আমরা ধীরে ধীরে পৌঁছালাম রাজগীর ভ্রমণের নবম অধ্যায়ে আর নালন্দা ভ্রমণের পঞ্চম পর্বে।
আমাদেরকে গাইড সিং-জি বললেন
“ঐ যে সামনে বিশাল প্ল্যাটফর্ম দেখছেন, ওটি হলো উন্মুক্ত স্থানে ধ্যান ও উপাসনার জন্য। ওপেন এয়ার মেডিটেশন-এর উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। এ তো আপনারা জানেনই যে ধ্যান বা মেডিটেশনই হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের মূল কথা। নালন্দাতেও তাই ছিল। নালন্দা তো বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পূর্বে আসলে ছিল বৌদ্ধ বিহার। এখানে ভিক্ষুকরা থাকতেন সাধনার জন্য। ওনাদের জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল ধ্যানের মাধ্যমে নির্বাণ প্রাপ্তি। যে জন্য ঐ উন্মুক্ত স্থানের নির্মাণ।
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপণের আগে এখানে অধ্যয়ণ হত না তা নয়। ওই সময় নালন্দার শিক্ষণীতি তিন ভাগে বিভক্ত ছিল:
১) অধ্যায়ন
২) অভ্যাস
ও
৩) অনুভূতি
লার্নিং, প্র্যাকটিস এন্ড রিয়েলাইজেশন।
এই ধরনের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য ছিল স্বাভাবিক মানুষের বাস্তব জীবনধারণের সময় যাতে ঐ আহরিত বিদ্যার প্রত্যেকটির যথাযথ ফলিত প্রয়োগ ঘটে। মানে সহজ কথায় এই বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র জ্ঞান আহরণের জন্যই ছিল না, বাঁচতে গেলে চলার পথে ঐ বিদ্যার্জন জরুরী বলে এখানকার পণ্ডিতদের মনে হয়েছিল। পরে যখন এখানে ধীরে ধীরে আরো অনেক বিহার গড়ে উঠলো, তখন এর নাম হলো “নালন্দা মহাবিহার"। এই পুরো জায়গাটির আসল নাম কিন্তু এখনো “নালন্দা মহাবিহার"-ই রয়ে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পরে তখন তার আগে পর্যন্ত এখানে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছিল সেই সবই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে ঢুকে গেল। বিদ্যার যে সমস্ত বিভাগের চর্চা তখন বিশ্বখ্যাত ছিল,
সেগুলি হল:
Logic, Grammar, Medicines (Ayurveda), Arts, Fine-arts, Metaphysics, Astronomy, Vedas, Hinayan, Mahayan, and other Buddhist philosophies.
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রাধাকুমুদ মুখার্জির মতে
‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রোজ একশোর মত লেকচারের আয়োজন করা হতো। বিভিন্ন বিষয়ের দর্শণ ও ধর্মের সাথে সে সবের যোগযোগ : আলোচনায় সেই দিকগুলি প্রধাণ ছিল। এছাড়া কলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত ছিল নালন্দা। মূর্তিনির্মাণকলা এখানকার বিশ্ববিখ্যাত এক শিল্প ছিল।' আশেপাশের দেওয়ালে তার নিদর্শণ স্পষ্ট। পড়াশোনার যে ধরন ছিল তাতে ফরমাল লেকচার ছাড়াও চলত learning by discussion and interrogation। হিঊ-এন্- সাং তা নিজের লেখায় তা বর্ণনা করেছেন। দলাই লামা পরে একেই ‘সায়েন্স অফ মাইন্ড’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুলপতিরা ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞ ও পন্ডিতদের অন্যতম। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম না বললেই নয়, তাঁরা হলেন, নাগার্জুন, আর্যদেব, অসঙ্গ, বসুবন্ধু, দিঙনাগ, ধর্মপাল, শীলভদ্র, ধর্মকৃতি, শান্তরক্ষিত ও পদ্মসম্ভব। যখন হিঊ-এন্- সাং এখানে বিদ্যার্থী ছিলেন তখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুলপতি ছিলেন শীলভদ্র স্বয়ং।ওনার কাছ থেকে হিঊ-এন্- সাং যোগশাস্ত্র ও ভূমি সংস্কার সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন।হিঊ-এন্- সাং কিন্তু অত্যন্ত প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন। উনি তখনকার প্রথম দশজন বিদ্বানদের মধ্যে ছিলেন একজন। আর ওনার শিক্ষক শীলভদ্র ছিলেন প্রখ্যাত সংখ্যাবিদ। সমস্ত সংখ্যাতত্ত্ব শীলভদ্র গুলে খেয়েছিলেন। সাথে আবার উনিই নালন্দার highest authority of yoga shastra ছিলেন।
দেখতেই পাচ্ছেন যে এখানকার লাইব্রেরী তো শেষ, কিছু অবশেষ ছাড়া। কিন্তু শীলভদ্রের লেখা একমাত্র পুস্তক “আর্য বুদ্ধভূমি ব্যাখ্যা”-র তিব্বতি অনুবাদ নেপালে সুরক্ষিত আছে। এমনিতে এই অনুবাদ এখন তিব্বত ও চীনের বিভিন্ন মন্দিরে পাওয়া যায়। এখানে (নালন্দায়) তো সব নষ্ট হয়েই গেছে, তবুও আমাদের সৌভাগ্য যে খোদ আসল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টাই আমাদের দেশে রয়ে গিয়েছে, যা কেউ কোনদিন এখান থেকে নিয়ে চলে যেতে পারবে না। আর দুঃখের বিষয় হলো এই যে, আমাদের নিজেদের দেশের এরকম একটা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা ও তথ্য আমরা পাচ্ছি একজন বিদেশি চৈনিক বিদ্যার্থী হিউ-এন্-সাং-এর বিবরণ থেকে; আমাদের দেশের কোন ব্যক্তি সেই সময় নালন্দা করে আলাদা কিছু এবং সুচারুরূপে বর্ণনা করে যান নি, বা তার তাগিদ ও গুরুত্ব উপলব্ধি করেন নি।”
আমরা এগিয়ে গেলাম গাইড কমলা সিং জির সাথে। সবাই এবারে এমন এক জায়্গায় দাঁড়ালাম যে তা অবাক করা। কমলা জি বলতে লাগলেন। আমরা তাঁর বর্ণনা অনুসারে মনে মনে ছবি আঁকতে থাকলাম, যার যার নিজের মত করে।
“এখন আমরা দেখছি নালন্দার ক্লাসরুম।”
শিহরিত হলাম্। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজ যে যে যা হয়েছি,করছি, বা ভবিষ্যত কে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, সবের শিক্ষা ওই 'ক্লাসরুম'।
রবীন্দ্র্নাথ ঠাকুর যে বিদ্যালয়ে যেতেন (কিছুদিনের জন্য), যে ক্লাসরুমে বসতেন, ডিরোজিও-র ক্লাস, সুভাষচন্দ্রের প্রেসিডেন্সি কলেজের করিডোর দিয়ে সাহেব পিটিয়ে বুক চিতিয়ে হেঁটে যাওয়া, নিজেদের ক্লাসের বিভিন্ন পর্যায়, সবটাই ‘ক্লাসরুম’-ভিত্তিক। কথায় বলে 'মানুষ গড়ার কারখানা'...সেই ক্লাসরুম্!!!
একেবারে অন্যরকম ক্লাসরুম, যেখানে ন'শো বছর ধরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলেছিল।
গায়ে কাঁটা দিলে আমার কি দোষ!
বলে চলেছেন কমলা সিং:
‘Bihar means a residential building for the Buddhist’ and ‘monastery means college unit or residence.’
