Wednesday, 18 December 2024

পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে: নরক গুলজার ও কিছু ছড়ানো কথা:


তখন চলছিল মধ্যান্তর। চা খেতে বেরিয়েছি। 
আমার আর দেবিকার মধ্যে এই পুরনো নাটকটা নিয়ে অত্যন্ত ব্যক্তিগত আলোচনায় হঠাৎ এক অচেনা অজানা ব্যক্তি কাঁটাতার পেরিয়ে প্রবেশ করে বললেন, 
-- এটা আসলে ওই নাটকটা নয় !!! এটা নতুন একটা নাটক নামিয়েছে, ওই পুরোনো নামে... 

 আমরা নিরুত্তর ....চেঞ্জ সবাই নিতে পারেন না। 

আমরা জানি কিছু জিনিস নামে কাটে -- 'ফেলুদা' 'ব্যোমকেশ' তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই ওনার কথাটা নেহাত ফেলনা নয়। তবে তা আংশিক সত্য আবার আংশিক মিথ্যাও বটে। এই নাটকটির যখন একটা লোকাল ভার্শন তৈরী করে আমরা স্টেজ করেছিলাম, (আমি কোনো থিয়েটার ব্যক্তিত্ব নই। তবে ভালবেসে অভিনয় করি। সাথে কিছু মানুষ আমাকে সসম্মানে মেনেও চলেন) তখন নাটকটিকে টেনে হিঁচড়ে, কেটে ছেঁটে, সময়োপযোগী করে মোটামুটি এক ঘন্টা কুড়ি মিনিটে নামানো গিয়েছিল। আর কাট-ছাঁট করলেও মূল নাটকে যা আছে তা থেকে খুব বেশি সরে যাই নি। বেশ ভালই হয়েছিল। এখানে নাটকটির দৈর্ঘ্যের প্রতি সৎ থাকতে গিয়ে অভিজ্ঞ পরিচালক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় একটু ভুলই করে ফেলেছেন বলে মনে হয়। আরো মেদহীন করা যেত, অনায়াসে। 

আমরা বসে ছিলাম 'বি'-রো তে। আমাদের ঠিক পিছনে এক ষাঠোর্ধ ভদ্রলোক (পরিচিত নাট্যব্যক্তিত্ব) দিব্যি নাক ডাকছিলেন। সে নাসিকাগর্জণের তীব্রতা এমন যে মাঝে মধ্যে আমি গুলিয়ে ফেলছিলাম যে কোনটা স্টেজের নাটকের ব্রহ্মার নাক ডাকার শব্দ আর কোনটা ওনার। 

 হ্যাঁ, তা যে কথায় ছিলাম -- ভদ্রলোক সত্য কথা বলেছেন এই জন্য এই নাটকটির বহুলাংশে সময়োপযোগী করতে গিয়ে তার মূল ভাব থেকে সরে যাওয়ার একটা ঝোঁক দেখা গিয়েছে। যদিও তা আবার সাবলীল ভাবে ফিরে এসেছে, কিন্তু ফাঁকটা দৃশ্যত ভরাট হয়নি। 
আবার ওই দর্শকের কথাটি একাধারে মিথ্যাও এই কারণে যে ওনার বোধহয় আশানুরূপ হয় নি। মনে হয় নিজের যৌবনকালে নাটকটি দেখে যেভাবে উপভোগ করেছেন তার তিরিশ বছর পরে আবার এই নাটকটি দেখে যে ভাবে চেয়েছিলেন সে ভাবে হয় নি। সেই আশানুরূপ মজাটুকু আর পান নি। কারণ আমার বদ্ধমূল ধারণা যে ওনার নিজেরই মনে নেই আসল নাটকে কি ছিল। কারণ বিপ্লববাবুর মত অভিজ্ঞ পরিচালক নাটকটি নামানোর সময় এইটুকু মাথায় রেখেছিলেন যে এই নাটক নিয়ে এপাশ ওপাশ করা যায় বটে কিন্তু বেশি সরা যায় না। তাহলেই ধপাস। ঘোরতর বিপত্তি। তাই আদি নাটকের মূল থেকে তিনি একবারের জন্যেও সরে আসেননি। 

 নাটকটিতে বিভিন্ন ব্যক্তির অভিনয় সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার নেই। কারণ নাটকটির গল্পই স্যাটায়ার নির্ভর। গোদা ভাষায়, কমেডি। যে কোনো কমেডির প্রাণ হল, timing and expression। সেদিক থেকে রিহার্সাল এবং স্টেজ দুটো দেখেই মনে হয়েছে যদি নাটকটির প্রতি সবথেকে অনেস্ট কেউ থেকে থাকেন তিনি হলেন ব্রহ্মার চরিত্রে রজত গাঙ্গুলী মশাই, ব্রহ্মার চরিত্রে। গৌতম হালদার নারদের ভূমিকায় এবং পার্থিব ডন বাঁটুলের চরিত্র চিত্রণে সমুজ্জ্বল| উনি ওনার প্যাটার্ন খুব একটা ভেঙে বেরিয়েছেন বলে মনে হলো না। বোধহয় ওই বিশেষ প্যাটার্নটার জন্যই ওনাকে এই নাটকটিতে ওরকম চরিত্রে ভাবা হয়েছে। 

 নাটকটির অভিঘাত, একদম লিনিয়ার ও এন্টারটেনমেন্ট ভিত্তিক। গভীর ভাবে ভাবার মত কিছু নেই। স্যাটায়ারের কশাঘাত সবার পূর্ব পরিচিত। শুধুমাত্র নির্মল হাসির উদ্রেকের জন্য যা যা করার প্রয়োজন সব করেছেন পরিচালক, মাত্র এগেরোটি রিহার্সালে। তবে পুরো নাটকটাতে একমাত্র যে দৃশ্যটি সব পেরিয়ে, মনকে ছুঁয়ে গেল, তা মানিকের ফলিডল খেয়ে আত্মহত্যার দৃশ্য। মানিকচাঁদের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত, ওরফে, তাজু। 

শুনলে মনে হবে যে আমি বোধহয় ওর খুব কাছের বন্ধু বলে এই প্রশংসাটা করলাম। আদপেই বিষয়টা তা নয়। আমার বিভিন্ন বন্ধু-বান্ধবরা, যাঁরা নামকরা শিল্পী, বা শিল্প জগতের সাথে যুক্ত আছেন, তাঁদের কাছে আমি আমার সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিটা সাহস করে তুলে ধরি, সে ভালো হোক বা খারাপ। আমি একজন কিছু না-জানা সাধারণ মানুষ। আমার তাঁদের সৃষ্টি ভালো লাগল না খারাপ, সেটা তাঁদের শিল্পী হিসেবে জানা সবথেকে আগের কর্তব্য বলে আমার মনে হয়। সিচুয়েশনটা বাইনারি -- হয় হ্যাঁ, না হলে, না; মধ্যবর্তী কোন যুক্তি এখানে খাটে না। 

 পুরোনো চালের কথায় একটা কথা না বললেই নয় যে, হ্যাঁ ফ্যাশন থেকে আরম্ভ করে এন্টারটেইনমেন্ট, সমস্ত কিছুই একটা ‘সার্কেল অফ লাইফ’ মেনে চলে, যেখানে ঘুরেফিরে সেই পুরোনোতেই ফেরত আসতে হয়। তা বলে কি আর ডাইনোসর ফেরত পাব ? আর পেলেও হয়ত কয়েক কোটি বছর পরে। সে প্রসঙ্গ আলাদা। কিন্তু যে মানুষ ওপেন মাইন্ডেড, তিনি বুকে হাত রেখে দেখতেই পাচ্ছেন, বুঝতেও পারছেন, যে গত ১৫ বছরে পুরোনোকে টেক্কা দেওয়ার মতো নতুন কিছুই তৈরি হয়নি । নতুন শিল্পীরা যতই বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ডের তকমা নিয়ে নিজেদের বগল বাজিয়ে বাজার গরম করেন না কেন, সে সবই ট্রানজিয়েন্ট, ক্ষণস্থায়ী। টাইমলেস হতে পারার মত আভ্যন্তরীন গভীরতার খুব অভাব। সবাই একটা মোমেন্টারী প্লেজারের দিকে দৌড়াচ্ছে, অন্ধ হয়ে। তার পরে যখন উপলব্ধি করছে যে পুরো দৌড়টা এক পরম শূন্যতার দিকে, তখন ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে নিজেরাই শূন্যতার দিকে ধাবমান হচ্ছে। যখন কারো কাছে শুনি যে 
 -- ব্রায়ান অ্যাডামসের নাম আর ক’জন জানে! দলজিত তার থেকে অনেক বড় স্টার… ওই তোমার জেনারেশনের কিছু লোক ওকে (ব্রায়ান অ্যাডামস)-কে নিয়ে নাচানাচি করে। দলজিতের নামবার অফ ফলোয়ার্স দেখ আর ব্রায়ান অ্যাডামসের দেখ। ওখানেই সব দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে যাবে। 

-- তখন অন্তঃসার শূন্যতাটা প্রকট হয়ে ওঠে| 

 ঠিক একই রকম ভাবে দেখতে পাই যে আধুনিক বিভিন্ন গায়ক গায়িকারা সেই বেগম আখ্তারের 'জোছনা করেছে আড়ি' র মত গানটিকে নিজেদের মতো গাওয়ার চেষ্টা করছেন। চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগের ইচ্ছে হচ্ছে বেগম আখতার-কে টেক্কা দিয়ে দেবেন। আর সে বৈতরণী পার করবে কে? না, ফলোয়ার্স। কমেন্ট বক্সে লেখা থাকে, “ওয়াও even bather then the original…” কিংবা “যা গেয়েছেন, তাতে আসলটির থেকেও ভাল হয়েছে।" 

আর আমার স্থির বিশ্বাস যে আসল গানটি তাঁদের মধ্যে শুনেছেন ক’জন! 

রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নাতনী স্বয়ং অনায়াসে বলে দিচ্ছেন, ওনার দাদুর সময়ের থেকে আধুনিক সময়ের অনেক তফাত্, তাই পুরাতনী গানে একটু হার্মোনিয়ামের বদলে সিন্থেসাইজার, তবলার বদলে প্যাড, এসব ব্যবহার করলে, তবেই সময়োপযোগী হওয়া যাবে। 

 সত্যিই খুব কঠিন সময়!! যখন মানুষ তার ঐতিহ্য-কে ভুলতে বসে, তখন তার এমন অধ:পতন হয় যে সেখান থেকে ফেরার পথ থাকে না। আজকাল আকচার দেখাই যায় যে মূল্যবোধ শিখতে মানুষ বিজ্নেস স্কুলে মোটা টাকা দিয়ে কোর্স করতে যায়। এবং সেটা আবার অনেক স্কুলের ইউ-এস্-পি।


 এই সার্বিক ও সর্বজনীন ক্ষণস্থায়িতার প্রসঙ্গে আমার ভাই ঠিকই বলেছে।  মানুষের ডেপ্থ অফ থিংকিং নিয়ে যখন ওর সাথে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ করে আমাকে বলল, 
 - দেখ অত ভেবে লাভ নেই। এখন লাইফ হলো গিয়ে রিলজ-এর মত -- হাতে এক মিনিট সময়…তার মধ্যে চেটেপুটে নাও ও নেওয়াও। 
কথাটা আমার বেশ মনে ধরেছে।
 কিন্তু পুরনোতে ফেরত যেতে গেলে তো আর এক মিনিটে হবে না। সেখানে দরকার ইচ্ছার, ধৈর্যের, স্থৈর্যের, নিরন্তর শেখার মানসিকতার, শিক্ষার আর রিসার্চের। আর এগুলোর জন্য দরকার অনুভূতির গভীরতার। এটা সত্যি যে উপরের যে কটি সফ্ট স্কিলের কথা বললাম, সেগুলো সবই ডাইনোসরের যুগের বলেই মনে হবে। এখনকার যুগে এসব কথা অচল। এখন ট্রেন্ডিং হতে গেলে, ইম্প্যাক্টফুল হতে, গেলে ফলোয়ার বৃদ্ধি করতে গেলে একটাই রাস্তা -- নিজেকে একটা প্যাকেজ হিসেবে বাজারে বেচে ফেলা। 

এই প্যকেজের ধারাকে অতিক্রম করতে পারে নি বাংলার থিয়েটার মহলও। বেশির ভাগ দলই আর নতুন অভিনেতা গড়ে না। নামকরা যাঁরা কিছু করে খাচ্ছেন, তাঁদের ভাড়া করে এনে টিকিট বিক্রি করার মার্কেটিং চলে। বাংলা থিয়েটারের ক্ষেত্রেও তাই নতুন কোনো বলিষ্ঠ নাটক গত পাঁচ বছরে দেখেছি কি না মনে পড়ে না। পুরনো বিখ্যাত যা কিছু ছিল দেবেশ চট্টোপাধ্যায় মশাই সেগুলোকে ছেঁকে নিয়ে নতুন মোড়কে মানুষের কাছে তুলে ধরছেন। তাতেই হাউস ফুলের পর হাউস ফুল। নতুন নাটকের বিক্রি কোথায়! তার মধ্যেও দেবাশীষ, অর্ণ (মুখোপাধ্যায়) আর সৌরভ (পালোধি) নতুন কিছু করে দেখানোর চেষ্টায় আছেন। তবে অর্ণ-র দলের (নটধা) নাটক যদি দুটো তিনটে কেউ দেখে থাকেন তাহলে তার পরেরটাই একটা প্যাটার্ন মনে হবে। সেখান থেকে সরে আসার মত দৃষ্টিভঙ্গি কিছু নেই। গৌতম হালদারের অভিনয়ের যেমন একটি বিশেষ ধরণ আছে, অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের দলেরও একেবারে ভিন্ন হলেও একটি বিশেষ অভিনয়ের ধরণ আছে, যা খুবই ফিজিক্যাল ফিটনেস নির্ভর বা স্টান্ট বেসড বললে ভুল হবে বলে মনে হয় না। ফলে অভিনয়শৈলীর সূক্ষতার অভাব বেশ প্রকট। তাই প্রথমে বেশ ভাল লাগে। কিন্তু নটধার দু-- তিনটে নাটক দেখার পরেই মনে হয়, আবার!!!.... এ আর নতুন কি!!! 

ঘুরে ফিরে দেখুন নতুনের হুজুগে ফিরে এলো সেই পুরোনো এল.পি.। এখনও যাঁরা গান শুনতে ভালোবাসেন, গানের কালেকশন রাখতে ভালবাসেন, তাঁরা সবাই এলপিতে ফিরে গিয়েছেন। সিডি ডিভিডিতে ধুলো পড়ে। 

আর আন্কোরা নতুনের বালাই শুনুন -- আমাদের সালকের পুরোনো বাড়িতে সনি-র একটি পুরোনো বক্স টিভি আছে। বয়স, কুড়ি বছরের বেশি। তখনও যেমন ছিল এখনো তেমন। ভার্জিন্, মেকানিকের হাত পড়ে নি। কিন্তু ‘নতুন’ ফ্ল্যাট টিভি যখন থেকে বাজারে এসেছে, তারপর থেকে এই কুড়ি বছরে এখন দেয়ালে যেটা ঝোলে, সেটা চার নম্বর। আগের খারাপ হওয়া ফ্ল্যাট টিভিটা যাঁকে বিক্রি করলাম তিনি পুরনো ইলেকট্রনিক গুডস এর ব্যবসায়ী। বললেন - পরেরবার যখন টিভি কিনবেন স্যার, আমি বলে দেবো যে কোন ব্র্যাণ্ডের কোন মডেলটা কিনলে অন্তত আগামী পাঁচ বছর আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। কারণ আমরা মার্কেটে থাকি, আমরা জানি যে কোনটার বয়স দু’ বছর আবার কোনটার বয়স ছ’ বছর। আট দশ বছরের ধরে একই ফ্ল্যাট টিভি ব্যবহার করছেন, এরকম রেয়ার। এখনকার টিভির অ্যাভারেজে লাইফ ম্যাক্সিমাম চার থেকে পাঁচ বছর। হয় বেশি দিন টেঁকে না, নয় টেকনোলজি এমন পাল্টে যায় যে আমরা নতুন কিনতে বাধ্য হই | 

 যে নাটক নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম তা হল সদ্য প্রয়াত নাট্যজগতের প্রবাদপ্রতীম মানুষ মনোজ মিত্র মহাশয় রচিত 1976 সালে স্টেজ হওয়া 'নরক গুলজার'। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর দল সুন্দরম্, মাঠে নেমেছে তাঁর হিট নাটক ‘নরক গুলজার’-কে আবার রস্টেজে নামানোর জন্য। প্রযত্নে সেই বিলু দত্ত মহাশয়। নাটকের শেষ তিনটে রিহার্সাল চলছিল ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল, কলেজস্ট্রিটে। কলেজ্স্ট্রিটে এমনিই ঘুরতে যাই মঝে মাঝে।

সেদিনও গিয়েছিলাম। তাজু বলল, “আমি ওখানে রিহার্সালে আছি, দেখা করে যা।" দিলখুশা থেকে একটা থামস আপ সহযোগে ফিস কবিরাজি খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে যখন তাজুর সাথে দেখা করব বলে হলের দিকে এগোচ্ছি, একটা এক কামরার ট্রাম ঝকর ঝকর করতে করতে ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কলকাতার বুক থেকে ঐতিহ্যবাহী ট্রাম তুলে দেওয়া হয়েছে --একথা ওই দর্শকের মন্তব্যের মত আংশিক সত্য আবার আংশিক মিথ্যা। মিথ্যা এই কারণে যে মোটেই সম্পূর্ণরূপে তুলে দেওয়া হয় নি। কিছু রুট এখনও আছে, যেগুলোতে ট্রাম যেমন নিয়মিত চলছিল, তেমনিই চলছে। আর ‘নরক গুলজার’-এর কথা কি আর বলি! নাটকের প্রোমোতেই বলা হচ্ছে“সুন্দরমের নতুন নাটক”।
 
আর বিভিন্ন নাট্যদলের অভিনেতাদের কৌলিন্য নিয়ে তো আগেই বলেছি। এখানেও সেটা বিদ্যমান। রজত গাঙ্গুলী, গৌতম হালদার, দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত কেউ-ই সুন্দরমের অংশ নন। থিয়েটার ফ্রেটার্নিটির স্বার্থে এবং মনোজ বাবুর চলে যাওয়ার ফলে ট্রাঙ্ক খুলে হাতড়িয়ে এই পুরোনো দলিলকে ল্যামিনেট করে তার পরে তাকে রিক্রিয়েট করে বলা, ‘সুন্দরমের নতুন নাটক’ – কিছু না, গাট্স লাগে, আদি স্রষ্টাকে এমন ট্রিবিউট দিতে। তবুও প্রাপ্তি অনেকটাই যে, যে ফর্ম্যাটেই হোক না কেন, পুরোনো গুলোই ঘুরে ফিরে আসছে। ডিরেক্টর প্রোডিউসার সবাই জানেন, পুরোনোই একমাত্র সম্পদ, যা দিয়ে বাজারে কিছু করে খাওয়া যাচ্ছে। 


লেখাটা খুব ছড়ানো। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত যা বক্তব্য তা হল, পুরনো বলে ফেলে দিলে একদিন কিন্তু ফিরে আসবেই যেদিন ওই পুরোনোকে খুঁজতে হবে। কিন্তু তখন আর তারা সহজলভ্য থাকে না। হয়তো অনেক খুঁজেও আর পাওয়া যাবে না। অথচ ভাবুন ওই পুরোনোগুলোই একসময় অবলীলায়, অক্লেশে, অবহেলায় আপনার কাছেই পড়েছিল ধুলোধূসরিত হয়ে। সেই পুরনোর মূল্য সেদিন আপনি বোঝেন নি, তাই তা হয়ে উঠেছিল আপনার বোঝা যা থেকে চেয়েছেন নিষ্কৃতি ও মুক্তি। আর আজ এমন দিন ঘুরে এসেছে যে সেই পুরনো কে ফিরত পেতে জীবন পণ করেছেন, সর্বস্ব উজাড় করে দিতে চাইছেন, পৃথিবী তোলপাড় করে ফেলছেন, কিন্তু সে সব আপনার সমস্ত সামর্থ্যের বাইরে চলে গিয়েছে। আপনার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে আজ আপনার ফেলে দেওয়া সেই পুরনো এমন বিশাল এবং বিপুল আকার ধারণ করেছে যে তা এক নিমেষে আপনার আধুনিকতার গর্ব এবং দম্ভকে অনয়াসে পিষে মেরে ফেলতে পারে। তাই পুরনোকে যাঁরা অশ্রদ্ধা করেন তাঁরা সবাই কালিদাস মাত্র -- গাছের যে ডালে নিজে বসে আছেন, বোকার মত সেই ডালটিকেই নিরন্তর কেটে চলেছেন। 

 পার্থক্য শুধু এই যে, কালিদাসের পায়ের নিচে মাটি ছিল এখন ওই ডালের নিচে অন্ধকার অতল খাদ। 
******** 
১. যে সব পুরোনো বন্ধুরা এক হলে, প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে ‘নরক গুলজার’ করে তোলা যায় আশ-পাশ, তাদের ছবিও সাথে রইল। 
 ২. আরো রইল সেই মায়াময় কিছু জনের ছবি, যারা না বুঝেই যে কোনো মুহূর্তে চারপাশ-কে শুধু আহ্লাদে নরক গুলজার করে তুলতে পারে। 

 আর উপরের দুটির কোনোটির ক্ষেত্রে রিহার্সাল লাগে না। ফ্রি-তেই পয়সা উসুল্।

Sunday, 24 November 2024

ভিখিরি


সাল ১৯৮৮-৮৯। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। কাঁচা, নরম মন! ভিখারীদের দেখলেই খুব কষ্ট হতো। ওদের কিছু না কিছু দিতে ইচ্ছা হত।
 
কিন্তু সেই আমি হঠাৎ একদিন পণ করে বসলাম যে জীবনে আর যাই হোক, কোন ভিখারীকে ভিক্ষা দেবো না। তার কারণ দুটি ঘটনার সমাপতন ও সেগুলোর আমার মনের ওপর যৌথ অভিঘাত। 

প্রথমটি হল, খবরের কাগজে বেরোলো যে হাওড়া স্টেশনে আমরা যে সবওয়ে দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করি, সেখানে এক ভিখারী ভিক্ষা করতে করতে হঠাৎই মারা গিয়েছে। আর তার কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে প্রায় পঁচাত্তর হাজার টাকা নগদ টাকা। আমার বাবা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তখন ওনার মাসিক বেতন হবে কুল্লে তিন হাজার টাকা। খুব মর্মাহত হয়েছিলাম, তুলনা করে। 

আর দ্বিতীয় ঘটনাটি আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা।

রোজ স্কুলে যাবার সময় বাবা আমাকে গুনে দু' টাকা দিতেন। এর মধ্যে এক টাকা গাড়ি ভাড়া, আর এক টাকা টিফিন বাবদ। আমাদের বাড়ি সালকিয়াতে। আর স্কুল ছিল বেলুড়ে। তখনো পর্যন্ত আমার কোনো সাইকেল ছিল না। সুতরাং, সে নিজের পছন্দের বই কেনাই হোক, আর পয়সা বাঁচিয়ে জন্মদিনে বন্ধুদের আমার সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু ভালো মন্দ খাওয়াব , সেটাই হোক, তার জন্য একমাত্র উপায় ছিল যে গাড়িভাড়া বাঁচানো। সালকিয়া থেকে বেলুড় পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া আসা করতাম, প্রায়ই, গাড়িভাড়া থেকে পয়সা বাঁচাতে।

এই যাতায়াতের পথে জয়সোয়াল হসপিটাল -এর কাছে এক ভিখিরি রাস্তায় বসে ভিক্ষা করত। বয়স ষাটের উপরে হবে। তাকে দেখে কেমন যেন একটা মায়া হত! আমি যখনই হেঁটে যাতায়াত করতাম তখনই তাকে আমার খুব কষ্ট করে বাঁচানো পয়সা থেকে চার আনা মানে পঁচিশ পয়সা করে দিতাম। সেও আমায় দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করতো। আর পুরো ব্যাপারটা আমার মনের মধ্যে একটা অন্যরকমের ভালো অনুভূতি তৈরি করত। মনে হত যেন, জীবনে যেন অনেকটা আলো; কি সুন্দর এ জগত! 

আগেই বলেছি যে আমার বাবার স্কুল শিক্ষক হিসেবে তখন রোজকার ছিল হাজার তিনেক টাকা। মা তখন এক স্নায়ুজনিত বিশেষ অসুখে ভুগছেন। সেই অসুখ থেকে মাকে নিরাময় করার জন্য বাবার জলের মতো টাকা খরচা হচ্ছে। তিন হাজার টাকার বাইরে আরো যদি কিছু রোজগার করা যায় তার জন্য বাবা দিন-রাত এক করে টিউশন পড়িয়ে সবদিক ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। জীবনের এই জটিলতা বোঝার মত বয়স তখন আমার না হয়ে থাকলেও, এইটুকু আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে বাবার কাছে কিছু বায়না করা মানে বাবার উপর একটা অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। এই কঠিন পরিস্থিতিতে ওই চার আনা পয়সা আমার কাছে অনেকটাই ছিল, যা আমি ওই ভিক্ষুককে দিতাম। আর সবদিক বাঁচিয়ে ওই পঁচিশ পয়সা ভিখারিটিকে দেওয়ার জন্য আমাকে কিন্তু পুরোটা পথ হেঁটে যাতায়াত করতে হতো।

একদিন একটি ঘটনা ঘটল। আমি সেদিন স্কুলে যাইনি। আমার এক দিদাকে নিয়ে লিলুয়ার কাছাকাছি একটি ব্যাংকে যাওয়ার কথা ছিল। ফলে সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে একটু ওলটপালট হল। আমি অন্য দিনের থেকে অনেকটা আগেই দিদাকে নিয়ে বেরোলাম। দিদা বাসে উঠতে পারত না তাই বাবা একটা রিক্সা ঠিক করে দিয়েছিল। সেই রিক্সায় করে যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়লো -- যে ভিখারিটিকে যাকে আমি ভিক্ষা দিই। প্রথমে চিনতেই পারি নি। পরে দেখলাম এ তো সে-ই বটে। দিব্যি ধোপদুরস্ত কাপড় পরা অবস্থায় একটা গলির মুখ থেকে রিক্সার স্ট্যান্ডে রিকশায় উঠছে। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না -- এ আমি কি দেখছি! পেরিয়ে চলে যাবার পরে, নিজেকে প্রবোধ দিতে লাগলাম, হয়তো একই রকম দেখতে অন্য কোন লোক! অস্থিরতা কাটল না। বাড়িতে ফিরে নিজেকে বোঝালাম যে সে নিশ্চয়ই অন্য ব্যক্তি, নিশ্চয়ই আমার চোখের ভুল। 

হেঁটে স্কুল যাতায়াতের জন্য আমার বেশ কিছু সঙ্গীসাথী ততদিনে জুটে গিয়েছিল। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আমার থেকে অনেক উন্নত হওয়া সত্ত্বেও তারা নিছক উৎসাহে এবং বন্ধু হওয়ার দরুন আমার সাথে বেশ মজা করেই হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেত এবং ফিরত। ঐ রোজের পথ হাঁটার মধ্যে আমরা যে কত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সেইসব অভিজ্ঞতা খুব ছোট বা অপাত দৃষ্টিতে তুচ্ছ হলেও, আমাদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বেশ সাহায্য করেছে বলেই মনে হয়। 

যাই হোক, আমি সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা আমার সেই বন্ধুদেরকে বললাম। ওরা তো শুনে রেগে কাঁই!  
শুভ্র বলল,
- দে, আরো দে! এলেন আমার দাতা কর্ণ! তোর স্বভাবই সবাইকে ভালো ভাবা। তুমি শালা হেঁটে স্কুলে যাও, কি না ওকে দান করবে...আর ও রোজ রিক্সায় চড়ে ভিক্ষে কত্তে আসে! তোর লজ্জা করে না! বাপের পয়সা এভাবে ভুলভাল লোককে দিয়ে বেড়াচ্ছিস! এর থেকে আমাদের রোজ ওই পয়সায় আইসক্রিম খাওয়ালে কাজ দিত! (তখন একটা কাঠি আইসক্রিমের দাম ছিল দশ পয়সা।) 
আমি কেঁদে ফেললাম।
প্রদীপ বলল,  
- ঐ মেলা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদিস না তো! হতেই পারে তুই ভুল দেখেছিস। কিন্তু আমাদের সেটা একবার দেখে নেওয়া দরকার যে ব্যাটা সত্যিই ভিখিরি কিনা।

পরদিন ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির মত শুরু হল অ্যাডভেঞ্চার 'ভিখিরি'।
আমরা নির্দিষ্ট সময়ে সেই গলির কাছে গিয়ে পৌঁছালাম যেখান থেকে আগের দিন ভিখিরিটাকে রিক্সায় উঠতে দেখেছিলাম। বিভিন্ন দিকে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম সবাই, যদি ভিখিরি আসে! 
ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে আগের দিনের মতোই সেই ভিখিরি এলো। পরনে সেই সুন্দর পোশাক। মাথায় টুপি। রিকশায় উঠলো। আমরা ছিলাম চারজন। তার মধ্যে এই বিশেষ অ্যাডভেঞ্চারের জন্য দু'জন সাইকেল নিয়ে এসেছিল। বাকি দুজন ওই দুই সাইকেল-বন্ধুর সওয়ারী হলাম। বেশ খানিকটা দূর থেকে ওই ভিখিরিকে ধাওয়া করতে লাগলাম।
রিক্সাটা সোজা রাস্তায় না গিয়ে গলিগালা দিয়ে ঘুরে গন্তব্যের দিকে এগোতে থাকলো। আমরাও পিছু পিছু যেতে থাকলাম।
সত্যবালা পেরোনোর পরে একটা খুব ঘিঞ্জি জায়গায় রিক্সাটা দাঁড়ালো। রিক্সা ওয়ালা-কে ভাড়া দিয়ে লোকটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।  
প্রদীপ রিক্সাওয়ালাটাকে একটু দূরে এসে পাকড়াও করে জানল যে ওই ভিখিরি বাবাজি ওদের বাঁধা সওয়ারী। ওই স্ট্যান্ড থেকে পালা করে বিভিন্ন রিক্সাওয়ালা ওকে রোজ এখানে নিয়ে এসে নামায়। 
আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। মাথায় দু-চারটে চাঁটি আর পাশের টিঊব ওয়েল থেকে জল খেয়ে খানিকটা ঠিক হলাম। 
আমরা দূর থেকে লুকিয়ে লক্ষ্য রাখতে থাকলাম। মিনিট দশেক বাদে সেই ব্যক্তি বেরোলেন আদ্যোপান্ত ভিখারীর বেশে। এই তো সেই মানুষ যাকে আমি রোজ ভিক্ষা দিই।লোকটা বেরোনোর সময় এক সুসজ্জিততা মহিলা তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন।

আমি সত্যিই আর নিতে পারছিলাম না। ভেঙে পড়েছিলাম, সম্পূর্ণরূপে। 
বন্ধুদেরকে বললাম 
- চল অনেক হয়েছে। যা বোঝার, বুঝে গিয়েছি। 
ওরা বলল, 
- না না অত্ত সস্তা! আমরা শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়বো....

শেষ আর দেখার মত কিছু ছিল না। আশানুরূপ পরিণতি।
 
সেই ভিখারি নির্দিষ্ট স্থানে স্থানে গিয়ে তার আসন সাজিয়ে ভিক্ষা চাইতে বসলো। আমরা ঠিক যেরকম ভাবে কোন পুজোর আয়োজন করার জন্য জোগাড় করি, সেরকম ভাবে বসার আগে সে জায়গাটাকে অতি যত্ন সহকারে সাজালো যাতে লোকের তাকে দেখে মায়া হয়।

আমি হাউহাও করে কাঁদতে থাকলাম -- এ আমি কি করেছি! কার জন্য কি করেছি! দিনের পর দিন একটা মানুষকে শুধু ভিক্ষা দেবে বলে নিজেকে কতটা কষ্ট দিয়েছি! কিন্তু তার বিনিময়ে এই প্রবল প্রবঞ্চনা!

তারপর থেকে পথ চলতি কোন ভিখিরিকে আজ পর্যন্ত ভিক্ষা দেওয়ার মত মন গড়ে তুলতে পারি নি। একটা সময় পর্যন্ত এ নিয়ে অনেকের সাথে তর্কে জড়িয়েছি, অকারণ মনোমালিন্য হয়েছে, যে এ দুটোই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মানছি, হয়ত তাই-ই, ভারতের জনগণের অবস্থা তাই-ই বলে। 

কিন্তু নিজেকে ঠকানোর আর সাহস পাই না। আমার মনের মধ্যে এত বড় বিশ্বাস ভাঙ্গার সম্পূর্ণ দায় ওই ভিখিরি দুটির যারা আমার বাবার থেকে অনেক অনেক বেশি বড়লোক ছিল, অথচ ভিক্ষা নিত আমার কাছ থেকে, হয়তো বা না জেনেই। 

কিন্তু আজও ওদের আমি ক্ষমা করতে পারলাম কই! 

- আর্য

Friday, 15 November 2024

জগদ্ধাত্রী পূজা: 2024

জগদ্ধাত্রী পুজোর ব্যাপারটা যে ঠিক কি সেটা বেশ বড়বেলা পর্যন্ত ভালো করে জানতাম না। কোনদিন আগ্রহও হয়নি। স্কুলে এই উপলক্ষ্যে ছুটি পেলেই বেজায় খুশি। 

এই নিয়ে জানার প্রথম আগ্রহটা চাগাড় দিল যখন আমি রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে স্নাতক (সাম্মানিক) স্তরে লেখাপড়া করতে গেলাম। যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন যে, বেলুড়মঠে কি মহাসমারোহে জগদ্ধাত্রী পূজা সম্পন্ন করা হয়! 

তা ওখানকার ছাত্র হিসেবে পুজোর বেশ কিছু গুরুদায়িত্ব এসে পড়ত। সেই সূত্রে খানিকটা জানলাম। এর মধ্যে আবার আমার আগ্রহে ধুনো দেওয়ার জন্য ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু অনিন্দ্য।  তাদের আদি ও পুরুষানুক্রমে বর্তমান নিবাস চন্দননগর এবং উপাধি রায়চৌধুরী। (উপাধি উল্লেখের কারণ ক্রমশ প্রকাশ্য)।

বিদ্যামন্দিরে অনিন্দ্য আমার রুমমেটও ছিল বটে। সারাদিন ধরে প্রাপ্ত দায়িত্ব সামলে যখন বিছানায় বসে বেলুড়মঠের জগদ্ধাত্রী পুজো, বিশেষতঃ প্রসাদের শুকনো বোঁদে (এ বস্তুটি একমাত্র ওখানেই পাওয়া যায় বলেই আমার এখনো স্থির বিশ্বাস)  সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করতাম, তখন, খুব ঠাণ্ডা গলায় অনিন্দ্য বলত,

- এ আর কি দেখছিস...আমাদের বাড়িতে আয় একবার। দেখিয়ে দেব সারারাত ঘুরিয়ে, যে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো কি জিনিস। কলকাতার যে কোনো হাই-প্রোফাইল দুর্গাপূজাকে যে কোনো দিন এক ডজন গোল দিয়ে দেবে। তবে হ্যাঁ, বোঁদেটা বাদ দিয়ে।

সব শুনে মনে মনে ভাবতাম গালগল্প। 

পুজো চলছে। ঠিক করলাম, যাব। দেখি কতটা বাড়িয়ে বলছে। কিন্ত বললেই কি আর যাওয়া যায়? আবার তার ওপরে ছুটি! সে তো মহারাজ কিছুতেই দেবেন না! 

অনিন্দ্য পাবে, কিন্তু আমি তো পাব না। 

তবুও হল। কপালে থাকলে খণ্ডাবে কে !

অনিন্দ্যর নিজের কাকা, শ্রী সুব্রত রায়চৌধুরী (এস আর সি), আমাদের ইংরেজি বিভাগের তখন নবীনতম শিক্ষক। তিনি আদ্যোপান্ত আধুনিক, আর বিদ্যামন্দিরের দম-বন্ধ করা পরিবেশে এক বিশুদ্ধ প্রাণদায়ী অক্সিজেন বয়ে আনা মানুষ।

অনিন্দ্য উপদেশ দিল, 

- চুপিচুপি কাকাইএর সঙ্গে কথা বল, যদি কিছু হয়। আর খবরদার বলবি না যে আমি বলেছি। তাহলে কিন্তু যাও বা চান্স আছে, সেটা যাবে।  

স্যারকে গিয়ে বললাম। তাতে স্যারের প্রথম রিঅ্যাকশান:

- ও, অনিন্দ্য তোকে বুদ্ধি দিয়েছে বুঝি?

- না স্যার, অনিন্দ্য জানে না। ওকে সারপ্রাইজ দেব বলে আপনার কাছে আসা। ওর কাছে এত গল্প শুনেছি, একবার চোখে না দেখলে বিশ্বাস হচ্ছে না যে এ সব সত্যি। 

- বেশ, আমি প্রভাকর মহারাজ (আমাদের তৎকালীন প্রিন্সিপ্যাল মহারাজ, অফিসিয়াল নাম, স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দ)- কে বলে রাখব। তুমি কিন্তু আর কাউকে বলবে না। যদি এরকম কিছু ঘুণাক্ষরেও আমার কানে আসে, তাহলে কিন্তু আমি নিজেই তোমার যাওয়াও আটকে দেব। 

- আচ্ছা স্যার। 

জগদ্ধাত্রী জগদ্ধাত্রী (দুগ্গা দুগ্গা- র সমার্থক প্রতিশব্দদ্বয়) করে আমার পারমিশন হয়ে গেল। 

বেলুড় রেলস্টেশন থেকে সপ্তমীর বিকেলে পঞ্চাশ মিনিটে চন্দননগর। স্টেশনে নেমে বাঁ দিকে অনিন্দ্যদের বাড়ি।

রায়চৌধুরীরা চন্দননগরের অভিজাত পরিবার | অনিন্দ্যদের বাড়ি নতুন হলেও সর্বক্ষেত্রে ও সর্বস্তরে সেই  অভিজাত্যের ছাপ বিরাজমান। আমাকে নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হতেই কেমন একটা চাপা উদ্দীপনা অনুভব করলাম। বাড়ির ছেলের বন্ধু এসেছে উৎসবের সময়ে, সে আপ্যায়ণ ও উষ্ণতা ভোলার নয় | 

সন্ধেবেলায় স্বয়ং এস আর সি স্যার হাজির | আমি তো শ্রদ্ধায় সঙ্কোচে কি করব কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। অনিন্দ্য ওনার সামনেই আমাকে ফস করে বলে বসল,

- তুই ওকে ভয় পাচ্ছিস? আমি তো কাকাইকে প্রাইভেট স্পেসে তোর মত 'তুই' বলেই ডাকি! ছোটবেলার অভ্যাস। আর বদলাই নি। কি করে জানব হঠাত আমার কলেজের স্যার হয়ে যাবে। তাহলে একবার চেষ্টা করে দেখতাম ... কি রে কাকাই, বল্ না!

- হ্যাঁ, আর্য, এখন তুমি আমাদের অতিথি... আর এটা কলেজ নয় | খুব আনন্দ করে কাটাও | অনিন্দ্য তোমাকে সব ঘুরে দেখিয়ে দেবে। আর কাল সকালে আর্যকে আমার বাড়িতে একবার নিয়ে আসিস।

অনিন্দ্য-কে বললেন স্যার। 

- ঠিক আছে... তুই এখন বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। 

অনিন্দ্য স্যার- কে বলল ।

আমি আমার বাবাকে ছোটবেলা থেকে 'আপনি' বলে সম্বোধন করি, সেখানে অত বড় একজন কাকাকে কেউ 'তুই' বলে! হজম ই হচ্ছিল না। হস্টেলে এক রুমে এতদিন থেকেও এ সিক্রেট তো জানতে পারি নি। ক্লাস চলে যখন তখন তো দিব্যি 'আপনি আজ্ঞে' করে! রেগে গিয়ে সে কথা বলতেই অনিন্দ্য হা হা করে হেসে বলল,

- প্রোটোকল ও এটিকেট... 

- তা বলে আমাকে এভাবে কি অপ্রস্তুতে ফেলেছিল বলত! উনি তো আমার স্যার, না কি! 

আবার হেসে বলল,

- তা তুই তো আর কাকাই কে 'তুই তোকারি' করতে যাচ্ছিস না!  চল, একটা পান দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে একটা চক্কর মেরে আসি।

তখন নতুন নতুন সিগারেট খেতে শিখেছি। হপ্তায় একটা কোনোরকমে লুকিয়ে দুজনে খেতাম। আমার কেনার ক্ষমতা ছিল না। অনিন্দ্যই খাওয়াত, দুটোই  - জরদা পান আর সিগারেট। ওর থিওরি অনুসারে, 

এক, তামাকু সেবনে সকালে কোষ্ঠ সহজে পরিষ্কার হয়। ( হস্টেলে এটা একটা মূল্যবান বিষয় - দ্রুত কোষ্টস্খলন) 

আর দুই, যে পরিমাণ ভেজাল ও দূষণ আমরা প্রতিনিয়ত গ্রহণ করছি, তাতে ওই মাঝে মধ্যে এট্টুখানি তামাকু সেবনে বিশেষ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। 

এবারে সন্ধ্যেবেলায় দুজনে বেরোলাম ঠাকুর দেখতে |  সেদিন এক অংশ  আর তার পরের দিন আর এক অংশ -- এভাবে অনিন্দ্য ভাগ করে নিয়েছিল। 

চাক্ষুস করে সত্যি বলছি আমি না হাঁ হয়ে গেলাম! 

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা বড় মানে শুধু মনে বা উৎসবের মাপে বড় নয়, ঠাকুরের মাপেও সেরকম। বেশিরভাগ ঠাকুরই দেখলাম এত বড় যে বিসর্জনের সময় আগে প্যান্ডেল খুলে তবে সেই সমস্ত ঠাকুরকে বের করতে হয়। আর সব থেকে বড় কথা, জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের মূর্তি নিয়ে দুর্গাপুজোর মতো আধুনিক 'থিম থিম' ছেলে খেলাটা ওখানে হয় না। সবই বিভিন্ন ধাঁচের, কিন্তু সেই সাবেকি ধরনের ঠাকুর। 

সাবেকিয়ানার কথায় মনে পড়ে গেল, বাংলার ঐতিহ্যের ইতিহাসের সাথে জগদ্ধাত্রী পুজোর একটা যোগ আছে। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই চন্দননগরের অবিসংবাদিত অধিপতি ও ফরাসিদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেওয়ান, ও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নিকট বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীর কাছে অর্থ ধার করতে মাঝেমধ্যেই আসতেন। ভাবুন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আসতেন অর্থ ঋণ করতে এক দেওয়ানের কাছে ! বুঝুন সেই দেওয়ানের প্রতিপত্তি কি!) এই ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর মৃত্যু হয় ১৭৫৬ সালে। ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী জগদ্ধাত্রী পুজোর শুরু করেন ১৭৫০ সাল নাগাদ, চন্দননগরে নিজ গৃহে। তারপর থেকে রায়চৌধুরীদের দেখাদেখি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন, নদীয়ায়। জগদ্ধাত্রী পূজা করলেও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন বলে বিশ্বাস। কলকাতায় আবার বেহালার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার তারও আগে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন বলে সময় বলে।

আর আমার বিশ্বাস অনিন্দ্যরা এই  ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর বংশেরই অংশবিশেষ, যদিও সে নিয়ে কোনো কথা কোনোদিন হয় নি।  

যায় হোক, অনিন্দ্যর বাড়িতে ওই তিন দিনের স্মৃতি এখনো অমলিন। 

কিন্তু বাস্তব হল এস আর সি স্যার বিদ্যামন্দির কলেজ থেকে রিটায়ার করলেন ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪। জগদ্ধাত্রী পুজোর ঠিক কদিন আগে। 

কি সমাপতন!  

.... 

....

....

আমি এখন যেখানে থাকি সেখানে ১৭ বছরের এই বসবাসের প্রত্যেকবারই জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে আসছে। 

এই বিশেষ দিনটাতে হাত ফাঁকা থাকে বলে আমি বেশ কিছু ছবি অকারনেই তুলে থাকি। ফেসবুক এনালিটিক্স বলে যে শুধু ছবি এখানে পোস্টালে যতটা রিচ (মানে যত লোকের কাছে পৌঁছায়, তার ব্যাপ্তি) হয়, লেখা দিলে তত হয় না।  

কিন্তু তাতে আমার কি! ছবির সাথেও লেখাও না  হয় রইল। যার ইচ্ছে পড়বে, যার ইচ্ছে হবে না, সে পড়বে না। সে শুধু ছবি দেখবে।

আবার যার ইচ্ছে শুধু পড়বে, ছবি দেখবে না, তাহলে তাই। 

মোদ্দাকথা, এমন একটা লোভনীয় প্ল্যাটফর্মে, যেখানে হাজারো তারকা আর নেতাদের লোভনীয় কিন্তু অকারণ চাপান-উতর  ও গালিগালাজের ভিড়ের মধ্যে আমার পোস্ট করা ছবি বা লেখা দু-চার জন পড়ে, তখন আমি কৃতার্থ বোধ করি। মনে হয় এর থেকে বেশি আনন্দ আর কিছুতে নেই। 

তবে এই সূত্রে বলে রাখি পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো করতে গেলে বা চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো করতে গেলে পুজো পারমিশন লাগে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটার রেজিস্ট্রেশন কর্পোরেশন ভিত্তিক।কিন্তু এ সম্পর্কে নিখুঁত কোন তথ্য হাজার খুঁজেও পাওয়া যায় না। 

ঠিক কতগুলো পুজো হচ্ছে তার একটা তথ্য থাকাটা খুব জরুরী। 

একটা রাফ ওভারভিউ হিসেবে বলা যায় যে,

১) সারা হাওড়াতে প্রায় তিন হাজার দুর্গাপূজা হয়।

২) শুধু চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার সংখ্যা প্রায় একশো পঞ্চাশ।


কথাগুলো ফুরোয় না/ নটেগাছটাও মুড়োয় না:

হাটখোলার দত্ত পরিবারের কথা কে না জানে!

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে পিতা মদনমোহন দত্তের  মৃত্যুর পরে পরিবারের প্রধান ছিলেন রামতনু দত্ত| ওনাকে সবাই ‘তনু বাবু’ বলে জানতেন। এই তনু বাবু ছিলেন তৎকালীন নব্য ‘বাবু’ সমাজের একজন প্রথম সারির বাবু। বলা হতো ‘আট বাবুদের এক বাবু হলেন তনুবাবু’। তাঁর দাপটে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। সাথে ছিল ভয়ংকর বিলাসব্যসন। কথিত আছে যে তাঁর বাড়ি প্রত্যহ উপর থেকে নিচ পর্যন্ত আতর দিয়ে ধোয়া হত।

Hatkhola Dutta House

এই দত্ত পরিবারের প্রধান প্রতিদ্বন্দী  ছিল গিয়ে তখনকার বাগবাজারের মিত্তির বাড়ি। রমতনু দত্তের সমসাময়িক মিত্তির বাড়ির প্রধান ছিলেন গোকুল মিত্র।

গোকুল মিত্রের কাছে তনুবাবুর খবর গিয়ে পৌঁছালো যে রামতনু দত্ত নাকি সারা বাড়ি আতর দিয়ে রোজ ধোয়ান।  এখন রেষারিষী করতে  গোকুল মিত্তিরও সারা বাড়ি অনায়াসে আতর দিয়ে ধোয়ার ব্যবস্থা করতেই পারতেন। কিন্তু তাতে আবার তনুবাবুকে নকল করা হয়ে যায়। কিন্তু কি করে এর জবাব দেবেন তার জন্য তিনি পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অস্থির  হয়ে পড়ছিলেন।

অবশেষে সুযোগ এলো।

একদিন এক গরীব ব্রাহ্মণ হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেন গোকুল মিত্রের দুয়ারে।  বললেন,

- আমার একমাত্র পুত্রের কর্ণমল (কানের খোল) বিষাক্ত  হয়ে এমন অবস্থা যে তাতে তার শ্রবণশক্তি চলে যেতে পারে, এমন কি সে বিষ ছড়িয়ে পড়ে তা প্রাণঘাতি হতে পারে। 

- আপনি আমার কাছে কি চান?

- কবিরাজ বলেছেন খুব ভালো ধরনের আতর এর একমাত্র চিকিৎসা। আপনি যদি কৃপা করে আমাকে একটু আতর দেন তবে আমার সন্তানের রোগের নিরাময় ঘটানোর চিকিৎসা আরম্ভ করতে পারি। ভাল আতর শুনেছি সোনার থেকেও বেশি মূল্যবান। সে আমি চিনিও না আর তা ক্রয় করা আমার সাধ্যাতীত।

গোকুল মিত্র দেখলেন তনুবাবুকে জব্দ করার এই সুযোগ।  তিনি গরিব ব্রাহ্মণ কে বললেন,

-  আরে হাটখোলার দত্ত পরিবার থাকতে আতর চাইতে এসেছেন আমার কাছে! আমি কি অত বুঝি না কি! শ্রেষ্ঠ আতর তো আপনি পাবেন তনু বাবুর কাছে। ওনার সম্ভারে যা আছে, আর কারো কাছে নেই। আপনি বরং ওখান থেকে আতর নিয়ে আসুন। দেখি কেমন আতর উনি আপনাকে দেন!


ব্রাহ্মণ সরল বিশ্বাসে বাগবাজার থেকে হেঁটে উপস্থিত হলেন হাটখোলায়।  তনুবাবুকে সব বলতেই উনি ধরে ফেললেন যে গোকুল মিত্রই তনুবাবুর আতরের সত্যতা যাচাই করতে এই ব্রাহ্মণকে ওনার কাছে পাঠিয়েছেন। কয়েক রতি আরবি বা ফরাসী আতর দিয়ে দেওয়া গোকুল মিত্তির অনায়াসেই পারতেন। কোন ব্যাপারই ছিল না। তার বদলে গরিব ব্রাহ্মণকে এত দূরে পাঠানোর কোন মানে হয়!  যাকগে এসব যখন হয়েই গেছে তখন দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়! 

তনুবাবু ব্রাহ্মণকে বললেন,

- হে ব্রাহ্মণ! আপনি বরং এই আতর নেওয়ার জন্য একটি যথার্থ পাত্র নিয়ে আসুন, যে আধারে আপনার সন্তানের নিরাময়ের জন্য আপনাকে আমি সঠিক পরিমাণে আতর দান করতে পারব!

গরিব ব্রাহ্মণের আতরের পাত্র কেনার পয়সা কোথায়! আতর তো আর মাটির কোনো পাত্রে রাখা যাবে না! তাই ‘যে আজ্ঞে’ বলে  হাটখোলা থেকে পুনরায় উপস্থিত হলেন বাগবাজারে। এসে গোকুল মিত্র কে বললেন

- হ্যাঁ তনুবাবু আতর দিতে রাজি হয়েছেন বটে।  কিন্তু উনি সঠিক মাপের এবং সঠিক গুণমানের একটি পাত্র চেয়েছেন, যাতে আতর দেওয়া যায়। আমার সে অর্থবল নেই যে আতর গ্রহণের জন্য যথার্থ পাত্র ক্রয় করব।

গোকুল মিত্র বুঝতে পারলেন সবটা।  তিনিও কম যান না!  বুঝতে পেরেই একটি বিরাট পিতলের কলসী ব্রাহ্মণকে দিয়ে বললেন

- যান, ওনাকে বলুন যে এই পাত্র আপনি এনেছেন আতর নেওয়ার জন্য।

 মনে মনে ভাবলেন খুব জব্দ করলেন তনুবাবুকে। কলসী ভরা দামী আতর.... আর যাই হোক অতটা দিতে পারবেন না।

ব্রাহ্মণ তনু বাবুর গৃহে পুনরায় উপস্থিত হলেন, ওই বিশাল কলসী সমেত। পাত্রের গুণমান ও আকার দেখে তনুবাবু তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন যে তাঁর ধারণা ভ্রান্ত নয়, যে মিত্তির ওনাকে জব্দ করতে চাইছেন। কিন্তু বেচারা ব্রাহ্মণকে ওভাবে আর অকারণে খাটানোর ইচ্ছে হল না। তাই তিনি ব্রাহ্মণকে বললেন,

- হে ব্রাহ্মণ আপনাকে এতটা কষ্ট দেওয়ার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন।  আপনি আজ সারাদিন আমার গৃহে অতিথি হয়ে থাকুন। আমার এখানে খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিন। দিনের শেষে আমি আপনাকে নিশ্চয়ই আপনার সন্তানের নিরাময়ের জন্য এই কলসী ভরে আতর প্রদান করব।

ব্রাহ্মণ স্নান আহারদি সেরে  নিজের সন্তানের জন্য এতটাই ব্যাকুল হলেন যে  তিনি বিকেল হওয়ার আগেই খুব ব্যস্ত হয়ে তনুবাবুর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন,

- আমি আপনার আতিথেয়তায় মুগ্ধ। কিন্তু আমার মন আমার প্রিয় সন্তানের জন্য বড়ই বিচলিত হয়ে আছে। আমি সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত থাকতে পারবো না। যদি আপনি এখনই ব্যবস্থা করে দিয়ে আমাকে আজ্ঞা করেন, তবে আমি আমার সন্তানকে যত শীঘ্রই সম্ভব ওষধি প্রদান করে সুস্থ করার জন্য চেষ্টা শুরু করতে পারি।

তনুবাবু বিচক্ষণ মানুষ। তিনি সবটা বুঝলেন এবং সেই কলসি ভরে তাঁকে আতর প্রদান করলেন। কলসি ভরে যে আতর তিনি  ব্রাহ্মণকে দিলেন সেই আতর ছিল তার সংগ্রহে রাখা সর্বশ্রেষ্ঠ আতর।  ওই আতরের তৎকালীন বাজারমূল্য হবে মোটামুটি আট হাজার টাকা।

ব্রাহ্মণ বিদায়ের সময় ব্রাহ্মণকে তিনি আতর ছাড়াও যথারীতি আরও অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রদান করলেন, উপঢৌকন হিসেবে। পাঁচশো এক টাকা প্রণামীও দিলেন।

বিদায়কালে তনু বাবু ব্রাহ্মণকে বললেন

- আপনাকে একটা অনুরোধ যে যিনি আপনাকে ঐ পাত্র দিয়ে আতর গ্রহণের জন্য পাঠিয়েছেন, তাঁকে বলবেন যে আশা করি যে এই সামান্য পরিমাণ আতরে তাঁর মত বড় মানুষের কর্ণের মল নিশ্চয়ই পরিষ্কার হবে। তবে তার পূর্বে আপনি আপনার সন্তানের জন্য যতটা আতরের প্রয়োজন তা কিন্তু একটি আলাদা কাচের পাত্র তুলে রাখবেন। ঐ বিশাল পাত্র যখন দিতে পেরেছেন, এ সামান্য পাত্রটুকু উনি নিশ্চয়ই আপনাকে দিতে পারবেন।

ব্রাহ্মণ সবটুকু বুঝতে পেরে তনুবাবুর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে বিদায় গ্রহণ করলেন।

এর কয়েক মাস পরে ব্রাহ্মণ তনু বাবুর কাছে ফিরত এসে তাঁকে সংবাদ প্রদান করলেন যে ওনার সন্তান সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হয়েছে এবং বাকি আতরটুকু নিয়ে ব্যবসা করে তিনি তাঁর দরিদ্রদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। আর উনি বাগবাজারের মিত্তিরবাড়িতেও গিয়েছিলেন, তনুবাবুর বার্তা পৌঁছাতে। তাতে গোকুল মিত্তির, ক্রোধে লাল হয়ে শুধু বলেছেন্,

- আপনি এখন আসুন! আর এর পরে কোনো দিন আমার দরজায় সাহায্য চাইতে এলে, ফল ভাল হবে না। 

তবে ব্রাহ্মণের পুনরায় তনুবাবুর কাছে ফেরত আসার উদ্দেশ্য একটাই -- তনুবাবুকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ।

কথনে: অনিন্দ্য রায়

অনুলিখন: আর্য

চিত্রঋণ: আন্তর্জাল

Saturday, 2 November 2024

দুদ্ধর্ষ দুবাই: পর্ব দশম (অ্যানেক্স)

এটা বলা হয়নি যে শেষ দিন ফেরার পথে ইন্দ্রানীর সাথে আমার ঝগড়া বাধলো। এই দুবাই শহরকে চট্পট চেটেপুটে নেওয়ার যে প্ল্যান ইন্দ্রানীর মাথায় ঘুরছিল আমি সেখান থেকে একটু রয়েসয়ে সব কিছু করতে চাইছিলাম। এখানেই দ্বন্দ্ব।  আমার বক্তব্য,  আমরা এসেছি অরিন্দম চৈতালির কাছে। আর প্রথম আলাপ হওয়া থেকে আজ অব্দি  ব্যাপারটা এক্সট্রা কিছু চেষ্টা না করেও এক রকম থেকে গিয়েছে। যখন হাওড়ায় এক জায়গায় থাকতাম, তখন আমরা বহুদিন একে অন্যের বাড়িতে কাটিয়েছি, নি:সংকোচে। কোনদিন একবারের জন্যও মনে হয়নি যে পরের বাড়িতে রয়েছি এবং উল্টোটাও সত্যি। সুতরাং দুবাই-তে আর দশটা ট্রাভেলার মতো দুবাই শহরকে ছ্'দিন পাঁচ রাতের মধ্যে দেখে শেষ করে ফেলতে হবে এরকম চাপ আমরা খামোখা নেব কেন? আমরা এসেছি, পাক্কা দু সপ্তাহের জন্য। 

বলাই বাহুল্য যে  পৃথিবীর সবথেকে মূল্য্বান (Expensive) শহরের মধ্যে দুবাইয়ের স্থান ১৫ নম্বরে আর কলকাতা সে দিক থেকে ২০৫ নম্বরে। সহজ কথায় কলকাতার রোজগারে দুবাই-তে এসে পনেরো দিন থেকে খেয়ে শহরটাকে সম্পূর্ণরূপে ঘুরে দেখতে গেলে আমাদের সারা জীবনের সঞ্চয় শেষ করে ফেললেও তা সম্ভব হবে না। অরিন্দম-চৈতালী তাই বারবার আমাদের ওখানে ডেকেছে, যাতে ওরা ওখানে থাকতে থাকতে আমরা ঘুরে আসতে পারি। যখন সে সুযোগ পেয়েছি আর যখন আমাদের ফেরার টিকিট ও কাটা আছে ১৫ দিন বাদে, তখন একদিন একটু রেস্ট নিতে ক্ষতি কি! আর সব থেকে বড় কথা আমি এ কথা বলেছিলাম আরো একটা বৃহত্তর কারণে।  অরিন্দম-চৈতালী আমাদেরকে যেভাবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উৎসাহ নিয়ে শ্হরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরচ্ছে, তাতে শুধু আমাদের নয় আমার মনে হয়েছিল ওদেরও একটু রেস্ট দরকার।ইন্দ্রানী প্রথমে সেটা বুঝতে পারেনি তাই ঝগড়ার সূত্রপাত। পরে যখন বুঝতে পেরেছে তখন আর কিছু বলেনি। 

সেদিন পুরো সকালটা তাই আমরা সিমপ্লি কাটা ঘুড়ির মত ল্যাদ খেলাম। ব্রেকফাস্ট করলাম অনেক দেরিতে। লাঞ্চ হলো প্রায় বিকেলে।  তারপর অরিন্দমই বলল যে 

- বসে থেকে আর কি করবি? চ' আমরা একটা শপিংমলে ঘুরে আসি।

ওদের বাড়ি থেকে যাওয়া-আসার পথে একটা উল্টো করা নৌকার মত মল পথে পড়ত। নামটাই খুব লোভনীয় -- লুলু মল।

বাঙালির কানে এই 'লুলু' শব্দটা এলেই কেমন একটা উলু দিয়ে যেন সম্ভাষণ করছে মনে হয়। কিংবা মানুষের কনজিউমার বিহেভিয়ারকে সম্পূর্ণরূপে তার সংযমের বিরূদ্ধে 'লু লু' বলে লেলিয়ে দিচ্ছে মনে হয়। আর সাথে যদি মহিলারা থাকে তাতে তো মলটির এরকমের লোভনীয় নামকরণের সার্থকতা নিয়ে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না! কারণ, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে মহিলাদের মত  buying spree পুরুষদের নেই (রাগ করার কিছু নেই। এটা নারীজাতির 'গুণ' হিসেবে মান্যতা পেয়েছে)। পুরুষদের টাকা ওড়ানোর আরো অনেক উপায় আছে। কিন্তু বেশিরভাগই নেহাত  নিপাট ভদ্রলোক বলে সাহস করে সেসব পথ মাড়ায় না। কিন্তু কাউকে এক বেলায় সর্ব্স্বান্ত করতে গেলে দুটি উপায় আছে, এক, জুয়াতে ভিড়িয়ে দেওয়া আর দুই, কোনো প্রিয় মহিলার সাথে একটি শপিং মলে গিয়ে বলা

- তোমার কি কি চাই...ফিল ফ্রি...। 

- ব্যাস্, কেল্লা ফতে! 

তবে চৈতালী বা ইন্দ্রানী কেউই এখানে বিশেষ কিছু ঘটাবে বলে মনে হয় না।  কারণ, ওদের ফিল্ড অন্য -- শাড়ী।  আর লুলু মলে তা কিছুতেই পাওয়া যাবে না। 

তার সাথে  ওদের একটা নীতিবোধের নবজাগরণ ডোজ অরিন্দম দিয়ে রেখেছিল।   সেই ভরসায় বুক বেঁধে আমরা লুলু মত মলের দিকে প্রস্থান করলাম।

এটা একটা সাধারণ শপিংমল এবং এখানে সব পাওয়া যায় (শাড়ী ইত্যাদি ছাড়া)  অনেক মলের মধ্যে লুলু মল তার নিজ বৈশিষ্ট্যে এবং গুনে অনন্য। মলটি সাতটি ভাগে বিভক্ত এবং প্রতিটি ভাগ ইসলাম অনুসারে, সাতটি 'জন্না' বা স্বর্গের নামে নামাঙ্কিত, আর সে নামাঙ্কন ঘটেছে অয়েল -এ আঁকা অ্যাবস্ট্র্যাক্ত আর্টের মাধ্যমে।

জ্ঞাতার্থে ইসলাম অনুসারে সাত স্বর্গের নাম পর পর লেবেলের ক্রমানুসারে নিচে দেওয়া হল: 

১ জন্নত -আল -আদাঁ

২ জন্নত -আল- ফিরদৌস (স্বর্গের দ্বিতীয় ও সবথেকে প্রিয় তল বলে পরিচিত্)

৩ জন্নত -আন- নঈম

৪ জন্নত -আল -মাওয়া

৫ দর্-উল্- খুল্দ 

৬ দর-উল্-মকাম

৭ দর্-উস্-সালাম



সপ্তম স্বর্গের শেষ প্রান্তে রয়েছে 'সিদরাত আল মুনতাহা' নাম্ক এক বিশালকায় লোট বৃক্ষে। এর পরে স্বর্গের শেষ। ঈশ্বর সৃষ্ট সমস্ত জীব ও তাদের দিব্য জ্ঞানের সীমানা এখানেই। 


যা আমাকে প্রথমে অবাক করেছে তা হল লুলু মার্টের মাছ-মাংসের ডিপার্টমেন্ট। সে যে কত রকমের প্রকারভেদ তা জানতে গেলে যেতেই হয় লুলু। চিকেন -মাটন প্রয়াসই আনা হয় বাড়িতে। কিন্তু এরকম অ্যানাটমি ধরে ধরে মাংস বিক্রি হয়, (লিভার্, কিড্নি হার্ট, আরো কত কি) তা আমার আগে জানা ছিল না। সব থেকে বড় কথা মুরগি বা পাঁঠার শরীরের মধ্যে  এতগুলো অংশ থাকে এবং সেই অংশগুলোকে এত সুন্দর করে প্যাকেজিং করে আলাদা করে বিক্রি করা যায় তা সত্যি আমার কাছে অজানা ছিল।


মাছের কাউন্টার তো একেবারেই ওপেন।  ওখানে যা আমার নজর কাড়ল তা হল একটা প্রায় দু'ফুট সাইজের হাঙ্গর। সে যেন পুরো জীবন্ত ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মনে পড়ে গেল  স্পিলবার্গের সেই বিখ্যাত মুভি 'Jaws'-এর কথা। অরিন্দম আমার আগ্রহ দেখে একবার এসে বিড়বিড় করে বলল বটে, 

- কিরে খাবি নাকি! 

- না...প্লিজ্...! 

 বিশ্বাস করুন, আমি জীবনে কোনদিন খাবার ব্যাপারে বিভিন্ন জীবজন্তুর আস্বাদ নিতে একেবারেই বিমুখ।  সমুদ্রের ধারে গেলেই যেমন সি-ফুড খায় আমি ওসবের ধারেবাড়েও নেই। যা স্ট্যান্ডার্ড, যা স্বাভাবিক, যা বাড়িতে থাকলে খাই বা আনিয়ে খাই, সেই সমস্ত খাবারেই আমি অত্যন্ত নিরাপদ বোধ করি এবং তাতে দেখেছি বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে উল্টোপাল্টা খাওয়ার জন্য মানুষের যেরকম পাইকারি হারে শরীর খারাপ হয়, সেসব অন্তত আমার হয় না। সৌভাগ্যক্রমে ইন্দ্রানী বা বুমবুম কেউ-ই খাবার দাবার নিয়ে খুব যে ওয়াইল্ড এক্স্পেরিমেন্ট করতে চায় তা নয়। 

তাই অরিন্দমের প্রস্তাব রিফিউজ করলাম। বললাম

- বরং শুনেছি যে সব থেকে ভালো মানের যে ইলিশ মাছগুলো ওঠে, সেগুলো নাকি বিভিন্ন বড় বড় দেশে চলে আসে। তোদের এখানেও নিশ্চয় ই আসে বলে মনে হয়। এই হাঙর খাওয়ার থেকে বরং এক একটা ইলিশ মাছ নিয়ে পরখ করে দেখা করে যেতে পারে যে আমাদের দেশের গুলোর সাথে এখানে এক্সপোর্ট কোয়ালিটি ইলিশের পার্থক্যটা কি !


অরিন্দম বললো 

- সেই বাজারটা অন্য জায়গায়।  আর লুলুতে সেরকম ভাল ইলিশ পাবি না। আমরা এখান থেকে কিন্তু মাছ কিনি না। এখান থেকেই চিকেন টিকেন ইত্যাদি কিনে নিয়ে যাই বটে। কিন্তু মাছ আমরা অন্য একটা মার্কেট থেকে কিনি। সেটা বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তাই যখন যাই তখন একেবারে পনেরো দিনের মতো মাছ একসঙ্গে নিয়ে চলে আসি। ওখানে একটি বাঙালি ছেলে আছে। বাংলাদেশী। তাকে বলা থাকে। সে আমাদের জন্য যত্ন করে আমাদের ফেভারিট মাছগুলো আলাদা করে রাখে। 

শুনে বললাম 

- বেশ তবে তাই হবে 

- হ্যাঁ ওই মাছের বাজারটা শারজার কাছাকাছি।  যেদিন ওদিকে যাব সেদিনই একেবারে ইলিশ্টা নিয়ে আসব। কিন্তু আজ ডিনারে আমরা একটা স্পেশাল খাবার খাব।  

- কি খাবার? 

- আমি এটা প্রায়ই অর্ডার করি। খেয়ে দেখ কেমন লাগে। একটা কমপ্লিট প্ল্যাটার্। সঙ্গে একটা স্টাফ্ড মোগলাই পরোটার মতো জিনিস কেটে কেটে দেয়। আর সাথে থাকে কাবাব। আর  তার সাথে তার সাথে স্পেশাল সস: হুমুস্। অনেকে হমাস বা হামুস-ও বলে। 

- প্ল্য়াটারটার নাম কি? 

- আরিয়াস্....

- আর হুমুস তা কি?

- ছোলা কে ভিজিয়ে তারপর অলিভ অয়েল দিয়ে মিহি করে বাটা। 

- শুনেই কেমন জিভে জল আসছে বুঝলি।  আর এর সঙ্গে যদি লাবান  আর স্প্রাইট থাকে। তাহলে তো আর কথাই নেই। পুরো জমে যাবে। 

- চল তাহলে লুলু থেকে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিয়ে আমরা আজকে ফুল বিনজ করব ।

চৈতালি বললো, 

- হ্যাঁ, ছোটুও নাকি আমাদেরকে খাওয়াবে বলে  চিজ পুডিং বানিয়েছে। 

এর পর লুলু মলের সমস্ত জিনিসই  বেশ মায়াময় ঠেকতে লাগলো। মনে হচ্ছিল আর তো বিশেষ কিছু এখানে দেখার নেই। এবার আপাতত বাড়ি ফিরলেই হয়। দেশটা অনেকটা পশ্চিমে। তাই সূর্যাস্তও দেরিতে। সেটা নিশ্চয়ই আগেই বিভিন্ন পর্বে সকলে বুঝতে পেরেছেন। সাড়ে আটটা নাগাদ যখন আমরা ফিরছি তখন সূর্য ডুবছে। 

অরিন্দমরা যে পাড়ায় থাকে সেখানে খুব উঁচু বিল্ডিং বলতে একটাই রয়েছে সেখানে। এর পরে ঐ অঞ্চ্লে অত উচু বিল্ডিং এর কোন পারমিশন পাওয়া যায়নি। এখন নিয়ম ম্যক্সিমাম আট তলা। সেই প্রাসাদের মত বিল্ডিংটার ছবি এখানে রইল। এটাও কিন্তু একটা রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স।  যখনই আমরা ওদের পাড়া ছেড়ে হাইওয়েতে এসে পড়ি তখন রাস্তা চেনার জন্য একটা দারুণ উপায় ছিল। চিহ্ন ছিল, একটা বিশেষ বাড়ি,  যার আকৃতি আনারসের মত। ওই আনারস বাড়ি দেখে আমরা বুঝতে পারতাম যে আমরা নিজেদের বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি বা এবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে  পড়বো। ওই আনারস বাড়ির এক অপূর্ব অবয়ব দেখতে দেখতে আমরা লুলু মল থেকে সেদিন বাড়ি ফিরে এলাম। 

ততক্ষণে আরিয়াসের অর্ডার হয়ে গেছে।  শুধু যা আসার অপেক্ষা!  আমরা লাবানের সাথে স্প্রাইট মিশিয়ে সঙ্গে সাউথ ইন্ডিয়ান চিঁড়ে ভাজা খেতে থাকলাম যাতে পিত্তি না পড়ে যায়!  সঙ্গে টিভিতে লাগানো হলো এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যামেরায় তোলা ছবি ও ভিডিও। আমরা এই ক'দিনে যে পরিমাণে ছবি ও ভিডিও তুলেছি সেগুলো সঠিকভাবে  দেখা তো দূর, ঠিকমতো ডাম্প্-ই করা হয়নি। এই প্রথম যতটুকু সময় পাওয়া গেল, তাতে বিভিন্ন ক্যামেরা থেকে ছবি ও ভিডিও এক জায়গায় করে তার সাথে টিভি কে কানেক্ট করে আমরা দেখতে শুরু করলাম।  


রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে দেখলাম আমাদের মরুভূমিতে চরে বেড়ানোর দিনটা। ঠিক যেন স্বপ্নের মত! 

এই স্বপ্ন নিয়ে আলোচনা করতে করতে আরিআস এসে গেল। সুন্দর করে সাজিয়ে আমরা খাবার খেতে আরম্ভ করলাম।  সঙ্গে চলল বলিউড সিনেমা।  অরিন্দমের ফেভারিট প্ল্যাটার সম্পর্কে কি আর বলি! সে এক অনবদ্য খাবার যা বারবার খেতে  ইচ্ছা হয় ! 

এটি যে কি জিনিস তার তুলনামূলক সংজ্ঞা দিতে গেলে বলা যেতে পারে যে, আরিয়াস হল অত্যন্ত উন্নত মানের চিকেন মোগলাইয়ের একটি ভিন্ন সংস্করণ। সঙ্গে থাকে বিভিন্ন ধরনের কাবাব ও চাটনি হুমুস। 

বুমবুম আর ছোটুর ডিনার সেদিন বাইরে।  ছোটু সেদিন বুমবুমকে নিয়ে গিয়েছিল ওর ওখানকার বন্ধুদের সাথে আলাপ করাতে। কাছাকাছি কোথাও তাদের সাথে একসাথে ডিনার। 

আমরা বড়রা বলিউড আর আরিয়াসে বুঁদ হয়ে রইলাম। 

আরিয়াস, লাবানাদি শেষ করে আমরা যখন  ডেজার্টের দেশে  ডেসার্টের খোঁজে  তখন পেলাম জিভে জল আনা বাড়িতে বানানো ছোটুর তৈরি করা চিজ পুডিং।  


ছোটু রান্না করেছে বলে বাড়িয়ে বলছি না, আমার খাওয়া সেরা চিজ পুডিং হচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল ছিল, ওদের নিজস্ব বেকারিতে প্রস্তুত করা চিজ পুডিং। সে স্বাদ অনবদ্য ও ভাষায় অবর্ণনীয়। এখন ললিত গ্রুপ অধিগ্রহণের পরে আর হয় কিনা জানি না। তা যাই হোক, ছোটু আজকে যে চিজ পুডিংটা বানিয়ে ছিল সেটা প্রায় গ্রেট ইস্টার্নের পুডিং টাকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দেওয়ার মত। 

আমার পেট ভর্তি থাকা সত্ত্বেও আমি যতটা চিজ পুডিং খেলাম তাতে আবার উল্টে বকুনিও খেতে হল ইন্দ্রানীর কাছে, যে অন্য কারোর কথা না ভেবেই আমি নাকি পুরোটা সাবাড় করে দেওয়ার তালে আছি। তাই নেহাত চক্ষুলজ্জাজনিত কারণে তখনকার মতো খান্ত দিলাম। আর ছোটুর সাথে চোখে চোখে কথা হল যাতে আমার জন্য কিছুটা থাকে, সকালবেলায় কফি দিয়ে খাওয়ার জন্য। 

ছোটু দেখলাম সকলের  গল্প করার ফাঁকে বাকি চিজ পুডিং-টা  চুপচাপ ফ্রিজে তুলে রেখে দিল।

বাকিটা আবার কাল সকালে চেখে দেখবো।  


সুবিধা একটাই। এখানে এসে দেখছি, ঘুম থেকে সবার আগে আমি উঠি। সুতরাং একা একা বিভিন্ন দুষ্কর্ম করার সুযোগ আমার কাছে সকালবেলাতেই যথেষ্ট।

আপাতত্: নিপাট ভাল মানুষের পো এর মত ঘুমোতে গেলাম। 

 


ঝাউতলার গল্প : পর্ব ৭

 ঝাউতলার ধন:



একবার হয়েছিল কি, এক টুনটুনি এক রাজার জিনা হারাম করে দিয়েছিল। বলেছিল

- রাজার ঘরে যে ধন আছে আমার ঘরেও সে ধন আছে 

রাজা বনাম টুনটুনি!!  

লড়াই এর ফলাফল ?

- এক টুনিতে টুনটুনালো/সাত রানীর নাক কাটালো | 

তারপর শেষে  রাজা টুনটুনিকে মারতে গিয়ে নিজের নাকেই কোপ।

ধনের প্রতিযোগিতায় নাকই ঘ্যাঁচাত।

ঝাউতলার গল্পটা অনেকটাই অন্যরকম | কিন্তু মিল যেখানে পাওয়া যেতে পারে তা হল একের ধনে অন্যের ঈর্ষা | 

ঝাউতলায় এখন ট্রেন্ডিং যে আমাদের নবীনদাকে দেখা গিয়েছে ধনের জন্য তরস খেয়ে ধনতেরাসের পূন্য তিথিতে বিভিন্ন সোনার দোকানে লাইন দিতে | ওনার পিছনে আমাদের পাড়ার পেপারাৎজিরা (যাদের পাতি বাংলায় 'ঘোঁটবাজ' বলে) ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায় | তাতে ওনার বিশেষ কিছু যায় আসে না। আগেকার দিনে পাড়ায় বিভিন্ন লোকের হাঁড়ির খবর রটে যেত কারণ সে সময়ে দেওয়ালেরও  কান ছিল।   এখন দুয়ারে উন্নয়নের দরুন দেওয়ালরা বধির হয়ে গেছে |  খবর আর দেওয়াল ভেদ করে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ঢুকতে চায় না।  কারন ফ্ল্যাটের দেওয়াল বড়ই পাতলা। হাঁড়ির খবরের সম্মানে লাগে অত পাতলা দেওয়াল ভেদ করতে । আমরা উন্নততর হয়েছি, আরও সভ্য হয়েছি, তাই খবর এখন চ্যানেলে আর মোবাইলে | আর ঘোঁট হল অসভ্যতা | ভদ্রলোকেরা এসব নিয়ে চর্চা করে না। তাই ধরন বদলে আমাদের হাউসিং কমপ্লেক্সে  ঘোঁট আর্কাইভ করা থাকে কমপ্লেক্সের মেইন এন্ট্রান্সে সিকিওরিটি কাউন্টারে। উৎসাহী ব্যক্তিরা যাতায়াতের পথে ওখান থেকে ঘোঁট সংগ্রহ করেন | এর জন্য মেম্বারশিপ লাগে না। 

সপ্তাহ খানেক আগে সেখান থেকে যে তথ্য পাওয়া গেল তা হল নবীনদা মাসখানেক আগে রিটায়ার করার পরে নাকি পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছেন| 

খবর মেন গেট থেকে গেলেও তার উৎস ঝাউতলার অর্থনীতিবেত্তারা | আমাদের ঝাউতলায় ব্যাংক এবং ফিনান্স নিয়ে জটিল কাজকর্মে ওস্তাদ লোকজন আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান তিনজন হলেন, এক, দেবাঞ্জন দুই, সমীর ও তিন, অনন্ত | জোকস অ্যাপার্ট, এনারা প্রত্যেকেই জাস্ট ব্রিলিয়ান্ট বললেও কম বলা হয়। 

এঁরা নবীনদার কর্মজীবন ও কাল্পনিক বেতনের ভিত্তিতে বেশ কয়েকদিন খুব খেটে হিসেব করে দেখেছেন যে নবীনদা সুপার অ্যানুয়েশনের অব্যবহিত পরে পাঁচ কোটি লিক্যুইড  ক্যাশের মালিক হয়েছেন। রিটায়ারমেন্টের পরে উনি এত টাকা নিয়ে করবেন তা নিয়ে আমরা সবাই খুবই চিন্তিত। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো  নবীনদা নিজেই জানেন না ওনার পোস্ট-রিটারমেন্ট বেনিফিট হিসেবে উনি পঞ্চকোটি ভারতীয় অর্থ লাভ করেছেন। 

আর নবীনদার বাস্তবের সাথে কিছুতেই এই তিন জনের হিসেব মিলছে না | রোজই এ নিয়ে সবার তর্কাতর্কি | একদিন আর না পেরে আগবাড়িয়ে বলতে গেলাম যে 

- দাদা আপনি যা পাচ্ছেন, তা পাচ্ছেন |  আর ওরা যা হিসেব করছে, তা করছে |  তার সাথে আপনি আসলে যা পেয়েছেন বা পাচ্ছেন, আর ওরা যা হিসেব করে বের করেছে, সে দুটোকে যে মিলতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি তো কেউ দেয়নি। সুতরাং আপনি এ নিয়ে এত চিন্তা করবেন না| মিছিমিছি রাতের ঘুম নষ্ট হবে। যেমন আছেন থাকুন। 

কিন্তু আমি যে উলুবনে মুক্তো ছড়ালাম তা তখন বুঝতে পারি নি। নবীনদা আসলে আরও বড় খিলাড়ী | 

সাথে ওনার পেটে পেটে অন্যের ধনের প্রতি টুনটুনির মত ঈর্ষা তা আমরা ঘুনাক্ষরেও টের পাই নি। 

এখন প্রশ্ন দুটি

এক, ঈর্ষা কার প্রতি? 

না, পনেরো বছর আগে রিটায়ার করে যাওয়া ব্যাঙ্ক অফিসার মিহিরদার প্রতি |

আর দুই, কেন এ হেন ঈৰ্ষা?

কারন সিকিওরিটির কাছে গচ্ছিত আর্কাইভ থেকে পুরোনো তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে যে মিহিরদার নাকি কয়েক কেজি সোনা আছে |

নবীনদা ভাবলেন,

- টাকা আমার থাকতে পারে | সোনা তো নেই।  

ব্যাস! এবারে সেই মিহিরদার সাথে নবীনদার টক্কর | অথচ দেখলে মনে হবে দুজনে যেন হরিহর আত্মা | দুজনে দুজনকে এই বয়সেও বাঁ... জাতীয় ব্রজবুলিতে নিত্য সম্বোধন করেন ৷ 

ওনাদের যেমন সদভাব, তেমন আদায় কাঁচকলায় | কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না |  পুরো সমান সমান | একমাত্র খামতি যদি কিছু  থেকে থাকে তা শুধু ওই কয়েক কেজি সোনায় | সুতরাং এই সোনার হিসেবটা আগে মিলিয়ে নিতে হবে। তবে না সমানে সমানে টক্কর! 

ফলস্বরূপ  ধনতেরাসের দিনে হাওড়া কলকাতা চত্বরে যত সোনার দোকান আছে সব দোকান নবীনদা ঘুরে ফেলেছেন।  সেটাও আমরা জানলাম নবীনদার কাছ থেকেই | গেটে খবর যে ছিল না তা নয় | কারণ কাকতালীয় ভাবে আমাদেরই ঝাউতলার এক বেচারা কিন্তু বিশিষ্ট বন্ধু সবজির আগুন বাজারে কালী পুজোর দিনে একটু ভালো-মন্দ খাবে বলে বাজার করতে গিয়েছিল। তার পরে বাজার ছাড়াও আরও অনেকগুলো কেনাকাটা করার ছিল | 

কদমতলা বাজার  বিভিন্ন প্রান্তে বিস্তৃত। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে যেতে যতগুলি সোনা রুপোর দোকান পড়ে, সব ক'টা দোকানেই নাকি আসা যাওয়ার পথে আমাদের বন্ধুবর নবীনদাকে দেখেছে | এটা সকালের দিকে । দুপুরবেলায় আরেক বন্ধু ওনাকে দেখেছে হাওড়া ময়দানের বড় সোনার দোকানের কাছে | আর সন্ধেবেলায় আমাদের অন্য এক ঝাউতলিস্ট ওনাকে সস্ত্রীক দেখেছে বৌবাজারে সোনাপট্টিতে | 

কিন্তু তারা কেউই এসব বলেনি কাউকেই, এক সিকিওরিটি ছাড়া কারন ওখানকার আর্কাইভে তথ্যভাণ্ডারকে নিয়মিত পুষ্ট করা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। 

কিন্তু কথায় কথায় নবীনদা নিজেই ফস করে বলে বসলেন, 

- সবকটা সোনার দোকানে কি ভিড় মাইরি! কি  লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন | ঢোকাই যাচ্ছে না, একটাতেও |

ব্যাস! আর যায় কোথায়!

এই কি যথেষ্ট নয় জানার জন্য যে, নবীনদার মনে আমাদের আমাদের মিহিরদার সোনার ধনের প্রতি কি মারাত্মক চাপা হিংসা !

সেই চাপা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে নবীনদা ঘুরে বেড়াচ্ছেন সোনার  দোকানে দোকানে, একটু সোনা পাওয়ার আশায় | কিন্তু হায়রে বিধাতা!  সোনা কিনতে চাইলেই কি আর পাওয়া যায়? লাইন দেখেই তিনি ঘেঁটে গিয়েছেন। ওনার বক্তব্য অনুসারে

- জামাইষষ্ঠীতে পাঁঠার মাংসের দোকানে যেরকম লাইন হয়, ঠিক সেরকম লাইন ! 

কিন্তু পাঁঠার কিলো আর সোনার কিলো তো আর এক নয় | 

এখন বিষয়টা গিয়ে দাঁড়ালো এরকম যে ব্যর্থ মনোরথে তিনি ফিরে আসবেন তা তো হতে পারে না!  শোনা গেছে যে উনি পিসি চন্দ্রকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন, বরাত দেবেন বলে। 

মেইন গেটে সিকিওরিটি কে কড়া হুকুম দেওয়া আছে যে এই ধরনের অতিপ্রীতিকর কোন ঘটনা যদি ঘটে তাহলে যেন তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট করে!

আসলে নবীনদা সুতনুর হাত থেকে লাটাইটা নিঃশব্দে কবেই কেড়ে নিয়েছেন তা আমরা বুঝতে পারিনি। সুতনু সেটা বুঝতে পেরে আজকাল বিশেষ আসে না | এলেও কোন কথা বলে না। ঠোঁটের একদিকে একটা না-ধরানো কিং সাইজের সিগারেট ঝুলিয়ে ফুল সাউথের আন্না স্টাইলে ধুলো উড়িয়ে লঝঝড়ে  স্কুটিটা নিয়ে সাঁ করে এসে দাঁড়ায়। তারপর সিগারেটটা ধরায়। তারপর খুব রয়ে সয়ে দু-একটা বাক্য বিনিময়ে করে আবার সাঁ করে স্কুটি টা নিয়ে ওর বাড়ির দিকে চলে যায়। 

নবীনদা  এসব চেয়ে চেয়ে দেখেন আর মিচকে মিচকে হাসেন | ওনার ভাবনার তল পাওয়া মুশকিল। 

আমার স্থির বিশ্বাস সোনা কেনার বরাত দেওয়ার প্রচার একটা ভাঁওতা মাত্র | আসলে কিন্তু তলে তলে সেদিনই সোনা স্টক করে মিহিরদাকে ছাপিয়ে গেছেন | বাকিটা সবাই বুঝতে পারছেন, যে দাদা মানে আমাদের নবীনদা আমাদের একটু ল্যাজে খেলাচ্ছেন । টুনটুনির মত। 

তবে আশা করি এ খেলায় কারোর নাক কাটা যাবে না। 

কালীপূজার রাতে ওনার নামে সংকল্প করা হয়। তাই উনি নির্জলা উপবাস করেন৷ আর উপবাস ত্যাগ করেন এক দিস্তে লুচি আর পাঁচকোল গ্রাম পাঁঠার নল্লী নিহারী সেবন মাধ্যমে | এ পাঁঠা যে সে পাঁঠা নয় | বলি দেওয়া পাঁঠা | এখন পাবলিকলি পশুবলি বন্ধ হয়েছে বলে উনি দোকানেই বলি চড়িয়ে আসেন | তারপর গোটা পাঁঠা পিস করে মোড়া হয় সবুজ শালপাতায় | তারপর তা বাড়িতে আসে | মায়ের প্রসাদ দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করবেন বলে সে পাঁঠা রান্না হয় নিরামিষ পদ্ধতিতে | মানে তা পেঁয়াজ রসুন বর্জিত। বলির পাঁঠার নল্লী নিহারী রান্না শুরু হয় রাত দশটা নাগাদা | লোহার কড়ায় ঢিমে আঁচে নিহারী রান্না হতে লাগে পাঁচ ঘন্টা |   

কালীপূজো শেষ হল রাত তিনটে নাগাদ | লুচি আর নিহারী প্রস্তুত | সিল্কের গাঢ় লাল পাঞ্জাবী আর তসরের ধুতি বাগিয়ে আসনে উপবিষ্ট হলেন নবীনদা, উপবাস ত্যাগ করতে | 

ধনে ধনে মিহিরদার সোনার সমান হয়ে উৎফুল্ল নবীনদা একটা লুচি গুছিয়ে পাঁঠার নলীর গা থেকে মাখনের মত নরম মাংস তাতে ভরে ঝোলের মধ্যে দু-বার ডুবিয়ে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে ' জয় মা!' বলে মুখে পুরে চোখ বুজে স্বর্গীয় আস্বাদ অনুভব করতে করতে উপোস ত্যাগ করলেন। 

এই না হলে অভিজাত্য! এই না হলে ধনী!

বিদিবদ্ধ ঘোষণা:

-  এই গল্পের সব চরিত্ররা কাল্পনিক

- এই গল্পে কোনো পশুপাখির কোনোভাবে কোনো ক্ষতি করা হয় নি। 



Monday, 28 October 2024

শুভ বিজয়া

 


ভালো মিষ্টি বাঙালীদের নাকি ইমোশনালি ট্রিগার করে, ঠিক যেমন বৃটিশদের, হুইস্কি।


আমিও আজ বিশেষ এক মিষ্টির খপ্পরে পড়ে ট্রিগার্ড হলাম, ইমোশনালি। আর সেটার ফল স্বরূপ নিচে যা বেরোলো, তার ভাল মন্দের সব দায় হলো এক কাকিমার, যিনি আমাকে আজ এক বিশেষ মিষ্টি খাইয়ে এ পথে চালিত করলেন।

****

সেদিন ছিল বিজয়া দশমী। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে মামার বাড়িতে দাদুর চৌকির তলা থেকে মিহিদানা চুরি করে খেতে গিয়ে আমি ধরা পড়ি ওই পাড়ার রূপা মাসীর হাতে। রূপা মাসী আমাকে কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রান্নাঘরে নিয়ে এসে খুব বকাবকি করছিল। হঠাৎ বড় মামিমা রূপা মাসীর হাত থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে ধমকের সুরে বলে উঠল,

-        কি ব্যাপার রে রূপা, তুই ওকে মারছিস কেন?

-        বৌদি ও মিহিদানা চুরি করে খাচ্ছিল।

বড় মামীমা যখন রেগে যেত, তখন জ্ঞান থাকত না। ভীষণ রেগে গিয়ে বলল:

-        তুই কিন্তু বাইরের লোক, তাই বুঝে শুনে কথা বলিস। বাড়ির ছেলে নিজের বাড়ি থেকে জিনিস নিয়ে খেলে তাকে চুরি বলে না রূপা। ও তো আর তোর বাড়ি গিয়ে পাত পেড়ে মিহিদানা খেতে যায় নি। ওর নিজের মামার বাড়িতে নিজের দাদুর আনা মিহিদানা খাচ্ছিল। তুই ওকে শাস্তি দেবার কে রে?

-        কি বলছ বৌদি...

-        হ্যাঁ বলছি, আর যা বলছি নিশ্চই শুনতে পেয়েছিস্! তাই তুইএখন আয় রূপা, আমি একাই সব সামলে নিতে পারব।

আমার রূপামাসীর জন্য খুব খারাপ লেগেছিল। বলতে গেলাম তাই,-

-        মাইমা, আমি কিন্তু লুকিয়েই মিহিদানা নিচ্ছিলাম...

-        চুপ্...একদম্ চুপ..., ছোট আছ্, ছোটদের মত থাক, বড়দের কথার মধ্যে নাক গলাবে না।

আমি আর সেদিন কথা বাড়াই নি। পরে আবার বড়মামীমা তাঁর অনবদ্য স্বভাবগুণে রূপামাসীকে আগের মতই আপন করে নিয়েছিল, দুদিনের মধ্যেই। কিন্তু রূপামাসী আমাদের্, মানে যত কুঁচোকাঁচা ছিলাম তাদের, পরে বকেছে, শাসন করেছে, কিন্তু আর কোনোদিন গায়ে হাত তোলেনি বা অসম্মান করেনি।

 ****

সেই সময়ে মামার বাড়িতে বিজয়ার দিন সন্ধ্যেবেলায় অন্তত সত্তর থেকে আশি জন বিজয়া করতে আসতেন। সবাইএর সবার বাড়িতে যাওয়ার প্রচলন ছিল। আমরাও আবার অন্য বাড়িতে যেতাম। আমার পুজোর সময় ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময়টাই মামার বাড়িতেই কাটতো। টানা এক মাসের পুজোর ছুটি। একদম ভাইফোঁটায় বাড়ি আসতাম।

ঠিক কতদিন পর্যন্ত জানিনা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে দুগ্গা ঠাকুর বিসর্জনের পরে ঐ বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে বিজয়া দশমীর করার প্রচলনটা ছিল। সেই প্রচলন অনুসারে যারা বয়েসে ছোট তারা বড়দের  বাড়িতে যেত, বিজয়ার প্রণাম করে আশীর্বাদধন্য হতে। এবার যদি কোন ভাবে যাঁরা বড় তাঁরা যদি ছোটদের বাড়িতে চলে আসতেন এবং ছোটরা যদি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বিজয় দশমীর সেরে নেওয়ার চেষ্টা করত,  তা হলে কিন্তু বড়রা বিজয়ার সেই  প্রণাম গ্রহণ করতেন না। বলতেন

- বাড়িতে এসো, নিজে এসো, তখন এই বিজয়ের প্রণাম গ্রহণ করব।


বিজয়া দশমীর দিন ঠাকুর বিসর্জনের পরে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে গুরুজনদের প্রণাম করার একটা ঐতিহ্যপূর্ণ রেওয়াজ ছিল। সারা পাড়ায় একটা উৎসবের মতো ব্যাপার ঘটতো সেদিন। বাড়িতে বাড়িতে অতিথিদের আপ্যায়ণের জন্য রান্না হতো ঘুগনি, নারকেলের ছাঁচের মিষ্টি, বা চন্দ্রপুলি।  দোকান থেকে আসত সীতাভোগ, মিহিদানা বা বোঁদে আর গজা বা কুঁচো গজা।সঙ্গে কিছু কিছু বাড়িতে ঝুড়িভাজা বা চানাচুরও দেওয়া হতো।

এটা ছিল দশমীর দিনের রুটিন। এরপর একাদশী থেকে কালী পুজো পর্যন্ত চলত দূরে থাকা কাছের সম্পর্কের আত্মীয়দের বাড়িতে প্রণাম করতে যাওয়া। খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না, প্রধাণত: মিষ্টিই নিয়ে যাওয়া হত। আর যাদের বাড়িতে যাচ্ছি তাদেরও কিন্তু ঐ কদিন সবসময় প্রস্তুত থাকতে হতো, যে কেউ যেন বিজয়া সারতে এসে শুধু মুখে ফিরে না যায়।

বিজয় দশমীর দিন পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন জায়গায় বিজয়া করতে যাওয়া প্রচলন আজ অবলুপ্ত।

ঠিক কবে পর্যন্ত বিজয় দশমীর প্রণাম করা যায় এ নিয়ে ধন্দ আছে। যেমন প্রথমে প্রচলন ছিল লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত বিজয়ার প্রণাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় সারা যায়। তারপরে ধীরে ধীরে বাঙালীর ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে তা কালী পূজা পর্যন্ত প্রসারিত হলো। কালীপুজোর বিসর্জন অব্দি বিজয়া দশমী করতে যাওয়া যেত। সেসব উঠে গিয়ে প্রথম এল এসএমএস-এ বিজয়া সারা।  তারপরে এখন হোয়াটসঅ্যাপের দয়ায় সুন্দর একটা ছবি (তাও আবার অন্য কারোর ফরোয়ার্ড করা)  পাঠিয়ে দিয়ে বিজয়া সেরে নেওয়া যায়।অনেক বয়স্ক মানুষই হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন না। কিন্তু তাতে কি! আমরা তো পাঠিয়ে দিয়েছি, সব -- প্রণাম, শুভেচ্ছা, এমনকি এ-আই কৃত এক হাঁড়ি ভর্তি পার্ফেক্ট রসগোল্লাও। ওনারা না জানতে পারলে আমাদের কিছু করার নেই।  নিরক্ষর শিশু, যাদের এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়েস হয় নি, তারা যদি স্মার্ট ফোন অনায়াসে ব্যবহার করতে পারে, এনারা শিক্ষিত অ্যাডাল্ট হয়ে, এটুকু পারেন না!

সত্যিই তো উজিয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি যাবার দরকার নেই তো!  বাড়িতে বসেই যখন সেরে নেওয়া যাচ্ছে তখন আর যেচে পড়ে কয়েকটা লোককে বিরক্ত না-ই বা করা গেল!

কিন্তু আদৌ কি ওনারা বিরক্ত হন? নাকি, আমরা নিজেদের অনিচ্ছা ঢাকতে ধরে নিই যে ওনারা বিরক্ত হবেন? মানে এটা আমাদের অজুহাত মাত্র নয় তো!

আসলে ইচ্ছেটা আমাদের নিজেদের মধ্যেই নেই যে আমরা অন্যের বাড়িতে যাব, বিজয়া সারবো। যাঁদের বাড়িতে যাওয়ার কথা তাঁরা তো আমাদের থেকে বড়, আমাদের গুরুজন। সেকেলে মানুষ তো। তাই আধুনিক যুগে মানুষের ব্যস্ততাকে সম্ভ্রমের সঙ্গে মেনে  নিয়ে তাঁরা কিন্তু সব সময় দু'হাতে, প্রাণভরে আমাদের আশীর্বাদ করেন, সে আমরা ওনাদের কাছে যাই, বা না যাই। আর যে অজুহাত দিয়ে ওনারা বিরক্ত হবেন বলে নিজেরাই এটা এড়িয়ে যাই, সেটা আসলে নিজেদের অসুবিধা ঢাকতে, স্বার্থপরতা ও আত্ম্সুখকে চাপা দিতে। তাঁরা আসলে পথ চেয়ে বসে থাকেন কিছু মানুষ আসবে তাঁদের সাথে কথাবার্তা বলবেন। বিজয়ার প্রণাম তো একটা ছুতো মাত্র, যাতে সমাজ ও পরিবারের সবাই যেন যোগাযোগ্-বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়েন। বছরে এক বার অন্তত্: এই সুযোগে সবার দেখা হোক্। আসলে হাত ও বুক ভরে নি:শর্ত আশীর্বাদ করার মানুষগুলো ধীরে ধীরে নি:শব্দে হ্রাসমান। তাই যতদিন ধরে রাখা যায় পুরনো বদ অভ্যাস, তাতে ক্ষতি কিছু হয় না।  কেউ কোনো গুরুজনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন করলে ছোট হয় না। এটা বাঙালী সমাজ ও পরিবারের মানব-বন্ধনের একটা বড় দিক।


ওই বদ অভ্যাস ধরে রাখার চেষ্টার দরুণ বেশ কিছু নতুন জিনিসের প্রাপ্তি ঘটে, আমার।
যেমন আজ সকালে সোমদেবদের বাড়ি গিয়ে ওর বাবা মাকে প্রণাম করতে গিয়ে দেখা গেল সোমদেবের মামাও সেখানে উপস্থিত। তিনি থাকেন মালদহে। মালদা থেকে আনা এক অদ্ভুত মিষ্টি আমার কপালে জুটলো। কলকাতায় অনেক তাবড় মিষ্টি দেখেছি, মিষ্টির দোকান দেখেছি, কিন্তু এই মিষ্টি তো কোনদিন দেখিনি। শুনলাম এ হলো মালদার স্পেশালিটি। নাম, খুবই পরিচিত। কিন্তু আমাদের কলকাতা-হাওড়ায় এই নামে যে সমস্ত মিষ্টি চালানো হয়, এই মিষ্টি দেখা এবং চেখে দেখার পরে বুঝলাম সবই নকল, মানে নাম ভাঁড়িয়ে চালানো হয়। আসল মিষ্টিটির রূপ-গুণ সব-ই আলাদা।


এই মিষ্টির নাম হল রসকদম্ব

জিওলজিক্যালি মিষ্টিটির তিনটি স্তর আছে। একদম ভিতরের স্তরে, যাকে ইংরেজিতে coreবলে, সেখানে রয়েছে একটি মাইক্রো-রসগোল্লার গুটি।
তার ওপরে হাফ ইঞ্চি পুরু আসল মিষ্টিটি কড়া ক্ষীরের তৈরি এবং তার রং হালকা থেকে গাঢ় বাদামী।
আর তার ওপর ছড়ানো আছে ছোট ছোট সাদা দানা।
ফিনিশিং হচ্ছে কদম ফুলের মত, এক্কেবারে।
আর খেয়ে দেখলে, এক সে স্বর্গীয় অনুভূতি!

 
ভাগ্যিস ভার্চুয়াল বিজয়ার বদলে ফিজিক্যাল বিজয়াটা সারতে গিয়েছিলাম !
নইলে যে কি মিস হত!