এই নিয়ে জানার প্রথম আগ্রহটা চাগাড় দিল যখন আমি রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে স্নাতক (সাম্মানিক) স্তরে লেখাপড়া করতে গেলাম। যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন যে, বেলুড়মঠে কি মহাসমারোহে জগদ্ধাত্রী পূজা সম্পন্ন করা হয়!
তা ওখানকার ছাত্র হিসেবে পুজোর বেশ কিছু গুরুদায়িত্ব এসে পড়ত। সেই সূত্রে খানিকটা জানলাম। এর মধ্যে আবার আমার আগ্রহে ধুনো দেওয়ার জন্য ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু অনিন্দ্য। তাদের আদি ও পুরুষানুক্রমে বর্তমান নিবাস চন্দননগর এবং উপাধি রায়চৌধুরী। (উপাধি উল্লেখের কারণ ক্রমশ প্রকাশ্য)।
বিদ্যামন্দিরে অনিন্দ্য আমার রুমমেটও ছিল বটে। সারাদিন ধরে প্রাপ্ত দায়িত্ব সামলে যখন বিছানায় বসে বেলুড়মঠের জগদ্ধাত্রী পুজো, বিশেষতঃ প্রসাদের শুকনো বোঁদে (এ বস্তুটি একমাত্র ওখানেই পাওয়া যায় বলেই আমার এখনো স্থির বিশ্বাস) সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করতাম, তখন, খুব ঠাণ্ডা গলায় অনিন্দ্য বলত,
- এ আর কি দেখছিস...আমাদের বাড়িতে আয় একবার। দেখিয়ে দেব সারারাত ঘুরিয়ে, যে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো কি জিনিস। কলকাতার যে কোনো হাই-প্রোফাইল দুর্গাপূজাকে যে কোনো দিন এক ডজন গোল দিয়ে দেবে। তবে হ্যাঁ, বোঁদেটা বাদ দিয়ে।
সব শুনে মনে মনে ভাবতাম গালগল্প।
পুজো চলছে। ঠিক করলাম, যাব। দেখি কতটা বাড়িয়ে বলছে। কিন্ত বললেই কি আর যাওয়া যায়? আবার তার ওপরে ছুটি! সে তো মহারাজ কিছুতেই দেবেন না!
অনিন্দ্য পাবে, কিন্তু আমি তো পাব না।
তবুও হল। কপালে থাকলে খণ্ডাবে কে !
অনিন্দ্যর নিজের কাকা, শ্রী সুব্রত রায়চৌধুরী (এস আর সি), আমাদের ইংরেজি বিভাগের তখন নবীনতম শিক্ষক। তিনি আদ্যোপান্ত আধুনিক, আর বিদ্যামন্দিরের দম-বন্ধ করা পরিবেশে এক বিশুদ্ধ প্রাণদায়ী অক্সিজেন বয়ে আনা মানুষ।
অনিন্দ্য উপদেশ দিল,
- চুপিচুপি কাকাইএর সঙ্গে কথা বল, যদি কিছু হয়। আর খবরদার বলবি না যে আমি বলেছি। তাহলে কিন্তু যাও বা চান্স আছে, সেটা যাবে।
স্যারকে গিয়ে বললাম। তাতে স্যারের প্রথম রিঅ্যাকশান:
- ও, অনিন্দ্য তোকে বুদ্ধি দিয়েছে বুঝি?
- না স্যার, অনিন্দ্য জানে না। ওকে সারপ্রাইজ দেব বলে আপনার কাছে আসা। ওর কাছে এত গল্প শুনেছি, একবার চোখে না দেখলে বিশ্বাস হচ্ছে না যে এ সব সত্যি।
- বেশ, আমি প্রভাকর মহারাজ (আমাদের তৎকালীন প্রিন্সিপ্যাল মহারাজ, অফিসিয়াল নাম, স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দ)- কে বলে রাখব। তুমি কিন্তু আর কাউকে বলবে না। যদি এরকম কিছু ঘুণাক্ষরেও আমার কানে আসে, তাহলে কিন্তু আমি নিজেই তোমার যাওয়াও আটকে দেব।
- আচ্ছা স্যার।
জগদ্ধাত্রী জগদ্ধাত্রী (দুগ্গা দুগ্গা- র সমার্থক প্রতিশব্দদ্বয়) করে আমার পারমিশন হয়ে গেল।
বেলুড় রেলস্টেশন থেকে সপ্তমীর বিকেলে পঞ্চাশ মিনিটে চন্দননগর। স্টেশনে নেমে বাঁ দিকে অনিন্দ্যদের বাড়ি।
রায়চৌধুরীরা চন্দননগরের অভিজাত পরিবার | অনিন্দ্যদের বাড়ি নতুন হলেও সর্বক্ষেত্রে ও সর্বস্তরে সেই অভিজাত্যের ছাপ বিরাজমান। আমাকে নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হতেই কেমন একটা চাপা উদ্দীপনা অনুভব করলাম। বাড়ির ছেলের বন্ধু এসেছে উৎসবের সময়ে, সে আপ্যায়ণ ও উষ্ণতা ভোলার নয় |
সন্ধেবেলায় স্বয়ং এস আর সি স্যার হাজির | আমি তো শ্রদ্ধায় সঙ্কোচে কি করব কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। অনিন্দ্য ওনার সামনেই আমাকে ফস করে বলে বসল,
- তুই ওকে ভয় পাচ্ছিস? আমি তো কাকাইকে প্রাইভেট স্পেসে তোর মত 'তুই' বলেই ডাকি! ছোটবেলার অভ্যাস। আর বদলাই নি। কি করে জানব হঠাত আমার কলেজের স্যার হয়ে যাবে। তাহলে একবার চেষ্টা করে দেখতাম ... কি রে কাকাই, বল্ না!
- হ্যাঁ, আর্য, এখন তুমি আমাদের অতিথি... আর এটা কলেজ নয় | খুব আনন্দ করে কাটাও | অনিন্দ্য তোমাকে সব ঘুরে দেখিয়ে দেবে। আর কাল সকালে আর্যকে আমার বাড়িতে একবার নিয়ে আসিস।
অনিন্দ্য-কে বললেন স্যার।
- ঠিক আছে... তুই এখন বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।
অনিন্দ্য স্যার- কে বলল ।
আমি আমার বাবাকে ছোটবেলা থেকে 'আপনি' বলে সম্বোধন করি, সেখানে অত বড় একজন কাকাকে কেউ 'তুই' বলে! হজম ই হচ্ছিল না। হস্টেলে এক রুমে এতদিন থেকেও এ সিক্রেট তো জানতে পারি নি। ক্লাস চলে যখন তখন তো দিব্যি 'আপনি আজ্ঞে' করে! রেগে গিয়ে সে কথা বলতেই অনিন্দ্য হা হা করে হেসে বলল,
- প্রোটোকল ও এটিকেট...
- তা বলে আমাকে এভাবে কি অপ্রস্তুতে ফেলেছিল বলত! উনি তো আমার স্যার, না কি!
আবার হেসে বলল,
- তা তুই তো আর কাকাই কে 'তুই তোকারি' করতে যাচ্ছিস না! চল, একটা পান দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে একটা চক্কর মেরে আসি।
তখন নতুন নতুন সিগারেট খেতে শিখেছি। হপ্তায় একটা কোনোরকমে লুকিয়ে দুজনে খেতাম। আমার কেনার ক্ষমতা ছিল না। অনিন্দ্যই খাওয়াত, দুটোই - জরদা পান আর সিগারেট। ওর থিওরি অনুসারে,
এক, তামাকু সেবনে সকালে কোষ্ঠ সহজে পরিষ্কার হয়। ( হস্টেলে এটা একটা মূল্যবান বিষয় - দ্রুত কোষ্টস্খলন)
আর দুই, যে পরিমাণ ভেজাল ও দূষণ আমরা প্রতিনিয়ত গ্রহণ করছি, তাতে ওই মাঝে মধ্যে এট্টুখানি তামাকু সেবনে বিশেষ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।
এবারে সন্ধ্যেবেলায় দুজনে বেরোলাম ঠাকুর দেখতে | সেদিন এক অংশ আর তার পরের দিন আর এক অংশ -- এভাবে অনিন্দ্য ভাগ করে নিয়েছিল।
চাক্ষুস করে সত্যি বলছি আমি না হাঁ হয়ে গেলাম!
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা বড় মানে শুধু মনে বা উৎসবের মাপে বড় নয়, ঠাকুরের মাপেও সেরকম। বেশিরভাগ ঠাকুরই দেখলাম এত বড় যে বিসর্জনের সময় আগে প্যান্ডেল খুলে তবে সেই সমস্ত ঠাকুরকে বের করতে হয়। আর সব থেকে বড় কথা, জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের মূর্তি নিয়ে দুর্গাপুজোর মতো আধুনিক 'থিম থিম' ছেলে খেলাটা ওখানে হয় না। সবই বিভিন্ন ধাঁচের, কিন্তু সেই সাবেকি ধরনের ঠাকুর।
সাবেকিয়ানার কথায় মনে পড়ে গেল, বাংলার ঐতিহ্যের ইতিহাসের সাথে জগদ্ধাত্রী পুজোর একটা যোগ আছে। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই চন্দননগরের অবিসংবাদিত অধিপতি ও ফরাসিদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেওয়ান, ও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নিকট বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীর কাছে অর্থ ধার করতে মাঝেমধ্যেই আসতেন। ভাবুন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আসতেন অর্থ ঋণ করতে এক দেওয়ানের কাছে ! বুঝুন সেই দেওয়ানের প্রতিপত্তি কি!) এই ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর মৃত্যু হয় ১৭৫৬ সালে। ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী জগদ্ধাত্রী পুজোর শুরু করেন ১৭৫০ সাল নাগাদ, চন্দননগরে নিজ গৃহে। তারপর থেকে রায়চৌধুরীদের দেখাদেখি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন, নদীয়ায়। জগদ্ধাত্রী পূজা করলেও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন বলে বিশ্বাস। কলকাতায় আবার বেহালার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার তারও আগে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন বলে সময় বলে।
আর আমার বিশ্বাস অনিন্দ্যরা এই ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর বংশেরই অংশবিশেষ, যদিও সে নিয়ে কোনো কথা কোনোদিন হয় নি।
যায় হোক, অনিন্দ্যর বাড়িতে ওই তিন দিনের স্মৃতি এখনো অমলিন।
কিন্তু বাস্তব হল এস আর সি স্যার বিদ্যামন্দির কলেজ থেকে রিটায়ার করলেন ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪। জগদ্ধাত্রী পুজোর ঠিক কদিন আগে।
কি সমাপতন!
....
....
....
আমি এখন যেখানে থাকি সেখানে ১৭ বছরের এই বসবাসের প্রত্যেকবারই জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে আসছে।
এই বিশেষ দিনটাতে হাত ফাঁকা থাকে বলে আমি বেশ কিছু ছবি অকারনেই তুলে থাকি। ফেসবুক এনালিটিক্স বলে যে শুধু ছবি এখানে পোস্টালে যতটা রিচ (মানে যত লোকের কাছে পৌঁছায়, তার ব্যাপ্তি) হয়, লেখা দিলে তত হয় না।
কিন্তু তাতে আমার কি! ছবির সাথেও লেখাও না হয় রইল। যার ইচ্ছে পড়বে, যার ইচ্ছে হবে না, সে পড়বে না। সে শুধু ছবি দেখবে।
আবার যার ইচ্ছে শুধু পড়বে, ছবি দেখবে না, তাহলে তাই।
মোদ্দাকথা, এমন একটা লোভনীয় প্ল্যাটফর্মে, যেখানে হাজারো তারকা আর নেতাদের লোভনীয় কিন্তু অকারণ চাপান-উতর ও গালিগালাজের ভিড়ের মধ্যে আমার পোস্ট করা ছবি বা লেখা দু-চার জন পড়ে, তখন আমি কৃতার্থ বোধ করি। মনে হয় এর থেকে বেশি আনন্দ আর কিছুতে নেই।
তবে এই সূত্রে বলে রাখি পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো করতে গেলে বা চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো করতে গেলে পুজো পারমিশন লাগে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটার রেজিস্ট্রেশন কর্পোরেশন ভিত্তিক।কিন্তু এ সম্পর্কে নিখুঁত কোন তথ্য হাজার খুঁজেও পাওয়া যায় না।
ঠিক কতগুলো পুজো হচ্ছে তার একটা তথ্য থাকাটা খুব জরুরী।
একটা রাফ ওভারভিউ হিসেবে বলা যায় যে,
১) সারা হাওড়াতে প্রায় তিন হাজার দুর্গাপূজা হয়।
২) শুধু চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার সংখ্যা প্রায় একশো পঞ্চাশ।
No comments:
Post a Comment