‘arch rivals’.  Keshto was smiling at the situation, as if he had done nothing and all his friends would be enthralled to hear an exaggerated and a twisted version of the truth from Sambhu, on whatever he spoke forth. Everyone knew, save Sambhu, that another piece of pure humour was going to be created.    

Good creations always need inspirations. The best poker in the team was Kanto. He was very good to catch the right moment to prick the balloon. So he invariably added,

- C’mon Samu, tell us, else your fat belly would puff larger with vaults of secrets of people in it. Well lemme guess…Has Keshto kissed Pompa?

Kanto had mastered the art to scrape the truth out from the most stubborn man on earth who is not ready to speak out what is asked for. Kanto, with his edge of slicing a conversation with blatant lies, apparently inadvertent and wild guess to entrap that very man to blow out the naked truth straight, always won the mind game. To make Samu speak was just a cake walk for him.

  - All bull shit. What is kissing to do with killing a dog!!!

- No, I was just thinking that a lover has the guts to do anything because everything is fair in love and war.

This really was the switch to allow the flow of the sludge in a gush from Sambhu.

- No no …It is not all about the girl. 

- Then????

- Last day he had been to Maluapara.

- So what…anyone can go there. 

- …let me finish it…

- Who is stopping you? 

- You….

- Well don’t lie about him. He has done nothing. Anyone has the liberty to visit Maluapara and we all have some friends there too.

- Done nothing!!!! He had beef kebab with paratha. And you say that he has ‘done nothing’!!! Just think that a Hindu is having beef. What would his ancestors think of him? 

- What!!! Keshtooooo!!! YOU had BEEF!!!! Shame on you, Keshto!!! We should disown you as friends. Even your ancestors shall do the same. You have forced them to do it with such basic violation. 

Kanto delivered this with all the possible nuances possible in the climax of jatra. After taking a deep breath, suddenly he again poked Sambhu,

- Samu are we not going to tell Shyamal Kaku (Keshto’s father) about that? 

Kanto tried to raise the effect of the situation with his exceptionally melodramatic expression, again. Everyone laughed. This was crude humour and out of the way. However, Sambhu maintained a seriousness and added,

- We should. And now see, he is hesitating to kill just a mad street dog!!! He bloody has eaten the flesh of a whole ox and now being sentimental unnecessarily. Don’t you kill mosquitos? Don’t you kill hens and cocks? Don’t you kill fishes? Don’t you kill rats and mice and…

- Shut up, else I’ll kill you, now. 

said Keshto with frozen and sharp voice that was devoid of any sort of light air. When Keshto used to take a serious stand on anything he was quite good in making the other people around understand that with his abrupt change in the inflection.

Now the fact that the dog needs to be disposed of somehow is not liked by Keshto and everyone else, but Sambhu. Everyone expected that even Sambhu would understand in time when he gets the real reason behind it.  

Keshto always maintained, since his childhood, a different equation of relationship with all the local street dogs. He used to feed them all, daily, made a shade for them to rest, collected clothes for them in the winter. And among all the dogs Lokka was his most favourite one. Until a month ago, Lokka was quite like Snowy to Tintin. 

So, it was not an easy task to kill Lokka. They had to wrench their hearts out to plan for Lokka’s brutal murder. Everyone was concerned to take care of Lokka when he would be dying. 

Keshto said,

- He should not suffer much of pain when he would be killed. 

Everyone agreed that pain is inevitable while dying but it should not be sustainable one so that he suffered long just to die. 

All started to think of the ways to get rid of Lokka, the most adorable street dog in the locality suddenly turned violent and biting people indiscriminately. Lokka’s crime record in the last fortnight had reached two deaths from hydrophobia, five bite injuries and two motor bike accidents. The injured ones are all bed -ridden and struggling to get back to their normal lives. 

One of the bikers, badly injured by Lokka’s guerrilla-style attack from the right side, recollected after he got back his full sense, thankfully. It could have been worse because the accident had caused him injury on his back-head resulting into senselessness and vomiting. Now that the news of his getting back to senses kept all the friends in good spirit. They all went to see the victim in the district hospital. His name was Pratap Maji. He described the incident in verbatim: 

- I could hardly control myself and my bike when the dog had attacked me from my right. I pulled my legs up so that it would not be able to reach me to bite me and and in doing so in motion and frenzy, I lost my balance and control and bumped straight into the deep open drain to my left. I don’t remember anything after that.

This is what the twenty-six-year-old boy from the neighbouring locality said. He added that he had a family. He lived with his  widowed elder sister and her two year only female child.  They both are dependent on him, only.  After her husband’s death in an accident this poor lady had been driven away by her in-laws from their home. Pratap and his motorbike are the only resources to do something, earn the livelihood and live on. The motorbike also has suffered heavy injuries, which have the possibility to be healed up by the insurance company. 

Such stories are common. Very common with twisting drifts in the middle boiling down to the basic theme of ‘fight to survive’. What is wonderful is that the different routes they take to culminate there are still unique. So very unique to raise our eye-brows, "How is that possible!!!" 

And still, what I believe is, even with the recent advent of the Artificial Intelligence, life remains the same with the bottom-line that “Truth is even stranger than fiction.”

The young man’s confession changed something in Keshto. It can be felt but cannot be explained. Suddenly, he, who takes life as it comes, started talking about the deeper things in life,with high philosophical edges, awaiting relative interpretations. 

So when it was concluded that Lokka was to be killed shortly, what Keshto said was,

- Only human beings have souls to be recycled into life and what about the dogs? 

Sambhu asked,

- Why? 

- Because it cannot come back as an apparition to avenge his murder. 

Kanto was scared to find Keshto in such a condition.

- Bhai, are you alright? Please, do not be upset, everything will be fine.

- Yes it should be. People lose their children and still live. You know Kanto, what is the most terrible thing in life?

- What? 

- To see one’s children suffer.

- It is life. What to do? 

- When the child is a human one, one has to endure it. But in the world of the animals, the weak ones, and the diseased ones have only one choice.

- What is it?

- To die. Their parents themselves kill the weaker ones. 

- What do you wanna say, man! 

- Nothing.

The next morning the friends were all together like every other day. Keshto was feeding the dogs a little far away and fondling their manes. Lokka appeared from nowhere. Seeing Lokka, we all secured ourselves so that he could not attack us. Keshto pretended that as if he had not seen Lokka and kept on cuddling the other dogs. Lokka, with much of jealousy, could not stand it. He went near Keshto to have the best share of Keshto’s care. Keshto ardently took Lokka out of the litter of matured dogs behaving like pups. Keshto always carried a solid log of wood used as a door hatch in old days while feeding the dogs. Lokka was eating from Keshto’s own hands and as he was rubbing Lokka’s neck with the other hand. All could see from a distance that Keshto was nodding his head and talking to himself and the dog both. Lokka was cooing with such love from Keshto as the later continued feeding and rubbing him on his shoulders and along his neck. The log of wood was lying beside the right hand of Keshto. 

In a flash of a moment Keshto picked the log up, one sudden heavy blow right in the middle of Lokka’s head, out of nowhere. The mad dog was dead in an instance. The log hit Lokka hard, as he was being fed by Keshto, like a thunder. It ripped Lokka’s brain apart with inside out. The sight was unbearable and beyond any description. We all shut our eyes with such unexpected fatal and gory strike. The dog instantly died with no chance to cry even. We were dumbstruck. 

Keshto waved his murder weapon from a distance to us, and shouted as a fallen hero in state of shock. 

- This is what is called painless death…painless death. Yah!!!….Painless…absolutely painless.

And for the first time in their lives the bosom friends saw their bravest friend Keshto break down into crying. 

They had all done many bad things together, learnt even worse things together. Through learning the darker sides of life, they found out what it takes to be good human beings, above all and everything. They believed that a drunken person is the most truthful one. They believed that the prostitutes are the most honest human beings, by profession. 

But this was new, altogether. Unexpectedly new and deeply moving. Through the death of just a mad street dog, they learnt for the first time, what ‘life’ is like, once more, with an added heavy layer. 

They all rushed to Keshto. Lokka laid beside Keshto’s drooping figure like a white stuffed dog on a scarlet carpet. Without a word, all pulled him up from his fallen state. He was smudged in drops of blood. Silently, they grabbed everyone else tight in their arms, smelling of unwashed clothes and sweat. All cried together, sitting in a circle, starved, until it was dark. No word came off them. 

Kanto managed a jute sack from his factory. Kamal managed a spade. Tulu and Nadu, in the middle of the night drove a tricycle van to bury the corpse of their beloved Lokka somewhere beside the train line. Keshto withdrew himself from everything. And Sambhu, in fear, never came out of his house for the next few days, until Keshto went to his home and sought his presence. He came out and broke down into crying straight on Keshto’s feet. 

- Forgive me Keshto…It was my idea. 

- Your idea was brilliant bro and we all did it seamlessly. Get up man!!! Lokka did not suffer much, as you had told us. I did take good care of that, no? 

Keshto’s vision was diffused with the liquid, that keeps our eyelids shutterring up and down with perfect agility, popularly known as ‘tears’, as he was torn apart, from within. 

With the news going viral that Lokka was no more, though not the way he was driven to escape from the earth, the entire neighbourhood was contended with a deep sigh of relief.  

AI Art by Meta



   



Thursday, 16 January 2025

রাজগীর ভ্রমণ: সপ্তম পর্ব : নালন্দা 4

আমরা এবার এসেছি নালন্দার চতুর্থ পর্বে। 

সোজাসুজি কথোপকথনে চলে যাওয়া যাক। 

আমাদের গাইড কমলা সিং বললেন, আমাকে ডেকে 

– এই যে, টেপ রেকর্ডিং-সাহেব, আপনি সামনে আসুন

এলাম। 

তখন উনি বললেন,

– তাহলে এবার বলতে শুরু করি। 

সবাই সমস্বরে উত্তর দিল, 

– হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন


– ওই সামনের যে বিল্ডিং বা মনুমেন্টটা যেখানে আছে ওটাই হল নালন্দার মূল রেফারেন্স পয়েন্ট। সমস্ত জায়গায় এটারই ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এর নাম সারিপুত্র স্তূপ। সারিপুত্র ছিলেন ভগবান গৌতম বুদ্ধের প্রধান শিষ্য। তিনি নালন্দার ভূমিপুত্র।  এই নালন্দাতেই জন্মগ্রহণ করেন এবং এখানেই ওনার মৃত্যু হয়। ভগবান বুদ্ধ বলতেন,  “যেখানে সারিপুত্র গেছে সেখানে আমার আর যাওয়ার প্রয়োজন কি!"  ভগবান বুদ্ধের এতটাই ভরসাযোগ্য ও বিশ্বস্ত ছিলেন সারিপুত্র। আর এই হল সেই পবিত্র স্থান যেখানে মৌর্য সম্রাট অশোক সারিপুত্রের সমাধির উপরে এই স্তূপ নির্মাণ করেন। সম্রাট অশোকের পরে সুঙ্গ-যুগ, পাল-যুগ, কুষাণ-যুগ ও গুপ্ত-যুগেও এই স্তূপের অনেক অংশ বিভিন্নভাবে নির্মিত হয়েছিল। 

মোট চারটে কাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক আগেই স্থাপিত হয়েছিল সেগুলো এই ধ্বংসস্তূপের নিচে ঢাকা পড়ে গেছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তাহলে তা হল তিনটি লাইন বরাবর তিনটি দিক বা অংশ। আর ঐ তিনটি লাইন হল বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়কালের।