দেখতেই পাচ্ছেন দুদিকে আছে রক্ষক দেবতার মূর্তি| সামনের ঘরটি হল মুখ্য পূজা/উপাসনাগৃহ, যেখানে বুদ্ধমূর্তি থাকতো। তখনকার রীতি অনুযায়ী প্রচলিত নিয়ম ছিল যে ছাত্র শিক্ষক নির্বিশেষে এই স্থান দিয়ে যাওয়ার সময় বুদ্ধমূর্তিকে প্রণাম করবে আর বৌদ্ধমন্ত্র উচ্চারণ করে বলবে
‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি
ধর্মং শরণং গচ্ছামি
সঙ্ঘম শরণং গচ্ছামি’
এটা একবার নয়। তিন তিনবার বলবে।
এখানে বলে দিই যে এখন যে বিহারটিতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তা হল আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য। সেই সময় এখানে রাজা ছিলেন রাজা দেওরাজ/দেবরাজ। সুমাত্রার রাজা বালপুত্র দেব এই বিহার নির্মাণের যাবতীয় খরচ বহন করেন। সেই নির্মাণের কাহিনী একটি তাম্রলিপি থেকে পাওয়া যায়। সেই তাম্রলিপিটি কলকাতার জাদুঘরে সুরক্ষিত আছে। তাতে লেখা আছেযে রাজার দেবরাজ পাল পাঁচটি বিহারের মেনটেনেন্স, মানে এই বিহারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। এখানকার সে ই সময়ের হস্তলিপির প্রতিলিপি থেকে ষড়দ্বীপরাজ বালপুত্রদেবের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এটুকু বলতে পারি যে এটা হচ্ছে বিহার সংখ্যা এক। এই বিহারের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট হল এটি ন’বার নষ্ট হয়েছিল এবং ন'বার পুনর্গঠিত হয়। নালন্দায় এত বেশি বার আর কোন বিহার নষ্ট হয়নি। না অন্য কোনো বিহার এতবার পুনর্গঠিত হয়েছে। এই বিহার হচ্ছে সেই স্থানের নিদর্শন যেখানে সব থেকে বেশি প্রতিস্থাপনের চিহ্ন অবশিষ্ট আছে।
পুনর্গঠন ও ন'টি স্তর সম্পর্কে গল্প আছে। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, (আঙুল দিয়ে দেখিয়ে) প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্তর রয়েছে। বাকি ছয়টি স্তর কিন্তু নিচে আছে। যখনই নতুন করে কোন স্তর তৈরি করা হবে, তখন তার নিজস্ব অস্তিত্ব তো নষ্ট হবেই। কিন্তু ভিত তো আর ফেলে দেওয়া যাবে না। ফলের প্রতিটা স্তরেই নিচের দিকের একটু একটু করে পড়ে আছে। এই যে স্তরটি দেখছেন (আবার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে) এর নিচে কিন্তু আর মাটি নেই। আছে পুরাণো স্তর। নি:সন্দেহে স্তরগুলিকে আলাদা করে বোঝা খুব কঠিন। কিন্তু আমি যখন গাইড হিসেবে আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, যতটা পারব বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।বিহার সংখ্যা এক-এর পুরোটাই আগুনে পুড়ে ঝলসে গিয়েছিল। ঘরের দেয়ালে সেই আগুনে ঝলসে যাওয়ার চিন্তা খুব স্পষ্ট। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন ঘরের জানালায় কোনো পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন নেই। কারণ এই জানালাগুলি তৈরি হয়েছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে। অথচ এই বিহার প্রথম তৈরি হয়েছিল নবম শতাব্দীতে। তখন ঐ জানালাগুলি ছিল না। টাইমলাইন অনুসারে তাই এই জানালাগুলো জ্বলার কথা নয়। যখন কিছু জ্বলবে, সেটা তার রানিং পিরিয়ডেই জ্বলবে। পরে তো আর জ্বলবে না, তাই না!
আমি একটা ঘরের মধ্যে এতগুলো শতাব্দীকে ধরে রাখার রোমাঞ্চ্কর ইতিহাসটকুই আপনাদের বোঝাতে চাইছি।
আসুন আমরা এগিয়ে যাই।”
একটা কথা বুঝতে বাকি নেই, যে খ্রিসমাসের আবহে নালন্দায় যে mass-এর সমাহার হয়েছে, আর তাতে ৯৫ শতাংশ লোক যেরকম জায়গাটিকে একটি অ্যামিউজ্মেন্ট পার্ক হিসেবে ধরে নিয়েছেন্, তাতে আমাদের মত একটি গ্রুপ্-কে পেয়ে আমাদের গাইড সাহেব তাঁর সবটুকু উজাড় করে দিতে চাইছিলেন।
(চলবে)


















