Friday, 2 February 2024

ম্যাস্টরমশাই : পর্ব ৫


-আপনি কানে দুল পরে ক্লাসে যান?

-হ্যাঁ, কেন বলুন তো? 

-এটা ঠিক স্কুল শিক্ষকদের মানায় না …আপনাকে স্কুলে ছেলেরা মানে?

-একদিন ক্লাসে এসে স্বচক্ষে দেখে যান না! 

- না না এসব একেবারে অনুচিত। এসব কিন্তু শিক্ষকদের আদপেই মানায় না। 

-যদি শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন আধিকারিকরা স্বয়ং হাতে পাথর দেওয়া আংটি পরে থাকতে পারেন, গলায় সোনার চেন-ও, তাহলে আমার শিক্ষক হয়ে কানে দুল পরা কি ভাবে ভুল, ঠিক বুঝতে পারলাম না।

-মানে? 

-মানে তো খুব পরিষ্কার। 

-আপনাদের মত শিক্ষকদের জন্য আজ শিক্ষকদের এত বদনাম। শিক্ষকতা স্টাইল –মারার বিষয় নয়। ঐতিহ্য নষ্ট করছেন আপনি। ওই জন্যই আপনাদের বিদ্যালয়ে ছাত্র হয় না…এসব বখে যাওয়া মাস্টার দেখলে কোন গার্জিয়েন আর ছেলে-কে পাঠাবেন!


-আসলে কি জানেন, আপনারা সমাজকে ভাবতে বাধ্য করেছেন, যে শিক্ষক মানেই গরীব…ছেঁড়া ধুতি, ছেঁড়া ছাতা…জাগতিক ভোগ বিলাস থেকে অনেক দূরের মানুষ…প্রায় সন্ন্যাসী, বিয়ে করে  সন্তান থাকা সত্ত্বেও, সারা দেশের মেধাবী ও অমেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের দেশে-বিদেশে বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত করা সত্ত্বেও তাঁরা চিরগরীব থাকবেন। সঙ্গে ভুলেছেন, ভারতীয় পুরুষদের কানের দুল বা কুণ্ডল পরার ঐতিহ্যকে। আপনি জানেন ‘কুণ্ডল’ কিসের প্রতীক? প্রজ্ঞা, বিদ্যা, শৌর্য, জ্ঞান ও দৃঢ়তার। 


-ও সব জ্ঞানের কথা রাখুন। কানে দুল পরে গ্যাঁজাড়ে আর হোমোসেক্সুয়াল-রা। ব্যাণ্ড মিউজিক করতে গেলে,  বা র‍্যাপ-ট্যাপ গাইতে গেলে লোকে ওসব পরে। তা বলে শিক্ষক!! 


-পাশ্চাত্যে মজেছেন। সে এক কানে দুল এবং তা-ও সাংকেতিক। সে সংকেতের যা ভাষা তা আপনার বোধগম্য হবে না। আপনি শুধু পাশ্চাত্যের পদলেহন-কারী দাসানুদাস হয়েই থাকুন। যা সবাই দেখায়, তাতেই মজে থাকুন। জানেন তারা কেন কানে দুল পরেন? কারণ ভোগবিলাসের চূড়ান্ত সীমায় সম্পৃক্ত হলে তাঁদের প্রাচ্য, বিশেষতঃ ভারতীয় সংস্কৃতি, টানে। পুরাণ-বেদ-উপনিষদ, সেই প্রাচীন, কিন্তু অতি-আধুনিক দর্শন দ্বারা তাঁরা উদবুদ্ধ হন। সেখানে কুণ্ডলধারণ মোক্ষলাভের বা salvation-এর চিহ্ন বিশেষ। সুতরাং শিক্ষক হয়ে যদি কানে দুল পরে থাকি, তা প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ধারক ও বাহক হিসেবে  এবং এর সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চাই স্টাইল স্টেটমেন্ট-কে। আর শিক্ষকতার জীবন ও আদর্শ বেছে নিয়েছি মানে আমাকে আজীবন গরীব থাকতে হবে এরকম ধারণা একেবারেই ভুল। বরং আমাদের ছাত্ররা আসলটা জানুক, শিখুক। স্মার্ট হোক। আমি সেই আধুনিক শিক্ষক রূপে লড়াই করতে প্রস্তুত যেখানে শুধু বিদ্যা-বুদ্ধিতে নয়, স্মার্টনেসেও আমাকে একজন ছাত্র সত্যিকারের মূল্যবোধ নিয়ে আইডিওলাইজ করবে। শিক্ষকরা অবদমিত জাতীয় স্টার, যাদের প্রকৃত মূল্য এখনো দেশের মানুষ ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি। ‘পথের পাঁচালী’-র পাঠশালায় তুলসী চক্রবর্তীতে আটকে আছেন। এদিকে সব বদলে গিয়ে যুগ চলে এসেছে, ‘তারে জমিন পর’-এর নিকুম্ভ স্যার-দের। বর্তমান সমাজে নিকুম্ভ-স্যারদের খুব দরকার, কি বাবা-মা-অভিভাবক, কি ছাত্রছাত্রী, সবার জন্য, যিনি আধুনিকতার মোড়কে পরিবেশন করবেন ভারতীয় ভাবধারা, সব দিক অক্ষুন্ন রেখে। 


