Friday, 15 November 2024

কথাগুলো ফুরোয় না/ নটেগাছটাও মুড়োয় না:

হাটখোলার দত্ত পরিবারের কথা কে না জানে!

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে পিতা মদনমোহন দত্তের  মৃত্যুর পরে পরিবারের প্রধান ছিলেন রামতনু দত্ত| ওনাকে সবাই ‘তনু বাবু’ বলে জানতেন। এই তনু বাবু ছিলেন তৎকালীন নব্য ‘বাবু’ সমাজের একজন প্রথম সারির বাবু। বলা হতো ‘আট বাবুদের এক বাবু হলেন তনুবাবু’। তাঁর দাপটে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। সাথে ছিল ভয়ংকর বিলাসব্যসন। কথিত আছে যে তাঁর বাড়ি প্রত্যহ উপর থেকে নিচ পর্যন্ত আতর দিয়ে ধোয়া হত।

Hatkhola Dutta House

এই দত্ত পরিবারের প্রধান প্রতিদ্বন্দী  ছিল গিয়ে তখনকার বাগবাজারের মিত্তির বাড়ি। রমতনু দত্তের সমসাময়িক মিত্তির বাড়ির প্রধান ছিলেন গোকুল মিত্র।

গোকুল মিত্রের কাছে তনুবাবুর খবর গিয়ে পৌঁছালো যে রামতনু দত্ত নাকি সারা বাড়ি আতর দিয়ে রোজ ধোয়ান।  এখন রেষারিষী করতে  গোকুল মিত্তিরও সারা বাড়ি অনায়াসে আতর দিয়ে ধোয়ার ব্যবস্থা করতেই পারতেন। কিন্তু তাতে আবার তনুবাবুকে নকল করা হয়ে যায়। কিন্তু কি করে এর জবাব দেবেন তার জন্য তিনি পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অস্থির  হয়ে পড়ছিলেন।

অবশেষে সুযোগ এলো।

একদিন এক গরীব ব্রাহ্মণ হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেন গোকুল মিত্রের দুয়ারে।  বললেন,

- আমার একমাত্র পুত্রের কর্ণমল (কানের খোল) বিষাক্ত  হয়ে এমন অবস্থা যে তাতে তার শ্রবণশক্তি চলে যেতে পারে, এমন কি সে বিষ ছড়িয়ে পড়ে তা প্রাণঘাতি হতে পারে। 

- আপনি আমার কাছে কি চান?

- কবিরাজ বলেছেন খুব ভালো ধরনের আতর এর একমাত্র চিকিৎসা। আপনি যদি কৃপা করে আমাকে একটু আতর দেন তবে আমার সন্তানের রোগের নিরাময় ঘটানোর চিকিৎসা আরম্ভ করতে পারি। ভাল আতর শুনেছি সোনার থেকেও বেশি মূল্যবান। সে আমি চিনিও না আর তা ক্রয় করা আমার সাধ্যাতীত।

গোকুল মিত্র দেখলেন তনুবাবুকে জব্দ করার এই সুযোগ।  তিনি গরিব ব্রাহ্মণ কে বললেন,

-  আরে হাটখোলার দত্ত পরিবার থাকতে আতর চাইতে এসেছেন আমার কাছে! আমি কি অত বুঝি না কি! শ্রেষ্ঠ আতর তো আপনি পাবেন তনু বাবুর কাছে। ওনার সম্ভারে যা আছে, আর কারো কাছে নেই। আপনি বরং ওখান থেকে আতর নিয়ে আসুন। দেখি কেমন আতর উনি আপনাকে দেন!


ব্রাহ্মণ সরল বিশ্বাসে বাগবাজার থেকে হেঁটে উপস্থিত হলেন হাটখোলায়।  তনুবাবুকে সব বলতেই উনি ধরে ফেললেন যে গোকুল মিত্রই তনুবাবুর আতরের সত্যতা যাচাই করতে এই ব্রাহ্মণকে ওনার কাছে পাঠিয়েছেন। কয়েক রতি আরবি বা ফরাসী আতর দিয়ে দেওয়া গোকুল মিত্তির অনায়াসেই পারতেন। কোন ব্যাপারই ছিল না। তার বদলে গরিব ব্রাহ্মণকে এত দূরে পাঠানোর কোন মানে হয়!  যাকগে এসব যখন হয়েই গেছে তখন দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়! 

তনুবাবু ব্রাহ্মণকে বললেন,

- হে ব্রাহ্মণ! আপনি বরং এই আতর নেওয়ার জন্য একটি যথার্থ পাত্র নিয়ে আসুন, যে আধারে আপনার সন্তানের নিরাময়ের জন্য আপনাকে আমি সঠিক পরিমাণে আতর দান করতে পারব!

গরিব ব্রাহ্মণের আতরের পাত্র কেনার পয়সা কোথায়! আতর তো আর মাটির কোনো পাত্রে রাখা যাবে না! তাই ‘যে আজ্ঞে’ বলে  হাটখোলা থেকে পুনরায় উপস্থিত হলেন বাগবাজারে। এসে গোকুল মিত্র কে বললেন

- হ্যাঁ তনুবাবু আতর দিতে রাজি হয়েছেন বটে।  কিন্তু উনি সঠিক মাপের এবং সঠিক গুণমানের একটি পাত্র চেয়েছেন, যাতে আতর দেওয়া যায়। আমার সে অর্থবল নেই যে আতর গ্রহণের জন্য যথার্থ পাত্র ক্রয় করব।

গোকুল মিত্র বুঝতে পারলেন সবটা।  তিনিও কম যান না!  বুঝতে পেরেই একটি বিরাট পিতলের কলসী ব্রাহ্মণকে দিয়ে বললেন

- যান, ওনাকে বলুন যে এই পাত্র আপনি এনেছেন আতর নেওয়ার জন্য।

 মনে মনে ভাবলেন খুব জব্দ করলেন তনুবাবুকে। কলসী ভরা দামী আতর.... আর যাই হোক অতটা দিতে পারবেন না।

ব্রাহ্মণ তনু বাবুর গৃহে পুনরায় উপস্থিত হলেন, ওই বিশাল কলসী সমেত। পাত্রের গুণমান ও আকার দেখে তনুবাবু তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন যে তাঁর ধারণা ভ্রান্ত নয়, যে মিত্তির ওনাকে জব্দ করতে চাইছেন। কিন্তু বেচারা ব্রাহ্মণকে ওভাবে আর অকারণে খাটানোর ইচ্ছে হল না। তাই তিনি ব্রাহ্মণকে বললেন,

- হে ব্রাহ্মণ আপনাকে এতটা কষ্ট দেওয়ার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন।  আপনি আজ সারাদিন আমার গৃহে অতিথি হয়ে থাকুন। আমার এখানে খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিন। দিনের শেষে আমি আপনাকে নিশ্চয়ই আপনার সন্তানের নিরাময়ের জন্য এই কলসী ভরে আতর প্রদান করব।

ব্রাহ্মণ স্নান আহারদি সেরে  নিজের সন্তানের জন্য এতটাই ব্যাকুল হলেন যে  তিনি বিকেল হওয়ার আগেই খুব ব্যস্ত হয়ে তনুবাবুর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন,

- আমি আপনার আতিথেয়তায় মুগ্ধ। কিন্তু আমার মন আমার প্রিয় সন্তানের জন্য বড়ই বিচলিত হয়ে আছে। আমি সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত থাকতে পারবো না। যদি আপনি এখনই ব্যবস্থা করে দিয়ে আমাকে আজ্ঞা করেন, তবে আমি আমার সন্তানকে যত শীঘ্রই সম্ভব ওষধি প্রদান করে সুস্থ করার জন্য চেষ্টা শুরু করতে পারি।

তনুবাবু বিচক্ষণ মানুষ। তিনি সবটা বুঝলেন এবং সেই কলসি ভরে তাঁকে আতর প্রদান করলেন। কলসি ভরে যে আতর তিনি  ব্রাহ্মণকে দিলেন সেই আতর ছিল তার সংগ্রহে রাখা সর্বশ্রেষ্ঠ আতর।  ওই আতরের তৎকালীন বাজারমূল্য হবে মোটামুটি আট হাজার টাকা।

ব্রাহ্মণ বিদায়ের সময় ব্রাহ্মণকে তিনি আতর ছাড়াও যথারীতি আরও অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রদান করলেন, উপঢৌকন হিসেবে। পাঁচশো এক টাকা প্রণামীও দিলেন।

বিদায়কালে তনু বাবু ব্রাহ্মণকে বললেন

- আপনাকে একটা অনুরোধ যে যিনি আপনাকে ঐ পাত্র দিয়ে আতর গ্রহণের জন্য পাঠিয়েছেন, তাঁকে বলবেন যে আশা করি যে এই সামান্য পরিমাণ আতরে তাঁর মত বড় মানুষের কর্ণের মল নিশ্চয়ই পরিষ্কার হবে। তবে তার পূর্বে আপনি আপনার সন্তানের জন্য যতটা আতরের প্রয়োজন তা কিন্তু একটি আলাদা কাচের পাত্র তুলে রাখবেন। ঐ বিশাল পাত্র যখন দিতে পেরেছেন, এ সামান্য পাত্রটুকু উনি নিশ্চয়ই আপনাকে দিতে পারবেন।

ব্রাহ্মণ সবটুকু বুঝতে পেরে তনুবাবুর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে বিদায় গ্রহণ করলেন।

এর কয়েক মাস পরে ব্রাহ্মণ তনু বাবুর কাছে ফিরত এসে তাঁকে সংবাদ প্রদান করলেন যে ওনার সন্তান সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হয়েছে এবং বাকি আতরটুকু নিয়ে ব্যবসা করে তিনি তাঁর দরিদ্রদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। আর উনি বাগবাজারের মিত্তিরবাড়িতেও গিয়েছিলেন, তনুবাবুর বার্তা পৌঁছাতে। তাতে গোকুল মিত্তির, ক্রোধে লাল হয়ে শুধু বলেছেন্,

- আপনি এখন আসুন! আর এর পরে কোনো দিন আমার দরজায় সাহায্য চাইতে এলে, ফল ভাল হবে না। 

তবে ব্রাহ্মণের পুনরায় তনুবাবুর কাছে ফেরত আসার উদ্দেশ্য একটাই -- তনুবাবুকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ।

কথনে: অনিন্দ্য রায়

অনুলিখন: আর্য

চিত্রঋণ: আন্তর্জাল

No comments: