বেঁচে
কি আর
গেলাম, সত্যি-ই? এক সমস্যা ফেলে আর এক সমস্যা।
বাসে
উঠতেই
সন্তুকাকু,
মানে
বাসের
কন্ডাক্টর,
আমার
কানে
এক
প্যাঁচ। “তুই কেন দেরী করলি? কাল থেকে বাসের আগে এসে দাঁড়াবি, না হলে কিন্তু বাস চলে যাবে”।
কান
পুরো
গরম
করে
দিয়েছে। চা-এর জল বসালে গরম হয়ে যাবে। যেন নিজে সবসময়ে টাইমে আসে! আমি কতদিন দাঁড়িয়ে থাকি আগেভাগে গিয়ে। বাস আর আসে না। বর্ষাকালে তো আরও-ই। রোজ নাকি জ্যাম থাকে। আর আমি যে স্কুলে যাওয়ার আগেই ভিজে চুপচুপে হয়ে যাই। পরের তিনদিন স্কুলে যেতে পারি না, জ্বরের চোটে। হোমওয়ার্ক, ক্লাসওয়ার্ক মিলিয়ে পাহাড়ের মত কাজ জমে যায়। ক্লাস টেস্ট মিস করি।
জ্বর
হলে
বড়রা
কেমন
টিভি
দ্যাখে,
গান
শোনে। আর আমার বেলায় বাড়িতে যখন আছিই তাহলে খানিকটা অঙ্ক করে নিতে হবে, পড়তে হবে, শুয়ে শুয়ে। টিভি দেখলে নাকি স্ট্রেস হবে। জ্বর সারতে দেরী হবে।
মা
তো
খড়্গহস্ত। যেন আমি ইচ্ছে করে জ্বর-টা পাকাই।
যা কিছু চোটপাট সব আমার ওপরে। কিন্তু
সন্তুকাকুকে বলার কোনো ক্ষমতা নেই। দু-একবার বলতে গিয়েছিল বাবা। সন্তুকাকু বলেছে, না পোষালে ছেড়ে দিতে বাস। অনেকে অপেক্ষা করে আছে এই সুযোগ পাওয়ার জন্য। আর সন্তুকাকু-র বিরূদ্ধে যদি কোনো কমপ্লেন্ট থাকে, তবে স্কুলে গিয়ে জানাতে।
বাবা-ও জানে স্কুলে গিয়ে জানালে, বাবা-কে আমার মতই ট্রিট করবে। তাই ভয়ে যায় না। সব রাগ এসে পড়ে আমার ওপর।
সন্তুকাকু তো কানে পাক দিয়েই খালাস। ইচ্ছে আছে একদিন সন্তুকাকু-কে বলব, যে এইটুকু একটা দেরী আমার জীবনে কি সব খারাপ সময় রোজ নিয়ে এসে হাজির হয়।
সবে
কানের
ব্যাথাটা
একটু
কমেছে, পিছন থেকে কে একজন আমার চোখ চেপে ধরে মাথায় এক গাঁট্টা। তারপরেই ঘুরে দেখি, বেদান্ত।
ওর
নামটা
শুনলেই
আমার
কেমন
বেদানা-র কথা মনে পড়ে।
আমার
জীবনের
আর
এক
রাক্ষস। “কি রে, কাল যে আমার ভাগের টিফিন-টা এল না? পুরোটাই তুই আর পুরোধা মিলে সাঁটিয়ে দিলি। পুরোধার সঙ্গে খুব ইন্টু-পিন্টু চলছে দেখছি আজকাল! গার্লফ্রেন্ড নাকি তোর”।
“হ্যাঁ, মানে, না সেরকম নয়। আমার ফ্রেন্ড। তোরা ওকে নিয়ে বাজে কথা কেন বলছিস”?
বেদান্ত-র আবার পার্টনারস ইন ক্রাইম আছে। তাদেরকে বলল, “ওই শোন, কি বলছে। আবার গায়ে ছ্যাঁকা লাগছে। বেশ
করেছি
বলেছি। হাজার বার বলব।কি
করবি
রে
তুই?”।
আমি
কোনো
উত্তর
দিলাম
না। কারণ এরা কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে ওস্তাদ। মা-এর কাছে হাজারো বকুনি সারাদিন ধরে খেয়ে খেয়ে এখন নিজের রাগ-কে কন্ট্রোল করতে ওস্তাদ হয়ে গিয়েছি। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা। ইচ্ছে আছে, বেদানার মত চিবিয়ে খাব একদিন, বেদান্ত-কে। দানাগুলোকেও রাখব না।
পুরোধা
আমার
খুব
ভাল
বন্ধু। ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ বলে যে সিনামাটা আছে। অনেকটা ওরকম। পুরোটা না। কারণ ওকে আমি ‘আই লাভ ইউ’ বলার মত কোনো কারণ খুঁজে পাই না। সবসময়ে আমার পাশে থাকে। আমাকে যে টিচারদের হাত থেকে কতবার বাঁচিয়েছে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আমি ওর জন্যে কিছুই সেরকম করি না। তাই আমার টিফিনটাই একটু শেয়ার করি, শুধু।
সারা
বাস
ধরে
শুধু
আমাকে
সেদিন
কথা
শুনতে
হল
আর
আমি
হলাম
গিয়ে
হাসির
খোরাক, সবার।
আসুক
না, সেই দিন, যেদিন স্কুলে ইন্টার-স্কুল ট্যালেন্ট কম্পিটিশন হবে। আমি কাউকে বলি নি ক্লাসে। স্কুলের মিউজিক টিচার-কেও বলেছি, কাঊকে না জানাতে। সারা স্কুলে ওই একজন-ই টিচার আছে যার একটু মানুষের মত স্বাভাবিক বুদ্ধিশুদ্ধি আছে বলে আমার মনে হয়।
গীটার
বাজিয়ে
গান
গেয়ে
আমি
তাক
লাগিয়ে
দিয়েছি
সবাই-কে, প্রথম রাউণ্ডেই। মা জানত। আর বাবা-র কাছে গিয়ে যখন বললাম, বাবা আমাকে বলল, “ঠিক হ্যায়। হম ভি দেখেঙ্গে তুমকো হরাতা কৌন হ্যায়!”
বাবা
শেখালো
আমাকে
হাতে
ধরে, বলল, “মন দিয়ে শোন, সবাই ইংরেজী গান গাইবে। তুই কিন্তু বাংলা গান। রবীন্দ্রনাথের। রকিশ স্টাইলে”। এই না বলে, আমাকে দু-টো গান শোনালো- এরিক ক্ল্যাপ্টন বলে নাকি কোন এক ইংরেজ লেজেন্ড আছে, যার নিজের ছেলে মারা যাওয়ার পর শুধু আকাউস্টিক গীটার নিয়ে “টিয়ার্স ইন হেভেন” বলে একটা গান গেয়েছিল, আর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, “নিভৃত প্রাণের দেবতা’। স্পিরিট-টা না কি একই। আমাকে গীটার বাজিয়ে দ্বিতীয়-টা গাইতে হবে। বাবা জানে আমার অফবীটের গান খুব পছন্দের। তাই এই গানটাকেও সেরকম করে গাইতে শিখিয়ে দিল।
আমার
বাবা-কে গান-বাজনা, গল্পের বই,কবিতা, ফাইন আর্টসের হিজিবিজি, ছবি তোলা এসব নিয়ে বসতে বললেই একেবারে অন্য মানুষ। কিন্তু অত সব ভারী ভারী কথা আমি
তো ঠিক সবটা বুঝি না। শুধু বুঝি, যে যা বলছে, সেগুলো বুঝতে পারলে শেখার মত, আর ওসব কোনো বই-এ লেখা নেই। বলার সময়ে বাবার চোখ-মুখ কেমন গোল গোল হয়ে হয়ে ওঠে। এক্সাইটমেন্টে মনে হয়।
আমি
জানি
আমার
বাবা
এই
সব
ব্যাপারে
যা
বলে
তা
একদম
অব্যর্থ। হলও তাই। কম্পিটিশনে যাঁরা জাজ হয়ে এসেছিলেন, আমাকে বেছে নিলেন সবথেকে বেশি ক্রেডিট-মার্কস দিয়ে।
যে
দিন
ফাইনাল
হবে, স্টেজের আলোটা আমার গায়ে এসে পড়বে, আমি মেখে নেব সারা গায়ে সেই আলো। মুগ্ধ হয়ে যাবে হল ভর্তি অডিয়েন্স আর জাজেরা।আমি আমার স্কুল-কে এনে দেব গর্ব করার মত সম্মান। তখন দেখব আমার মত কেউ আছে কি না। মারপিঠ আমি করতে পারি না, পছন্দ-ও করি না। কিন্তু এই শক্তি পৃথিবীর সবথেকে বড় শক্তি। বাবা আমাকে শিখিয়েছে – “অনেকেই তোর থেকে বেশি জানে, আরো ভালো গায় বা বাজায়। কিন্তু যখন তুই নিজে স্টেজের আলোয়, জানবি ওই আলো ঈশ্বরের, যতক্ষণ তুই সেখানে আছিস তুই-ই রাজা, তুই-যা করবি সেটাই একমাত্র ঠিক। কারণ, যারা তোর থেকেও বেশি জানে, তারা কিন্তু তাদের অত জানা নিয়েও স্টেজের নিচে দাঁড়িয়ে। অথচ তুই কিন্তু কম জানা নিয়েও স্টেজে। তাই তুই-ই তখন শেষ কথা”।
দেখেছি
কথাটা
বিশ্বাস
করে
বারে
বারে
ফলে
গ্যাছে।
শুধু
একটাই
মুশকিল। পরীক্ষার দেওয়ার
সময়ে এখনো আমি এরকম করে ভাবতে পারি না। বোধ হয় খাতা-টা থেকে স্টেজের মত ঈশ্বরের আলো বেরোলে, ওটাও আমি ঠিক করে নিতে পারব।
বাস
স্কুলে
ঢুকে
সবাই
নেমে
মর্নিং আসেম্বলি-তে প্রেয়ারের লাইনে দাঁড়িয়ে। জানতেই পারিনি কখন সেখানে পৌঁছে গেছি, এই সব ভাবতে ভাবতে।
হটাৎ
মনে
পড়ল, ফার্স্ট পিরিয়ডেই আজ অঙ্ক ইউনিট টেস্ট। আর আমি বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছি।
(চলবে...)
No comments:
Post a Comment