প্রবন্ধ:
আজকাল আমার একটা রোগ হয়েছে, বেশি জানা মানুষদের এড়িয়ে চলি, আর ক্ষমতাবানদের থেকে শত-হস্ত দূরে ৷
আগে ছিলাম ঠিক উল্টোটা -- আজ যাদের
থেকে দূরত্ব তৈরী করছি তাদের নিকটে আসার জন্য অনেক চেষ্টা,পরিকল্পনা, কষ্ট --সব করে হয়ত সামান্য কাছে এসে এমন কিছু শিখেছিলাম যা সারাজীবনের পাথেয় হয়ে
রয়ে গিয়েছে ৷ আর ক্ষমতাবান মানুষদের কাছ থেকে শিখেছিলাম বিনয়, ক্ষমতাহীন
মানুষদের কাছে কিভাবে তা বিন্দুমাত্র প্রদর্শন না করে তাদের কাছে টেনে এনে
ক্ষমতাবান করে তোলার শিক্ষা, যার মূলে আছে শিক্ষা ৷
এখন সময় বদলেছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ার
জের এতই তীব্র, ঝাঁঝালো ও দিশাহীন যে সময়ে সময়ে তা অসহিষ্ণুতার
উদ্রেক ঘটায়৷ ওখানে লিখতে লিখতে, বলতে বলতে,
দেখাতে দেখাতে, মানুষ এখন নিজের হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতা
সম্পর্কেও নির্লিপ্ত। Virtual World -এ lost…বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত...তাকে আবার আমরা self confidence নামে
অভিহিত করে থাকি। সেই আত্মম্ভরিতা এতটাই যে সোজা মিথ্যা বলতে ও প্রচার করতে বাধে
না৷ যেমন কালীপূজোর দিন জ্ঞানগর্ভ ফরওয়ার্ড করা পোস্ট পেলাম যে পৃথিবী কাঁপানো Rolling Stones এর লোগো - এক লাস্যময়ীর লোলুপ জিহ্বা (which is an obvious symbolic reflection of sensuous and
lustrous boisterousness) যার
সঙ্গে ত্রিসীমানায় অন্তত: শক্তির পবিত্র ভক্তিরসের কোনো যোগ নেই। এই অজানা চতুর্থ
মাত্রাটি মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়েছে।লক্ষণীয়, নিজের মস্তিষ্ক্প্রসূত ফ্রাশ্ট্রেশনের বানী একটা
পোস্টার বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। নীচে
লেখা থাকছে কোনো মহাপুরুষের নাম, ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের ছবি সমেত। সেসব আবার রক্তবীজের মত ছড়িযে পড়ছে। যারা
ছড়াচ্ছে, তাদের জীবনের একটাই লক্ষ্য যে তাদের সে
সব ভুয়ো পোস্টে কত লাইক হল! হাজার হাজার হয়! আর যারা ছ্ড়ায়, তারা মনে মনে ভাবে যে মানুষ কি রকম *ণ্ডু। তাই
আবার লেখে আবার ছ্ড়ায়। কারণ *ণ্ডু জনগণ তা-ই চেটেপুটে খায়, আর সোশ্যাল মিডিয়া-তে ঢেকুর তোলে। আটকানোর কেউ নেই তো! বিভিন্ন জায়গায়
বিভিন্ন স্থানে তারা শুধু আবর্জনার স্তূপ তৈরি করছে, যা
সমাজের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক। ফলে দিনের শেষে যাঁরা সত্যিই সৃষ্টি করতে
চান তাঁরা ওই পর্বত্প্রমাণ স্তুপের নিচে অনায়াসে চাপা পড়ে পিষ্ট হচ্ছেন। সারা দিন ধরে খারাপ কিছু দেখতে দেখতে মানুষের রুচি ও মূল্যবোধ দুই-ই ক্রমাগত
খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে -- নিম্নগামী।
সব থেকে মজার কথা হলো যে খারাপটা
বলতে বলতে, করতে করতে, এমন
জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে যে সে খারাপ থেকে পালাবার কোন পথ নেই। আরো
মজার কথা হলো এই যে খারাপটাই ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হয়। কারণ
যত খারাপ হবে, তত বেশি মানুষ দেখবে, শুনবে। খারাপের বিরুদ্ধে ভালোর অনুপাত চিরকালই কম। পৃথিবীতেযদি ১ লক্ষ মানুষ থাকেন তার মধ্যে মাত্র একশো জন ভালো বলে পৃথিবী
