Sunday, 20 October 2019

বিল্টুর ডায়েরী - চতুর্থ পর্ব

স্কুলের পরীক্ষা চলছে বিজ্ঞান খাতায় ইচ্ছে হচ্ছে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ, সব রঙ মিশিয়ে গুলে ঢেলে দিই হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন তৃষ্ণা ম্যাডাম মাথার চুলটা এমন করে কেটেছেন যেন ধূমকেতু পায়ের নখ, হাতের নখে ফ্লুরোসেন্ট নেলপালিশ আমার সামনে এসে আঙ্গুল নেড়ে কি যেন বলতে গেলেন দেখলাম, নেলপালিশ আর চোখের মণি, দুটোই নীল রঙের এল--ডি বাল্বের মত জ্বলজ্বল করছে কি ভূত না কি! আমি ভয়ের চোটে কিছু বলার আগেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম আর সায়েন্স ম্যা কে জিজ্ঞেস করলাম চিৎকার করে,

-       - - কেন তৃষ্ণা ম্যা আমাকে মার্ক করে এরকম সব সময়ে পিছনে লেগে থাকেন আর অপদস্থ করেন সকলের সামনে?

এর জবাব এল আরও সাংঘাতিক ভাবে সায়েন্স ম্যাম হোয়াইট বোর্ডে মার্কার পেন দিয়ে ক্লাস টেন-এ কি সব খোপ কাটা কাটা চৌকো চৌকো ঘরে গ্রাফ বলে যেমন করে দাঁড়ি কাটে, সেই সব এঁকে সেরকম করে বোঝাতে আরম্ভ করলেন দুটো লাইন টেনে, একটা ক্রস চিহ্ন বানালেন যেখানে একটা লাইন আর একটা লাইন কে ক্রস করেছে একটা পয়েন্টে। ঊনি বলে চলেছেন,

-        - - এটা এক্স অ্যাক্সিস, আর এটা ওয়াই আর, এই ধর গিয়ে হলে তুমি দুটো রে (আলোর সোজা লাইন্) তোমার ওপরে বাইসেক্ট করছে আমরা দেখতে পাচ্ছি।...তাই তোমাকেই বাছা হয়েছে, সবার মধ্যে থেকে। তুমিই সে...যকে বার বার বেছে নেওয়া হবে, সবার সামনে অপমান করার জন্য্, বারে বারে...

ক্লাসের ফার্স্ট বয় কিংশুক বলে উঠল,
-          মুরগী! কোঁকর কোঁ!
-           
সারা ক্লাস হেসে উঠল। তৃষ্ণা ম্যাম স্কেল টেবিলে ঠুকে সাইলেন্স বলে চেঁচালেন বটে, কিন্তু ওনার ঠোঁটের কোনেও সবটা সাপোর্ট করে একটা মুচকি হাসি। যার মানে হল গিয়ে, ঠিক হয়েছে! এটাই তোর শাস্তি! ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম  না যে, আমি করেছি টা কি?
মনে মনে আরও ভাবলাম, আমার কি দোষ, বাবাও তো ঠিক এরকম করেই মা এর সঙ্গে ঝগড়া হলে এই একই প্রশ্ন করে, আরে বাবা, আমি করেছি টা কি? আমার বাবাকে তখন একটা বেচারা ভালমানুষ মনে হয় শুধু এখন আমাকে কেউ ভুল করে এরকম বেচারা ভাবে না, আর ভাল ভাবা তো দূর্! তবে আমার বয়েই গেল। সারাদিন সব জায়্গা থেকে বকুনি খেতে খেতে এখন অভ্যেস হয়ে গ্যাছে। তাই আর গায়ে মাখি না বিশেষ। বলছে বলুক। এরা সব, মানে বড়রা নিজেদের নিয়েই স্যাটিসফায়েড নয়, তাতে আমাদের নিয়ে তো হবেই। হিংসে হিংসে! আমরা যে দিব্বি খেলে-দেলে-টিভি দেখে-খেয়ে দেয়ে আনন্দে আছি, সেটা মনে হয় সহ্য করতে পারে না। আর ভাল সুবিধে হল যে, আমরা কিছু ঘুরিয়ে বললেই, আমরা 'ঈল ম্যানরড্', বড়দের ঠিক সম্মান করতে শিখিনি। এ সব আর কতদিন চলবে! 

...ওদিকে একগাদা লাইন ওই বোর্ডে আমার ওপর দিয়ে আঁকা চলতে লাগল শেষে মনে হল একটা মাকড়সার জাল, আর সেই জালে আমি আটকে গেছি একটা মাকড়সা, ইয়া বড়, আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে তার চোখ দুটোও তৃষ্ণা ম্যামের মতই, এল--ডি লাইটের মত জ্বলছে, আর তার থেকে বের হচ্ছে লেজার-রে সেই লেজার রে আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আমি যেন কানা। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। আমি কোন দিকে যাব, কোথায় গিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাব, কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না আর নড়ব কি! মাকড়সার জালে বন্দী যত চিৎকার করতে যাচ্ছি, গলা ভয়ে বুজে যাচ্ছে ঠোঁট নড়ছে শুধু, কিন্তু কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে মরে যাওয়ার আগের মুহূর্ত। ম্যামের মত দেখতে মাকড়সাটার রেঞ্জের মধ্যে আমি, এক লহমায় আমাকে নিজের শুঁড় দুটো দিয়ে বা সামনের হাত দুটো বাড়ীয়ে গিলে ফেলতে পারে! হাঁ করে সবে এল-ই-ডির মত জ্বলতে থাকা নখ সমেত দাঁড়ার ঝাপটা দিতে যাবেন, আমাকে মারার জন্য, কোথা থেকে দেখলাম আমাদের দুজনের মাঝখানে প্রিন্সিপ্যাল স্যার এসে হাজির, বাজপাখির রঙের শেডের ব্লেজার পরা আর শকুনের মত ঠোঁট।

-         -- কি ব্যাপার তৃষ্ণা! তুমি আবার.....আবার এর পিছনে লেগেছ! তুমি আমার রুমে এস, কথা আছে।

-         -- স্যার, না...মানে, এই ছেলেটি বড় অসভ্য। সব পরীক্ষায় টুকে টুকে ভাল ছেলে সাজতে চায়।

-       -- তাই নাকি! ( তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে)  তাহলে তো তুমি খুব বড় অভিনেতা, সাত্যকি! 

         আমি তো কিছু বুঝে উঠতে পারছি না! কি যে আমার ওপর আসতে চলেছে, কে জানে! 

ত       -- তোমার  জন্য এইবারে আমাদের এই স্কুল প্রথমবার গানের কম্পিটিশনে স্টেট লেভেলে পৌঁছেছে। তুমি কার কাছে গান শেখ?

-        -- কারোর কাছে নয় স্যর। বাবাও চান আমি কারো একজনের কাছে শিখি, কিন্তু মা চায় না। স্কুলের এত পড়াশোনার চাপ... তারপর আমি যেগুলো ভাল পারি সে সব নিয়ে বসার সময় হয় না। আর সময় হলেও সেগুলো তো সবাই বলে 'সময় নষ্ট'। তাই আর সময় হয়ে ওঠে না। 

-        -- সে কি কথা ! তোমারএত ট্যালেন্ট্...জাস্ট নষ্ট হতে দেওয়া যায় না! তোমার বাবা-কে আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো, খুব শিগগির। তোমার ডায়েরী নিয়ে ছুটির পরে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। আমি লিখে দেব। আমাদের সবাইকে তোমাকে নিয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য দিল্লী যেতে হতে পারে। সেই সময়ে যত পরীক্ষা থাকবে, তোমার জন্য মাফ। তোমাকে দিতে হবে না

আমি অবাক চোখে দেখলাম প্রিন্সিপ্যালের দিকে। একবার চোখ বন্ধ করে আবার তাকালাম। দেখলাম স্বয়ং শিবঠাকুর দাঁড়িয়ে, প্রিন্সিপ্যালের জায়গায়। আমার কাঁধে হাত রেখে মুচকি হাসলেন। সে হাসির মানে আমি বুঝি আমি আছি তো, তোমার চিন্তা কিসের। অত সুন্দর ধুঁতরো ফুল রাস্তার পাশের গাছ থেকে এনে আমাকে তুমি দিয়েছ। সবাই তো এটা ওটা যা দেয়্, কিনে দেয়। তোমার দেওয়ায় আমি খুশি হয়েছি।

সবে শিব্ঠাকুরকে আমি কিছু বলতে যাব, দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আর পল্টু হাঁ করে চেঁচাচ্ছে।....

ওঃ! বুঝলাম! যা দেখলাম সবই স্বপ্ন। এখন সকাল। মনে করার চেষ্টা করলাম, সেদিন কি বার, স্কুলে যেতে হবে কি না! হ্যাঁ। বুধবার। আজ আবার পরীক্ষাও আছে, বিজ্ঞান। 

আচ্ছা বিজ্ঞান তো এত কিছু পারে! কেন পারে না আমাদের মত ছোটোদের একটা ব্যবস্থা করতে.... এরকম ভয়ানক লেখাপড়ার হাত থেকে একটু মুক্তি দিতে!

কোনোমতে রেডি হয়ে স্কুলে গিয়ে পৌঁছালাম। ফার্স্ট পিরিওডেই পরীক্ষা। আবার তৃষ্ণা ম্যাম! কি বিতৃষ্ণা!

-     -- এই যে সাত্যকি! গুড মর্নিং! কনগ্র্যাচ্যুলেশন! উই আর অল প্রাঊড অফ ইউ! তোমার জন্য আজ স্কুলের ইতিহাসে প্রথম ঘটেছে এমন একটা ঘটনা। আমাদের স্কুল জুনিয়র সোলো ভোক্যাল কম্পিটশনে স্টেট লেভেলে গিয়েছে, আর তুমি হচ্ছ আমাদের স্কুলের একমাত্র রিপ্রেসেন্টেটিভ।
      আমি অবাক! সময় নিয়ে ঢোঁক গিলে কোনোমতে বললাম,

-          -- থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম!

এই কথা মুখ থেকে বেরোলো বটে কিন্তু, ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না, এ ও স্বপ্নের অংশ নয় তো! নিজের গালে কষে এক থাপ্পড় মারলামজেগে আছি কি না দেখতে!

ম্যাম বললেন,

-     -- এ কি সাত্যকি? কি করছ তুমি? পাগল হয়ে গেলে নাকি! নিজেকে ওভাবে কেউ মারে নাকি! 
       বলে কাছে টেনে নিয়ে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আমার সামনে নিচু হয়ে বসে বললেন।

-        -- আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। পারবে  আমাকে ক্ষমা করে দিতে?

আমি শুনেই কেঁদে ফেললাম।  সারা ক্লাসরুমে সকলের সামনে ওনার কাছ থেকে এতটা সম্মান তো আমি কোনোদিন পাই নি! কারো কাছ থেকেই পাই নি। কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, চোখ ঝাপসা। ম্যাম ততক্ষণে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন।  মায়ের মতই সুন্দর গন্ধ ওনার গায়ে। আমাকে যখন ছাড়লেন, দেখলাম ওনার দু-চোখেও জল। গর্বে চিৎকার করে বললেন,
-         -- থ্রি চিয়ার্স ফর সাত্যকি!
         সারা ক্লাস গম গম করে উঠল।
-          -- হিপ হিপ হুররে!
 আর আমি মনে মনে বললাম,
-          -- জয়, শিবঠাকুরের জয়! জয়, বাবা-মায়ের জয়! জয়, পল্টুর জয়!
 -- আজ পরীক্ষাটা দারুণ হবে। কিচ্ছু গুলিয়ে যাবে না। কিচ্ছু ভুলে যাব না লিখতে লিখতে।

(চলবে...)

No comments: