ঝাউতলার ধন:
একবার হয়েছিল কি, এক টুনটুনি এক রাজার জিনা হারাম করে দিয়েছিল। বলেছিল
- রাজার ঘরে যে ধন আছে আমার ঘরেও সে ধন আছে
রাজা বনাম টুনটুনি!!
লড়াই এর ফলাফল ?
- এক টুনিতে টুনটুনালো/সাত রানীর নাক কাটালো |
তারপর শেষে রাজা টুনটুনিকে মারতে গিয়ে নিজের নাকেই কোপ।
ধনের প্রতিযোগিতায় নাকই ঘ্যাঁচাত।
ঝাউতলার গল্পটা অনেকটাই অন্যরকম | কিন্তু মিল যেখানে পাওয়া যেতে পারে তা হল একের ধনে অন্যের ঈর্ষা |
ঝাউতলায় এখন ট্রেন্ডিং যে আমাদের নবীনদাকে দেখা গিয়েছে ধনের জন্য তরস খেয়ে ধনতেরাসের পূন্য তিথিতে বিভিন্ন সোনার দোকানে লাইন দিতে | ওনার পিছনে আমাদের পাড়ার পেপারাৎজিরা (যাদের পাতি বাংলায় 'ঘোঁটবাজ' বলে) ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায় | তাতে ওনার বিশেষ কিছু যায় আসে না। আগেকার দিনে পাড়ায় বিভিন্ন লোকের হাঁড়ির খবর রটে যেত কারণ সে সময়ে দেওয়ালেরও কান ছিল। এখন দুয়ারে উন্নয়নের দরুন দেওয়ালরা বধির হয়ে গেছে | খবর আর দেওয়াল ভেদ করে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ঢুকতে চায় না। কারন ফ্ল্যাটের দেওয়াল বড়ই পাতলা। হাঁড়ির খবরের সম্মানে লাগে অত পাতলা দেওয়াল ভেদ করতে । আমরা উন্নততর হয়েছি, আরও সভ্য হয়েছি, তাই খবর এখন চ্যানেলে আর মোবাইলে | আর ঘোঁট হল অসভ্যতা | ভদ্রলোকেরা এসব নিয়ে চর্চা করে না। তাই ধরন বদলে আমাদের হাউসিং কমপ্লেক্সে ঘোঁট আর্কাইভ করা থাকে কমপ্লেক্সের মেইন এন্ট্রান্সে সিকিওরিটি কাউন্টারে। উৎসাহী ব্যক্তিরা যাতায়াতের পথে ওখান থেকে ঘোঁট সংগ্রহ করেন | এর জন্য মেম্বারশিপ লাগে না।
সপ্তাহ খানেক আগে সেখান থেকে যে তথ্য পাওয়া গেল তা হল নবীনদা মাসখানেক আগে রিটায়ার করার পরে নাকি পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছেন|
খবর মেন গেট থেকে গেলেও তার উৎস ঝাউতলার অর্থনীতিবেত্তারা | আমাদের ঝাউতলায় ব্যাংক এবং ফিনান্স নিয়ে জটিল কাজকর্মে ওস্তাদ লোকজন আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান তিনজন হলেন, এক, দেবাঞ্জন দুই, সমীর ও তিন, অনন্ত | জোকস অ্যাপার্ট, এনারা প্রত্যেকেই জাস্ট ব্রিলিয়ান্ট বললেও কম বলা হয়।
এঁরা নবীনদার কর্মজীবন ও কাল্পনিক বেতনের ভিত্তিতে বেশ কয়েকদিন খুব খেটে হিসেব করে দেখেছেন যে নবীনদা সুপার অ্যানুয়েশনের অব্যবহিত পরে পাঁচ কোটি লিক্যুইড ক্যাশের মালিক হয়েছেন। রিটায়ারমেন্টের পরে উনি এত টাকা নিয়ে করবেন তা নিয়ে আমরা সবাই খুবই চিন্তিত। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো নবীনদা নিজেই জানেন না ওনার পোস্ট-রিটারমেন্ট বেনিফিট হিসেবে উনি পঞ্চকোটি ভারতীয় অর্থ লাভ করেছেন।
আর নবীনদার বাস্তবের সাথে কিছুতেই এই তিন জনের হিসেব মিলছে না | রোজই এ নিয়ে সবার তর্কাতর্কি | একদিন আর না পেরে আগবাড়িয়ে বলতে গেলাম যে
- দাদা আপনি যা পাচ্ছেন, তা পাচ্ছেন | আর ওরা যা হিসেব করছে, তা করছে | তার সাথে আপনি আসলে যা পেয়েছেন বা পাচ্ছেন, আর ওরা যা হিসেব করে বের করেছে, সে দুটোকে যে মিলতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি তো কেউ দেয়নি। সুতরাং আপনি এ নিয়ে এত চিন্তা করবেন না| মিছিমিছি রাতের ঘুম নষ্ট হবে। যেমন আছেন থাকুন।
কিন্তু আমি যে উলুবনে মুক্তো ছড়ালাম তা তখন বুঝতে পারি নি। নবীনদা আসলে আরও বড় খিলাড়ী |
সাথে ওনার পেটে পেটে অন্যের ধনের প্রতি টুনটুনির মত ঈর্ষা তা আমরা ঘুনাক্ষরেও টের পাই নি।
এখন প্রশ্ন দুটি
এক, ঈর্ষা কার প্রতি?