ভালোভাবে চলে। আজকে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সেই ভালো খারাপের
অনুপাত একলক্ষে একজনও কিনা সে সন্দেহের অবকাশ রেখে যায়। আসলে
সমস্যাটা আরো গভীরে। আমরা সমাজের যে স্তরে বাস করি আমাদের
পারিপার্শ্বিক মানুষগুলোকেও সেই একই স্তরে বলে ভেবে নিই। যেমন একজন শিক্ষিত মানুষ
তিনি কি আশা করবেন? - যে তাঁর পারিপার্শ্বিক সমস্ত মানুষ,তাঁরাও শিক্ষিতই হবেন। কিটি পার্টিতে শুনলে তাঁরা অবাক হয়ে যান যে ভারতবর্ষের
প্রায় এক্শো পঞ্চাশ কোটি জনগনের মধ্যে এখনো মাত্র ষাট শতাংশ স্বাক্ষর। তাঁরা কবাব-প্ল্যাটার বা সিঙ্গল মল্টে আলোচনা করে অবাক হন যে ভারতবর্ষের ৮০
থেকে ৮৫ শতাংশ মানুষ এখনো সরকারি হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল,আর ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ মানুষ এখনো পর্যন্ত সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। নিজেদের বেশিরভাগ-ই কিন্তু ওই সরকরী ব্যবস্থায় মানুষ হয়েছেন।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে আমাদের দেশ
এখনো একশো বছরের স্বাধীনতা ও পার করেনি, কিন্তু পৃথিবীর
বৃহত্তম সেকেন্ডারী স্টেট বোর্ড এজুখেশনের মাথা, যিনি
গত চোদ্দ বছর ধরে সমস্ত মাধ্যমিক মার্কস শিট আর সার্টিফিকেটে সই করে আসছেন,তিনি বর্তমানে জেলবন্দী।
ভেঙেচুরে তছনছ করে যে
অবস্থার সম্মুখে সময় আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তাতে অরুণ
মুখোপাধ্যায়ের মারীচ সংবাদের একটা ডায়লগ মনে পড়ে যায়,
n
গণতন্ত্র
কি, ওওও
গণতান্ত্রিক দেশের মানুষ বেশ ভালই বোঝে....
সোশ্যাল মিডিয়া
নিশ্চিত ভাবে এক গণতান্ত্রিক মাধ্যম বটে কিন্তু তার হাত ধরে মানুষ যে স্তরে নামতে
শিখে যায় বা শিখছে তার দায় কার?
মূল্যবোধ সমাজবদ্ধ মানব জীবনের পক্ষে
খুবই মূল্যবান। কিন্তু বিষয়টি যখন সোশ্যাল মিডিয়ার
ক্ষেত্রে উঠে আসে তখন সে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন সমাজ এবং তার মূল্যবোধ ও ভিন্ন।কিন্তু সেই ভিন্ন সমজের ভিন্ন
মূল্যবোধ সম্পর্কে সম্পর্কে ধারণা বেশির্ভাগ মানুষের -ই নেই। এই নেট
দুনিয়ায় মূল্যবোধের ব্যুত্পত্তি ঘটাতে হলে মানুষকে আরো অনেক সংযত হতে হবে। সোশ্যাল
মিডিয়াকে ঠিক ভাবে হ্যান্ডেল করার জন্য পরিণত শিক্ষার দরকার । সোশ্যাল মিডিয়াতে আলাদা করে মূল্যবোধ গঠন করা এবং সেখানে প্রত্যেক নাগরিকের
সেই মূল্যবোধকে আত্মস্থ করা -- কঠিন। কিন্তু করতেই হবে, আজ না হয় কাল। তবেই ভবিষ্যতের আমরা একটি সুস্থ উন্নততর সমাজ জীবনকে দেখতে পাবো, কারণ আজকের বাস্তব সমাজ জীবনের বেশ খানিকটা সোশ্যাল মিডিয়া নিয়্ন্ত্রণ করে। organized mediain print and
audio visual are mostly in ahands of the competent and very responsible and
wise people. কিন্তু আজকের সোশ্যাল মিডিয়া কারোর ধার ধারে না। সোশ্যাল মিডিয়া আমদের প্রত্যেকের জীবনে একটি
বড় অংশ অধিকার করে ফেলেছে, আমাদের বেশ অজান্তেই। আর সেখানে কারো কোনো দায়িত্ব নেই যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের ঈশ্বর! পরম!
চরম! আমদের সবার মনসিক ভাবে ভাল বা খারাপ থাকার কারণ ঐ সোশ্যাল মিডিয়া!
আমি সেই জন্য সমাজ মাধ্যমে থেকে দেখতে
থাকি বোঝার চেষ্টা করতে থাকি,যা কিছু আসে,ঘটে।
নিজে যে ব্যবহার করি না তা নয়। নিজে যা
কিছু তৈরি করার চেষ্টা করি, অন্তর থেকে, সেগুলো শেয়ার করতে থাকি। কারণ সমাজে থাকতে গেলে, সমাজ কে জানাটা খুবই জরুরী। সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে কিন্তু বাঁচা
যায় না। আবার আমি সেখানে মরাল পুলিশিং-ও করতে পারি না, কারণ, সেটা মানছে কে আর শুনছে কে! যে যার
জায়্গায় অনড়। আমরা দেখতেই পাচ্ছি কেউ যদি ন্যায্য কথা বলেন, তার বিরুদ্ধেও বিদ্বেষের এবং বিদ্বেষীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়! এমনকি কোন সেন্সিটিভ
কথা ভাইরাল হলে প্রাণ-সংশয় পর্যন্ত হতে পারে। কারোর
কোন কিছুকে যদি সততার সাথে খারাপ বলি, বলি যে আমার পছন্দ
হয়নি, আর তাতেই হয়্ত দেখা গেল্, আমার বিপরীতে কয়েক হাজার লাইক পড়েছে। এর ফলে খুব খারাপ
সৃষ্টি করা একজন মানুষ ভেবে বসেন যে,“আরে এত মানুষ যখন ভালো বলছে, এ ব্যাটা কে রে যে আমাকে খারাপ বলার হিম্মত দেখাচ্ছে!” উল্টে আমিই ট্রলড হতে থাকি। এখানে ক্ষমতা দেখিয়ে পেশি ফোলানো খুব সহজ, কারণ, রাস্তায় নেমে মারপিঠ করতে হয় না। তাই যে যত
খারাপ কথা বলতে পারবে তার জয় হবে। ঈলন মাস্ক যে মাইক্রো ব্ল্গার ট্যুঈটার্-কে “এক্স্” নামে ভূষিত করলেন্, তার কারণ বোধ করি প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন এক্স-রেটেড পোস্টের জের। আর রইল পড়ে
ব্যাঙের আধুলী আমাদের প্রাথমিক গণতান্ত্রিক অধিকারের বলে নিজের নিরাপত্তা। সারা শহরে সাইবার পুলিশ স্টেশন আছে মাত্র একটি যেখানকার কর্মী-অফিসারদের
বেশিরভাগই সাইবার ক্রাইম কাকে বলে বললে বলবে, বিভিন্ন
সাইটে অফেন্সিভ ছবি পোস্ট আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি যাওয়া
(দ্বিতীয়্টায় শুধু কেস হয়্, কোনোদিন কেউ ফিরত পেয়েছে বলে শোনা যায় নি, আর পঞ্চাশ হাজারের কম চুরি গেলে কেউ সেভাবে পাত্তাও দেয় না) আর সাইবার
ক্রিমিনাল ল’য়্যর কতজন আছেন তা গুনতে গেলে হাতের একটা
আঙুলের চারটে কর-ও লাগবে বলে মনে হয় না।
তাই সচেতন হয়ে গিয়েছি জ্ঞানী
ব্যক্তিদের আজকাল ভয়ই পাই কারণ আজ সবাই জ্ঞানী। তাদের বেশিরভাগের
কাছ থেকে শেখার কিছু না থাকলেও অযাচিত অপমানটুকু পাওনা হয়ে যায়।
তাই ভয় পাই বলতে, যে,“হে কল্কি! তুমি এসো বা না এস, এতটা
গাঁটের কড়ি খরচা করে এমন ‘দশমঅব্তার’ আমাদের দেখিও না!”

No comments:
Post a Comment