ক্ষিদের চোটে আমার আর বুমের পেটে
ততক্ষণে ছুঁচোয় ডন বৈঠক দিচ্ছে। সোয়া পাঁচটা হবে তখন। এতটা সময় কোথায় কাটানো যায়। বেশি
দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে হল না। লেডী রানু মুখার্জী মঞ্চের বাইরেই ভাজাভুজির ভুরিভোজ।
যাঁরা সেখানে নিয়মিত নাটক দেখতে যান, সবাই সেই ফিশ ফ্রাই আর ডিমের ডেভিলের গুনমান সম্পর্কে সব জেনেও আবার খাবো স্টাইলে সেখানেই পেট ভরান। এই কাঊন্টারে এক অদ্ভুত ব্যাপার।
কখনো আজ অব্দি দেখি নি যে চাহিদার সঙ্গে উৎপাদন এবং বন্টনের কোনো সামঞ্জস্য আছে। চাহিদার থেকে উৎপাদন কম রেখে একটা কৃত্রিম হাহাকার সৃষ্টি করা হয়, অকারনেই। যিনি বিক্রি করেন, তাঁর তাড়াহুড়ো দেখলেই মনে হবে, এই সব শেষ হয়ে গেল বুঝি এবং এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই উনি পাত-তাড়ি গোটাবেন। বুম যথারীতি ডিমের ডেভিল দেখে লালায়িত। আমার কাছ থেকে একশো টাকার নোট নিয়ে ভাঙ্গাতে গিয়ে না পেয়ে
ফিরে এল। খুচরো নিয়ে যখন দু হাত দূরে আবার ফিরত গেল, শেষ ডিমের ডেভিল-টা নির্দয় কোনো
ব্যক্তি বুমের জন্য অপেক্ষা না করেই কিনে নিয়ে রসনা তৃপ্তি সেরেছেন। সেই অজানা ব্যক্তি ও দোকানদারের প্রতি কুপিত হয়ে বুম আর সেখান থেকে কিছু খাবে না বলে সিদ্ধান্ত
নিল। আমি-ও কথা না বাড়িয়ে টিকিট কাউন্টারের সামনে মুক্ত মঞ্চের কাছে এলাম। সেখানে পাপড়ি
চাট ছিল, এই বাঁচোয়া। পেটে ওই সুস্বাদু খাবার যেতেই, বুমের মুড ঠিক হয়ে গেল। আমার ভরসা নন্দন চত্তরের আদি অনন্তকাল থেকে চেনা সেই ‘আমন্ত্রন’। আশ মিটিয়ে দুটো ডিমের ডেভিল, একখানা ফিশফ্রাই ৩-১ শেয়ারে আর কয়খান কচুরী আলুর-দম
দিয়ে। সঙ্গে একটা ছোট পেপসি কোলা। আহ! পেট জুড়োলে প্রাণ-ও জুড়োয়। তবে এত কিছু করেও,
সবে তখন পাঁচটা চল্লিশ।
ভরসা পেন্টিং এক্সিবিশন, আকাদেমী অফ ফাইন আর্টস-এ। বুমেরও এই ব্যাপারে বেশ আগ্রহ আছে।কাছাকাছি কোথাও এলে আমি আর বুম সময় পেলেই এখানে একবার ঢুঁ
মেরে যাই। ছবির কিছু বুঝি বা না বুঝি, আমার বিশ্বাস, আমরা ন্যূনতম নান্দনিক দৃষ্টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে অন্তত একটা আনন্দ খুঁজে পাই। যতটুকুই বোধগম্য হোক না কেন, সেখানে আলোচনা আমার আর বুমের মধ্যেই সীমিত। বুম লাইন ড্রয়িং/ পেনসিল স্কেচ
ভালই আঁকে, কোনো ট্রেনিং বা শিক্ষানবিশী ছাড়াই। সেন্স অফ প্রোপোরশান বেশ ভাল। ইন্টারপ্রেট
ও করতে পারে, নিজের সরল স্বাভাবিক চোখ দিয়ে। আমার মত জটিল মানসিকতা নয় বলেই বোধ হয়,
অনেক কঠিন ছবি-ও দেখেছি নিজের মত করে সহজ সরল ভাবে ব্যাখ্যা করে দিতে পারে। আমার মনের
সব জট ছাড়িয়ে হেসে বলে, “তুমি! বাবা, তুমি এই সহজ ব্যাপারটা
বুঝতে পারলে না! ইনক্রেডিবল”! অঙ্ক শিক্ষকের কথা মনে পড়ে যায়।
মনে হয়, নাঃ! সত্যি-ই কি গর্হিত অপরাধ করে ফেললাম, এত সহজ জিনিষ-টা আমি বুঝে উঠতে পারলাম
না। অনেক কিছু বুঝতে, শিখতে ও জানতে আজকাল বুম বা তার জেনারেশনের কাউকে আমার প্রয়োজন হয়। ওদের দেখার চোখ আমাদের থেকে একবারেই পৃথক -- অনেক সহজ, সরল, সোজাসাপটা।
![]() |
| জল রঙ ২ |
![]() |
| জল-রঙ ১ |
যতই মিক্সড মিডিয়া-তে পেন্টিং
এর চল বাড়ুক, যতই তেল রঙের আলো ছায়ায় ছবিরা প্রাণ পাক না কেন, আমার দেখার নেশা জল রঙ্-এ
আঁকা ছবি। যাঁরা তা আঁকতে পারেন, তাঁরা ঈশ্বর, আমার কাছে। প্রথম জল রঙে আঁকা ছবি আমার চোখে লেগেছিল,
অবন ঠাকুরের হাতে আঁকা। বাবা দেখিয়েছিলেন। ব্যাস ক্লাস নাইনে দেখা সেই ছবিগুলোই হয়ে
গেল পরম ছবি, যার ওপরে বোধহয় বাস্তবে আর হয় না -- পরম শূন্য উষ্ণতার মত। ওটাই স্কেল। ওটা দিয়েই
আজও ভাল খারাপের বিচার চলতে থাকে মনের গভীরে। আজ-ও কেউ অবন ঠাকুর-কে
ছাড়াতে পারল না।
![]() |
| জল রঙ ৩ |
কিছু জল রঙ্-এ আঁকা ছবি দেখতে পেলাম,
সেদিন। মিনিয়েচার। ১৬/১২ ফ্রেমে। কালার ক্রাঊড। ভিড়ে ঠাসা মানুষের কিছু ছবি। আর কিছু
ছবি ঐতিহাসিক স্থানের, ইঁট-পাথরের তৈরী, অনেক
দর্শকের ভিড়। বেনারসের ঘাটের একটি অসাধারণ ছবি দেখে মনে পড়ে গেল অবন ঠাকুরের আঁকা গঙ্গার ঘাটের কাছে বট গাছের নিচের সেই প্রাত্যহিক
চিত্রের কথা, জল রং-এ আঁকা, আবার-ও। সেই অসম্ভব ছবি গুগল ঘেঁটে
পাওয়া যাবে না। জোড়াসাঁকো গেলে তবেই মানব জনম সার্থক হবে, অমন একটা ছবি কেউ আঁকতে
পারে দেখে, তা-ও আবার জল রং-এ। ভেবেই পাই না -- জেবড়ে যায় না, একটু-ও
একবার-ও!! একবার স্মাজ করলেই জল রঙ দিয়ে ছবি আঁকাই শেষ, মেক আপ এর কোনো জায়গা নেই – ঠিক নাটকের মত – একবার ডেলিভার করার পর, আর
ফিরৎ এসে কারেকশনের সুযোগ নেই – কোনো জায়গা নেই যে একটা ভুল
ডেলিভারেন্স কে প্রোটেক্ট করবে। জীবনে রোমাঞ্চ চাও? জল রঙ্-এ ছবি আঁক, বা নাটক
কর, বুঝবে! "The world is a stage..." ব্লা ব্লা ব্লাহ!!!
লেখাটা ভুল
লাইনে চলে যাচ্ছে। ফিরে আসি।
আমি আকাদেমী
গ্যালারী থেকে বেরোতে যাব, হঠাৎ পিছন থেকে বুমের ডাক, “বাবা, একটা জিনিস দেখবে এস”। সাদার্ন গ্যালারীটা সেদিন এমন ভাবে আলাদা করা ছিল যে আমি
লক্ষ্যই করি নি। ফটোগ্রাফি-র এক্সিবিশন চলছে। বুম আমাকে টেনে নিয়ে গেল একটা ছবির
কাছে। “এরকম ছবি তো কত
তুলেছ তুমি! তোমার ছবির এক্সিবিশন হয় না কেন”? এরকম প্রশ্নের
উত্তরে আমি আর কি বলি! নিজেকে ‘সিধু জ্যাঠা’ মনে হল। (এই allusion তাঁরাই বুঝবেন যাঁরা ‘সোনার কেল্লা’-য় সিধু জ্যাঠার ডায়ালগ টা জানেন)। মনে পোরে গেল চন্দ্রবিন্দুর গানের কিছু কলিঃ
"আমাদের বগল ভরা স্ট্রাগল আছে/ ছাগল ভরা মাংস
তাই চাড্ডি পরে শোধ করে যাই/ লোন-এরই ভগ্নাংশ
একদিন আমেরিকাও ধ্বংস হবে/ বিলেত যাবে ঝুলে
আর জয় বাঙ্গালী থাকবে শুধু/ ভাতে ঈশবগুলে..."
আমি আর ব্যতিক্রমী হতে পারলাম কই!
মোবাইল ফোন, ক্যামেরার মেগাপিক্সেল,
ডিজিট্যাল এডিটিং এর চক্করে এখন আর ছবি তোলার মধ্যে রোমাঞ্চ-টাই হারিয়ে গিয়েছে। শেষ
মনে রাখার মত কিছু স্লাইড তুলেছিলাম, তাজমহলে। ফিল্ম স্লাইড দ্যাখার মত যন্ত্র আর পাওয়া
যায় না। অনেক স্মৃতির হাত ধরে আবার ফিরে এলাম বর্তমান মুহূর্তে।
![]() |
| তৈল চিত্র |
সময় প্রায় হয়ে এসেছিল। পরের প্রহসন
দেখার জন্য। ‘সধবার একাদশী’, দীনবন্ধু মিত্রের লেখা। আগের নাটকের
টিকিট পয়সা দিয়ে কিনেছিলাম বলে দেবাঞ্জনের কাছে খুব গালি খেয়েছি। এ বারে আর এই সৎ সাহস-টা
ওকে দেখাতে পারলাম না। ও আমাদের দু জনের জন্য দু-টো টিকিট আলাদা করে তুলে রেখেছিল।
টিকিটের অলঙ্করণের ধারণা-ও বেশ আলাদা। দেখে ভালই লাগবে – যেন ঊনিশ শতকের নিউজ-প্রিন্ট-এ তৎকালীন হরফে এবং ভাষায় ছাপা। বুমের খুব টেনশন হচ্ছিল, দেবাঞ্জন মেক
আপ-টা নেবে কখন। সাড়ে ছ’টায় নাটক শুরু, তখন প্রায় ছ’টা পঁচিশ ছুঁই ছুঁই, আর দেবাঞ্জন তখনও আড্ডায় মশগুল। কি করে কি হবে! আমি বললাম, ওর চিন্তা-টা ওকে-ই করতে দিতে। কিন্তু বুম দেবাঞ্জনকে
খুব ভালবাসে। কিছুতেই মাথা থেকে চিন্তা-টা গেল না। আমরা আকাদেমীর সামনে থেকে লেডী রানু
মুখার্জী মঞ্চের দিকে হাঁটা দিলাম।




No comments:
Post a Comment