- ওসব সিনেমায় হয়। শিক্ষকদের অনেক স্যাকরিফাইস করতে হয়, তবে তিনি শিক্ষক হয়ে ওঠেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা ভাবুন?


- …নিশ্চয়ই। উনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, নারীশিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন, কলকাতা থেকে যার শুরু, সমাজকে আলো দেখানোর উদ্দেশ্যে। আর সেই কলকাতা থেকে আজ শুরু হয়েছে যাত্রা, সরকারী বিদ্যালয়গুলোকে ধীরে ধীরে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়ার। আমাদের এই বিদ্যালয়ে, যেখানে আমি শিক্ষকতা করি, সেখানে,  কি কি সমস্যা, আমাদের উন্নতির জন্য কি কি প্রয়োজন, কি ভাবে স্ট্রাটেজী বদলে কিছু ছাত্র আনা যায়, তা নিয়ে সদর অফিস থেকে কোনো একজন প্রতিনিধি আমাদের বিদ্যালয়ে গত বাইশ বছরে একবারও আসেন নি। শেষ একটা প্রায়-না-পড়তে-পারার-মত অর্ডার পাওয়া গিয়েছিল ডি-আই মহাশয়ের তরফ থেকে, যে এই ইস্কুলটাই তুলে দেওয়া হোক। 


এক কাজ করুন…আপনি একদিন আমাদের বিদ্যালয়ে আসুন, আমন্ত্রণ রইল। বিদ্যাসাগর মশাই-এর কাছ থেকে একজন শিক্ষক হওয়ার জন্য যা শিখেছি তা আপনাকে প্রদর্শনের অপেক্ষায় রইলাম। 


- এর সঙ্গে কানের দুলের কি সম্পর্ক? উনি কানে দুল পরতেন নাকি!


- না উনি নিজে পরতেন না। অন্য কেউ পরত বলে কোনোদিন বাগড়া দিয়েছেন বা তাঁদের অশিক্ষিত বখে যাওয়া বলে দেগে দিয়েছেন বলেও শুনি নি। তবে দু’টো সম্পর্ক আছে। ওই যে আগেই বললাম, পুরাণ ও বেদ থেকে জানা যায়, তৎকালীন সময় থেকে ‘কুণ্ডল’ ছিল পুরুষের অন্যতম ভূষণ। কর্ণের কবচ-কুণ্ডলের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। আর একটা কথা আমি আজকালকার যুগের শিক্ষক হয়ে বলতে চাই নি, কারণ আমি নিজে জাতি ও বর্ণভেদে বিশ্বাস করি না।  সব ভেদাভেদ লোপ পাক বললেই তো হল না, এস-সি/এস-টি/ওবিসি কোটা উলটে বুঝিয়ে দেয় সর্বস্তরে কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজ করে, যে ভেদাভেদ আছে, থাকবে। আমি শিক্ষক হিসেবে এ সব গ্লানি মুছে যাক, চাইলেই তো হবে না! কিন্তু সে দিক থেকে দেখতে গেলে কি জানেন, আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসে ও সমাজের কাছে আমি সেই একজন একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ। আর উপনয়ণের সবথেকে বড় রীতি হল কান-বিঁধানো ও কুণ্ডল ধারণ, যা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী ব্যতীত সারা ভারত তথা পৃথিবীব্যাপী প্রচলিত। আমি শিক্ষক ও ধার্মিক বটে। সঙ্গে এও বলে রাখি, পরে কানের দুল নিয়ে আরো কিছু বলে আঘাত দিতে এলে আগে একটু পড়াশোনা করে আসবেন, নাহলে ফেঁসে যেতে পারেন। কারণ আপনি আমার ধর্মে আঘাত করছেন বলে আমি প্রতিবাদ জানাতেই পারি। ‘কর্ণভেদ সংস্কার’ ভারতীয় হিন্দুধর্মের  বিভিন্ন জাতির মধ্যে একটি বিরাট প্রচলিত উৎসব বিশেষ। ব্রাহ্মণ যখন উপনয়ণের মাধ্যমে দ্বিজ ধারণ করেন, তখন এই সংস্কারের রূপায়ণ বাধ্যতামূলক, জানবেন। 


দ্বিতীয়তঃ, যদি ফ্যাশন বা স্টাইল স্টেটমেন্ট বলেন, তাহলে বলব, কোনটা শালীন আর কোনটা অশালীন তা বিচার করার দায়িত্ব কার? এই যে অনেক শিক্ষক দিব্বি বুকের দুটো বোতাম খুলে ঘুরে বেড়ান, তখন কিছু হয় না। আমার নিজের চোখে দেখা যে প্রবীন শিক্ষক ছাত্রকে শাস্তিস্বরূপ  তাঁর খালি গায়ে মাসাজ করাচ্ছেন। ভাবুন, একজন শিক্ষিকা কি এটা পারবেন করতে, কোনোদিন? হাসবেন না। এখনো কোনো শিক্ষিকা লো-কাট আপার উইয়ার পরলে, বা ধোপদুরস্ত সেজে থাকলে (বুকের দুটো বোতাম খুলে ঘোরার মত কুরুচি কোনো শিক্ষিকার নেই) এক্ষুনি সবার মাথা ঘুরে যাবে, এমনকি অশালীন হওয়ার দায়ে কোর্টের চক্কর কাটতেও হতে পারে। দক্ষিন চব্বিশ পরগনার বাখরাহাট গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা সালোয়ার কামিজ পরে বিদ্যালয়ে যেতেন। সালোয়ার কামিজ নাকি অশালীন, তাই তুলকালাম হল। আইনি মারপ্যাঁচে গেল, কোর্ট অব্দি। উনিও হাল ছাড়েন নি। লড়ে জিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ঘুচিয়ে দিয়েছেন, আপনাদের মত কূপমণ্ডুকদের মরাল পোলিসিং। এখন হাজারে হাজারে শিক্ষিকা ওই পোশাকে স্কুলে যান। সময় বদলাচ্ছে ময়াই! তাকিয়ে দেখুন।


ধরা যাক ‘তারে জমিন পর’ এর নিকুম্ভ স্যার (আমির খান) ওরকম হেয়ার স্টাইল এর সঙ্গে যদি কানে দুল-ও পরতেন, তখন আম-জনতা দিব্যি মেনে নিত। মনে হত, এই তো…বাহ! যদি সরকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একটু এরকম ঝাঁ-চকচকে হতেন! আধুনিক শিক্ষকের ঠিক এরকমই হওয়া উচিত। আপনিও সেই হাওয়ার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু উলটে সরকারী স্কুল গুলোকে অক্সিজেন দেওয়ার বদলে ভুল ফোকাস নিয়ে এভাবেই বরং শিক্ষকরা খারাপ ও অযোগ্য বলে নানা ভাবে প্রচার করে তাঁদের অপমান করতে থাকুন, যাতে জনমানসে দাগ আরও গভীর হয় এবং শহরাঞ্চলে ছেলেমেয়েরা প্রাঈভেট স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়, যেখানে এটা পরীক্ষিত সত্য, বিদ্যা-বুদ্ধিতে সরকারী শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেক বেশি এগিয়ে। শহরে না হয় প্রাইভেট স্কুলের রমরমা। ৭৫-৮০ শতাংশ সাধারণ মানুষ কিন্তু সরকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ওপর নির্ভরশীল। তাহলে কি বেশিরভাগ শহরের ছেলেমেয়েরাই মানুষ হচ্ছে, আর বিদেশে যাচ্ছে? ঠিক করে তথ্য খুঁজুন, দেখবেন ধারণা বদলে যাবে। শহরের ছেলেমেয়েদের সুযোগ অনেক বেশি, জনঘনত্ব অনেক বেশি। আনুপাতিক হিসেবে পাওয়া সুযোগের উচিত ব্যবহার তারা করতে পারছে না। সেই তুলনায় বৃহত্তর গ্রামাঞ্চলে অত্যন্ত কম সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও শতকরা ও আনুপাতিক হারে অনেক বেশি সংখ্যক ছেলেমেয়ে দিব্যি সাফল্যের সঙ্গে মানুষ হচ্ছে। 


যে শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করা যাবে না, কাউকে স্নেহ বশত: মারা -ধরা-বকা যাবে না, সেখানে প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকা-কে এমনভাবে ব্যক্তিত্ব তৈরী করতে হবে, যে তাঁর চেহারা, মানসিক গঠন ও কথাবার্তাতেই সবাই যেন বুঝে যান যে তিনিও শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি কমপ্লিট প্যাকেজ। তাঁকে পেরিয়ে কিছু করাটা বেশ মুশকিলের। পার্সোনালিটী দিয়ে জিতে নিতে হবে, সবটা। সেটা কিভাবে নির্ধারিত হবে তা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা হতেই পারে, এবং তা একান্ত ব্যক্তিগত, কিন্তু কুরুচিপূর্ণ নয়।  


তাই সবাইকে অনুরোধ,  শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে নো-পাঙ্গা!


তাঁরা অন্ততঃ আপনার থেকে অনেক বেশি সমাজ সচেতন। আর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পোশাক নিয়ন্ত্রণ আপনার দায়িত্বের মধ্যে আদৌ পড়ে কি? যা যা পড়ে, তা-ই আগে ঠিক করে করে উঠুন, দেখুন, শহরের ধুঁকতে থাকা সরকারী স্কুল গুলোকে আসলে কিভাবে চাঙ্গা করা যায়। দাবী জানান সবাই মিলে, শহরের সমস্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলে  ইংরেজি মাধ্যম বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা হোক। সারা বছরে মাথা পিছু ৫০০ টাকার বেশি লাগার কথা নয়। বই-খাতা-পোশাক (জুতো সমেত) সব সমগ্র শিক্ষা মিশন দেয়। মিড-ডে-মিল আছে। নবম শ্রেণি-তে উঠলে সাইকেল। কন্যাশ্রী প্রকল্প। দেবে কোনো প্রাইভেট স্কুল? আর দিলেও ঘুরিয়ে তার বিশগুণ টাকা আপনার আমার কাছ থেকে নিয়ে নেবে।


আপনি পুরুষ হিসেবে এই প্রোজেক্টে সফল হলে, আমি বখে যাওয়া আধুনিক শিক্ষকদের তরফ থেকে মিনে করা সোনার কানের দুল আপনাকে উপহার দেব, আপনার পৌরুষের সাফল্য-স্বরূপ, সঙ্গে একটা ট্যাটু, ফ্রি। 


বিঃদ্রঃ 

আমার এক বন্ধু বিদ্যালয় প্রধান। ইচ্ছে থাকলেও কান বিঁধোতে পারছে না, ইমেজ ধরে রাখার জন্য। আমাদের ইমেজ লেন্সের রিয়াল ইমেজ। ফোকাল লেন্থের মধ্যেই থাকি কি না।আয়নায় যে ইমেজ তৈরী হয় তা ভার্চুয়াল। টিচার্স রক, ম্যান!!! সো জাস্ট চিলের পিঠে চেপে চিল! ততঃক্ষণ সবাই ভাবুক, Shelley আর Keats-এর  রোমান্টিক রোমহর্ষক রোমন্থনে চিল-দের (skylarks) মধ্যে কি অপার উড়াণ অনন্য বিভিন্নতায় লুক্কায়িত ছিল!!!

No comments: