Friday, 19 January 2024

দুদ্ধর্ষ দুবাই: দশম পর্ব: মলে-বাজারে

আমরা তখন বেলুড়ে থাকতাম। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, বেলুড় হাই স্কুলে। সাতাশি সাল। বাবার পা মচকে গিয়ে গোড়ালীতে একটা ক্র্যাক। ডাক্তার বললেন একদম শয্যাশায়ী থাকতে হবে, আগামী দু সপ্তাহ। পায়ে প্লাস্টার হল। বাবার স্কুল সালকিয়াতে। বেলুড় থেকে সালকিয়া - বাবাকে স্কুলে যাওয়ার সময় বাসে ঝোলাঝুলি করে যেতে হত। সুতরাং যাঁকে শয্যাশায়ী থাকতে হবে বলে ডাক্তার প্রেসক্রাইব করেছেন, তিনি আর যাই হোক বাড়ি থেকে বাইরে বের হতে পারবেন না, সেটা নিশ্চিত। এখনকার সময় দাঁড়িয়ে সমস্যাটা বেশ ক্ষুদ্র এবং হাস্যকর মনে হলেও সেই আশির দশকে সমস্যাটা বেশ গভীর ও গম্ভীর ছিল। কথায় কথায় ঊবর তো দূর, ট্যাক্সি বা ভাড়ার গাড়ির চল ছিল না। আর থাকলেও, আমাদের সেই অর্থনৈতিক সামর্থ ছিল না।

এমনিতেই ছোটবেলা থেকে নানা রকম পারিবারিক সমস্যার জেরে আমার বড় হওয়ার মানসিকতাটা একটু ছোট থেকেই শুরু হয়েছিল বটে। তবে অনেক দূর থেকে শুধু খাবার জল ভরে বয়ে আনা আর সকালবেলা রোজ দায়িত্ব নিয়ে দোকান বাজার করার মধ্যে ফারাক ছিল বৈ কি। আমার টেম্পোরারী প্রোমোশন হল। রোজের বাজার ও মুদিখানা -- সবটাই আমার হাতে এসে পড়ল।

আমি প্রথম বাজারে গেলাম। না ভুল বললাম আমি প্রথম একা বাজারে গেলাম। তার আগে বাবার সাথে মাঝেমধ্যেই বাজারে যেতাম। শিখতাম। কিভাবে দর করতে হয়, পয়সা ফেরত দেওয়ার সময় কিভাবে হিসেব করতে হয়, যোগ বিয়োগের সহজ পদ্ধতি, নামতার প্রয়োগ -- এ সমস্ত ওই বাজার থেকেই শেখা।  কোন ডাক্তারের বা শিক্ষকের আমাদের সমাজের কি কি বিরাট সম্মান তা আমি বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়ে বুঝতে পারতাম। 


সমস্ত সমস্ত শিশু-কিশোররাই মনে মনে চায় বড় হয়ে তারা তাদের বাবা-মা মায়ের মত হবে। আজকাল আমরা ও-টি-টি তে হামেশাই যে রকম পিতা-মাতা-সন্তান জটিলতা দেখি, তার সাথে আমাদের সময়ে ব্যাপারটা আলাদা রকমের ছিল।  সন্তানরা তাদের বাবা বা মা মায়ের প্রতি এরকম মনে মনে ঘেন্না পুষে রেখে ঘুরে বেড়াত না। আর তারা বাবা-মা বা গুরুজনদের সাথে কথায় কথায় ওরকম কিলোদরে ইংরেজী 'ফ'-যুক্ত শব্দ ব্যবহার করত না। রাগ কি হত না? আলবাৎ হত! সে রাগ থাকলেও তা গভীর হওয়ার আগেই বাবা-মায়ের স্নেহের স্রোতে,  ভালোবাসার টানে কোথায় যেন তলিয়ে উধাও হয়ে যেত। রাগ পুষে রাখার সুযোগ হত না। সারা জীবন ধরে পিতৃ বা মাতৃঘৃণার জের বয়ে নিয়ে চলার দায় ছিল না। 


আমাদের বাবা মায়েরা যেভাবে আমাদের প্রজন্মকে বড় করেছেন তার থেকে সময় অনেকটাই বদলে গেছে বলে আমাদের অনেক কিছুর সাথেই আজকালকার সময়ের সাথে মিল খোঁজাটা বাতুলতা বৈ আর কিছু নয়। তবে কিছু কিছু বিষয় সত্যিই মেনে নিতে বেশ কষ্ট হয়, যখন দেখি মূল্যবোধের এক বিরাট দেওয়াল দুটো প্রজন্মের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে | সেই দেয়ালের এপার এবং ওপারে ভালো-খারাপের নিক্তিটা সামাজিকভাবে খুবই আপেক্ষিক।

সেই প্রথম যে একা বাজারে যাওয়া শুরু করলাম তারপর থেকে বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও মাঝেমধ্যেই বায়না করে বাজারে যেতাম। ভালো লাগতো যেতে | ওই যে বললাম নিজের মধ্যে একটা প্রাপ্তবয়স্ক -মনস্কতা কাজ করতো, বাজার গেলেই। দায়িত্ব যেমন অনেকেই নিতে চায় না। ঠিক উল্টোদিকে আমি বোধহয় দায়িত্বটা নিতে চাইতাম | কারণ বুঝেছিলাম যে বাজার দোকান করার মধ্যেই বড় হওয়ার আসল রহস্যটা লুকিয়ে আছে।


বেলুড় বাজারে কি আর এমন পাওয়া যাবে! অন্য দশটা বাজারের মতো - মাছ মাংস সবজি মুদিখানা মুড়ি বাতাসা চানাচুর - এইসব নিয়েই আমাদের বেলুড় বাজার।  সেই বাজারে সব ছোট ছোট ব্যবসায়ী। যে যার ক্ষেতের জিনিস নিয়ে এসেছে বা নিজেদের পুকুর থেকে মাছ | চালানি বরফের মাছের চল খুব একটা ছিল না। সবই জ্যান্ত মাছের কারবার | চালানি বরফের  মাছ শুধুমাত্র নিমন্ত্রণ বাড়িতেই হত।  খানিকটা বড় মাছ নিলে কয়েকটা পমফ্রেট, অল্প চিংড়ি কাঁকড়া মৌরলা পুঁটি এসব আমরা অল্প হলেও ফ্রি-তে ই কপালে জুটত |


কোনো দোকানদারকে আজকালকার মত নিক্তি মেপে ওজন করতে বা বেশি দাম চাইতে দেখি নি।  এখন দুটো লঙ্কা কোন সবজিওয়ালা প্রাণ ভরে নিজের থেকে দেয় না, বাগিয়ে নিতে হয়। একসময়ে যে জিনিসগুলো আমরা বাজারে  উদ্বৃত্ত হিসেবে পড়ে থাকতে দেখেছি এবং যে সব দোকানদারেরা আমাদের বিনামূল্যে দিতেন, সে সব আজ অগ্নিমূল্য |  


দরের দিক থেকে সে উন্মুক্ত বাজারে আমরা  আজ আন্তর্জাতিক|  আর বাকি সব ক্ষেত্রেই আমরা একটুও যে এগোইনি তা অরিন্দম চৈতালিদের বর্তমান কর্মস্থল ও বাসস্থান দুবাই এর বাজারে গিয়ে বুঝতে পারলাম।

দুবাইয়ের শপিং মলগুলির সবক'টিই দর্শনীয় স্থান এবং সেইসব বাজারের প্রত্যেকটির র‍্যাঙ্কিং রয়েছে |  বাজারের কোয়ালিটি ও র‍্যাঙ্ক অনুযায়ী একই জিনিসের দাম সেগুলিতে বেশি বা কম হয়। তবে এইটুকুই বলা যায় ওখানে আলাদা করে দোকান বলে কোনো বস্তু খুব একটা চোখে পড়ে না। সব থেকে ছোট দোকানও একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। হাইপার মার্কেট হলে তো কথাই নেই! সেখানে নেই, এমন কোন জিনিস নেই | আমার ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি কলকাতার নিউ মার্কেট নাকি পৃথিবী--বিখ্যাত একটি মার্কেট; চাইলে সেখানে বাঘের গোঁফের লোমও পাওয়া যেতে পারে। দুবাইয়ের হাইপার মার্কেট গুলো অনেকটা সেরকম, কি নেই সেখানে !


অরিন্দম প্রথমে একদিন আমাকে ফাঁকতালে একটা লোকাল মার্কেটে নিয়ে গিয়েছিল, এটিএম থেকে টাকা তুলতে। সেই মার্কেটই এমন চটকদার যে তা বলে বোঝানো যাবে না। অরিন্দম আমাকে বলেছিল

এ কি দেখছিস? চল, তোকে একদিন লুলু মার্কেটে ঘুরিয়ে নিয়ে আসব | 

লুলু মার্কেট -- নামটাই কেমন একটা 'লোলুপ' লোভের উদ্রেক ঘটায়, অবচেতনে।  গত কয়েক দিনে লুলু মার্কেটের পাশ দিয়ে অনেকবার যাতায়াত করেছি। মাথার  ওপরের ছাউনিটা অনেকটা এরোপ্লেনের মতো তার পেটের ভেতরে কি আছে সেটা দেখার জন্য উৎসাহ বেড়েই চলেছিল। 

পরের দিন যেদিন আমাদের বিশেষ কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ছিল না। সেদিন আমাদের গন্তব্য হলো লুলু মার্কেট।


লুলু মার্কেটে গিয়ে তো চক্ষু পুরো চড়কগাছ। কি বিশাল রে ভাই! কি সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার! যে ভাবে মাছ-মাংস সবজি-পাতি বিক্রি হচ্ছে, তা আমি জীবনে কোনদিন দেখিনি। তরমুজের  যে  ওরকম সাইজ হতে পারে তা শুধুমাত্র ছোট বেলায় অমর-চিত্র-কথা সিরিজে জাতকের গল্পে ছবিতে দেখেছিলাম। ডাব কেটে তার মুখে স্ট্র লাগিয়ে সেই অবস্থায় রীতিমতো সিল ও প্যাকেজিং করে বিক্রি করা যায় সেটাও প্রথম দেখলাম |

ইংরেজিতে দুটো ব্যাপারের পার্থক্য আমার মাথায় আজও ঢোকেনি:  

একটা হচ্ছে ‘ম্যাল’ আর ‘মল’ (ইংরেজী বানান দুটি ক্ষেত্রেই ‘mall’) – এদের পার্থক্য কি! আর দ্বিতীয় হচ্ছে লাইন আর লেমন এই দুটোরই বা পার্থক্য কি! কোনো সহৃদয় ব্যক্তি এই বিষয়ে জ্ঞাত থাকলে আমাকে জানাবেন প্লিজ | কথাটা এইজন্য মাথায় এলো যে হচ্ছে আমি একটি শপিংমলে লাইম আর লেমনের পাহাড়ের  সামনে দাঁড়িয়ে কনফিউজড হয়ে যাচ্ছিলাম |  কারণ শপিং মল বলতে আমার সর্বোচ্চ দৌড় পার্ক সার্কাসের Quest Mall.

মাছ মাংস কাটাকাটির কথায় যাচ্ছি না। অভিনব ব্যবস্থা। তবে সেই সমস্ত মাছের ভান্ডারে আমাদের সামনে একটা আড়াই ফুটের হাঙর যেভাবে মৃত অবস্থাতেও আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল তাতে আমার খুব ছোটবেলায় দেখা বিখ্যাত ইংরেজি সিনেমা Jaws এর পোষ্টারের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল | আর মাংস-র যে কত রকমারী তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। মোরগ বা পাঁঠার অ্যানাটমী সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা তৈরী করার জন্য যথেষ্ট। ওদের শরীরের অত্গুলো অংশ যে আছে আর সে সব যে আমরা খাই, তা এতদিন না জেনেই যে খেয়ে এসেছি, তা স্পষ্ট হল। 


প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কেনার ছিল ঠিকই | সেসবের বাইরে আমরা আবার এই মার্কেটে আসার সময় পাবো কিনা সেটা বুঝতে পারছিলাম না | তাই খেজুরের বিপুল ভান্ডার থেকে বিভিন্ন রকমের খেজুর কিনে নেওয়া হল |  আর কেনা হলো ওই দেশের স্পেশাল মিষ্টি 'বাখলাভা' | 

অরিন্দম যতদিন দেশে ছিল ততদিন যতবারই আমরা একসাথে বাজারে গিয়েছি, ততবারই আমরা একসাথে লাঞ্চ বা ডিনার বা দুটোই করেছি, সে আমাদের কারোর বাড়িতেই হোক বা কোন রেস্তোরাঁয়। ওখানে, মানে বিদেশে ওদের বাড়িটা এত সুন্দর যে আমাদের আর রেস্তোরাঁয় বসে কিছু খাওয়ার ইচ্ছেই হল না | আমাদেরকে চয়েস দেওয়া হয়েছিল কিন্তু আমরা সবাই বললাম, বাড়িতে বসে হাত-পা ছড়িয়ে গল্প করতে করতে টিভি দেখতে দেখতে আমরা একসাথে ডিনারের মজাই আলাদা। এখন, ডিনারে কি খাওয়া হবে - ওখানকার একটা স্পেশালিটি আর সেটা নাকি আবার আমার নেমসেক! -- 'আরিয়াস' |  সে কি বস্তু আমরা আর জিজ্ঞাসা করলাম না, কারণ এমন এক মহান খাদ্য সম্পর্কে যদি আগে থেকে জেনে ফেলি যে কি জিনিস তাহলে তার রহস্যটাই মাটি |  তারপর টেবিল ভর্তি করে যখন খাবার সাজানো হল তখন দেখলাম আরিয়াস হল আমাদের এখানকার ফুল লোডেড মোগলাই পরোটারই আরেক জাতভাই |  অনুষঙ্গে ছিল অনেক রকমের চাটনি এবং সস | বহু প্রকারের কাবাব আর ছিল ওখানকার স্পেশালিটি চর্বি গলিয়ে তৈরি করা 'হামাস'। আর সঙ্গে স্প্রাইট মিশ্রিত সেই বিখ্যাত ড্রিংক– লাবান |


এটা জাস্ট পাঠকদের একটা ধারনা দেওয়ার জন্য বলা |  কিন্তু এই যে আমি বর্ণ্নাটা দিচ্ছি, আমি কিন্তু সত্যিই আরিয়াস নামক খাবারটিকে মিস করছি | 

মনে পড়ে গেল আবার,  ছোটবেলার কথা | বছরে একবার শুধু পুজোর বাজার করতে যাওয়ার সময় আমাদের রেস্তোরাঁতে খাওয়ার সুযোগ হতো। সেই উত্তেজনাটাই অকল্পনীয় |  খাবার এমন কিছু নয়, পারিজাত সিনেমার ঠিক আগে, সুইমিং পুলের গায়ে একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্ট - স্টার | অসাধারণ ফিস-ফ্রাই তৈরি করত |  তার সাথে থাকতো এক অদ্ভুত সুস্বাদু কাসুন্দি আর কুচো মিক্সড স্যালাড | তার জন্য যে আনন্দ তৈরী হত মনের মধ্যে, সে বড় মধুর।


ভবিষ্যতে বড় হওয়ার সাথে সাথে অনেকবার অনেক জায়গায় বাজার করলাম |  অনেক ঘুরলাম | অনেক খেলাম | কিন্তু স্টার রেস্তোরাঁতে ওই ফিস ফ্রাইয়ের স্বাদ আজ পর্যন্ত এক অনির্বচনীয় মহিমায় উদ্ভাসিত | পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফিস ফ্রাই দিলেও ওটার কাছাকাছি হবে বলে এই জীবনে আর মনে হয় না |  ঠিক সেই রকম ভাবেই এই জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ পরোটাও ওই অরিন্দম চৈতালির খাওয়ানো আরিয়াসের স্মৃতিতেই আজীবন আলিঙ্গন করে থাকবে |  এরপর আর যে যতই পরোটা খাওয়াক না কেন, আরিয়াসকে ছাপিয়ে কোন পরোটার স্মৃতি আর মনের মধ্যে এরকম চিরকালীন দাগ রেখে যাবে না।

ভেবেই জিভের গোড়াটা কেমন সুড়সুড় করছে |  দুধের স্বাদ আপাতত ঘোলেই  মেটাই | আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই এক দাদা বৌদি খুব যত্ন করে চিকেন মোগলাই পরোটা বানিয়ে দেন।  ওনাদের সেভাবে নাম ডাক নেই। তবে হলফ করে বলতে পারি যে বর্তমানে ধর্মতলার বিখ্যাত অনাদি কেবিন যা মোগলাই বানায় তাকে দাদা-বৌদি যে কোনো দিন যে কোনো সময়ে দাঁড়িযে দাঁড়িয়ে পাঁচ গোল দিয়ে দেবে। 

তাই এখন দাদা বৌদির মোগলাই-ই আমার স্বপ্নের নেমসেক খাদ্যাভিরুচি মেটাক!

কিন্তু যেটা অনেক চেষ্টা করেও এখন পাব না, তা হল সেদিনের খাওয়ার শেষে মিষ্টিমুখে ছোটুর নিজে হাতে বানানো চিজ-কেক। সেটা কেমন ছিল, তা বর্ণনা করার মত ভাষার ওপর দখল আমার নেই। 

(চলবে)


No comments: