ভালো মিষ্টি বাঙালীদের নাকি ইমোশনালি ট্রিগার করে, ঠিক যেমন বৃটিশদের, হুইস্কি।
আমিও আজ বিশেষ এক মিষ্টির খপ্পরে পড়ে
ট্রিগার্ড হলাম, ইমোশনালি। আর সেটার ফল স্বরূপ নিচে যা বেরোলো, তার ভাল মন্দের সব দায় হলো এক কাকিমার, যিনি আমাকে আজ এক বিশেষ মিষ্টি খাইয়ে এ পথে চালিত করলেন।
****
সেদিন ছিল বিজয়া দশমী। আমার স্পষ্ট মনে আছে
যে মামার বাড়িতে দাদুর চৌকির তলা থেকে মিহিদানা চুরি করে খেতে গিয়ে আমি ধরা পড়ি
ওই পাড়ার রূপা মাসীর হাতে। রূপা মাসী আমাকে কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রান্নাঘরে
নিয়ে এসে খুব বকাবকি করছিল। হঠাৎ বড় মামিমা রূপা মাসীর হাত থেকে আমাকে ছিনিয়ে
নিয়ে ধমকের সুরে বলে উঠল,
-
কি ব্যাপার রে রূপা, তুই ওকে মারছিস কেন?
-
বৌদি ও মিহিদানা চুরি করে
খাচ্ছিল।
বড় মামীমা যখন রেগে যেত, তখন জ্ঞান থাকত না। ভীষণ
রেগে গিয়ে বলল:
-
তুই কিন্তু বাইরের লোক, তাই বুঝে শুনে কথা বলিস।
বাড়ির ছেলে নিজের বাড়ি থেকে জিনিস নিয়ে খেলে তাকে চুরি বলে না রূপা। ও তো আর তোর
বাড়ি গিয়ে পাত পেড়ে মিহিদানা খেতে যায় নি। ওর নিজের মামার বাড়িতে নিজের দাদুর আনা
মিহিদানা খাচ্ছিল। তুই ওকে শাস্তি দেবার কে রে?
-
কি বলছ বৌদি...
-
হ্যাঁ বলছি, আর যা বলছি নিশ্চই শুনতে পেয়েছিস্!
তাই তুইএখন আয় রূপা, আমি একাই সব সামলে নিতে পারব।
আমার রূপামাসীর জন্য খুব খারাপ লেগেছিল। বলতে
গেলাম তাই,-
-
মাইমা, আমি কিন্তু লুকিয়েই মিহিদানা
নিচ্ছিলাম...
-
চুপ্...একদম্ চুপ..., ছোট আছ্, ছোটদের মত থাক, বড়দের কথার মধ্যে নাক গলাবে না।
আমি আর সেদিন কথা বাড়াই নি। পরে আবার বড়মামীমা
তাঁর অনবদ্য স্বভাবগুণে রূপামাসীকে আগের মতই আপন করে নিয়েছিল, দু’দিনের মধ্যেই। কিন্তু রূপামাসী
আমাদের্, মানে যত কুঁচোকাঁচা ছিলাম তাদের, পরে বকেছে, শাসন করেছে, কিন্তু আর কোনোদিন গায়ে হাত তোলেনি বা অসম্মান করেনি।
সেই সময়ে মামার বাড়িতে বিজয়ার দিন সন্ধ্যেবেলায় অন্তত সত্তর থেকে আশি জন বিজয়া করতে আসতেন। সবাইএর সবার বাড়িতে যাওয়ার প্রচলন ছিল। আমরাও আবার অন্য বাড়িতে যেতাম। আমার পুজোর সময় ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময়টাই মামার বাড়িতেই কাটতো। টানা এক মাসের পুজোর ছুটি। একদম ভাইফোঁটায় বাড়ি আসতাম।
ঠিক কতদিন পর্যন্ত জানিনা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে দুগ্গা ঠাকুর বিসর্জনের পরে ঐ বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে বিজয়া দশমীর করার প্রচলনটা ছিল। সেই প্রচলন অনুসারে যারা বয়েসে ছোট তারা বড়দের বাড়িতে যেত, বিজয়ার প্রণাম করে আশীর্বাদধন্য হতে। এবার যদি কোন ভাবে যাঁরা বড় তাঁরা যদি ছোটদের বাড়িতে চলে আসতেন এবং ছোটরা যদি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বিজয় দশমীর সেরে নেওয়ার চেষ্টা করত, তা হলে কিন্তু বড়রা বিজয়ার সেই প্রণাম গ্রহণ করতেন না। বলতেন
- বাড়িতে এসো, নিজে এসো, তখন এই বিজয়ের প্রণাম গ্রহণ
করব।
বিজয়া দশমীর দিন ঠাকুর বিসর্জনের পরে
বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে গুরুজনদের প্রণাম করার একটা ঐতিহ্যপূর্ণ রেওয়াজ ছিল। সারা পাড়ায়
একটা উৎসবের মতো ব্যাপার ঘটতো সেদিন। বাড়িতে বাড়িতে অতিথিদের আপ্যায়ণের জন্য রান্না
হতো ঘুগনি, নারকেলের ছাঁচের মিষ্টি, বা চন্দ্রপুলি। দোকান থেকে আসত সীতাভোগ, মিহিদানা বা বোঁদে আর গজা বা
কুঁচো গজা।সঙ্গে কিছু কিছু বাড়িতে ঝুড়িভাজা বা চানাচুরও দেওয়া হতো।
এটা ছিল দশমীর দিনের রুটিন। এরপর একাদশী
থেকে কালী পুজো পর্যন্ত চলত দূরে থাকা কাছের সম্পর্কের আত্মীয়দের বাড়িতে
প্রণাম করতে যাওয়া। খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না, প্রধাণত: মিষ্টিই নিয়ে যাওয়া
হত। আর যাদের বাড়িতে যাচ্ছি তাদেরও কিন্তু ঐ ক’দিন সবসময় প্রস্তুত থাকতে হতো, যে কেউ যেন বিজয়া সারতে এসে শুধু
মুখে ফিরে না যায়।
বিজয় দশমীর দিন পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন
জায়গায় বিজয়া করতে যাওয়া প্রচলন আজ অবলুপ্ত।
ঠিক কবে পর্যন্ত বিজয় দশমীর প্রণাম করা
যায় এ নিয়ে ধন্দ আছে। যেমন প্রথমে প্রচলন ছিল লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত বিজয়ার প্রণাম
ও শুভেচ্ছা বিনিময় সারা যায়। তারপরে ধীরে ধীরে বাঙালীর ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে
তা কালী পূজা পর্যন্ত প্রসারিত হলো। কালীপুজোর বিসর্জন অব্দি বিজয়া দশমী করতে
যাওয়া যেত। সেসব উঠে গিয়ে প্রথম এল এসএমএস-এ বিজয়া সারা। তারপরে এখন হোয়াটসঅ্যাপের দয়ায় সুন্দর একটা
ছবি (তাও আবার অন্য কারোর ফরোয়ার্ড করা) পাঠিয়ে
দিয়ে বিজয়া সেরে নেওয়া যায়।অনেক বয়স্ক মানুষই হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন না।
কিন্তু তাতে কি! আমরা তো পাঠিয়ে দিয়েছি, সব -- প্রণাম, শুভেচ্ছা, এমনকি এ-আই কৃত এক হাঁড়ি ভর্তি পার্ফেক্ট রসগোল্লাও। ওনারা না জানতে পারলে আমাদের
কিছু করার নেই। নিরক্ষর শিশু, যাদের এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়েস
হয় নি, তারা যদি স্মার্ট ফোন অনায়াসে
ব্যবহার করতে পারে, এনারা শিক্ষিত অ্যাডাল্ট হয়ে, এটুকু পারেন না!
সত্যিই তো উজিয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি যাবার
দরকার নেই তো! বাড়িতে বসেই যখন সেরে নেওয়া
যাচ্ছে তখন আর যেচে পড়ে কয়েকটা লোককে বিরক্ত না-ই বা করা গেল!
কিন্তু আদৌ কি ওনারা বিরক্ত হন? নাকি, আমরা নিজেদের অনিচ্ছা ঢাকতে
ধরে নিই যে ওনারা বিরক্ত হবেন? মানে এটা আমাদের অজুহাত মাত্র নয় তো!
