মা আমাকে যখন ডাকল, তখন
স্কুলের সময় হয়ে গ্যাছে। কি করে কি করব বুঝেই উঠতে পারছিলাম না। ব্রেকফাস্ট করতে
অন্যদিন আধঘন্টা লাগে। আজ আমি কার্টুন দেখতে গিয়ে চল্লিশ মিনিট নিয়ে ফেলেছি।
পল্টু আজ বড্ড জ্বালাচ্ছিল। একে তো মুখে কথা ফোটে না, কিন্তু ওর প্রতি মুহূর্তে চাহিদার শেষ নেই। আর সব কিছু যেন আমার কাছেই
আছে। বোঝে না, আমি ও ওর থেকে না হয় বছর চারেকের মাত্র বড়।
আমিই বা আর কত পারব!
আজ জানলার গরাদের ফাঁকদিয়ে ইচ্ছে করে দু’ দু’বার বল ফেলে দিয়ে, মাথায়
হাত দিয়ে ‘ এইইইইই দাআআ!’ বলে আমার
দিকে তাকিয়ে সামনে গজানো দাঁতগুলো বের হাসল। এর মানে আমার কাছে স্পষ্ট – 'বলটা
এনে দাও'।তখন কার্টুনে দুরন্ত মুহূর্ত। কিন্তু আমাকে যেতেই
হবে, না হলে কেঁদে চিৎকার করে এমন করবে, যা-ও বা সকালে ব্রেকফাস্টে কার্টুন দিয়ে একটু দিনটা হ্যাপি হ্যাপি শুরু
করছি তা-ও যাবে।
পল্টুর এই সব লক্ষ্মীছাড়া ব্যাপারে আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমার
সব কাজের মধ্যে পল্টুর কাজ কর্মের দিকে একই সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হয়। সমস্যা হয় না।
মা যদি 'দশভূজা' হয়, তাহলে আমিও 'দশভূজ'। কিন্তু
যখন মা বা বাবা আমাকে বকে, তখন আমি স্পষ্ট দেখতে পাই যে,
ওরা সব্বাই, 'ভূজ'-টুজ
কিছু নয়, 'দশানন'।
পল্টুকে-ও ব্রেক ফাস্ট দেওয়া হয়েছিল। কি একটা সাদা রঙের
আটা-গোলা মত। গন্ধ পেলেই আমার বমি আসে। আমাকেও নিশ্চয়ই পল্টুর মত বয়েসে এই সবই
খাওয়াতো। আসলে মানুষ জন্মানোর পরে তার বমি করার অভ্যাস বা অনুভূতি কোনোটাই থাকে
না। এই সমস্ত অখাদ্য খাওয়ানোর ফলে শরীরে প্রথম ‘বমি’ নামের ভাবটা আসে। পটির মত বমি করাটা না শিখলে মানুষ
যেন 'মানুষ' হয় না। স্কুলে কম্পিউটার
পড়ায়। মানুষের ক্ষেত্রে ইনপুটের জায়গা, মানে ‘মুখ’, মানে আমাদের ‘হাঁ-গাল’। সেটা দিয়েই যদি ইনপুট আর আউটপুট, মানে
খাচ্ছি আবার বমিও করছি, (যদিও আউটপুট-টা টেম্পোরারী) এ-রকম
বোথ-ওয়ে হয়, তাহলে আমাদের ফিক্সড আউটপুটের জায়গা, মানে...'ইয়ে' দিয়েও কেন ইনপুট,
মানে খাওয়া যাবে না? আবার সুবিধে বলতে,
ওখানে জিভ নেই। কাছাকাছি নাক-ও নেই, তাই
স্বাদ-গন্ধ কিছুই মালুম হত না। কোনো ঝামেলা ছাড়াই কেমন পুষ্টি পাওয়া যেত। কিন্তু
ওখানে যে দাঁত নেই। এটা একটা বড় কারণ অবশ্য। তবে ব্যাঙেরও তো দাঁত নেই।
যাই হোক, প্লটুর ব্রেকফাস্ট আপাততঃ বাঘা-র
পেটে, কারণ পল্টু মেঝেতে ওই বাটি-টা রেখে খেতে খেতে খেলছিল।
তারপর ও ভুলেই গিয়েছিল, খাবারের কথা। বাঘা সেই সুযোগ কি আর
ছাড়ে। মা যদি চলে আসত আমি পড়তাম বিপদে। কারণ্, মা আমকে দেখতে
বলে গিয়েছিল যে পল্টু ঠিকমত খাচ্ছে কি না।
আমি ততক্ষণে পল্টুর জন্য অন্ততঃ বার দুয়েক চারতলা থেকে নিচে
গিয়ে ওর ফেলে দেওয়া বল কুড়িয়ে এনেছি। আবার নিজের খাওয়াও শেষ করেছি। কেঊ বোঝে না,
এটা সকাল বেলায় কি যে ঝক্কি! এবার যদি স্কুল বাস আমকে না নিয়ে চলে
যায়, তার সব দোষ এসে পড়বে প্রথমে আমার ওপরে, তারপরে আমার প্রাণের ঐ টিভিটার ওপরে।
এরকম অশান্তি হলেই বাবা-মায়ের মধ্যে একচোট লেগে যায়, যে টিভি-র কানেকশনটা আর রাখা যাবে কি না। এই ব্যাপারে বাবা অনেকটা আমার
মত। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বটে, কিন্তু সেই ঝগড়ায় শুধুই
মিথ্যে। যতই বলুক না কেন টিভি-র কানেকশন কেটে দেবে, পারবে
না। আমি জানি। খেলা, খবর, ওয়েব সিরিজ -
এ সবের নেশা থেকে আর বেরোবে কি করে। আমাকে ডেকে শাসন না করে, দিক না দেখি বাবা, কেমন পারে টিভির কানেকশন কেটে
দিতে! টিভির নেশা কি আর যে সে নেশা, যার আছে সে-ই বোঝে,
যে অত সহজে এটা ছাড়া যায় না। বাবা-মা যখন ঝগড়া করে, তখন তাই নিজেকে নিয়ে বেশ গর্ব হয়, “বাপ-কা বেটা” ভেবে।
ভাগ্যিস টিভি-র কোনো 'নেশামুক্তি' সেন্টার
নেই।
আমি যখন খাওয়া শেষ করলাম, তখন দেখি বাঘা
মেঝেতে শুয়ে সামনের দু-টো পা দিয়ে পল্টুর ব্রেকফাস্টের বাটি-টা ধরে চেটে এমন সাফ
করে ফেলেছে, যে আর মাজা-ধোয়া লাগবে না। ছুটে গিয়ে কেড়ে নিতেই
বাঘার লোভী চোখ আমার দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে রইল, ভাবল বুঝি
আরো খানিকটা জোগাড় করে দেব। লোভী বাঘা যেমন করে নিজের ঠোঁট আর নাক চাটল সপাৎ সপাৎ
করে, যে আমার মনে হল, সত্যি-ই এ
কুকুরের-ই খাবার, জোর করে মানুষের ছানাদের খাওয়ানো হয়।
বেচারাদের প্রতিবাদের কোনো দাম নেই তো, তাই।
বাবা ঘরে ঢুকল, স্নান সেরে। “কি রে বিল্টু, রেডি তো?
বাস আসার সময় হয়ে গ্যাছে কিন্তু, এখন মিস করলে
আমি কিন্তু ওই ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুরে গিয়ে দিয়ে আসতে পারব না”। শুধু মা একবার শুনতে পেলেই হত কথাটা। কিন্তু বাবা এ সব কথা এমন করে
বলে, যাতে মা কোনোদিন শুনতেই না পায়।
আর যদি কোনোদিন পায়, গোবিন্দপুরের পরেই
লন্ডন, প্যারিস, ম্যানহ্যাটন, হংকং -- সব ঘুরে ঢাকা-তে এসে বিশ্রাম নিতাম, আর বাবা
কে মিচকি হাসি হেসে বলতাম, “দ্যাখো, কেমন
লাগে! আর বলবে কোনোদিন?”
এই সব ভাবতে ভাবতে, মা ঢুকল। “বিল্টু তুই দু’পায়ে দু’রকমের মোজা কেন পরেছিস? উফ!
হাড়মাস কালি করে দিল গো আমার। একটা মোজার সেট পর্যন্ত তুমি এখনো চেনো না, মানুষ হবে কি করে! ডিসিপ্লিন এখন থেকে না শিখলে কিছুই করে উঠতে পারবে না”।
কেনই বা তিনটে সেট মোজা কিনে রেখেছে! আর যদি বা রেখেছে, সবকটাই তো সাদা। কি যায় আসে, কোনটার সঙ্গে কোনটা
পরলাম! নিজেরাই ছোটোদের কনফিউজ করে, আর দোষ হয় আমাদের। এর
নাম না কি ‘ডিসিপ্লিন’! সব
বাড়িতে একই রকমের অশান্তি, স্কুলে তো সকলের কাছে তা-ই শুনি।
মনে হয় এটা একটা ‘জেনারেশন প্রব্লেম’। কি করে যে এদের এখান থেকে বের করা যায়। শুনেছি ছোটোদের যে সব
বাবা-মা-রা ঠিক মত মানুষ করতে পারছে না, সেই
সব বাবা-মাদের মাথার চিকিৎসার জন্য ডাক্তার হয়েছে আজকাল। কিন্তু নিয়ে যাবে কে?
বাবা-মা ভুল – এটা আর কোন বাবা-মা মানে।
যাক গিয়ে, যা পারে করুক। গলির মুখে
স্কুল-বাসটা এই মাত্র এসে দাঁড়ালো। আমিও রেডি।
আজ বেঁচে গেলাম। আজকের মত বাড়ি থেকে ছুটি।
Saturday, 19 October 2019
বিল্টুর ডায়েরী - প্রথম পর্ব
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment