(একটি মিথ্যা ঘটনা অবলম্বনে)
ইব্রাহিম সেদিন সকালবেলায় নিজের দোকানের তেরপলের খুঁটগুলো লগার মাথায় আটকে ছাউনি করে দোকান দেওয়ার আগে ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চারপাশে দেখার চেষ্টা করল যে কেউ আছে কিনা আশেপাশে। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। কি যেন মনের মধ্যে একটা খোঁচা!
না না! এর মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পুলিশি অত্যাচার, পাড়ায় মারপিট, বা অন্য যে কোন রকমের বাজার চলতি সমস্যার কোন সম্পর্ক নেই। কারণ হলো গত সপ্তাহে রোববারে কাজলবাবুর সাথে এক হাত ঝগড়া। কি নিয়ে ? না, কচি পাঁঠার নলি নিয়ে ৷
ইব্রাহিম শান্তিপ্রিয় লোক ৷ প্রতি রবিবার ওই কচি পাঁঠার দোকানটা সকালবেলা খুলে বসে। আজ বলে নয়, বহু বছর আগে থেকেই ৷ রেওয়াজি নয়, কচি পাঁঠার মাংসের দোকান। ঐ কচি পাঁঠার জন্য ইব্রাহিমের বেশ নাম-ডাক আছে, এই অঞ্চলে। প্রত্যেক রবিবার একটা লম্বা লাইন পড়ে যায় বেশ ভোর থেকে। আজ পর্যন্ত ইব্রাহিম চাহিদা অনুযায়ী যোগান দিতে পারে নি। সকাল ন'টা-সাড়ে ন'টার পরে খদ্দের ফিরিয়ে দিতে হয়। ইব্রাহিম তাতেই খুশি। কোনদিন চায়নি যে সে কচি পাঁঠা বিক্রি করে বিরাট বড়লোক হবে।
ইদানিং ইব্রাহিম পড়েছে এক নতুন বিপদে। মাস দুয়েক হল এক ভদ্রলোক তার দোকানে বেশ উৎপাত শুরু করেছেন।প্রত্যেক রবিবার উনি আসেন। প্রায় আড়াই-তিন কেজি মাংস নেন। তাতে ইব্রাহিমের আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তি হল যে ওনার ওই আড়াই-তিন কেজির সমস্তটাই কচি পাঁঠার সামনের রানের নলির অংশ হতে হবে।এতো আচ্ছা ঝামেলা! এখন যদি একটা লোককেই ইব্রাহিম আড়াই তিন কেজি মাংস শুধুমাত্র সামনের রানের নলি থেকে দিয়ে দেয়, তাহলে বাকি খদ্দেররা আর কি পাবে। ইব্রাহিম খদ্দেরদের সবাইকে বেশ তুষ্ট করে চলতে অভ্যস্ত। খানিকটা সামনের রান, দু-এক পিস নলি, খানিকটা গর্দান, খানিকটা পাঁজর, একটু মেটে -- সব মিলিয়ে মিশিয়ে দিব্বি সবাইকে দেয় ৷ সেই নিয়ে কেউ কোনোদিন কোনো অভিযোগও করে নি। উল্টে কদাচিৎ কেউ কোনো বিশেষ অংশের মাংস অনুপাতে বেশি চাইলে তাঁকে অত্যন্ত বিনীত ভাবে ক্ষান্ত করেছে -
- যা দিচ্চি বাবু আবনি শুদু লিয়ে যান। পুরো মালাই চমচম আছে - মুখে দিবেন কি, আর দাঁত লাগবে না... গলে সোজ্জা পেটে চলে যাবে... মালুম ও পাবেন না। আর খরাব হলে নেকস্ট টাইম পয়সা লিব না।
সত্যিই ইব্রাহিমকে কোনোদিন একবারের জন্যও আজ পর্যন্ত কাউকে পয়সা ফিরৎ দিতে হয় নি। ইব্রাহিম যা দেয়, সবাই হাসিমুখে বাড়ি নিয়ে যায়। ওর থেকে মাংস নিয়ে কয়েক দশক যাবত সবাই খুব তুষ্ট। বাড়ির অতিথিদের গর্ব করে অনেকে বলেন,
- খেয়ে দেখ, আমাদের ইব্রাহিমের কচি পাঁঠা! একবার খেলে মুখে লেগে থাকবে, আজীবন্!
সে হেন ইব্রাহিমের এ কি দুর্গতি!
কাজল ঠাকুর, ওনার নাম ৷ ইব্রাহিম জেনেছে ৷ মাস দুয়েক হল ঝিলপারের তেরো তলায় ফ্ল্যাট কিনে এসেছেন ৷ এসেই বিরাট খাদ্যরসিক হিসেবে এলাকায় (বদ) নাম কুড়িয়েছেন ৷ পেটের হজমশক্তির মত এই সব কুকথা তিনি নিমেষে হজম করার ক্ষমতা রাখেন। আর এই হৃদয় এবং পাচনক্ষমতাকে উনি নিজে সর্বসমক্ষে "স্পোর্টসম্যান স্পিরিট" হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। কথিত আছে কোনো নেমন্তন্ন বাড়িতে ওনার মত আর এক জনেরও এমন 'স্পোর্টসম্যান -স্পিরিট' থাকলে, কেটারার-কে আর লাভের মুখ দেখতে হবে না। ইব্রাহিম খবর পেয়েছে শেষবার কোথায় একটা বেড়াতে গিয়ে এমন রাজকীয় আহার কাজলবাবু করেছেন যে সেই হোটেলের ম্যানেজমেন্ট শেষে ওই ট্যুরের কর্মকর্তাদের ডেকে রোজের খাবারের প্রি-ফিক্সড কোটেশন-রেট বদলাতে বাধ্য হয়েছেন।
সে হেন কাজলবাবু ইব্রাহিমকে থোড়াই কেয়ার করবেন।
তবে ফি-হপ্তা সামনের রানের নলি নিয়ে কথা কাটাকাটি শেষ রবিবারে অকারণে প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছল ৷
কাজলবাবু ইব্রাহিম দোকান খুলতেই বললেন,
- দেখ, আজ আমি সবার আগে এসেছি। আমি পাঁঠার যেটা যেটা চাইব তুই দিবি।
- কাজুল সাব , আবনি হর রোজ কেনো এরকম বুলেন - এটা পাসিবল না আছে ৷ সমঝা করুন৷
- কি সমঝাবো বাবা...! আমার লাইন আগে আর আমি তো এক পয়সাও সস্তায় চাইছি না। পুরো ক্যাশে পেমেন্ট ৷ তা তুই দিবি না কেন, নলি?
পিছন থেকে জিমে যাওয়া ঔরঙ্গজেব দাড়ি ওয়ালা একটি তিরিশ বছরের ছেলে প্রায় বচ্চনের মত ব্যারিটোনে টিটকিরি করে বলল -
- কাকু আপনি এক কাজ করুন ৷ গোটা পাঁঠাটাই নিয়ে চলে যান ৷ দেখবেন সবটা থেকেই শুধু নলি বেরোবে ৷
- তুমি কে হে ছোকরা ?
- আমি ? কাষ্টমার ৷ ওই দূরে যে কচিটা ঝুলছে, ওটার সামনের বাঁ দিকের রান ও গর্দান দুটোই আমার ৷
- ধুরঃ পাগলা! আমি সেই ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে লাইনে দাঁডিয়ে! আমি তোমার আগে আছি ৷ তুমি পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওগুলো আমার ব্যাগেই ঢুকে যাবে ৷
- তাই নাকি? আমি তো কাল সন্দেবেলা থেকে এই ইঁটটা পেতে গেছি, দেখেন নি?
- ওসব বাজে ফাজলামো আমার সঙ্গে কোরো না হে ছোকরা! ফল ভাল হবে না।
- কেন কি করবেন?
- কি করব দেখবে?
- হ্যাঁ...নিশ্চয়ই দেখব...
- দেখবে?
- আরে দাদা, দেখান না কি দেখাবেন...
সোজা ইব্রাহিমের দিকে ঘুরে গিয়ে বললেন
- ইব্রাহিম, যতগুলো পাঁঠা ঝুলছে, তার সব ক'টার সামনের রানগুলো আমার...কেটে নামাও...
লোকটিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন৷ তিনি ততোধিক রেগে বললেন,
- ইব্রাহিম দা, ওনাকে একটার সামনের রান তুমি অলরেডি দিয়েছ, আর যদি লাগে, লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়াতে বল।
এ কথাটা সবার বেশ পছন্দ হলেও, কাজল-বাবুর মোটেও পছন্দ হল না, কারণ উনি ভাল করেই জানেন যে, লাইনের শেষে দাঁড়ানো মানে খালি হাতেও ফিরত যেতে হতে পারে। তাই বললেন
- ইব্রাহিম, আমি লাইনে আগে আছি, যা বলছি তাই কর!
- দেখেন বাবু, আবনি একটু সমঝা করুন, এ রোকোম বায়না করলে আমি সব কাস্টমার-কে দেখব কি করে!
- এটা বায়না নয় ৷ আমার অধিকার ৷ আমি ও কাস্টমার...না আমি বিনি পয়সায় কিনছি , না আমি লাইন ভেঙেছি !!
- বাত পয়সা আউর অধিকার কি নহি হ্যায়। ওসুল ভি এক চিজ হোতি হ্যায়, যো কি আপকা সমঝ কে বাহার হ্যায় ৷
- কি বললি !!!! আমার সমঝকে বাহার?... দেখাচ্ছি মজা...সমঝে দিচ্ছি আমি তোকে...
এই বলেই ছুটে গিয়ে সোজা চপারটা হাতে তুলে নিয়ে তাড়া করলেন ইব্রাহিমকে ৷ কাজলবাবুর চোখে তখন খুন চেপে গিয়েছে ৷ শ্রীমান পৃথ্বিরাজ সিনেমায় উৎপল দত্তর উত্তেজিত চোখে রক্ত জমাট বাঁধলে যেমন দেখায়, তেমন তেজস্বী দেখাচ্ছিল ওনাকে।
পাগল ভেবে কি করে বসেন এই ভয়ে লাইনও এক নিমেষে ফাঁকা ৷ তবে কাজলবাবু একলাফে সেই বীরপুরুষের সামনে ৷ সে সবে পাশে রাখা বাইকে চড়ে পালাতে যাবে, কাজলবাবু সাঁ করে চাবিটা বাইকের কি-হোল থেকে খুলে নিয়ে নিজের পকেটে ৷ তারপর কবাডি খেলার মত সামনে দাঁড়িয়ে চপার হাতে বলতে থাকলেন,
- আয় তবে সম্মুখ সমরে!!!!
- দাদা কাজটা কিন্তু ঠিক করছেন না.....
- তোর গর্দান কেটে নিলে তখন কি ঠিক আর কি ভুল, হা হা হা হা!!!!
- আমি পুলিশ ডাকব...
- ডাক... পুলিশ যেন কচিপাঁঠা খায় না!!!
- কি যে বলছেন, আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে...আরে ও দাদা... চপার টা ওভাবে ঘোরাবেন না... খুব ধার কিন্তু... আপনার নিজেরই ক্ষতি হতে পারে...
- মামাদোবাজির জায়গা পাওনি? আমারই ক্ষতি হবে, নাকি? ভীতু ডরপোক আরশোলা টিকটিকি...
বলে কাজলবাবু পুরো ক্যাপ্টেন হ্যাডক স্টাইলে ছুটে আক্রমণ করতে গেলেন ঔরঙ্গজেবকে ৷ সে বাইক থেকে নেমে সটান দৌড় ৷
লোকটিকে ধাওয়া করতে করতে কাজলবাবু নিজেই হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে সামনের দিকে পড়লেন ৷ চপারটা ছিটকে রাস্তার মাঝখানে ৷ ইব্রাহিম দেখল এই সুযোগ ৷ সোজা গিয়ে চপারটা তুলে নিয়ে পোঁপাঁ দৌড়! খুন খারাপির থেকে অন্তত: বাঁচল, ব্যাপারটা।
কাজলবাবুও উঠে হাত-পা ঝেড়ে দেখলেন, ময়দান ফাঁকা। ইব্রাহিমের দোকান থেকে ঝুলতে থাকা কচি পাঁঠা দুটো নামিয়ে সামনে দাঁড়ানো একটা টোটোতে চেপে ধাঁ ৷ রোমহর্ষক কচিপাঁঠা-এক্সট্র্যাকশণ্।
ইব্রাহিম পুলিশের কাছে গিয়ে জবাই করা পাঁঠা চুরির ডায়েরী করেছে বটে ৷ কিন্তু এলাকায় খবর আছে যে সেই রোববার রাতে থানায় চড়ুইভাতি হয়েছে -- কচিপাঁঠার ঝোল আর ভাত ৷ আর রান্না না কি করেছিলেন কাজলবাবু স্বয়ং |
তারপর থেকে এখনও অব্দি কাজলবাবুকে আর এলাকায় দেখা যায় নি।
এক সপ্তাহও কাটে নি ৷ এই রোববারে দোকান খুলতে ইব্রাহিমের ভয় তো একটু হবেই ৷ তাই না !
.png)
No comments:
Post a Comment