বলাই বাহুল্য যে পৃথিবীর সবথেকে মূল্য্বান (Expensive) শহরের মধ্যে দুবাইয়ের স্থান ১৫ নম্বরে আর কলকাতা সে দিক থেকে ২০৫ নম্বরে। সহজ কথায় কলকাতার রোজগারে দুবাই-তে এসে পনেরো দিন থেকে খেয়ে শহরটাকে সম্পূর্ণরূপে ঘুরে দেখতে গেলে আমাদের সারা জীবনের সঞ্চয় শেষ করে ফেললেও তা সম্ভব হবে না। অরিন্দম-চৈতালী তাই বারবার আমাদের ওখানে ডেকেছে, যাতে ওরা ওখানে থাকতে থাকতে আমরা ঘুরে আসতে পারি। যখন সে সুযোগ পেয়েছি আর যখন আমাদের ফেরার টিকিট ও কাটা আছে ১৫ দিন বাদে, তখন একদিন একটু রেস্ট নিতে ক্ষতি কি! আর সব থেকে বড় কথা আমি এ কথা বলেছিলাম আরো একটা বৃহত্তর কারণে। অরিন্দম-চৈতালী আমাদেরকে যেভাবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উৎসাহ নিয়ে শ্হরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরচ্ছে, তাতে শুধু আমাদের নয় আমার মনে হয়েছিল ওদেরও একটু রেস্ট দরকার।ইন্দ্রানী প্রথমে সেটা বুঝতে পারেনি তাই ঝগড়ার সূত্রপাত। পরে যখন বুঝতে পেরেছে তখন আর কিছু বলেনি।
সেদিন পুরো সকালটা তাই আমরা সিমপ্লি কাটা ঘুড়ির মত ল্যাদ খেলাম। ব্রেকফাস্ট করলাম অনেক দেরিতে। লাঞ্চ হলো প্রায় বিকেলে। তারপর অরিন্দমই বলল যে
- বসে থেকে আর কি করবি? চ' আমরা একটা শপিংমলে ঘুরে আসি।
ওদের বাড়ি থেকে যাওয়া-আসার পথে একটা উল্টো করা নৌকার মত মল পথে পড়ত। নামটাই খুব লোভনীয় -- লুলু মল।
বাঙালির কানে এই 'লুলু' শব্দটা এলেই কেমন একটা উলু দিয়ে যেন সম্ভাষণ করছে মনে হয়। কিংবা মানুষের কনজিউমার বিহেভিয়ারকে সম্পূর্ণরূপে তার সংযমের বিরূদ্ধে 'লু লু' বলে লেলিয়ে দিচ্ছে মনে হয়। আর সাথে যদি মহিলারা থাকে তাতে তো মলটির এরকমের লোভনীয় নামকরণের সার্থকতা নিয়ে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না! কারণ, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে মহিলাদের মত buying spree পুরুষদের নেই (রাগ করার কিছু নেই। এটা নারীজাতির 'গুণ' হিসেবে মান্যতা পেয়েছে)। পুরুষদের টাকা ওড়ানোর আরো অনেক উপায় আছে। কিন্তু বেশিরভাগই নেহাত নিপাট ভদ্রলোক বলে সাহস করে সেসব পথ মাড়ায় না। কিন্তু কাউকে এক বেলায় সর্ব্স্বান্ত করতে গেলে দুটি উপায় আছে, এক, জুয়াতে ভিড়িয়ে দেওয়া আর দুই, কোনো প্রিয় মহিলার সাথে একটি শপিং মলে গিয়ে বলা
- তোমার কি কি চাই...ফিল ফ্রি...।
- ব্যাস্, কেল্লা ফতে!
তবে চৈতালী বা ইন্দ্রানী কেউই এখানে বিশেষ কিছু ঘটাবে বলে মনে হয় না। কারণ, ওদের ফিল্ড অন্য -- শাড়ী। আর লুলু মলে তা কিছুতেই পাওয়া যাবে না।
তার সাথে ওদের একটা নীতিবোধের নবজাগরণ ডোজ অরিন্দম দিয়ে রেখেছিল। সেই ভরসায় বুক বেঁধে আমরা লুলু মত মলের দিকে প্রস্থান করলাম।
এটা একটা সাধারণ শপিংমল এবং এখানে সব পাওয়া যায় (শাড়ী ইত্যাদি ছাড়া) অনেক মলের মধ্যে লুলু মল তার নিজ বৈশিষ্ট্যে এবং গুনে অনন্য। মলটি সাতটি ভাগে বিভক্ত এবং প্রতিটি ভাগ ইসলাম অনুসারে, সাতটি 'জন্না' বা স্বর্গের নামে নামাঙ্কিত, আর সে নামাঙ্কন ঘটেছে অয়েল -এ আঁকা অ্যাবস্ট্র্যাক্ত আর্টের মাধ্যমে।
জ্ঞাতার্থে ইসলাম অনুসারে সাত স্বর্গের নাম পর পর লেবেলের ক্রমানুসারে নিচে দেওয়া হল:
১ জন্নত -আল -আদাঁ
২ জন্নত -আল- ফিরদৌস (স্বর্গের দ্বিতীয় ও সবথেকে প্রিয় তল বলে পরিচিত্)
৩ জন্নত -আন- নঈম
৪ জন্নত -আল -মাওয়া
৫ দর্-উল্- খুল্দ
৬ দর-উল্-মকাম
৭ দর্-উস্-সালাম
সপ্তম স্বর্গের শেষ প্রান্তে রয়েছে 'সিদরাত আল মুনতাহা' নাম্ক এক বিশালকায় লোট বৃক্ষে। এর পরে স্বর্গের শেষ। ঈশ্বর সৃষ্ট সমস্ত জীব ও তাদের দিব্য জ্ঞানের সীমানা এখানেই।
যা আমাকে প্রথমে অবাক করেছে তা হল লুলু মার্টের মাছ-মাংসের ডিপার্টমেন্ট। সে যে কত রকমের প্রকারভেদ তা জানতে গেলে যেতেই হয় লুলু। চিকেন -মাটন প্রয়াসই আনা হয় বাড়িতে। কিন্তু এরকম অ্যানাটমি ধরে ধরে মাংস বিক্রি হয়, (লিভার্, কিড্নি হার্ট, আরো কত কি) তা আমার আগে জানা ছিল না। সব থেকে বড় কথা মুরগি বা পাঁঠার শরীরের মধ্যে এতগুলো অংশ থাকে এবং সেই অংশগুলোকে এত সুন্দর করে প্যাকেজিং করে আলাদা করে বিক্রি করা যায় তা সত্যি আমার কাছে অজানা ছিল।
মাছের কাউন্টার তো একেবারেই ওপেন। ওখানে যা আমার নজর কাড়ল তা হল একটা প্রায় দু'ফুট সাইজের হাঙ্গর। সে যেন পুরো জীবন্ত ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মনে পড়ে গেল স্পিলবার্গের সেই বিখ্যাত মুভি 'Jaws'-এর কথা। অরিন্দম আমার আগ্রহ দেখে একবার এসে বিড়বিড় করে বলল বটে,
- কিরে খাবি নাকি!
- না...প্লিজ্...!
বিশ্বাস করুন, আমি জীবনে কোনদিন খাবার ব্যাপারে বিভিন্ন জীবজন্তুর আস্বাদ নিতে একেবারেই বিমুখ। সমুদ্রের ধারে গেলেই যেমন সি-ফুড খায় আমি ওসবের ধারেবাড়েও নেই। যা স্ট্যান্ডার্ড, যা স্বাভাবিক, যা বাড়িতে থাকলে খাই বা আনিয়ে খাই, সেই সমস্ত খাবারেই আমি অত্যন্ত নিরাপদ বোধ করি এবং তাতে দেখেছি বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে উল্টোপাল্টা খাওয়ার জন্য মানুষের যেরকম পাইকারি হারে শরীর খারাপ হয়, সেসব অন্তত আমার হয় না। সৌভাগ্যক্রমে ইন্দ্রানী বা বুমবুম কেউ-ই খাবার দাবার নিয়ে খুব যে ওয়াইল্ড এক্স্পেরিমেন্ট করতে চায় তা নয়।
তাই অরিন্দমের প্রস্তাব রিফিউজ করলাম। বললাম
- বরং শুনেছি যে সব থেকে ভালো মানের যে ইলিশ মাছগুলো ওঠে, সেগুলো নাকি বিভিন্ন বড় বড় দেশে চলে আসে। তোদের এখানেও নিশ্চয় ই আসে বলে মনে হয়। এই হাঙর খাওয়ার থেকে বরং এক একটা ইলিশ মাছ নিয়ে পরখ করে দেখা করে যেতে পারে যে আমাদের দেশের গুলোর সাথে এখানে এক্সপোর্ট কোয়ালিটি ইলিশের পার্থক্যটা কি !
