সকাল থেকেই একটা অন্যরকম অনুভূতি। আজ আমার ছেলে-কে নিয়ে নাটক দেখতে যাব। এটা যে প্রথম
বার, তা নয়। আগেও বহুবার গিয়েছি। কিন্তু উত্তেজনার পারদ-চড়া-টা অন্য জায়গায়। কলেজ জীবনের
সেই দিন গুলো…যখন পরপর দু-টো নাটক একটানা একদিনে দেখে ফেলা,বা পর পর তিনটে
সিনেমা…অবশেষে আমার ছেলেকেও সেই পথে টানতে পেরেছি, যে সে অত্যন্ত আগ্রহের
সঙ্গে রাজী হয়েছে, এ এক বিরাট প্রাপ্তি।
বুমের কোচিং-ক্লাস ছুটি তিনটেয়। আমার ফোনে দেখি বুমের ফোন, পৌনে তিনটের
সময়ে। কি করে ম্যানেজ করে পনেরো মিনিট আগেই বেরিয়ে এসেছে। আমিও আমার বন্ধু, নটরঙ্গের
নাট্যকর্মী দেবাঞ্জনের কাছ থেকে নাটকের টিকিট সংগ্রহ করে,বুম-কে নিয়ে আসার জন্য তখন
বাসে। শরৎ বোস রোড থেকে, আকাদেমী – আমাদের সময়ে পৌঁছাতে হবে। বুমকে নিয়ে আবার ফিরতি বাসে। দেখতে
পাচ্ছি প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যালে বুম অত্যন্ত বিরক্ত হচ্ছে, দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে।
আমরা গেটে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেবাঞ্জন চিৎকার
করে বলল, “আরে কি গো, যাও…ভিতরে…শুরু হয়ে গিয়েছে তো।
নাটকের নাম
‘যদিদং’।। নাটক ও নির্দেশনা, সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয়ে, দেবশঙ্কর
হালদার ও সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয় মোটেও জটিল নয়। এক দম্পতি, তাঁরা ডিভোর্স চান।
উপযুক্ত কাউকে না পেয়ে, ডিভোর্স ল’ইয়ার ভেবে দেবশঙ্কর কে রাস্তা থেকে কিডন্যাপ করে নিজেদের বাড়িতে
নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন আসু সমাধানের জন্য।কিন্তু পাকচক্রে দেবশঙ্কর হলেন একাধারে ভণ্ড
উকিল এবং সাধুবাবা। কিন্তু খুব সাঙ্ঘাতিক রকমের মানবিক, ও বাস্তববাদী। দেবশঙ্করের
হাত ধরে, ‘মানুর মা’, অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী হয়ে ওঠেন এক জীবন্ত চরিত্র, যদিও স্টেজে,
এমনকি ব্যাকগ্রাঊন্ডেও ‘মানুর মা’-এর একটাও ডায়ালগ, উপস্থিতি ও অস্তিত্ব নেই। দম্পতিদের শত পার্থক্য থাকলেও, রাগে
মাথায় খুন চেপে গেলেও, দম্পতি-রা মন থেকে অবিচ্ছেদ্য-ই থেকে যান, অন্য কেউ-ই কোনোদিন সেই স্থান দখল করতে পারেন না। কাগজে কলমে যা-ই হোক
না কেন, টান মুছে যায় না, সে তা কেউ স্বীকার করুক বা না করুক -- নাটকের এই হল সার বক্তব্য, আপাদমস্তক কমেডির মোড়কে।
দেড় ঘন্টার স্ল্যাপস্টিক কমেডী। অসাধারণ ডায়ালগ, বিস্তৃতি ও বিন্যাসের বাঁধুনী। অসাধারণ অভিনয়। অট্টহাস্য ও হাততালি-তে সরগরম অডিয়েন্স অডিটোরিয়াম-কে করে তুলছে গমগমে। এমন
নাটক, মাত্র তিনটি চরিত্র নিয়ে যে হতে পারে, বুমের ধারণার-ও বাইরে ছিল। আর আমি
এমন হিলারিয়াস নাটক শেষ কবে দেখেছি, ভুলে গিয়েছি। কেনারাম বেচারাম দেখতে গিয়েছিলাম,
মনে সেভাবে দাগ কাটে নি। গরুর গাড়ির হেডলাইট-এর শো হাউসফুল হলেও, হেডলাইটের জোর স্তিমিত
হয়ে এসেছে। সবথেকে মন ভেঙ্গে গিয়েছে 'ভূশণ্ডির মাঠে' দেখতে গিয়ে। অনেকটা আশা, আমার, বুমের যে একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হবে। আশা এবং মোহ, দুই-ই ভঙ্গ। যাক গিয়ে, আমরা বরং 'যদিদং'-এ আসি। নাটকটিতে দু'-একটা জায়গা ছাড়া, অশ্লীলতা বা কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা কোথাও নেই। আসলে আদ্যোপান্ত কমেডি তৈরী করতে গেলে সারাক্ষণ সব জায়গায় একেবারে শুদ্ধ কমেডি পরিবেশন করা অসম্ভব। সেখানে নাট্যকার-কে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের রুচি-র নিচে নামতে হয়। তবে এই নামার একটা সুবিধা আছে। কোথাও সাধারণ মানুষের কাছে এই ধরণের কমিক ডায়ালগ বেশ গ্রহণযোগ্য এবং তা নাটককে পপুলার করে বৈ কি! আমি বলছি না, 'যদিদং' সে রকমের উপাদানে পূর্ণ। দু-এক জায়গায়, হয়ত ভাবলে আরো সমৃদ্ধ কিছু বেরিয়ে আসতে পারত, যেখানে সোহন এবং দেবশঙ্কর বাবুদের মত প্রতিভাবান, অভিজ্ঞ নাট্যকার ও অভিনেতারা রয়েছেন।
পুরো নাটকটা শেষ হওয়ার সময়ে শুধু নাটকের মেসেজ দেওয়ার জন্য আলাদা
করে যে মরাল ডায়ালগ রাখা হয়েছে, তা হঠাৎ-ই পরিষ্কার হরফে নেমে আসার ফলে নাটকে সারাক্ষন
ধরে চলে আসা কমেডি ধূলিসাৎ হয়ে যায় এবং এই মরাল প্রিচিং-এর মোড টা কোথাও যেন একটা দর্শকের
মেরিট-কে খেলো করে দেয় – যেন ও ভাবে না বোঝালে তাঁরা বুঝতেনই না।
মনে হতেই পারে বেশি খুঁতখুঁতে মানুষ হিসেবে এমন নাটকের দোষ-ত্রুটি
ধরতে বসেছি।
“কি একটা যেন থেকে
যাচ্ছে, দু’জনের মধ্যে, যেটাকে কিছুতেই ভাগ করা যাচ্ছে না”। -- এটাই নাটকের
মূল বার্তা।
আর সবথেকে
বড় যা থেকে গেল, নাটক শেষে, তা হল, কমেডির রেশ। কিছুতেই আলাদা করে তা ভাগ করা যাবে
না, নাটক-টা না দেখলে।
মন ভেঙ্গে গেল। দেবাঞ্জন-কে যখন বললাম, আর একবার নাটক-টা দেখার
ইচ্ছে রইল, দেবাঞ্জন আমাদের বলল, “কল শো ছাড়া, এটা আর ‘নটরঙ্গ’ স্টেজ করবে না, হয়ত"।
মন খারাপ লাগল বটে, খুবই। কিন্তু তখন-ও আর একটা নাটক দেখা বাকি।
আমাদের খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। সকাল ১১টার পর থেকে পেটে কোনো দানা-পানি পড়ে নি, বুম,
আমার – দু’জনেরই।

No comments:
Post a Comment