সব থেকে নিচে যে ছোট লাইনটি দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে গুপ্ত যুগের। এর চার কোণে চারটি স্তূপ ছিল যেগুলি দ্বারা বোঝাই যাচ্ছে যে এই অংশটি ঘেরা ছিল। আর ওগুলোর দেওয়ালে যে ভাঙ্গা মূর্তি ছিল তা গৌতম বুদ্ধের ও বোধিসত্ত্বের।  এই সমস্ত মূর্তি দেড় হাজার বছর পূর্বের  গুপ্ত যুগের স্থাপত্য ও শিল্পকলার অসাধারণ নিদর্শন। সেগুলির সাথে আবার সারনাথ স্তূপের শিল্পকলার অনেক মিল পাওয়া যায়।


আচ্ছা এবারে বলি যে পঞ্চম কাঠামোটি ছিল গুপ্তযুগের পঞ্চায়তনের মত। ‘পঞ্চায়তন’ শব্দের অর্থ হলো ‘পাঁচ'। চার কোণে চারটি স্তূপের কথা আগেই বলা হয়েছে। আর মদ্যিখানে যা ছিল তাই নিয়ে 'পাঁচ'। কিন্তু মদ্যিখানের সেই অংশটি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। 

আর সেই মদ্যিখানের আকৃতি কেমন ছিল তা সম্পর্কে পার্সি ব্রাউন একটা কনজেক্চর (conjecture) দিয়েছিলেন যে ওটি  একটি 'চৈত' বা মন্দির ছিল। জাস্ট সেটা দেখলে ওই পঞ্চম অংশটি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা যেত। সেটার ফটোগ্রাফ পরে দেওয়ালে লাগানো হয়েছিল। সেটাও পরে ভেঙে যায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর সেই ফটোগ্রাফ ওখানে লাগানো হয়নি। পার্সি ব্রাউন ওই অংশটিকে পঞ্চম কাঠামো হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।  তাঁর মত অন্যান্য তাবড় ইতিহাসবিদ ও আর্কিওলজি বিভাগের বিদ্বান লোকজনও মেনে নিয়েছিলেন যে পঞ্চম কাঠামোটি কোন শুধুমাত্র কোনো স্তূপ বা স্তম্ভ ছিল না,  ছিল একটি 'চৈত' বা মন্দির।

এবারে ঐ মাঝের যে লাইনটা দেখছেন তা হলো ষষ্ঠ স্তর।  আর সব থেকে উপরেরটি হল সপ্তম স্তর।  সপ্তম স্তরের যে অবশেষ এখানে পড়ে আছে, সেখানে ছিল উত্তর দিকে মুখ করে থাকা একটি বুদ্ধমূর্তি। 

তাহলে কি বুঝলেন? 

এই হল সপ্তম 

তার নিচে ষষ্ঠ,

তার নিচে পঞ্চম, 

আর বাকি চারটি স্তর রয়েছে একেবারে নিচে।  


প্রত্যেকটির উপরের কাঠামো ওভার এন্ড রাউন্ড ভাবে গঠিত হওয়ার ফলে এর ব্যাপ্তি এতটাই যে তা অত্যন্ত এক্সটেনসিভ। আর যত ছোট স্তুপ আছে তা ধরেই নেওয়া হয় সম্রাট অশোকের তৈরি। এর আশেপাশে যে গোলাকৃতি বিভিন্ন রকমের কাঠামো দেখা যাচ্ছে, তা তিনটি ভিন্ন রকমের।

প্রথম ধরণ হল্, ছোট ছোট পূজাগৃহ ও বুদ্ধমূর্তি।

দ্বিতীয় ধরণ, গোল গোল ছোট ছোট স্তূপ আছে সেগুলো ‘বটিকা’ নামে পরিচিত। ওইগুলো হচ্ছে মানুষের মানত বা মানসিক পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ঈশ্বরের প্রতি দান হিসেবে তৈরি করা স্তূপ।

আর তৃতীয় রকমের হচ্ছে যে সব গোল গোল বড় স্মারক দেখা যাচ্ছে সে রকম আবার বিভিন্ন দ্বারের ওপরেও তৈরি করা হয়েছে। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিদ্যার্থীদের জ্ঞান লাভের উদ্দেশে তৈরী করা হয়েছিল।

তবে মোদ্দা কথা হল্, এই তিন রকমের কাঠামো চারিদিকে যে আছে আর প্রধান ও মূল অংশটি হল 'সারিপুত্র স্তূপ', সম্রাট অশোকের তৈরী করা। আগেই বলেছি যে সম্রাট অশোক নিয়মিত এখানে আসতেন পুজো দিতে। 

এই লাইনে বাকি যা আছে তা হচ্ছে ১২-১৩-১৪ নম্বর চৈত বা মন্দিরের অবশেষ।  এগুলি দুবার নির্মিত হয়েছিল প্রথমবার গুপ্ত যুগে। তারপর সেগুলো সব খারাপ হয়ে যাবার পর পাল যুগে বিভিন্ন রাজা আবার এগুলি নির্মাণ করেন। গুপ্ত যুগের যত রাজা ছিলেন তাঁরাও এখানে পুজো দিতেন আর এর পাশেই দেখতে পাচ্ছেন যে আরও মানসিক বা মানত করার স্তূপ আছে। যেগুলি  প্রস্তর্-নির্মিত, সেগুলি পাল যুগের আর যেগুলি ইঁট দিয়ে তৈরি, সেগুলি হচ্ছে গুপ্ত যুগের। ১২-১৩-১৪ নম্বরের চৈতগুলির শুধুমাত্র পাদদেশ দেখা যাচ্ছে। এখানে অনেকগুলি মূর্তি ছিল। মূর্তিগুলো এখন আর এখানে নেই। উন্মুক্ত স্থান তো! যে সমস্ত মূর্তি এই ১২-১৩-১৪ নম্বর মন্দির থেকে পাওয়া গেছে তার সবকটিই সংগ্রহশালায় রাখা।

তাহলে এই চারটি মন্দির হল এই লাইনে, আর দুটি বিহার লাইনের পিছনে। আর ওই মধ্যের লাইনে এগারোটা বিহার পাওয়া গেছে। 


শুনলে আশ্চর্য হবেন যে পৃথিবীর সমস্ত বিখ্যাত সংগ্রহশালায় নালন্দার কোন না কোন অংশ রক্ষিত আছে। 

আচ্ছা, নালন্দার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ধাতু কি ছিল বলুন তো?

শেষ ইতিহাস পড়েছি মাধ্যমিকে। লিখে যা নম্বর পেয়েছিলাম, তা জনসমক্ষে বলতে লজ্জা হয়। ভাগ্গিস মৌখিকটুকু ছিল! 

তাই আমি তো কিছু বলতেই পারলাম না। 

কিন্তু যারা নম্বর পেয়েছিল, ঐ সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের স্মৃতিও আজ দুরবল বলে মনে হল।

তাই আমরা সবাই চুপ করে রইলাম।



অগত্যা সিং-জি উত্তর দিলেন নিজেই।

- ব্রোঞ্জ

- এখানকার মিউজিয়ামে তাই আলাদা করে ব্রোঞ্জের গ্যালারি আছে। শুধু এখানেই নয়, বিদেশের বিভিন্ন মিউজিয়ামে নালন্দার ব্রোঞ্জ রাখা আছে। ওরকম হাই কোয়ালিটি ব্রোঞ্জ রেয়ার্। 

এই বলতে বলতে উনি আমাদের সাথে নিয়ে হাঁটতে রইলেন।সঙ্গে দিলেন একটি ছোট্ট ট্রিভিয়া। 

- একবার  এক আমেরিকান মহিলা পর্যটককে এখানে ঘোরাচ্ছিলাম। বললাম ওনাকে যে এখানকার ব্রোঞ্জ তো আমেরিকার বস্টনেও রয়েছে।  কিন্তু সেই মহিলা তখনই জবাব দিয়েছিলেন যে,

- না নেই। এই তথ্য অর্ধসত্য।

- মানে? 

- মানে…. হ্যাঁ একসময় সেই ব্রোঞ্জ বস্টনে ছিল বটে। কিন্তু পরে আমেরিকা তা ভারত সরকারকে হস্তান্তরিত করে দেয়। 

(চলবে)

রাজগীর ভ্রমণ: ষষ্ঠ পর্ব: নালন্দা 3:

এবারে আমরা এসেছি নালন্দার তৃতীয় পর্বে। 

(এবার নিচের পুরোটাই আমাদের গাইড সাহেবের বলা হিন্দি কথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বঙ্গানুবাদ)

সাধারণ ভূমিকা: 

**********

“পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে  আপনাদের স্বাগতম।  

(World’s First International Residential University)

আমি কমলা সিং, আপনাদের আজকের মার্গদর্শক। 

আমরা চলেছি বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে। 

নালন্দা শব্দের ব্যূৎপত্তিগত অর্থ হল (Etymological meaning):

‘নালম দধাতি ইতি’ হল ‘নালন্দা’| ‘নালম’ মানে ‘পদ্মের নাল’| আর, যে ভূমিতে পদ্মের জন্ম হয় তা হল ‘দা’। ‘পদ্ম’ হল জ্ঞানের প্রতীক -- জ্ঞানের পদ্মসম ফুল যে স্থানে ফোটে তাই-ই ‘নালন্দা’ – জ্ঞানপীঠ।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আনুমানিক আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর পুরোনো।   

প্রথম কুমারগুপ্ত 427 CE (common era) তে নালন্দার গোড়াপত্তন ঘটান। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ শুধুমাত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য “জ্ঞাণ ও প্রজ্ঞার স্বর্ণযুগ ও পবিত্রভূমি” হিসেবে  সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল। 

*****

এই পর্যন্ত বলে আমাদের গাইড সাহেব এগিয়ে যেতে লাগলেন, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব প্রবেশ দ্বার পেরিয়ে। আমরা পিছনে পিছনে। কমলা সিং-জি কে আমদের মার্গদর্শক হিসেবে নেওয়ার আগে আরো এক্জনের সঙ্গে কাজল বাবু প্রায় কথাবার্তা শেষ করে এনেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে নাকচ করে দিয়ে সিং-জি কে সাথে নেওয়া হয়। সেই নিয়ে বিড়বিড় করে আলোচনা চলছিল অনন্তর সঙ্গে। সিং-জির সজাগ কান তা এড়িয়ে গেল না। অনন্ত-কে বললেন,

- বহুত সারে হ্যায়্, মেরা লায়ক্, ইহাঁ পে...আপ জিসে চাহে চুন সখ্তে হ্যায়্...

অনন্ত বলে উঠল,

- মে বি দেয়ার আর মেনি গাইড্স্, বাট দে মে নট বি অ্যাজ নলেজেবেল অ্যাজ য়্যু। রাইট্?

- কৌন কাহা?

- ম্যাঁয় বোলা। আপকা বাল -কা কলর দেখ কে হাম বোলে হ্যাঁয়্।

- আরে বাল কা কলর তো....ক্যায়া বোলে, হাম পিছ্লে ছব্বিশ সাল সে ইয়ে কাম কর রাহা হ্যায়।

- ওহি.... ওহি... হ্যায় না....এজ ইজ এক্স্পিরিয়েন্স, অ্যান্ড নলেজ ইজ পাওয়ার...

বুলবুলি বলে উঠ্ল্,

- বাল দেখ্কেই হাম ঠিক আদমি পেহচান লিয়া...

চারপাশে সবাই হেসে উঠল। 

এ তো আচ্ছা মুশাকিলের কথা। বুলবুলি যা ই-ই বলে তাতে সবার এত হাসির কি আছে!! কই, অনন্ত যখন বলছিল, তখন তো কেউ ওরকম করে হেসে উঠল না!! সব হাসি যেন বুলবুলির কথায়! অকারণে। 

কিন্তু তাতে বুলবুলি রাগ করে না। এটা ওর মহত গুণ। এখানেই একজন বিজ্ঞ মানুষের সাথে সাধারণদের পার্থক্য। 


কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে। সিং-জি হাসির শেষে বললেন,

- তা হলে বলা শুরু করি?

- হ্যাঁ, হ্যাঁ...

- নালন্দার সবথেকে গুরুত্ব্পুর্ণ  প্রবেশ দ্বার, পূর্ব প্রবেশ দ্বার দিয়ে আমরা ভিতরে এলাম। আর আমাদের কোনো পরীক্ষা দিতে হল না। 

তবে এই বিহারের (এখানে 'বিহার' মানে রাজ্য নয়, আগের পর্বে এর অর্থের সময়ানুপাতিক ব্যাখ্যা করা আছে) সীমানার বিস্তার ওই দূরের গাছটা অব্দি। এখানে (নালন্দায়) মোট এগারোটি বিহার আছে। আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে এগারোটা বিহার যদিও দেখা যাচ্ছে না। আরো একটু এগিয়ে গেলে দেখা যাবে।

যেটা এখানে বলার, যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সাত্শো বছরের কিছু বেশি দিন চলেছিল। তাই অতগুলি শতক ধরে একটা মাত্র ভবন-ই যথেষ্ট ছিল না। কখনো পুরোনো ভবন খারাপ হত, কখনো আবার রাজবন্দীরাও থাকতেন। কখনো আক্রমনে নষ্ট হয়েছে। এবারে যেহেতু সমগ্র প্রতিষ্ঠাণটি চলত ধর্মীয় ফিলজফির ওপরে ভিত্তি করে, তাই নষ্ট হয়ে যাওয়া ভবনগুলিকে কখনই সম্পূর্ণরূপে ধূলিসাথ করে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। আগের পুরোনো  জায়গাটাকে ধ্বসিয়ে দিয়ে সেটাকে ভিত করে তার ওপরে নতুন কাঠামো গড়া হত। প্রত্যেক যুগে এরকম হয়েছে। ফলে নতুন স্তর (লেভেল) তো গঠিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। 


এবারে যা দেখছেন, তা হল একজন বিদ্যার্থীর থাকার ঘর। আগেই বলা হয়েছে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে প্রত্যেক বিদ্যার্থীকে নিজস্ব ঘর দেওয়া হত (সিঙ্গল অক্যুপ্যান্সি)। শেয়ার করার কোনো ব্যাপার ছিল না। ওটা ছিল হোস্টেলের প্রবেশের দরজা, যা পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আর ঐ লাইন বরাবর সব বিদ্যার্থীদের থাকার ঘর, তারপরে দেখছেন, ওই করিডোর আর এর পরে আছে লেক্চার হল। লেক্চার হল এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। ওদিকে বেঁকলে তবে পাবেন। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে সেটা হল বিহার সংখ্যা পাঁচ। এর প্রথম লেভেল হল যেখানে আমাদের পা। দ্বিতীয় লেভেল , ওই যে। তৃতীয় লেভেল নালীর পাশে। আর চতুর্থ লেভেল হল ওই ওপরে।

চার লেভেল চার রাজত্বকাল (আওয়াদী/অক্যুপেশন্)। সবটা খুব স্পষ্ট। দ্বিতীয় লেভেল ওব্দি একটা সিঙ্গল ব্লকের বিল্ডিং ছিল যা ভবনের প্রবেশদ্বার ওব্দি বিস্তৃত ছিল। তার এন্ট্রান্স কিন্তু নীচে ছিল না। কিন্তু পরের দুটি যুগে যখন এখানকার ছাত্র সংখ্যা বাড়ল, তখন এই একটা ব্লক-কে দু-ভাগে ভাগ করে দেওয়া হল। তখন এটাকে মাঝখান থেকে কেটে দেওয়া হল। তার আগে এখানে কোনো সিঁড়ি ছিল না। এখন এটা পঞ্চম স্তর, আর ওপরের টা চতুর্থ। এটা কোনো স্বতন্ত্র বিহার ছিল না। এটা চতুর্থ বিহারের এক্স্টেনশন মাত্র, যাকে মোনাস্টিক অ্যানেক্স বলা হয়। আবার ভাল করে দেখুন: ওই হল পাঁচ্, আর এই হল চার। 


আরো দেখুন দেওয়াল কি রকম চওড়া: আট ফুট। (জাস্ট ভাবুন্, আট ফুট চওড়া দেওয়াল, মানে ছিয়ানব্বই ইঞ্চি। আমার হাইট ছ্’ফুট দুই ইঞ্চি।  আমাদের ফ্ল্যাটের দেওয়াল কোথাও কোথাও দশ ইঞ্চি ম্যাক্সিমাম)। এরকম চওড়া দেওয়াল হওয়ার কারণ হল, বহুতল বিল্ডিং-এর লোড অনেকটা। পাইলিং সিস্টেম তো সেকালে ছিল না। ফলে ফাউন্ডেশন-ই সব। দেওয়ালকেও ওই ভিত্তি বা ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ধরা হত। তাই অত চওড়া দেওয়াল। আর এত চওড়া দেওয়ালের আর একটা সুবিধা ছিল যে তা ন্যাচারাল এ-সি র কাজ করত। 

তাহলে দাঁড়াল কি! 

এই হল কামরা/ঘর; আর ওইটা হল চার নম্বর স্তর; এটা দুটি ব্লকের মধ্যের প্যাসেজ আর ওই হল নতুন গেট, যেখান দিয়ে আমরা হোস্টেলে ঢুকলাম। 

আসুন আমার সঙ্গে....

******

এগোনোর আগে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এক একটা স্তর পেরোনো মানে এক এক শতাব্দী, এক এক রাজত্ব কাল। টাইম মেশিনে ভ্রমণ একেই বলে। বর্তমানে যখন হুঁশ ফিরে আসছে, তা যেন স্পিলবার্গের ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’! 

মনে মনে ঘুরতে লাগল, 

ভারতে মুসলিম রাজত্ব ছিল মোটামুটি পাঁচশ বছর। (1200-1700)

সে সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইমারত

ফতেপুর সিক্রীর বয়েস: সাড়ে চারশো বছর। স্থাপনকাল 1569

তাজ্মহলের বয়েস তিনশো পঁচাত্তর বছর। স্থাপনকাল 1639

আবার ইংরেজ রাজত্ব ছিল প্রায় দু’শো বছর। 1757 -1947 (1757-1857/1858-1947)

কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই ইংরেজরা এদেশে থাকত। 

ফোর্ট ঊইলিয়াম স্থাপিত হয় তিন্শো আঠাশ বছর আগে। স্থাপনকাল 1696

রাইটার্স বিল্ডিং এর বয়েস দু’শো পঁয়তাল্লিশ বছর। স্থাপনকাল 1780

আমাদের সালকিয়ার পুরোনো বাড়ির বৈঠকখানার বয়েস একশো পঁচিশ। 

আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে দেখতে গেলে:

বলোগানা: স্থাপনকাল 1088 (পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখনো চালু আছে) 

অক্সফোর্ড: স্থাপনকাল 1096

কেম্ব্রিজ : স্থাপনকাল 1209

সেনেট অফ শ্রীরামপুর ইউনিভার্সিটি: স্থাপনকাল 1818 (ভারতে স্থাপিত প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়) 

কলকাতা: স্থাপনকাল 1857

আর আমরা দাঁড়িয়ে আছি আজ থেকে দু’হাজার ছ’শো বছরের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ধবংসাবশেষে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

গায়ে জাস্ট কাঁটা দিল, যখন হোস্টেল রুমের ভিতরে প্রবেশ করে অনুমান করতে লাগলাম, সেই ঘরেই থাকতেন সে সময়ের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্যার্থীদের কোনো এক জন করে, বিভিন্ন সময়ে, সাত শো বছর ধরে....

তাঁরা কেউ নেই এখন পৃথিবীতে। কেউ তাঁদের নাম জানেন না, সে সময়ের শ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু তাঁদের আশ্রয়্দাতা সেই ইমারত, সেই বিদ্যা ও জ্ঞানের পীঠস্থান যেমন কে তেমন সেই, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পুড়িয়ে, গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরেও। মাটির তলায় চাপা পড়ে যাওয়ার পরেও। 

একেই বলে 

‘রাখে হরি, মারে কে’

না কি একেই বলে,

‘অমর’ 

না কি, 

‘ফিনিক্স’! 

না কি, 

'মিঠুন চক্কোত্তি’, 

একশো গুলিতেও যাঁর মৃত্যু নেই!!!

(চলবে)


Sunday, 12 January 2025

রাজগীর ভ্রমণ: পঞ্চম পর্ব: নালন্দা 2

এবারে আমরা এসেছি নালন্দার দ্বিতীয় পর্বে।

(এবার নিচের পুরোটাই আমাদের গাইড সাহেবের বলা কথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বঙ্গানুবাদ)

সাধারণ ভূমিকা: (মানে, আগে যা ঘটেছে)

**********

“পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের স্বাগতম।
(World’s First International Residential University)
আমি কমলা সিং, আপনাদের আজকের মার্গদর্শক।
আমরা চলেছি বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে।
নালন্দা শব্দের ব্যূৎপত্তিগত অর্থ হল (Etymological meaning):
‘নালম দধাতি ইতি’ হল ‘নালন্দা’| ‘নালম’ মানে ‘পদ্মের নাল’| আর, যে ভূমিতে পদ্মের জন্ম হয় তা হল ‘দা’। ‘পদ্ম’ হল জ্ঞানের প্রতীক -- জ্ঞানের পদ্মসম ফুল যে স্থানে ফোটে তাই-ই ‘নালন্দা’ – জ্ঞানপীঠ।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আনুমানিক আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর পুরোনো।
প্রথম কুমারগুপ্ত 427 CE (common era) তে নালন্দার গোড়াপত্তন ঘটান। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ শুধুমাত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য “জ্ঞাণ ও প্রজ্ঞার স্বর্ণযুগ ও পবিত্রভূমি” হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল।

*******

প্রথম পর্বের পরে….
আমরা পুরোপুরি তখন আমাদের গাইড কমলা সিং-জি এর ম্যাজিক স্পেলের কন্ট্রোলে। যেন একটা হিপ্নোটাইজড অবস্থা, ড: হাজরা আর মুকুল। উনি আমাদের নালন্দার পূর্ব প্রবেশ দ্বারের কাছে নিয়ে এলেন। তারপর উনি যা বললেন, তাতে আমরা, স্থানটির প্রতি মনে মনে শ্রদ্ধাবনত না হয়ে পারলাম না।

******

কমলা সিং-এর ভাষ্যের অনুবাদ:
(নালন্দার কমপ্লেক্সে ঢুকে খানিকটা এগিয়ে এসে যখন আসল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারে উপস্থিত হলাম....)
“আমরা দাঁড়িয়ে আছি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে পুরোনো প্রবেশ দ্বারগুলির একটিতে। এটি নালন্দার পূর্ব প্রবেশ দ্বার। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দিকে চারটি প্রবেশদ্বার ছিল। প্রত্যেক প্রবেশদ্বারে থাকতেন একজন দুঁদে দ্বার-পন্ডিত যাঁকে আধুনিক ইংরেজি ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ডীন অফ অ্যাডমিশন’ বলা চলে।

East Gate of Nalanda University

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর শিক্ষা ও রিসার্চের বিশ্বখ্যাত কেন্দ্র ছিল। সেখানে অধ্যয়্ণের জন্য প্রবেশের অনুমতি পাওয়া অত সহজ ছিল না। আর আরো ইন্টারেস্টিং হল এই যে, এখানে যে কোনো স্তরেই শিক্ষা লাভ সম্পূর্ণ করার কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল বা সীমা ছিল না। আর কোনো স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ করলে না দেওয়া হত তার জন্য কোনো বিশেষ শংসাপত্র। সহজ কথায় নালন্দায় পাঠ অর্জণ করে কোনো সার্টিফিকেট পাওয়া যেত না। যাঁরা এখানে আসতেন, তাঁরা কেউই ডিগ্রী পাওয়ার আশায় আসতেন না। আসতেন নিজেদের জ্ঞানার্জনের অকৃত্রিম নেশার টানে। বিদ্যার মাধ্যমে প্রজ্ঞার আহরণই ও আত্মতুষ্টিই ছিল নালন্দায় অধ্যয়নের একমাত্র উদ্দেশ্য। কেউ নালন্দায় পাঠরত, বা সেখান থেকে বিদ্যার্জন সম্পুর্ণ করেছে, এ খবর সব জায়গায় এমনিই ছড়িয়ে যেত। আর তাঁদের ছিল বিশ্বব্যাপী সম্মান।
আর সাধারণ বিভাগে যাও বা অধ্যয়ণের সুযোগ পাওয়া যেত, কিন্তু 'স্কুল অফ ডিসকাশনস/ডিবেট' মানে যাকে আমরা বাংলায় বলি ‘তর্কশাস্ত্র’, সেখানে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। অতি প্রতিভাবান, এমনকি বাঘা বাঘা পণ্ডিতদেরও ঐ স্তরে অ্যাড্মিশনের প্রোব্যাবিলিটি ছিল দশ জনের মধ্যে মেরে কেটে দু'থেকে তিন জন। বাকিরা বিফল মনোরথে ফিরত চলে যেতেন। নালন্দার দ্বার পণ্ডিতদের পাণ্ডিত্যের পরিধি ও গভীরতা এখান থেকে সহজেই অনুমেয়।
এবারে নালন্দার দ্বারপণ্ডিত কারোর অ্যাড্মিশনের যে পরীক্ষা নিতেন তা কেমন ছিল জানা যাক।
যে কোনো স্তরে প্রবেশের জন্য প্রথমেই থাকতে হবে ত্রিপিটক সম্পর্কে সম্যক ও গভীর জ্ঞান। তারপরে বাকি সবটা বিষয়ভিত্তিক।

বিষয়ভিত্তিক প্রথম স্তরে পাশ করতে হত বিশেষ বিষয়ে, যে বিষয় নিয়ে ক্যান্ডিডেট এখানে পড়তে চান।
তার পরের স্তরে থাকত পার্সোনালিটি টেস্ট।
ঐ দুটো উতরোলে তার পরে আবার পার্সোনাল ইন্টারভিউ।
আর প্রত্যেকটা স্তর ছিল মারাত্মক কঠিন।
লিপি থেকে জানা যায় একাদশ শতাব্দীতে এই পূর্ব প্রবেশ দ্বারের দ্বার পণ্ডিত ছিলেন শেরোন্যায়। দক্ষিণ দ্বারে কৃষ্ণাচার্য, পশ্চিমে নাত্রশান্তি ও উত্তরে নারোপা।

Our Respected Guide Sri Kamla Singh



(আমার ধারণা কোন দরজায় কোন পণ্ডিত থাকতেন, সেটা কল্পণা-প্রসূত। গল্প-কে বাড়ানো ও মনোগ্রাহী করে তোলার স্বার্থে বহু জায়্গায় গাইডরা এভাবে বলে থাকেন। কৃষ্ণাচার্য ও নারোপার অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু বাকি দুই জনের নাম আমি কোথাও খুঁজে পাই নি।)
এখানে বলে রাখা ভাল যে, যে ‘হিউ-এন সাং’-এর বিবরণ থেকে আমরা নালন্দা সমপ্র্কে এত কিছু জানতে পারছি, তাঁর আসল নাম ছিল ‘Xuanzang’। নালন্দায় পাঠ নেওয়ার সময়ে তাঁর নামকরণ করা হয় 'মোক্ষদেব'। তাঁর সময়ে নালন্দা মনাস্ট্রিজের প্রধাণ ছিলেন শীলভদ্র।
যে গঠন এখন আপনারা দেখছেন, তা খনন করে বের করা হয়েছে। এর বাইরের দিকের যে অংশ এত বছর ধরে জল ও বায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কিন্তু কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ পুনরুদ্ধার (রেস্টোরেশন) করা হয়েছে। ভিতরের অংশ একেবারে আসল, ও আদি। দেওয়াল সেখানে আট থেকে দশ ফুট চওড়া।
খারাপ হওয়া অংশগুলির পুনরুদ্ধার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজারা করেছেন বটে কিন্তু তা সবই ওপরে ওপরে। ভিতরের আসল খাঁচাটি এখনও একই আছে, সেই যখন স্থাপন করা হয়েছিল, তখনকার মত। তাতে এখনো ওব্দি কোনো হাত পড়ে নি।
আসুন আমার সঙ্গে….

********
আমরা প্রবেশ করলাম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব প্রবেশদ্বার দিয়ে। অনায়াসে।
কেউ আট্কালো না। শুধু কমপ্লেক্সের প্রবেশদ্বারে নামমাত্র প্রবেশমূল্যের টিকিট লেগেছে ।
আর সেখানে দ্বাররক্ষী মেরে কেটে উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ।
(চলবে)

Friday, 10 January 2025

রাজগীর ভ্রমণ: চতুর্থ পর্ব: নালন্দা 1:


কাচের ব্রিজ থেকে বেরিয়ে, আমরা সোজা চলতে থাকলাম নালন্দার উদ্দেশ্যে। ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটা। তখন লাঞ্চ  করতে গেলে নালন্দায় সময় কমে যাবে। কোনো অবস্থাতেই সেটা তো করা যাবে না। গতকাল বিচ্ছিরি মিস হয়েছে। ঢুকতেই পারিনি। এই যে এত পথ ভ্রমণ করে রাজগীরে আসা, তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য নালন্দা দর্শণ। বাকি সব কিছু উপলক্ষ্য মাত্র -- এই 'বিশ্ব শান্তি স্তুপ' বা 'গ্লাস ব্রিজ' বা অন্যান্য  আরো যা কিছু, সব শুধু টাইম পাস। তাই লাঞ্চ পিছিয়ে গেলে কোনো আপত্তি নেই। তবে লাঞ্চ না করে গেলে আবার পিছুটান থেকে যাবে। ফলে একটা দোটানা ও মতভেদ রয়েই গেল। 

আমার সাথে যাঁরা ছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই যথেষ্ট শিক্ষিত,  এবং শিক্ষার মর্যাদাকে কখনো অসম্মান বা উপেক্ষা করেন না। সেখানে যখন জানতে পারা যায় যে ভারতবর্ষে এমন একটা জায়গা ছিল যেখানে পৃথিবীতে প্রথম হোস্টেল ফেসিলিটি ছিল এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়- এর তকমা পাওয়া উপাধিধারীদের পৃথিবীব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তখন আর কিছু না, গর্ব বোধ হয়। একদিনের একবেলার লাঞ্চ সেখানে খুব ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ। 

কিন্তু ভাবলেই দুঃখ হয় যে আজ সেই শিক্ষার মান কোথায় নেমেছে – সেই ভারতবর্ষেই যখন ক্লাস এইট পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দেওয়া হয়েছে। এই বিহার রাজ্যেরই কোনো এক মুখ্যমন্ত্রী আবার নিরক্ষর ছিলেন – তখন সবটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। আরো কষ্ট হয় যে আমরা সেই ভারতেই বাস করি যেখানে আড়াই হাজার বছর আগে নালন্দা পৃথিবীর সর্বপ্রথম বৃহত্তম রেসিডেন্সিয়াল ইউনিভার্সিটি ছিল। উৎকর্ষের মান তো প্রশ্নাতীত। এখানে দাঁত ফোটাতে গেলে উচ্চ মানের মেধা, বিদ্যা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন ছিল। (পরের পর্বে সে নিয়ে আরো বিশদে আলোচনা করা যাবে)  শুধু ভারতের নয় পৃথিবীর সমস্ত মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল যে তাঁরা কি করে নালন্দার মত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করবেন।

নালন্দার বিশাল ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে এটুকুই শুধু মনে হচ্ছিল: কি ছিলাম, আর কি হয়েছি! 
সব থেকে বড় কথা বুলবুলিও বেশ বিদুষী। যথেষ্ট মেধা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী। যে ধরণের প্রশ্ন বুলবুলি আমাদের গাইড্কে করছিল, তাতে তার জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সহজেই অনুমেয়। তাই নালন্দায় দাঁড়িয়ে আমি অন্তত বুলবুলিকে নিয়ে মজা করাটুকু ছেড়ে দিই কিছুক্ষণের জন্য। সব জায়গায় সব কিছু খাপ খায় না। গৌতম-বুলবুলির মধ্যে এই নালন্দা পর্বে কিছু ঘটে নি তা নয়। শুধুমাত্র গুনগত উৎকর্ষের খাতিরে নালন্দায় দাঁড়িয়ে সেই হালকা মজাটুকু এক্কেবারে এড়িয়ে গেলাম। কারণ, মানবসভ্যতার উন্নততম প্রাচীন জ্ঞান ও বিদ্যার পীঠস্থানে দাঁড়িয়ে অন্তত এত সস্তা মজা ঠিক মানানসই লাগে না। 

আমি ভাবতেই পারছি না যে আমি দ্বিতীয়বারের জন্য দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর প্রাচীনতম ও বৃহত্তম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, যার অস্তিত্ব সবাইকে, পৃথিবীর তৎকালীন সমস্ত ক্ষমতাকে রীতিমতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। কারণ নালন্দা ছিল জ্ঞান, বিদ্যা ও প্রজ্ঞার একমাত্র আধার যা সমস্ত শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অনায়াসে খর্ব করতে পারে।

“ নালন্দা, স্যালুট!” – মনে মনে এই কথা  বলে পোড়া ইঁটের গায়ে স্পর্শ করতেই মনে হল আমার জীবন সার্থক |

যত বয়েস বেড়েছে, বেড়েছে ইতিহাসের প্রতি কৌতূহল। ইস্কুলে পড়ার সময়ে খালি সাল মুখস্থ আর অমুক পাতা থেকে তুসুক পাতা ওব্দি ঝাড়া মুখস্থ – পড়তে বসলেই ইতিহাস বিষয়ের নামে গায়ে জ্বর আসত। আর প্রচলিত ভুল ধারণা ছিল, যে যত পাতা উত্তর লিখতে পারবে, সে তত নম্বর পাবে। ফলে কোনো আগ্রহ-ই তৈরী হয় নি। এখন যা-ই দেখি শুনি শিখি, তাতে ইতিহাস ব্যাপারটা অনিবার্য কারণে হলেও অবধারিত ভাবে চলেই আসে। 

তাই নালন্দার সামনে দাঁড়িয়ে আমার জীবন ধন্য কেন মনে হল, তা কিছুই না, নালন্দার ঐতিহাসিক স্থান-মাহাত্ম, ও শিক্ষাক্ষেত্রে তার গুরুত্ব। খুব গভীর উপলব্ধির ব্যাপার।

এখানে বলে রাখি, এই লেখায় নালন্দা সম্পর্কে তথ্যগত কোনো ত্রুটি থাকলে তার দায় আমার নয়। আমাদের সাথে যিনি গাইড ছিলেন, তাঁর বয়স সত্তরের ওপরে। তিনি পান-সুপুরি চিবোনো মোটা  জিবে শুদ্ধ হিন্দিতে যা যা বললেন তা আমি মোবাইলে রেকর্ড করে নিতে থাকলাম। এক একটি স্থানে দাঁড়িয়ে উনি যা যা বললেন সবটাই আমি মোবাইলে বন্দী করে নিয়ে এলাম। সেগুলোর বাংলা তর্জমা এখানে করছি। তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুবাদ রাখলাম। সেই হিসেবে তথ্যে কোনো গরমিল থাকলে তা আমাদের শ্রদ্ধেয় গাইড সাহেবের।

অনুবাদ করার সময়ে গাইড সাহেবের বলা কিছু জায়গায় সন্দেহ থাকার দরুন, সে সব নিরাময়ের উদ্দেশ্যে আমাকে দু'জনের সাহায্য নিতে হয়েছে। এক, সুমন্ত নালন্দা সম্পর্কে যে গাইড বুকটা কিনেছিল, সেটার। আর দুই, অবশ্যই, আন্তর্জালের। তাতেও মনে হয় না সবটা একদম সঠিক করা গেল। তবু মোটামুটি ধারণা গঠনের জন্য যথেষ্ট। 

আজ রইল নালন্দার প্রথম পর্ব। 

(এবার নিচের পুরোটাই আমাদের গাইড সাহেবের বলা কথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বঙ্গানুবাদ)

**********
“পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে  আপনাদের স্বাগতম।  
(World’s First International Residential University)
আমি কমলা সিং, আপনাদের আজকের মার্গদর্শক। 
আমরা চলেছি বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে। 
নালন্দা শব্দের ব্যূৎপত্তিগত অর্থ হল (Etymological meaning):
‘নালম দধাতি ইতি’ হল ‘নালন্দা’| ‘নালম’ মানে ‘পদ্মের নাল’|  আর, যে ভূমিতে পদ্মের জন্ম হয় তা হল ‘দা’। ‘পদ্ম’ হল জ্ঞানের প্রতীক --  জ্ঞানের পদ্মসম ফুল যে স্থানে ফোটে তাই-ই ‘নালন্দা’ – জ্ঞানপীঠ।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আনুমানিক আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর পুরোনো।   

প্রথম কুমারগুপ্ত 427 CE (common era) তে নালন্দার গো‌ড়াপত্তন ঘটান। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ শুধুমাত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য “জ্ঞাণ ও প্রজ্ঞার স্বর্ণযুগ ও পবিত্রভূমি” হিসেবে  সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল। 

কিন্তু নালন্দায় একদম প্রথমে  কোনো  বিশ্ববিদ্যালয়-ই ছিল না।  399-412 CE তে নালন্দায় এক চৈনিক পরিব্রাজক এলেন। নাম ছিল ফ্যাক্সিয়ঁ, সবাই যাঁকে ‘ফং’ বলে জানেন। দশ বছর তিনি নালন্দায় ছিলেন। তাঁর লেখা ভ্রমণবৃত্তান্ত অনবদ্য ও ইতিহাস হিসেবে এক অমূল্য লিখিত দলিল। সেখানে তাঁর বর্ণনায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তাঁর বর্ণনা অনুসারে নালন্দা তখন শুধুমাত্র এক বর্ধিষ্ণু বৌদ্ধ তীর্থক্ষেত্র ছিল। পালি ভাষায় লিখিত বৌদ্ধ সাহিত্য থেকেও জানা যায় যে তখন নালন্দা এক উন্নত উপনগরী ছিল মাত্র। ভগবান বুদ্ধ নালন্দাতে বহুবার এসেছেন। সেখানে ছিল “পাবারিক” নামে একটি আম্রকুঞ্জ (ম্যাংগো গ্রোভ্)। যখনই তিনি রাজগৃহ থেকে পাটলীপুত্র যেতেন, তখনই পাবারিক আম্রকুঞ্জে থাকতেন। রাজগৃহ থেকে নালন্দা এক যোজন দূরত্বে অবস্থিত ছিল। ভগবান বুদ্ধ প্রত্যেকবারই ঐ পথ একবারে, কোথাও না থেমে, হেঁটে অতিক্রম করতেন। পরে পাবারিক আম্রকুঞ্জ বুদ্ধকে দান করে দেওয়া হয়। মহাপরিনির্বাণের ঠিক পূর্বে রাজগৃহ থেকে কুশিনগর যাওয়ার পথে ভগবান বুদ্ধ শেষবারের মতো নালন্দায় এসেছিলেন। ভগবান বুদ্ধের সবথেকে কাছের দুই শিষ্য সরিপুত্র ও মৌদ্গলিয়ান বা মহামৌদ্গলিয়ান এই নালন্দা অঞ্চলেরই অধিবাসী ছিলেন। গৌতম বুদ্ধের ঐ দুই প্রধান শিষ্য ছাড়াও বুদ্ধের অনেক শিষ্য ও বিভিন্ন মগধরাজ ও সম্রাটদের জন্মস্থান ছিল এই নালন্দা।
আগেই বলা হয়েছে, বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায় যে নালন্দা একটি প্রধান উপনগরী ছিল।  ভগবান বুদ্ধের মত, সেখানে ছিল ভগবান মহাবীরেরও প্রায়ই যাতায়াত।  বৌদ্ধ সাহিত্য অনুসারে ভগবান মহাবীরের নাম ছিল ‘নিগন্ঠ নটপুত্র’ (অর্থাত ‘জাতক’ বংশের নগ্ন স্থপতি’)। নালন্দাতে তাঁরও অনেক ভক্ত ছিল। তাঁদের মধ্যে উপালি, দ্বিঘাতপর্শী, অসিবন্ধকপুত্র ছিলেন অন্যতম। মহাবীর বর্ষাঋতুতে নালন্দাতে থাকতে পছন্দ করতেন বলে জানা যায়। এরকম তিন বার তিনি বর্ষায় নালন্দাতে আশ্রয় নেন – দু’বার তাঁর সন্ন্যাস জীবনে আর একবার ‘তীর্থঙ্কর’ রূপে।

320  খ্রীষ্টপূর্বে মৌর্য সম্রাট অশোক নালন্দায় একটি স্তূপ নির্মাণ করেন। এই নালন্দার গুরুত্ব আরো বাড়লো যখন 427 CE তে, বুদ্ধের এক হাজার বছর পরে, মগধ সম্রাট কুমারগুপ্ত এখানে প্রথম এক বিহার নির্মাণ করলেন। বিহারের ততকালীন নাম ছিল ‘পাটলীপুত্র’। কিন্তু বিহার নির্মাণ করা ওখানকার রাজা-রাজড়াদের একটা বিলাস ব্যাসন ও শখের মধ্যে পড়ত। ‘বিহার’ শব্দের অর্থ ‘বৃক্ষের আবাসস্থল’, ‘বিহার’ শব্দের অর্থ ‘ভ্রমণ’। কুমারগুপ্তের উত্তরসুরিরা পরে আরো অন্যান্য বিহার স্থাপন করেন। 700 CE তে হর্ষবর্ধনও বিহার স্থাপন করেন। 900 CE তে পূর্ব ভারতের পাল রাজারাও বেশ কিছু বিহার তৈরি করেন। সুমাত্রার রাজা বালপুত্রদেবও বিহার নির্মাণে যোগদান করেন। 500 CE তে  শ্রীবিজয় ছিল একটি হিন্দু রাজ্য। শ্রীবিজয় থেকে আসা নালন্দায় পাঠরত ছাত্রদের সুবিধার্থে সুমাত্রারাজ বালপুত্রদেব নালন্দায় একটি মনাস্ট্রি নির্মাণ করেন।

এর পরে এক চৈনিক পরিব্রাজক নালন্দায় এসে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে নালন্দা সম্পর্কে অনেক কিছু লিখলেন। উনি ছাড়াও নালন্দায় অনেক বিদেশী বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু সবার মধ্যে ওই চৈনিক পরিব্রাজক, যিনি সকলের নজর কেড়ে নেন তাঁর নাম ছিল হিউ-য়েন সাং। তিনি প্রথমে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পরে শিক্ষকও হন।  তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে এই সময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রের সংখ্যা ছিল দশ হাজার। শিক্ষকের সংখ্যা দু’হাজার। সারা পৃথিবীতে সেই সময়ে ভারতবর্ষের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একমাত্র আন্তর্জাতিক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞানের পীঠস্থান হিসেবে নালন্দার খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল।  নালন্দা থেকে লব্ধ জ্ঞানের মান ও উৎকর্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিল --
প্রথমটির নাম ‘রত্নদধি’
দ্বিতীয়টির নাম ‘রত্নরঞ্জক’
তৃতীয়টির নাম ‘রত্নসাগর’।

আবার জৈন সাহিত্য থেকে জানতে পারা যায় যে মহাবীর এখানে ১৪ টি বর্ষা ঋতু কাটিয়েছেন। বলাই বাহুল্য মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধের সময় নালন্দা ছিল খুবই উন্নত মানের একটি মন্দির উপনগরী। এখানে সবাই তীর্থব্রজে আসতেন। পরে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। কথিত আছে সম্রাট অশোক সরিপুত্র-র চৈতিতে (মন্দিরে) পুজো দিতে আসতেন। 

তারানাথ নামক একজন তিব্বতী সাধুর বই ‘হিস্ট্রি অফ বুদ্ধিঈজিম ইন ইন্ডিয়া’ থেকে জানা যায় যে দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রখ্যাত মহাযান দার্শনিক নাগার্জুন নিজে ছিলেন নালন্দার ছাত্র। পরে তিনি আবার নালন্দার প্রধান পুরোহিত (হাই প্রিস্ট) রূপে অভিষিক্ত হন। 

সুবিষ্ণু ছিলেন নাগার্জুনের সমসাময়িক এক বৌদ্ধ ব্রাহ্মন। বৌদ্ধ ধর্মের দুটি প্রধান বিভাগ 'হীনযান' ও 'মহাযান' প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি আবার ১০৮ টা মন্দির নালন্দায় স্থাপন করেছিলেন। চতুর্থ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রখ্যাত দার্শনিক আর্যদেব, পঞ্চম শতব্দীতে যোগাচার্য বিভাগের আরেক দার্শনিক অসঙ্গ ও তার ভাই বসুবন্ধু নালন্দার সাথে খুব নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিলেন।

খননকার্য থেকে গুপ্ত সম্রাটদের আগে নালন্দা কার অধিকারে ছিল, তা পরিষ্কার জানা যায় না। কুমারগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্তের সময়ের মুদ্রাই নালন্দা থেকে পাওয়া নালন্দায় প্রথম রাজত্বকালের একমাত্র ও আদিমতম প্রমাণ।  হিউ-য়েন সাং এর বর্ণনা অনুযায়ী সক্রাদিত্য নালন্দাতে একটি বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করেন। তাঁর পরের প্রজন্মে বুদ্ধগুপ্ত, তথাগতগুপ্ত, বালাদিত্য ও বজ্র আরো কিছু বৌদ্ধমন্দির স্থাপন করেন। সক্রাদিত্যকে মহেন্দ্রগুপ্ত বা কুমারগুপ্ত নামেও অনেকে চেনেন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল 413 থেকে 455 CE |

পঞ্চম শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে ফা-হিয়েন যখন এই দেশে আসেন তখন কিন্তু ওই সময়ের বৌদ্ধ ধর্মের স্থাপনা নিয়ে খুব একটা কিছু উনি বলে যাননি। কিন্তু তাঁর লেখায় একটা ‘নালো' নামে এক গ্রামের কথা পাওয়া যায়। ঐ নালো-ই, তাঁর বর্ণনা অনুসারে, ছিল সরিপুত্রের জন্ম ও মৃত্যুস্থল।  ইতিহাসবিদ-রা বলেন যে এই নালন্দা-কেই ফা-হিয়েন 'নালো' রূপে বর্ণনা করেছেন।
 
হিউ-য়েন সাং এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে রাজা পূর্ণবর্মণ একটা আশি ফুট উচ্চতার তাম্র মূর্তি নালন্দায় স্থাপন করেছিলেন। তিনি আরও লিখেছেন যে কনৌজরাজ হর্ষবর্ধন ৬০৬ থেকে ৬৪৭ সাল পর্যন্ত এখানে একটি বিশাল বড় পিতলের বৌদ্ধ মন্দির স্থাপণ করেছিলেন।কথিত আছে যে কোন যে যখনই কোনো ধর্মসভা হত, তখন নালন্দা থেকে প্রায় এক হাজার বৌদ্ধ সাধু সেখানে উপস্থিত হতেন।

দ্বাদশ  শতাব্দীর শেষে বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণে নালন্দা ধ্বংস হয়ে যায়। আর সেইসঙ্গে বিশাল লাইব্রেরী উনি জ্বালিয়ে দেন।  নালন্দাতে ওই সময়ে পরপর তিনবার আক্রমণ হয়েছিল। নালন্দা আক্রমণের পরে শেষ প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন নালন্দার তৃতীয় বর্ষের বিদ্যার্থী শ্রীভদ্র। ১২৩৫ সালে তিব্বতী তীর্থযাত্রী চ্যাঙ লোটসাওয়ার বর্ণনা থেকে জন্য যায় যে তিনি নালন্দার শেষ শিক্ষক রাহুল শ্রীভদ্র র সাথে সাক্ষাত করেন। তখন শ্রীভদ্রের বয়স নব্বই। তিনি তখনও নালন্দার একমাত্র জীবিত শিক্ষক হিসেবে সত্তর জান ছাত্রকে পাঠদান করে চলেছিলেন। নালন্দায় সবাই আক্রমনের সময় হয় নিহত হয়েছিলেন না হলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।  শ্রীভদ্র আশ্চর্যভাবে ওখানে টিকে যান। ওনার বর্ণনা অনুসারে বখতিয়ার খিলজী চৌরাশি বিহার বা চৈত (অর্থাৎ মন্দির) নৃশংস ভাবে ধ্বংস করেন। এই ধ্বংসাত্মক আক্রমণের পরে আর নালন্দার আর মাত্র দুটি বিহার অবশিষ্ট ছিল।

দ্বাদশ শতাব্দীতে চোল রাজারা, আর তারপরে পাল রাজারা নালন্দার ধ্বংসাবশেষের যত্ন নিতে আরম্ভ করেন। নালন্দাকে মেরামত করে নতুন করে তৈরি করা আর সম্ভব ছিল না। কিন্তু যথাসম্ভব পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছিল।

এর পর চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত নালন্দার বিবরণ পাওয়া যায়। তার পরে এই স্থানে কোন জনপ্রাণীর বসবাস ছিল না। কারণ বৌদ্ধ ধর্মের জনপ্রিয়তা তখন ভীষণভাবে কমতে আরম্ভ করেছিল। নালন্দা অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য তৎকালীন রাজারা কোন অর্থসাহায্য দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বহু বছর ধরে অযত্নের ফলে এই অঞ্চল মাটির প্রলপে ঢাকা পড়ে যায়।

সোজা ১৮৬১-৬২ সালে ব্রিটিশ আর্কিওলজিস্ট স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই ধ্বংসাবশেষের খোঁজ পেলেন। তার খোঁজের সূত্র ছিল হিউয়েন সাং এর লোকসংস্কৃতি সম্পর্কিত লিপির পাঠোদ্ধার।
তারপরে ১৯১৫ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত ১২ বছর ধরে নালন্দার ধ্বংসাবশেষের খনন কার্য তিনি চালান। 1974 থেকে 1982 পর্যন্ত আবার নতুন করে খনন কার্য শুরু হয় ১৯৮২ সাল অবধি মোট উদ্ধার করা নালন্দার মোট ধ্বংসাবশেষের দৈর্ঘ্য হল এক কিলোমিটারের বেশি।

খনন  কার্য এখনো চলছে। তবে খনন করতে গিয়ে দেখা গেল যে এই অংশের দুটি শাখা আছে: একদিকে বৌদ্ধ বিহার, যার মধ্যে মনাস্ট্রিগুলো পড়ে আর অপর দিকে হলো বিহার নগরের দিক।
আসুন সবাই এগিয়ে যাই।”

**********
আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত আমাদের মাননীয় গাইড-কে অনুসরণ কারতে লাগলাম। 
কমলা সিং-জি তখন আমাদের সেই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মত।
(চলবে)

রাজগীর ভ্রমণ: তৃতীয় পর্ব: ঝুলন্ত ব্রীজে বুলবুলি


সেদিন সকালে উঠে লেট-দাকে ডেকে দিতে হল। ওনার ঘুম বেশ গভীর। কোনো অ্যালার্ম কাজ করে না। ঘুম থেকে উঠে চা খাওয়া অভ্যেস। খেতে খেতে ফর্সা ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বেগ আনার চেষ্টা করতে করতে বললেন,

কি হে, কাল রাতে অসুবিধা হয় নি তো?
কিসের অসুবিধা?
আমি নাক ডাকি তো তাই…
হ্যাঁ, সে তো বেশ জোরেই ডাকেন দেখলাম। তবে আমিও আপনার থেকে কম যাই না বলে শুনেছি। কারণ নিজের নাসিকা নিনাদ তো আর নিজে শোনা যায় না। তবে আপনার ঘুম তো বেশ গভীর, তাই আর আমার নাক ডাকায় আপনার বিশেষ অসুবিধা হয় নি।
হ্যাঁ ঘুম গভীর হলেও কাল রাতে আমি যখন টয়লেটে উঠলাম তখন তোমারও নাক ডাকার শব্দ বেশ জোরেই শোনা যাচ্ছিল্।
হা হা হা হা আমি কখনো অস্বীকার করেছি যে আমার নাক ডাকে না! তবে একটা জিনিস দারুন হলো…
কি?
নাক ডাকা নাক ডাকায় কাটাকুটি হয়ে গেল।
হা হা হা হা ব্যাপারটা কিন্তু বোঝার আছে...আর চা-টা দারুণ!!!
এই বলে লেটদা হাসতে হাসতে প্রাতকৃত্য সারতে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। আমি আগে উঠেছিলাম। ফলে আমার সব সারা হয়ে গিয়েছিল। ব্যাগ আর ক্যমেরা গুছিয়ে আমি ওনাকে বলে নিচে ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম।
আটটায় কল টাইম দেওয়া ছিল। সাড়ে আটটার মধ্যে বেরোনোর কথা। কিন্তু বুলবুলিকে দেখতে পচ্ছি না। ব্রেকফাস্ট সেরে জানতে পারলাম যে বুলবুলি নাকি সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ব্রেকফাস্ট এর জন্য ওখানে ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু ব্রেকফাস্ট তো আর আটটার আগে দেবে না। তাই বিফল মনোরথে বুলবুলি আবার নিজের রুমে ফিরে গেছে। আর এখন যখন ব্রেকফাস্ট দেয়া হচ্ছে, তখন কিন্তু বুলবুলির কোন পাত্তা নেই।
তবে মিহিরদার কথা এবারে ফেল করে গেল। উনি যাওয়ার আগে ঝাউতলায় বার বার বলেছিলেন, বিশেষ বিশেষণ সহযোগে, যে, যদি দেরী কেউ করে, তাহলে একমাত্র কাজলদা। কাজলদা সবার আগে রেডি-স্টেড-অন ঈয়ো'মার্কস হয়ে পুরো মিহিরদার মুখে ঝামা ঘষে দিলেন।
মিহিরদা খুব দুরন্ধর এক ব্যক্তি। দেখে ঠিক বোঝা যায় না। কাল্টিভেট করলে, বোঝা যায়, সত্তর পেরিয়েও কি জিনিস। আর যখনি দেখেন যে লুজ বল ফেলেছেন, তখন ব্যাপারটা খুঁচিয়ে তুললেও উনি অদ্ভূত ভাবে নিজেকে নিরুত্তর রাখেন। স্নায়ুর লড়াই-এ শিক্ষনীয়।
সেদিনের প্ল্যান অনুসারে ব্রেকফাস্টের পরে বাসে করে আমরা প্রথমে যাব গ্লাস ব্রিজে। ভারতের দ্বিতীয় কাচের সেতু। দৈর্ঘ্য পঁচিশ ফুট, প্রস্থ ছ'ফুট, একসাথে জনা পঁচিশের ভার নিতে পারে। সেতুটি পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসে একটি বিশাল ও গভীর উপত্যকায় ঝুলন্ত। জাস্ট নাক গলিয়ে বেরিয়ে আছে। এপার আছে, ওপার নেই। শুরু আছে, শেষ নেই। হূট করে মাঝখানে শেষ হয়ে যাওয়া একটা ব্রিজ। যেহেতু এটার নাম কাচের সেতু, বোঝাই যাচ্ছে যে এটার ফ্লোর বা মেঝে ও বেড়া, পুরোটাই কাচের। ব্রিজটা যেখানে মাঝপথে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে সেখানে একটা গোলাকৃতি প্রশস্ত স্থান। অনেকটা চিকেন ড্রামস্টিকের মত। ওই গোলাকার মুণ্ডটিতে সবাই গোল করে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করবেন, সে ভাবেই তৈরী করা।
খানিক দূরেই পুরনো হ্যাঙ্গিং ব্রিজ। সেটাতে এখন আর বিশেষ কেউ যায় না। বোধ হয় বিপজ্জনক হয়ে ওঠার জন্য সেটিতে ওঠা ও যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। । হ্যাঙ্গিং ব্রিজটা গ্লাস ব্রিজ থেকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। দুটি ব্রীজই রাজগীরের নেচার পার্কের অংশ বিশেষ। ২০২১ সালে বিহার সরকার গ্লাস ব্রীজ্টিকে সবার জন্য উনমুক্ত করে দেয়। প্রবেশের টিকিট ওয়েব সাইট থেকে কাটা যায়। তাহলে আর অযথা টিকিট কাটার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট হয় না।
এই অনলাইনে টিকিট কাটা নিয়ে একটা ছোট গল্প আছে। আমাদের বন্ধুরা আগে থেকেই অনলাইনে চেষ্টা করছিল টিকিট কাটার। যে যে জায়গাগুলো আমরা ঘুরতে যাব, সেখানে যেন টিকিট কাটার লাইনে কোন সময় অযথা নষ্ট না হয়। ঐ সময় বাঁচনোর জন্য পাঁচ ছয় জন একসাথে উঠে পড়ে লেগেছিল। কিন্তু কিছুতেই সে টিকিট কাটা আর যায় না! টিকিট আছে কিন্তু কাটা যাচ্ছে না। দিনের বেলা সার্ভারের সমস্যা ধরে নিয়ে কেউ কেউ মাঝ রাতে টিকিট কাটার চেষ্টা করল। কিন্তু হায়, কেউই টিকিট পেল না; উল্টে আবার কারোর কারোর এমনও হয়েছে যে টাকা কেটে নিল, কিন্তু টিকিট পেল না। সে সব টাকা অবশ্য পরে ফেরত পাওয়া গেছে।
বেড়াতে যাওয়ার হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে যখন এরকম একটা অবস্থা চলছে, কাজলদা হঠাৎ লটারী পাওয়ার মত সবার টিকিট কেটে পাঠিয়ে একটা জয়ের হাসি হাসলেন, সেখানে। কিন্তু হায়! সে টিকিট কোথাকার? গ্লাস ব্রীজের নয়। ওয়াইল্ড লাইফ সাফারির। রাজগীর নেচার পার্কে জীবজন্তু দেখার ওয়াইল্ড লাইফ সাফারিও হয়। কিন্তু তার টিকিট আলাদা। আর আমাদের কেউই সেই সাফারীতে আগ্রহী নই। কাজলদা বেমক্কা সেটার টিকিট কেটেই যার পর নাই আহ্লাদিত। আমাদের স্থির গন্তব্য গ্লাস ব্রিজ। বেশিরভাগ ওয়াইল্ড লাইফ সাফারির অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কোন কালেই 'ওয়াইল্ড' পশুদের দেখা যায় না। শেষমেশ একটা গরু, বা চারটে বনমোরগ আর তা না মিললে পথের কুকুর ছাড়া কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। তাই জন্য এবারেও ওয়াইল্ড লাইফ সাফারিতে খুব একটা আগ্রহী কেউই ছিল না। ওয়াল্ড লাইফ সাফারি আর গ্লাস ব্রিজের জায়গাটা একই স্থানে, ওই নেচার পার্কের মধ্যে। রাস্তা শুধু আলাদা। ব্রিজের রাস্তায় যাতে বন্য জন্তুরা চলে না অসতে পারে, সে জন্য উঁচু পাঁচিল দিয়ে দুটো জায়গাকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে। সরকার জায়্গাটিকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে তুলেছে। আর এখনও পর্যন্ত ভালভাবেই মেন্টেইন্ড।
নেচার পার্কে ঢুকে প্রথমে যেতে হয় বাসস্ট্যান্ডে। ওখানে শুধুমাত্র নেচার পার্কের বাসই চলে। তাতে করে অনেকটা ভিতরে গিয়ে একটা পয়েন্টে বাস সবাইকে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে বাকিটা হাঁটা পথে। আমরা নেচার পার্কে ঢোকার পরেই অনেকটা সাজানো পথ পেরিয়ে বাসের লাইনে গিয়ে পৌঁছালাম। মনে হল, যে আগের দিনের মতো হয়তো রোপ ওয়েতে ওঠার মত দেড় ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমাদের আগে মোটামুটি কুড়ি পঁচিশ জন রয়েছেন মাত্র। আর একটা এক একটা বাসে ২৬ জন করে তোলা হচ্ছে। ফলে আমাদের বাস পেতে খুব একটা দেরী হবে না।
বাসে উঠে স্বভাব অনুযায়ী ড্রাইভারের সাথে আলাপ জমালাম, আমি আর অনন্ত। আর তাতে উঠে এল মারাত্মক তথ্য –
– আপ্ লোগ জল্দি যাঈয়েগা…
– ক্যিঊ?
– ওয়া পে অল্রেডি দো’শো আদমী লাইন মে খড়া হ্যায়।
– ওঃ ! খালি দো'শো আদমী!!!
– একসাথ জানে নহি দেতা। পন্দ্রা পন্দ্রা লোগ এক এক ওয়ারী মেঁ।
– ক্যায়া বোল রহে হো!! তব ওহ্যাঁ পৌঁছনে মে কিতনা টাইম লগ জায়েগা?
– মানিয়ে কি সওয়া এক সে দেড় ঘন্টা!
বলে কি! আবার দেড় ঘন্টার চক্কর, লাইনে? টিকিট কাটার সময় বাঁচিয়ে তবে লাভ কি হল!
– আপ্লোগ তো বচ গয়ে!
– আগর টিকট ওন্লাইন না লিয়া হোতা তো খালি পাঁচ মিনিট কে লিয়ে গ্লাস বিরিজ মেঁ চড়্নে কে লিয়ে সারাদিন লগ যাতা।
– ক্যিঊ?
– ক্যিঊ কি, টিকটকা কাউন্টার আভি আভি খুলা হ্যায়।
যাক বাবা! তবু একটা ভাল কাজ তো করা আছে, নাহলে এ ক'টা দিনের মধ্যে পুরো এক দিন গ্লাস-ব্রিজ, তা-ও আবার মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য, জাস্ট পোষাত না।
সবাই বাস থেকে নামার পরে আমরা যখন ড্রাইভারের বলা এস্টিমেটেড টাইমের কথা ঘোষণা করলাম, প্রথমে কেমন একটা ত্রাহী ত্রাহী রব উঠল। তারপর থিতিয়ে গেল, সবাই গুটি গুটি লাইনে এসে দাঁড়ালাম্। ড্রাইভার মিথ্যে বলে নি। লাইনের হাঁসুলী বাঁক আর তার ধীর লয়ে এগোনো সবটাই অসহ্য। শুধুমাত্র পরিবারের ক'জন বেড়াতে এলে, মোটামুটি বেড়াতে আসার মুডের ওখানেই ইতি। ঝগড়া হয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ভাগ্গিস বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পরিবারেরা আসা!
কিছুই না, এতক্ষণ লাইনে দাঁড়ানো কি মুখের কথা! তাই দলের মহারথীরা মুখ খুলল। তারপরে তাদের মুখনিসৃত যে সব বাণী ঝরে পড়তে লাগল, তাতে একটা নীল মলাটের বই হয়ে যায়। লাইনে থেকেও বিক্ষিপ্ত থাকায়, সুসজ্জিত বিরাট চেহারার সিকিওরিটি আমাদের ওয়ার্ণিং দিয়ে খানিকটা ওপরে উঠে গত তিন দিন পেট পরিষ্কার হয় নি, এরকম মুখ করে দাঁড়াতেই তার মুখটা ঠিক কিসের মত দেখতে ঐ নিয়ে বিস্তর গবেষণা, মন্তব্য ও মতান্তরের মাঝে, সমীর হঠাত অনন্তর কাছ থেকে জোয়ানের কৌটো চাইল। FYI অনন্ত ঐ জোয়ানের স্টকটা সবসময়ে ক্যারী করে। সেই কৌটো চাওয়ার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক কিচ্ছু ছিল না। আমরা যখন তখন চেয়ে খাই। কিন্তু সমীর সেটা নিয়ে নিজে না খেয়ে হঠাত সেই হুঁকোমুখো সিকিওরিটি স্টাফের দিকে তীরবেগে ধাবিত হল। সকলে দেখলাম শুনলাম। পেটের নীচ থেকে হাসির রোল মুখ দিয়ে বেরোতে চেয়েও বেরোচ্ছে না।
সমীর গিয়ে বলল্,
– ক্যা স্যারজী? ইতনা গোমড়া মুখ কর কে খাড়া ক্যিঊ হ্যায়্?
– আপ লাইন মে যাইয়ে….
– লাইনমে জায়েগা, জরুর জায়েগা...তুম থোড়া জোয়ান খা লো। ম্যায় ওয়াপিস চলা জায়েগা।
...বলে সমীরণ কৌটো খুলে তাকে জোয়ানের আরক দিতে গেল। কিন্তু ভীষণ বিরক্ত হয়ে সে বলল,
– লাইন মে যাইয়ে, হম খৈনী নহী লেতা।
– আরে ভাই, খৈনী হম ভি নেহী খাতা। ইয়ে জোয়ান হ্যায়, খৈনিকা বাপ। ইয়ে খানে সে সব কুছ হজম হো যাতা হ্যায়। আঊর খিদে বাড়্তা হ্যায়।
– ইয়ে খিদে কেয়া হ্যায়্?
– খিদে খিদে….খিদে নেহি জানতা?
– ওহি তো পুছ রাহা হ্যায়্? খিদে কেয়া চিজ হ্যায়…
– আরে খিদে খিদে...পেট কা খিদে, শরীর কা খিদে…জিসকে লিয়ে আদমি জিতা হ্যায়!....খা কে তো দেখো পইলে।
বলতে বলতে সমীর সিকিওরিটীর হাত ধরে টেনে খুলে তার তালুতে জোয়ানের দানা ঢালতে আরম্ভ করেছে। আর সে সমীরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কারো বুকের পাটা নেই যে তার সাথে এসে দুটো এক্স্ট্রা কথা বলে! আর এ কে রে? সোজা হয়ে দাঁড়াতে যার কোমরে ব্যাথা লাগে, ঘাড়ের সাথে সারা শরীরকে ঘোরাতে হয়, স্পন্ডোলিসিসের জন্য, তার কোনো ভয়-ডরের কোনো লেশমাত্র নেই! সারা মুখে-চোখে এক অজানা বিস্ময়। তবু মেজাজ নিয়ে বলল,
– ক্যায়া খিধে খিধে লগা রখ্খা হ্যায়্...সিধা লাইন মে যা কে খাড়া রহিয়ে।
সমীরও নাছোড়্বান্দা।
– আচ্ছা বাবা যাতা হ্যায়। তুম খা-কে বোলো পহলে, ক্যায়্সা লগা!
সেও দেখলাম, ওই কথায়, তার হাতের তেলোর জোয়ানের আরক গপ করে মুখে পুরে দিল। তারপর টম্ অ্যান্ড জেরী শো এর মত, কয়েক মুহূর্তে কয়েক’শো অভিব্যক্তি।
সমীরের তখন চুপ করে যাওয়া উচিত। কিন্তু তাতেও তার হয় না। আরও খোঁচাতে লাগল। সে কি আর থামে!
– কেয়া বোলা থা হাম্, আচ্ছা হ্যায় না? জোয়ান খানে সে জওয়ানী ভি বড়তা হ্যায়।
তাতে চক্ষু বিস্ফারিত করে সিকিওরিটি বলল,
– এইসা কেয়া! মগর ম্যায় শাদিশুদা নেহি হুঁ।
– তো ক্যায়া হুয়া, ইস সে শাদি কে লিয়ে ইচ্ছে চাঙ্গা হো জায়গা।
সিকিওরিটি তখন কেমন একটা সম্মোহিত চোখে আবার একবার সমীরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এক একটা হাসি-চাপা আগ্নেয়্গিরি। শুধু অবসর বুঝে ফেটে পড়ার অপেক্ষায়।
সমীর ফিরতেই তার পিঠটিঠ চাপড়ে সবাই একাক্কার কাণ্ড, যেন প্রায় হেরে যাওয়া টেস্ট ম্যাচে সেঞ্চুরী করা ব্যাটসম্যান। সমীর ডিক্লেয়র করে আমার হাতে ব্যাট দিয়ে বলল,
– বাকি টা খেলে দাও।
লোকটা বোধ হয় সমীরকে ধন্যবাদ জানাতে কয়েকটা সিঁড়ি নেমে আসতেই জিগ্গেস করলাম,
– ইয়ে ব্রীজ মে একসাথ মে কিতনে আদমি অ্যালাউড হ্যায়?
– পনদ্রা...ক্যিউ?
– হম চব্বিশ জন হ্যায় তো, একসাথ নেহী যা সখেগা?
– নহী! উতনা লোড একসাথ মে নহী লে পায়েগা।
– কিতনা কেজি কা লোড লেতা হ্যায়?
– বোলা না পনদ্রা আদমি কা!!!
– অউর ঔরত হোগী তো?
– এক হি...পন্দরা…
অনন্ত যোগ দিল
– হমারা টিম কা পন্দরা ঔরত একসাথ যা নে সে, আজ ইয়ে গ্লাস ব্রীজ কা আখরী দিন হোগা।
– অ্যাইসা কিঊ?
– আপ হামারা টিম কো গাঊর সে দেখিয়ে...পতা চল যায়েগা। ওহ যো দিখ রহা হ্যায়, দেখিয়ে ওঁহা...জিস পাত্থরকে উপর ওহ ব্য়ৈঠী থি, ওহ থোড়া নীচে দব গয়া।
বলে অনন্ত বুল্বুলির দিকে দেখাল।
লোকটা জোয়ান চিবোতে চিবোতে দেখতে লাগল। আর বিশ্বাসও করল।
– অনন্ত বলল,
– এক দো ছোড়কে বাকি সব এয়্সা হি হ্যায়্।
শুনে লোকটা খুব চিন্তায় পড়ে গেল, আর ছুট্টে তার বস কে রিপোর্ট করতে গেল।
ইতিমধ্যে চলতে লাগল ফটো শেশন। তাতে আমি বিকৃত অঙ্গভঙ্গী করে ব্যাক্গ্রাউণ্ড নষ্ট করতে থাকলাম।
অনন্তর বেটার হাফ দেবশ্রী এসে আমাকে বলল,
– এটা কি হচ্ছে? লোকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে আমাদের।
– ভাল, দেখ্ছে দেখুক না, কিছু বলার সাহস পাবে না।
– তারপর কিছু হলে কে সামলাবে?
– কাউকে কিছু করতে হবে না...এলেই কাম্ড়ে দেব।
– তোমরা জাস্ট হোপলেস।
তার মধ্যে আবার অনন্ত বলল জোয়ানে নাকি এমন ঝাঁঝ যে ওর জিভ মোটা হয়ে গিয়ে ছোট্দের মত হয়ে গ্যাছে। সব ধ্বণি ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারছে না। সব দন্ত-’স' মূর্ধাণ্য 'ষ' তালব্য 'শ' উচ্চারণ করতে গিয়ে 'চ' বেরিয়ে পড়ছে। কি সব্বোনেশে কাণ্ড! এ লোকটা তো কথা বলতে গেলে মার খেয়ে যাবে। তাই আমরা ঠিক করলাম, যতক্ষণ না অনন্ত-র জিভ ঠিক হয়, ততক্ষণ আমরা চার পাঁচ জন মিলে একটা একই রোগে ভোগা কমিউনিটি গড়ে তুলি, যাতে তেউ কিচু বোত্তে লে আম্লা নিদেলাই লুতে দাঁলাতে পালি!!! (কেউ কিছু বলতে এলে আমরা নিজেরাই রুখে দাঁড়াতে পারি!)
সেদিন সুদীপের ওপর অনেকটা দায়িত্ব দিয়েছিল অনন্ত। কিন্তু কিছুতেই অনন্ত সুদীপকে ডাকতে পারে না। এমনিতে স্নেহবশত: অনন্ত সুদীপকে শুধু 'সুদী' বলে ডাকে। তাই অবিলম্বে তার ডাককে লাগাম দিতে হল।
সমীরের আবার নাকি 'ধ' এর বদলে 'গ' বেরোচ্ছে। পাহাড়ী অঞ্চল। সত্যিই বার বার সবাইকে সাবধান করতেই হয়। 'ধারে যেও না' বলতেই হয়। কিন্তু সে তো অশ্রাব্য শোনাবে। আমি সমীরকে অনুরোধ করলাম, অন্তত: কিছুক্ষণের জন্য মৌনী নিতে। কিন্তু অভ্যাস যাবে কোথায়! মাঝে মাঝেই চিত্কার করে এক ওকে তাকে সাবধান করতে যায়। অবশেষে বললাম,
– ভাই ঠিক না হওয়া ওব্দি নিজের ছেলে-বৌ থেকে অন্তত: দূরে থাক।
এসব চলতে চলতে কখন আমরা গ্লাস ব্রীজের মুখে পৌঁছে গিয়েছি বুঝতেই পারি নি।
টেম্পারড গ্লাসের অনেকগুলো স্তরকে জুড়ে এই সেতু। সিকিওরিটি আমাদেরকে ১৩ জনের দু দলে ভাগ করে দিল। ওজন-জনিত যে প্রশ্নের কথা বলা হয়েছিল, তার উত্তরে জানা গেল মোট ২৫ জন অ্যাডাল্ট একসাথে ধরানো যায়। কিন্তু সেফ সাইডে থাকার জন্য, কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তার অর্ধেক ব্যবহার করা হয়।
কাচের গায়ে যাতে স্ক্র্যাচ না হয় সে জন্য জুতো খুলে যেতে হয়। ফীট্-কভারও আছে। ব্যবহার করে ফিরত দিতে হয়।
ব্রীজের ওপরে পা দিতেই বুলবুলির চোখ বন্ধ। গ্লাস ফ্লোরের নিচে অগাধ গভীর খাদ, সবুজ জঙ্গলে ঢাকা। পাশে যারা আছে, বুলবুলি তাদের হাত ধরে বলেই চলেছে
– আমাকে তোরা খুলতে বলিস না।
উত্তরে আস্ছে,
– কিছু হবে না…. খোল…
পুরো বিষয়টার মধ্যে একটা শব্দ মিসিং ছিল, আর সেটা হল ‘চোখ’।

চোখ মেলে তাকালে সত্যিই নয়নাভিরাম দৃশ্য! একটা ধোঁয়াশার স্তর ভিজিবিলিটিকে খর্ব করেছে বটে, তবে পাহাড়ের বুকে এরকম অভিজ্ঞতা যে প্রথম, তা অনস্বীকার্য। বরং ওই হাল্কা ধোঁয়াশার চাদর একটা অদ্ভঊত রোম্যান্টিক ও মিষ্টি মিস্টিসিজম তৈরী করেছে।
ওখানকার কন্ট্রোলে যে সিকিওরিটি ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি সুদীপ চাটুজ্জে (বনশালীর প্রিয় সিনেমাটোগ্রাফার্)-কে হার মানিয়ে দেবেন। দু মিনিটের মধ্যে কাপল ফটো, গ্রুপ ফটো, ইন্স্টা ফটো এমন্কি রিল্জ বানিয়ে দিয়ে দিলেন, চার পাঁচ রকম অ্যাঙ্গেল থেকে। আর সব সিঙ্গল টেক-এই পার্ফেক্ট।
সোজা কথায় উনি জানেন, ওই পয়েন্টে মানুষ কি পেলে তাড়াতাড়ি বিদেয় হবে। ওখানে ছ্বি তোলাটাই মুখ্য। প্র্রাণ ভরে প্রকৃতির আস্বাদ নেওয়াটা গৌন। তাই উনি লোকে যেটা চায়, সেটা দিয়ে দিলে ভিড় তাড়াতাড়ি সরে যাবে বলে, he has mastered the art.
গ্লাস ব্রীজ থেকে নেমে দেখলাম অদূরে পুরোনো ঝুলন্ত ব্রিজে যাওয়ার আগ্রহ কারোরই খুব একটা নেই। এখানে এ জীবনে আর আসবো কিনা কোনো গ্যারান্টী নেই। তাই সবাইকে বলে হাঁটা দিলাম ঝুলন্ত ব্রীজের দিকে। মাত্র পাঁচ -ছ্'শো মিটার দূরে হবে। গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে দারুণ মেঠো রাস্তা। হাঁটা শুরু করতেই দেখি কচ আর তার দেবমিতা আমার সাথে। ওরা কথায় কথায় মনে পড়িয়ে দিল যে, ঠিক এরকম একটা ব্রীজ ছিল হ্যারিসন ফোর্ডের ইণ্ডিয়ানা জোন্স সিরিজের কোনো একটিতে। তখন মনে পড়ল না কিছুতেই। পরে হোটেলে ফিরে ধাঁ করে মনে পড়ে গিয়েছিল সবটা।
"টেম্পল অফ ডুম্"-এ ছিল, ওরকম ঝুলন্ত ব্রীজে ফাইটিং সিন। ভিলেন ছিলেন অমরেশ পুরী। পরিচালক স্পিলবার্গ উত্তর ভারতের কোনো এক অঞ্চলে দৃশ্যটি তুলতে চেয়েছিলেন। অনুমতি পান নি। অগত্যা শ্রীলঙ্কার ক্যাণ্ডি হাইল্যাণ্ডে দড়ির ঝুলন্ত ব্রীজে দৃশ্যটি তোলা হয়। অনেকে গাঁজাখুরী গপ্প বলে বদ্নাম করলেও, এটি আমার কাছে বাপু আইকনিক, তিনটে কারণে:
১. হ্যারিসন ফোর্ড
২. স্পিলবার্গ
৩. অমরেশ পুরী স্পিলবার্গের সিনেমায় (এটা কি গর্বের বিষয় নয়?)
তবে ঝুলন্ত ব্রীজে পৌঁছে দেখলাম, সেখানে যাতায়াত বন্ধ। নাকের বদলে নরুণ, তার পাশে একটা ছোট ঝুলন্ত ব্রীজ। সেটা দিয়ে যাতায়াত করা যায়্। তাই-ই সই!
ততক্ষণে আমাদের দলের সবাই-ই মোটামুটি এসেছে।
আর কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ঝুলন্ত ব্রীজের মাঝখানে বুলবুলি। পর পর খচাত খচাত ক্লিক, মোবাইলে, ক্যামেরায়, বিভিন্ন পোজে, বিভিন্ন আলোয়। হঠাত বুলবুলির ইচ্ছে হল, সানগ্লাস পরে গৌতমের সাথে ছবি তুলবে। বেশ। সানগ্লাস কোথায়? না, গৌতমের ব্যাকপ্যাকে। তা, আবার বেশ। বুলাও গৌতমকো।
গৌতম এল, কিন্তু ব্যাগ? নেই তো। কোথায় ব্যাগ?
লাস্ট দেখা গিয়েছে আসার সময়ে সাফারির বাসে। তারপর?
কেউ জানে না।
কিন্তু ব্যাগে রয়েছে সব – সানগ্লাস, টাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স, আরো অনেক কিছু।
ঝুলন্ত ব্রীজের ওপার থেকে বুলবুলি রাগে ছুটে নাম্তে গিয়ে দুলে উঠল ব্রীজ।
না। কিন্তু কিছু ঘটল না। সেফ ল্যান্ডিং।
ওখানে পোস্টেড সিকিওরিটিকে বলা হল হারানো ব্যাগের কথা।
মোবাইল ফোন ওখানে কাজ করে না। স্টাফেদের মধ্যে অনুমোদনও নেই। ওনারা ওয়াকিটকি ব্যবহার করেন, খুব দরকার হলে। কালে ভদ্রে ব্যবহার হয় বলে ব্য়াটারী নেই। সিকিওরিটির ভদ্রলোক পরের সিকিওরিটির পয়েন্টে চলে গেলেন, ব্যাগ হারানো রিপোর্ট করতে। সাথে গেল, গৌতম ও অনন্ত।
পাঁচ মিনিটে ফিরে এসে বললেন
– মেডাম, গেট মেঁ ব্যাগ রখ্খা হুয়া হ্যায়্। ২৩ নাম্বার বাস -সে মিলা হ্যায়।
ব্যাগটা যে পাওয়া গিয়েছে, এতে সবাই খুব নিশ্চিন্ত। বুলবুলি-গৌতম-ও।
দাম্পত্য জীবনে পঁচিশ বছর একসাথে কাটালে খুশির অভিব্যক্তিগুলো বদলে যায়, আর তা সব দম্পতির ক্ষেত্রে ধ্রুব সত্য। বুলবুলি-গৌতমেরটা নমুনা মাত্র।
– ব্যাগ্টা তোমাকে লক্ষ্য রাখতে বললাম। এটুকু পারলে না। কি কর!
– কখন বললে?
– বেশি বাজে বকলে আর কাজের কথাটা কানে ঢুকবে কোথ্থেকে? খালি হ্যা হ্যা হি হি...সিরিয়াস হও।
– ব্যাগটা তোমার। তোমার পিঠে ব্যাগ। আমি হঠাত বললেই খোঁজ রাখব কি করে?
– রাখতে হবে।
বুলবুলি ভীষণ রেগে বলল,
– আচ্ছা, ব্যাগের বদলে তুমি হারাও না কেন বলতো?
গৌতম কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলে বুলবুলির কি হাল হয়, সে আমরা আগেই দেখেছি।
চোখে হারানো কাকে বলে, সেই প্রথম চাক্ষুস করেছিলাম সবাই।
কাকতালীয় ভাবে ঘটনাস্থল, সেই বাস।
(চলবে)