অরিন্দম বললো
- সেই বাজারটা অন্য জায়গায়। আর লুলুতে সেরকম ভাল ইলিশ পাবি না। আমরা এখান থেকে কিন্তু মাছ কিনি না। এখান থেকেই চিকেন টিকেন ইত্যাদি কিনে নিয়ে যাই বটে। কিন্তু মাছ আমরা অন্য একটা মার্কেট থেকে কিনি। সেটা বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তাই যখন যাই তখন একেবারে পনেরো দিনের মতো মাছ একসঙ্গে নিয়ে চলে আসি। ওখানে একটি বাঙালি ছেলে আছে। বাংলাদেশী। তাকে বলা থাকে। সে আমাদের জন্য যত্ন করে আমাদের ফেভারিট মাছগুলো আলাদা করে রাখে।
শুনে বললাম
- বেশ তবে তাই হবে
- হ্যাঁ ওই মাছের বাজারটা শারজার কাছাকাছি। যেদিন ওদিকে যাব সেদিনই একেবারে ইলিশ্টা নিয়ে আসব। কিন্তু আজ ডিনারে আমরা একটা স্পেশাল খাবার খাব।
- কি খাবার?
- আমি এটা প্রায়ই অর্ডার করি। খেয়ে দেখ কেমন লাগে। একটা কমপ্লিট প্ল্যাটার্। সঙ্গে একটা স্টাফ্ড মোগলাই পরোটার মতো জিনিস কেটে কেটে দেয়। আর সাথে থাকে কাবাব। আর তার সাথে তার সাথে স্পেশাল সস: হুমুস্। অনেকে হমাস বা হামুস-ও বলে।
- প্ল্য়াটারটার নাম কি?
- আরিয়াস্....
- আর হুমুস তা কি?
- ছোলা কে ভিজিয়ে তারপর অলিভ অয়েল দিয়ে মিহি করে বাটা।
- শুনেই কেমন জিভে জল আসছে বুঝলি। আর এর সঙ্গে যদি লাবান আর স্প্রাইট থাকে। তাহলে তো আর কথাই নেই। পুরো জমে যাবে।
- চল তাহলে লুলু থেকে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিয়ে আমরা আজকে ফুল বিনজ করব ।
চৈতালি বললো,
- হ্যাঁ, ছোটুও নাকি আমাদেরকে খাওয়াবে বলে চিজ পুডিং বানিয়েছে।
এর পর লুলু মলের সমস্ত জিনিসই বেশ মায়াময় ঠেকতে লাগলো। মনে হচ্ছিল আর তো বিশেষ কিছু এখানে দেখার নেই। এবার আপাতত বাড়ি ফিরলেই হয়। দেশটা অনেকটা পশ্চিমে। তাই সূর্যাস্তও দেরিতে। সেটা নিশ্চয়ই আগেই বিভিন্ন পর্বে সকলে বুঝতে পেরেছেন। সাড়ে আটটা নাগাদ যখন আমরা ফিরছি তখন সূর্য ডুবছে।
অরিন্দমরা যে পাড়ায় থাকে সেখানে খুব উঁচু বিল্ডিং বলতে একটাই রয়েছে সেখানে। এর পরে ঐ অঞ্চ্লে অত উচু বিল্ডিং এর কোন পারমিশন পাওয়া যায়নি। এখন নিয়ম ম্যক্সিমাম আট তলা। সেই প্রাসাদের মত বিল্ডিংটার ছবি এখানে রইল। এটাও কিন্তু একটা রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স। যখনই আমরা ওদের পাড়া ছেড়ে হাইওয়েতে এসে পড়ি তখন রাস্তা চেনার জন্য একটা দারুণ উপায় ছিল। চিহ্ন ছিল, একটা বিশেষ বাড়ি, যার আকৃতি আনারসের মত। ওই আনারস বাড়ি দেখে আমরা বুঝতে পারতাম যে আমরা নিজেদের বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি বা এবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে পড়বো। ওই আনারস বাড়ির এক অপূর্ব অবয়ব দেখতে দেখতে আমরা লুলু মল থেকে সেদিন বাড়ি ফিরে এলাম।ততক্ষণে আরিয়াসের অর্ডার হয়ে গেছে। শুধু যা আসার অপেক্ষা! আমরা লাবানের সাথে স্প্রাইট মিশিয়ে সঙ্গে সাউথ ইন্ডিয়ান চিঁড়ে ভাজা খেতে থাকলাম যাতে পিত্তি না পড়ে যায়! সঙ্গে টিভিতে লাগানো হলো এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যামেরায় তোলা ছবি ও ভিডিও। আমরা এই ক'দিনে যে পরিমাণে ছবি ও ভিডিও তুলেছি সেগুলো সঠিকভাবে দেখা তো দূর, ঠিকমতো ডাম্প্-ই করা হয়নি। এই প্রথম যতটুকু সময় পাওয়া গেল, তাতে বিভিন্ন ক্যামেরা থেকে ছবি ও ভিডিও এক জায়গায় করে তার সাথে টিভি কে কানেক্ট করে আমরা দেখতে শুরু করলাম।
রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে দেখলাম আমাদের মরুভূমিতে চরে বেড়ানোর দিনটা। ঠিক যেন স্বপ্নের মত!
এই স্বপ্ন নিয়ে আলোচনা করতে করতে আরিআস এসে গেল। সুন্দর করে সাজিয়ে আমরা খাবার খেতে আরম্ভ করলাম। সঙ্গে চলল বলিউড সিনেমা। অরিন্দমের ফেভারিট প্ল্যাটার সম্পর্কে কি আর বলি! সে এক অনবদ্য খাবার যা বারবার খেতে ইচ্ছা হয় !
এটি যে কি জিনিস তার তুলনামূলক সংজ্ঞা দিতে গেলে বলা যেতে পারে যে, আরিয়াস হল অত্যন্ত উন্নত মানের চিকেন মোগলাইয়ের একটি ভিন্ন সংস্করণ। সঙ্গে থাকে বিভিন্ন ধরনের কাবাব ও চাটনি হুমুস।
বুমবুম আর ছোটুর ডিনার সেদিন বাইরে। ছোটু সেদিন বুমবুমকে নিয়ে গিয়েছিল ওর ওখানকার বন্ধুদের সাথে আলাপ করাতে। কাছাকাছি কোথাও তাদের সাথে একসাথে ডিনার।
আমরা বড়রা বলিউড আর আরিয়াসে বুঁদ হয়ে রইলাম।
আরিয়াস, লাবানাদি শেষ করে আমরা যখন ডেজার্টের দেশে ডেসার্টের খোঁজে তখন পেলাম জিভে জল আনা বাড়িতে বানানো ছোটুর তৈরি করা চিজ পুডিং।
ছোটু রান্না করেছে বলে বাড়িয়ে বলছি না, আমার খাওয়া সেরা চিজ পুডিং হচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল ছিল, ওদের নিজস্ব বেকারিতে প্রস্তুত করা চিজ পুডিং। সে স্বাদ অনবদ্য ও ভাষায় অবর্ণনীয়। এখন ললিত গ্রুপ অধিগ্রহণের পরে আর হয় কিনা জানি না। তা যাই হোক, ছোটু আজকে যে চিজ পুডিংটা বানিয়ে ছিল সেটা প্রায় গ্রেট ইস্টার্নের পুডিং টাকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দেওয়ার মত।
আমার পেট ভর্তি থাকা সত্ত্বেও আমি যতটা চিজ পুডিং খেলাম তাতে আবার উল্টে বকুনিও খেতে হল ইন্দ্রানীর কাছে, যে অন্য কারোর কথা না ভেবেই আমি নাকি পুরোটা সাবাড় করে দেওয়ার তালে আছি। তাই নেহাত চক্ষুলজ্জাজনিত কারণে তখনকার মতো খান্ত দিলাম। আর ছোটুর সাথে চোখে চোখে কথা হল যাতে আমার জন্য কিছুটা থাকে, সকালবেলায় কফি দিয়ে খাওয়ার জন্য।
ছোটু দেখলাম সকলের গল্প করার ফাঁকে বাকি চিজ পুডিং-টা চুপচাপ ফ্রিজে তুলে রেখে দিল।বাকিটা আবার কাল সকালে চেখে দেখবো।
সুবিধা একটাই। এখানে এসে দেখছি, ঘুম থেকে সবার আগে আমি উঠি। সুতরাং একা একা বিভিন্ন দুষ্কর্ম করার সুযোগ আমার কাছে সকালবেলাতেই যথেষ্ট।
আপাতত্: নিপাট ভাল মানুষের পো এর মত ঘুমোতে গেলাম।








No comments:
Post a Comment