কিন্তু সেই আমি হঠাৎ একদিন পণ করে বসলাম যে জীবনে আর যাই হোক, কোন ভিখারীকে ভিক্ষা দেবো না। তার কারণ দুটি ঘটনার সমাপতন ও সেগুলোর আমার মনের ওপর যৌথ অভিঘাত।
প্রথমটি হল, খবরের কাগজে বেরোলো যে হাওড়া স্টেশনে আমরা যে সবওয়ে দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করি, সেখানে এক ভিখারী ভিক্ষা করতে করতে হঠাৎই মারা গিয়েছে। আর তার কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে প্রায় পঁচাত্তর হাজার টাকা নগদ টাকা। আমার বাবা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তখন ওনার মাসিক বেতন হবে কুল্লে তিন হাজার টাকা। খুব মর্মাহত হয়েছিলাম, তুলনা করে।
আর দ্বিতীয় ঘটনাটি আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা।
রোজ স্কুলে যাবার সময় বাবা আমাকে গুনে দু' টাকা দিতেন। এর মধ্যে এক টাকা গাড়ি ভাড়া, আর এক টাকা টিফিন বাবদ। আমাদের বাড়ি সালকিয়াতে। আর স্কুল ছিল বেলুড়ে। তখনো পর্যন্ত আমার কোনো সাইকেল ছিল না। সুতরাং, সে নিজের পছন্দের বই কেনাই হোক, আর পয়সা বাঁচিয়ে জন্মদিনে বন্ধুদের আমার সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু ভালো মন্দ খাওয়াব , সেটাই হোক, তার জন্য একমাত্র উপায় ছিল যে গাড়িভাড়া বাঁচানো। সালকিয়া থেকে বেলুড় পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া আসা করতাম, প্রায়ই, গাড়িভাড়া থেকে পয়সা বাঁচাতে।
এই যাতায়াতের পথে জয়সোয়াল হসপিটাল -এর কাছে এক ভিখিরি রাস্তায় বসে ভিক্ষা করত। বয়স ষাটের উপরে হবে। তাকে দেখে কেমন যেন একটা মায়া হত! আমি যখনই হেঁটে যাতায়াত করতাম তখনই তাকে আমার খুব কষ্ট করে বাঁচানো পয়সা থেকে চার আনা মানে পঁচিশ পয়সা করে দিতাম। সেও আমায় দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করতো। আর পুরো ব্যাপারটা আমার মনের মধ্যে একটা অন্যরকমের ভালো অনুভূতি তৈরি করত। মনে হত যেন, জীবনে যেন অনেকটা আলো; কি সুন্দর এ জগত!
আগেই বলেছি যে আমার বাবার স্কুল শিক্ষক হিসেবে তখন রোজকার ছিল হাজার তিনেক টাকা। মা তখন এক স্নায়ুজনিত বিশেষ অসুখে ভুগছেন। সেই অসুখ থেকে মাকে নিরাময় করার জন্য বাবার জলের মতো টাকা খরচা হচ্ছে। তিন হাজার টাকার বাইরে আরো যদি কিছু রোজগার করা যায় তার জন্য বাবা দিন-রাত এক করে টিউশন পড়িয়ে সবদিক ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। জীবনের এই জটিলতা বোঝার মত বয়স তখন আমার না হয়ে থাকলেও, এইটুকু আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে বাবার কাছে কিছু বায়না করা মানে বাবার উপর একটা অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। এই কঠিন পরিস্থিতিতে ওই চার আনা পয়সা আমার কাছে অনেকটাই ছিল, যা আমি ওই ভিক্ষুককে দিতাম। আর সবদিক বাঁচিয়ে ওই পঁচিশ পয়সা ভিখারিটিকে দেওয়ার জন্য আমাকে কিন্তু পুরোটা পথ হেঁটে যাতায়াত করতে হতো।