আসলে ইচ্ছেটা আমাদের নিজেদের মধ্যেই নেই যে আমরা অন্যের বাড়িতে যাব, বিজয়া সারবো। যাঁদের বাড়িতে যাওয়ার কথা তাঁরা তো আমাদের থেকে বড়, আমাদের গুরুজন। সেকেলে মানুষ তো। তাই আধুনিক যুগে মানুষের ব্যস্ততাকে সম্ভ্রমের সঙ্গে মেনে নিয়ে তাঁরা কিন্তু সব সময় দু'হাতে, প্রাণভরে আমাদের আশীর্বাদ করেন, সে আমরা ওনাদের কাছে যাই, বা না যাই। আর যে অজুহাত দিয়ে ‘ওনারা বিরক্ত হবেন’ বলে নিজেরাই এটা এড়িয়ে যাই, সেটা আসলে নিজেদের অসুবিধা ঢাকতে, স্বার্থপরতা ও আত্ম্সুখকে চাপা দিতে। তাঁরা আসলে পথ চেয়ে বসে থাকেন কিছু মানুষ আসবে তাঁদের সাথে কথাবার্তা বলবেন। বিজয়ার প্রণাম তো একটা ছুতো মাত্র, যাতে সমাজ ও পরিবারের সবাই যেন যোগাযোগ্-বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়েন। বছরে এক বার অন্তত্: এই সুযোগে সবার দেখা হোক্। আসলে হাত ও বুক ভরে নি:শর্ত আশীর্বাদ করার মানুষগুলো ধীরে ধীরে নি:শব্দে হ্রাসমান। তাই যতদিন ধরে রাখা যায় পুরনো বদ অভ্যাস, তাতে ক্ষতি কিছু হয় না। কেউ কোনো গুরুজনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন করলে ছোট হয় না। এটা বাঙালী সমাজ ও পরিবারের মানব-বন্ধনের একটা বড় দিক।
ওই বদ অভ্যাস ধরে রাখার চেষ্টার দরুণ বেশ
কিছু নতুন জিনিসের প্রাপ্তি ঘটে, আমার।
যেমন আজ সকালে সোমদেবদের বাড়ি গিয়ে ওর
বাবা মাকে প্রণাম করতে গিয়ে দেখা গেল সোমদেবের মামাও সেখানে উপস্থিত। তিনি থাকেন মালদহে।
মালদা থেকে আনা এক অদ্ভুত মিষ্টি আমার কপালে জুটলো। কলকাতায় অনেক তাবড় মিষ্টি
দেখেছি, মিষ্টির দোকান দেখেছি, কিন্তু এই মিষ্টি তো কোনদিন দেখিনি। শুনলাম এ হলো মালদার স্পেশালিটি। নাম, খুবই পরিচিত। কিন্তু আমাদের
কলকাতা-হাওড়ায় এই নামে যে সমস্ত মিষ্টি চালানো হয়, এই মিষ্টি দেখা এবং চেখে দেখার
পরে বুঝলাম সবই নকল, মানে নাম ভাঁড়িয়ে চালানো হয়। আসল মিষ্টিটির রূপ-গুণ সব-ই আলাদা।
এই মিষ্টির নাম হল ‘রসকদম্ব’।
জিওলজিক্যালি মিষ্টিটির তিনটি স্তর আছে।
একদম ভিতরের স্তরে, যাকে ইংরেজিতে ‘core’ বলে, সেখানে রয়েছে একটি মাইক্রো-রসগোল্লার গুটি।
তার ওপরে হাফ ইঞ্চি পুরু আসল মিষ্টিটি কড়া ক্ষীরের
তৈরি এবং তার রং হালকা থেকে গাঢ় বাদামী।
আর তার ওপর ছড়ানো আছে ছোট ছোট সাদা দানা।
ফিনিশিং হচ্ছে কদম ফুলের মত, এক্কেবারে।
আর খেয়ে দেখলে, এক সে স্বর্গীয় অনুভূতি!
ভাগ্যিস ভার্চুয়াল বিজয়ার বদলে ফিজিক্যাল বিজয়াটা
সারতে গিয়েছিলাম !
নইলে যে কি মিস হত!

No comments:
Post a Comment