না, পনেরো বছর আগে রিটায়ার করে যাওয়া ব্যাঙ্ক অফিসার মিহিরদার প্রতি |
আর দুই, কেন এ হেন ঈৰ্ষা?
কারন সিকিওরিটির কাছে গচ্ছিত আর্কাইভ থেকে পুরোনো তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে যে মিহিরদার নাকি কয়েক কেজি সোনা আছে |
নবীনদা ভাবলেন,
- টাকা আমার থাকতে পারে | সোনা তো নেই।
ব্যাস! এবারে সেই মিহিরদার সাথে নবীনদার টক্কর | অথচ দেখলে মনে হবে দুজনে যেন হরিহর আত্মা | দুজনে দুজনকে এই বয়সেও বাঁ... জাতীয় ব্রজবুলিতে নিত্য সম্বোধন করেন ৷
ওনাদের যেমন সদভাব, তেমন আদায় কাঁচকলায় | কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না | পুরো সমান সমান | একমাত্র খামতি যদি কিছু থেকে থাকে তা শুধু ওই কয়েক কেজি সোনায় | সুতরাং এই সোনার হিসেবটা আগে মিলিয়ে নিতে হবে। তবে না সমানে সমানে টক্কর!
ফলস্বরূপ ধনতেরাসের দিনে হাওড়া কলকাতা চত্বরে যত সোনার দোকান আছে সব দোকান নবীনদা ঘুরে ফেলেছেন। সেটাও আমরা জানলাম নবীনদার কাছ থেকেই | গেটে খবর যে ছিল না তা নয় | কারণ কাকতালীয় ভাবে আমাদেরই ঝাউতলার এক বেচারা কিন্তু বিশিষ্ট বন্ধু সবজির আগুন বাজারে কালী পুজোর দিনে একটু ভালো-মন্দ খাবে বলে বাজার করতে গিয়েছিল। তার পরে বাজার ছাড়াও আরও অনেকগুলো কেনাকাটা করার ছিল |
কদমতলা বাজার বিভিন্ন প্রান্তে বিস্তৃত। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে যেতে যতগুলি সোনা রুপোর দোকান পড়ে, সব ক'টা দোকানেই নাকি আসা যাওয়ার পথে আমাদের বন্ধুবর নবীনদাকে দেখেছে | এটা সকালের দিকে । দুপুরবেলায় আরেক বন্ধু ওনাকে দেখেছে হাওড়া ময়দানের বড় সোনার দোকানের কাছে | আর সন্ধেবেলায় আমাদের অন্য এক ঝাউতলিস্ট ওনাকে সস্ত্রীক দেখেছে বৌবাজারে সোনাপট্টিতে |
কিন্তু তারা কেউই এসব বলেনি কাউকেই, এক সিকিওরিটি ছাড়া কারন ওখানকার আর্কাইভে তথ্যভাণ্ডারকে নিয়মিত পুষ্ট করা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।
কিন্তু কথায় কথায় নবীনদা নিজেই ফস করে বলে বসলেন,
- সবকটা সোনার দোকানে কি ভিড় মাইরি! কি লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন | ঢোকাই যাচ্ছে না, একটাতেও |
ব্যাস! আর যায় কোথায়!
এই কি যথেষ্ট নয় জানার জন্য যে, নবীনদার মনে আমাদের আমাদের মিহিরদার সোনার ধনের প্রতি কি মারাত্মক চাপা হিংসা !
সেই চাপা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে নবীনদা ঘুরে বেড়াচ্ছেন সোনার দোকানে দোকানে, একটু সোনা পাওয়ার আশায় | কিন্তু হায়রে বিধাতা! সোনা কিনতে চাইলেই কি আর পাওয়া যায়? লাইন দেখেই তিনি ঘেঁটে গিয়েছেন। ওনার বক্তব্য অনুসারে
- জামাইষষ্ঠীতে পাঁঠার মাংসের দোকানে যেরকম লাইন হয়, ঠিক সেরকম লাইন !
কিন্তু পাঁঠার কিলো আর সোনার কিলো তো আর এক নয় |
এখন বিষয়টা গিয়ে দাঁড়ালো এরকম যে ব্যর্থ মনোরথে তিনি ফিরে আসবেন তা তো হতে পারে না! শোনা গেছে যে উনি পিসি চন্দ্রকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন, বরাত দেবেন বলে।
মেইন গেটে সিকিওরিটি কে কড়া হুকুম দেওয়া আছে যে এই ধরনের অতিপ্রীতিকর কোন ঘটনা যদি ঘটে তাহলে যেন তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট করে!
আসলে নবীনদা সুতনুর হাত থেকে লাটাইটা নিঃশব্দে কবেই কেড়ে নিয়েছেন তা আমরা বুঝতে পারিনি। সুতনু সেটা বুঝতে পেরে আজকাল বিশেষ আসে না | এলেও কোন কথা বলে না। ঠোঁটের একদিকে একটা না-ধরানো কিং সাইজের সিগারেট ঝুলিয়ে ফুল সাউথের আন্না স্টাইলে ধুলো উড়িয়ে লঝঝড়ে স্কুটিটা নিয়ে সাঁ করে এসে দাঁড়ায়। তারপর সিগারেটটা ধরায়। তারপর খুব রয়ে সয়ে দু-একটা বাক্য বিনিময়ে করে আবার সাঁ করে স্কুটি টা নিয়ে ওর বাড়ির দিকে চলে যায়।
নবীনদা এসব চেয়ে চেয়ে দেখেন আর মিচকে মিচকে হাসেন | ওনার ভাবনার তল পাওয়া মুশকিল।
আমার স্থির বিশ্বাস সোনা কেনার বরাত দেওয়ার প্রচার একটা ভাঁওতা মাত্র | আসলে কিন্তু তলে তলে সেদিনই সোনা স্টক করে মিহিরদাকে ছাপিয়ে গেছেন | বাকিটা সবাই বুঝতে পারছেন, যে দাদা মানে আমাদের নবীনদা আমাদের একটু ল্যাজে খেলাচ্ছেন । টুনটুনির মত।
তবে আশা করি এ খেলায় কারোর নাক কাটা যাবে না।
কালীপূজার রাতে ওনার নামে সংকল্প করা হয়। তাই উনি নির্জলা উপবাস করেন৷ আর উপবাস ত্যাগ করেন এক দিস্তে লুচি আর পাঁচকোল গ্রাম পাঁঠার নল্লী নিহারী সেবন মাধ্যমে | এ পাঁঠা যে সে পাঁঠা নয় | বলি দেওয়া পাঁঠা | এখন পাবলিকলি পশুবলি বন্ধ হয়েছে বলে উনি দোকানেই বলি চড়িয়ে আসেন | তারপর গোটা পাঁঠা পিস করে মোড়া হয় সবুজ শালপাতায় | তারপর তা বাড়িতে আসে | মায়ের প্রসাদ দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করবেন বলে সে পাঁঠা রান্না হয় নিরামিষ পদ্ধতিতে | মানে তা পেঁয়াজ রসুন বর্জিত। বলির পাঁঠার নল্লী নিহারী রান্না শুরু হয় রাত দশটা নাগাদা | লোহার কড়ায় ঢিমে আঁচে নিহারী রান্না হতে লাগে পাঁচ ঘন্টা |
কালীপূজো শেষ হল রাত তিনটে নাগাদ | লুচি আর নিহারী প্রস্তুত | সিল্কের গাঢ় লাল পাঞ্জাবী আর তসরের ধুতি বাগিয়ে আসনে উপবিষ্ট হলেন নবীনদা, উপবাস ত্যাগ করতে |
ধনে ধনে মিহিরদার সোনার সমান হয়ে উৎফুল্ল নবীনদা একটা লুচি গুছিয়ে পাঁঠার নলীর গা থেকে মাখনের মত নরম মাংস তাতে ভরে ঝোলের মধ্যে দু-বার ডুবিয়ে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে ' জয় মা!' বলে মুখে পুরে চোখ বুজে স্বর্গীয় আস্বাদ অনুভব করতে করতে উপোস ত্যাগ করলেন।
এই না হলে অভিজাত্য! এই না হলে ধনী!
বিদিবদ্ধ ঘোষণা:
- এই গল্পের সব চরিত্ররা কাল্পনিক
- এই গল্পে কোনো পশুপাখির কোনোভাবে কোনো ক্ষতি করা হয় নি।
No comments:
Post a Comment