একদিন একটি ঘটনা ঘটল। আমি সেদিন স্কুলে যাইনি। আমার এক দিদাকে নিয়ে লিলুয়ার কাছাকাছি একটি ব্যাংকে যাওয়ার কথা ছিল। ফলে সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে একটু ওলটপালট হল। আমি অন্য দিনের থেকে অনেকটা আগেই দিদাকে নিয়ে বেরোলাম। দিদা বাসে উঠতে পারত না তাই বাবা একটা রিক্সা ঠিক করে দিয়েছিল। সেই রিক্সায় করে যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়লো -- যে ভিখারিটিকে যাকে আমি ভিক্ষা দিই। প্রথমে চিনতেই পারি নি। পরে দেখলাম এ তো সে-ই বটে। দিব্যি ধোপদুরস্ত কাপড় পরা অবস্থায় একটা গলির মুখ থেকে রিক্সার স্ট্যান্ডে রিকশায় উঠছে। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না -- এ আমি কি দেখছি! পেরিয়ে চলে যাবার পরে, নিজেকে প্রবোধ দিতে লাগলাম, হয়তো একই রকম দেখতে অন্য কোন লোক! অস্থিরতা কাটল না। বাড়িতে ফিরে নিজেকে বোঝালাম যে সে নিশ্চয়ই অন্য ব্যক্তি, নিশ্চয়ই আমার চোখের ভুল।
হেঁটে স্কুল যাতায়াতের জন্য আমার বেশ কিছু সঙ্গীসাথী ততদিনে জুটে গিয়েছিল। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আমার থেকে অনেক উন্নত হওয়া সত্ত্বেও তারা নিছক উৎসাহে এবং বন্ধু হওয়ার দরুন আমার সাথে বেশ মজা করেই হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেত এবং ফিরত। ঐ রোজের পথ হাঁটার মধ্যে আমরা যে কত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সেইসব অভিজ্ঞতা খুব ছোট বা অপাত দৃষ্টিতে তুচ্ছ হলেও, আমাদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বেশ সাহায্য করেছে বলেই মনে হয়।
যাই হোক, আমি সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা আমার সেই বন্ধুদেরকে বললাম। ওরা তো শুনে রেগে কাঁই!
শুভ্র বলল,
- দে, আরো দে! এলেন আমার দাতা কর্ণ! তোর স্বভাবই সবাইকে ভালো ভাবা। তুমি শালা হেঁটে স্কুলে যাও, কি না ওকে দান করবে...আর ও রোজ রিক্সায় চড়ে ভিক্ষে কত্তে আসে! তোর লজ্জা করে না! বাপের পয়সা এভাবে ভুলভাল লোককে দিয়ে বেড়াচ্ছিস! এর থেকে আমাদের রোজ ওই পয়সায় আইসক্রিম খাওয়ালে কাজ দিত! (তখন একটা কাঠি আইসক্রিমের দাম ছিল দশ পয়সা।)
আমি কেঁদে ফেললাম।
প্রদীপ বলল,
- ঐ মেলা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদিস না তো! হতেই পারে তুই ভুল দেখেছিস। কিন্তু আমাদের সেটা একবার দেখে নেওয়া দরকার যে ব্যাটা সত্যিই ভিখিরি কিনা।
পরদিন ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির মত শুরু হল অ্যাডভেঞ্চার 'ভিখিরি'।
আমরা নির্দিষ্ট সময়ে সেই গলির কাছে গিয়ে পৌঁছালাম যেখান থেকে আগের দিন ভিখিরিটাকে রিক্সায় উঠতে দেখেছিলাম। বিভিন্ন দিকে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম সবাই, যদি ভিখিরি আসে!
ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে আগের দিনের মতোই সেই ভিখিরি এলো। পরনে সেই সুন্দর পোশাক। মাথায় টুপি। রিকশায় উঠলো। আমরা ছিলাম চারজন। তার মধ্যে এই বিশেষ অ্যাডভেঞ্চারের জন্য দু'জন সাইকেল নিয়ে এসেছিল। বাকি দুজন ওই দুই সাইকেল-বন্ধুর সওয়ারী হলাম। বেশ খানিকটা দূর থেকে ওই ভিখিরিকে ধাওয়া করতে লাগলাম।
রিক্সাটা সোজা রাস্তায় না গিয়ে গলিগালা দিয়ে ঘুরে গন্তব্যের দিকে এগোতে থাকলো। আমরাও পিছু পিছু যেতে থাকলাম।
সত্যবালা পেরোনোর পরে একটা খুব ঘিঞ্জি জায়গায় রিক্সাটা দাঁড়ালো। রিক্সা ওয়ালা-কে ভাড়া দিয়ে লোকটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।
প্রদীপ রিক্সাওয়ালাটাকে একটু দূরে এসে পাকড়াও করে জানল যে ওই ভিখিরি বাবাজি ওদের বাঁধা সওয়ারী। ওই স্ট্যান্ড থেকে পালা করে বিভিন্ন রিক্সাওয়ালা ওকে রোজ এখানে নিয়ে এসে নামায়।
আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। মাথায় দু-চারটে চাঁটি আর পাশের টিঊব ওয়েল থেকে জল খেয়ে খানিকটা ঠিক হলাম।
আমরা দূর থেকে লুকিয়ে লক্ষ্য রাখতে থাকলাম। মিনিট দশেক বাদে সেই ব্যক্তি বেরোলেন আদ্যোপান্ত ভিখারীর বেশে। এই তো সেই মানুষ যাকে আমি রোজ ভিক্ষা দিই।লোকটা বেরোনোর সময় এক সুসজ্জিততা মহিলা তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন।
আমি সত্যিই আর নিতে পারছিলাম না। ভেঙে পড়েছিলাম, সম্পূর্ণরূপে।
বন্ধুদেরকে বললাম
- চল অনেক হয়েছে। যা বোঝার, বুঝে গিয়েছি।
ওরা বলল,
- না না অত্ত সস্তা! আমরা শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়বো....
শেষ আর দেখার মত কিছু ছিল না। আশানুরূপ পরিণতি।
সেই ভিখারি নির্দিষ্ট স্থানে স্থানে গিয়ে তার আসন সাজিয়ে ভিক্ষা চাইতে বসলো। আমরা ঠিক যেরকম ভাবে কোন পুজোর আয়োজন করার জন্য জোগাড় করি, সেরকম ভাবে বসার আগে সে জায়গাটাকে অতি যত্ন সহকারে সাজালো যাতে লোকের তাকে দেখে মায়া হয়।
আমি হাউহাও করে কাঁদতে থাকলাম -- এ আমি কি করেছি! কার জন্য কি করেছি! দিনের পর দিন একটা মানুষকে শুধু ভিক্ষা দেবে বলে নিজেকে কতটা কষ্ট দিয়েছি! কিন্তু তার বিনিময়ে এই প্রবল প্রবঞ্চনা!
তারপর থেকে পথ চলতি কোন ভিখিরিকে আজ পর্যন্ত ভিক্ষা দেওয়ার মত মন গড়ে তুলতে পারি নি। একটা সময় পর্যন্ত এ নিয়ে অনেকের সাথে তর্কে জড়িয়েছি, অকারণ মনোমালিন্য হয়েছে, যে এ দুটোই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মানছি, হয়ত তাই-ই, ভারতের জনগণের অবস্থা তাই-ই বলে।
কিন্তু নিজেকে ঠকানোর আর সাহস পাই না। আমার মনের মধ্যে এত বড় বিশ্বাস ভাঙ্গার সম্পূর্ণ দায় ওই ভিখিরি দুটির যারা আমার বাবার থেকে অনেক অনেক বেশি বড়লোক ছিল, অথচ ভিক্ষা নিত আমার কাছ থেকে, হয়তো বা না জেনেই।
কিন্তু আজও ওদের আমি ক্ষমা করতে পারলাম কই!
- আর্য

No comments:
Post a Comment