আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে ঠিক এই দিনে সকালবেলায় উঠেই ফ্রেশ হয়ে বাড়িতে রাঁধুনি রত্নাকরের বানানো দারুণ ইউলি খেয়ে ব্রেকফাস্ট করে কি করব কি করব একটা ভাব আসতেই অরিন্দম বলল
- চ'... আশেপাশে ঘুরে আসি ৷ আজ তো বিকেলে আমরা desert safari তে যাবই ৷ কিন্তু সেটা হল গিয়ে একটা স্পেশাল লোকেশন ও সিলেক্টেড ইউনিক প্লেস ৷ কিন্তু তার আগে এখানকার লোকাল মরুভূমি কেমন তার একটা feel নিয়ে আসবি চল ৷ কম্পারেটিভ স্টাডি করতে সুবিধা হবে।
বাইরে গরমের চোটে অরিন্দমের অফারে কেউই সেরকম উৎসাহিত বোধ করল না দেখলাম; যেন, 'সেই তো বিকেলে একই জিনিস দেখতে যাব! এখন আর সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করে কি লাভ!' - এর মত ভাব করে ভাবলেশহীন হয়ে রইল সবাই ৷
তখন অরিন্দম চৈতালীকে বলল,
- Spinneys থেকে কি সব আনতে হবে বলছিলে...
- এখন যাবে?
- যাই... সেরে ফেলি...
- সাড়ে বারোটা বাজে কিন্তু... গাড়ি আমাদের সাড়ে তিনটে নাগাদ নিতে আসবে... এখনও সবার চান-খাওয়া বাকি ৷ বেশি দেরী কোরো না...
- না না এই যাব আর আসব..
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দেখলাম বুম এই আপাত- নিরীহ বাজারে যাওয়ার পিছনে একটা গভীর ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পারল ও আমাদের দুজনের সঙ্গে ঝুলে পড়ল।
আমরা প্রথমে ওদের বাড়ির নিচের শপিং মার্টের বাইরে সবথেকে কাছের আর একটু বড় মার্ট Spinneys এ পৌঁছালাম ৷ এমন সব ফ্রেশ ফল ও সবজি যে দেখে যেন একটা fb - র ভাষায় 'feeling খাই খাই' হয়। তার পাশেই একটা liquor store l সেটাতে ঘুরে যা বুঝলাম যে ওখানকার লোকজন মোটামুটি বেশিরভাগই হয় বিয়ার না ওয়াইন পান করে ৷ ওয়াইনের বিরাট সম্ভার | হুইস্কির নানা রকমের ব্র্যান্ড আছে বটে, তবে বিয়ার-ওয়াইনের মত চলে না। তবে পান না করলেও ওন্ড মঙ্ক -এর বিরাট ভান্ডার দেখে বেশ আহ্লাদিত হলাম। পানের কথা যখন উঠলই তখন এখানে বলে রাখা ভাল যে এ দেশে লোকে খেতে বসলেই লাবান নামক এক দুগ্ধজাত পানীয় পান করেন। সবার শপিং কার্টে আর কিছু থাকুক না থাকুক লাবান থাকেই৷ দুধ থেকে বানানো ঝাঁঝালো পানীয় ৷ তাতে Sprite জাতীয় সফট ড্রিঙ্ক মিশিয়ে খেলে অনবদ্য স্বাদের হয়ে ওঠে। আমি আর অরিন্দম দুতিন বেলা রোজ এক গেলাস করে তো খেতামই ৷ অরিন্দমের যা কেনার ছিল, মানে যা কেনার অছিলায় আমরা বের হয়েছিলাম তা হল এই লাবান ৷ সেটা spinneys থেকে কিনে আমরা চললাম স্থানীয় মরুভূমির উদ্দেশ্যে ৷

কিছুই না... রাস্তা এক জায়গায় যেখানে শেষ, তার সামনে আর দুপাশে ধূ ধূ মরুভূমি ৷ গাড়ি থেকে নামার সময় দরজা খুলতেই যে গরম হলকা টা মুখে এসে লাগল তাতে টের পেলাম সত্যিই মরুভূমি কারে কয় ! বেরিয়ে দু মিনিট কাটানোই খুব কঠিন। মোবাইলে ছবি তুলব কি , চড়া রোদ্দুরে স্ক্রীণের ব্রাইটনেস ম্যাক্সিমাম করেও কিস্যু দেখতে পেলাম না। আন্দাজে দু একটা ছবি তুলে গাড়িতে উঠে জানলার কাচ নামিয়ে যা যতটুকু পাওয়া যায় তুললাম ৷ মরুভূমি একদম সোনার কেল্লার আদলের ৷ সত্যিই যে ছবির মত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
- বিকেলে আমরা যেখানে যাব তার সঙ্গে এই মরুভূমির খুব একটা মিল পাবি না ৷
অরিন্দম জানাল ।
মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করছি যে মরুভূমি আবার অন্য কেমনতর হতে পারে ! এখন যা দেখছি তাইই তো দারুণ- মরুভূমি হো তো এ্যাইসা !!
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা মরুদ্যানের সামনে এনে গাড়িটা দাঁড় করালো অরিন্দম ৷ বলল,
- এগুলো এখানকার নার্সারী ৷
আমি তো দেখে থ! বলেই ফেললাম
- নার্সারী কি রে! এতো post doctorate ...
গোটা গোটা বিশাল সাইজের গাছের সম্ভার | ছোট, মানে আধ ফুটের গাছ থেকে, বিশাল বড়, মানে কুড়ি ফুটের গাছ বা তার থেকেও বড় গাছ বিক্রির জন্য থরে থরে সাজানো ৷ কোনো জায়গা পার্মানেন্টলি নতুন সবুজ দিয়ে সাজাতে হলে ওখানকার লোকজন এইসব গাছ কিনে নিয়ে গিয়ে সোজা সেখানে পুঁতে দেয় ৷ এমনভাবে সেটা করে যে সেই জায়গাটা কদিন আগেই যে ঊষর মরুভূমি ছিল, তা বিশ্বাস করাই কঠিন।
প্রথম দিন থেকেই অরিন্দম সুযোগ পেলেই আশ-পাশ দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আসত ৷ সেরকম নার্সারী থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে পড়ল একটা pet market | বাড়ির পোষ্যদের শপিং মল। সেখানো পোষ্যদের তো পাওয়া যাবেই সঙ্গে তাদের জন্য খানাপিনা ও খেলধূলার সাজ সরঞ্জাম ৷ নানা ধরনের কুকুর বেড়াল পাখ পাখালি ছাডাও আছে কচ্ছপ, খরগোশ ইত্যাদি। চিড়িয়াখানার মত সুন্দর করে সাজানো সব দোকান। সবটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
আর যদি সে সব কুকুর বেড়ালের অভিব্যক্তি যদি কেউ দ্যাখে - আহ্লাদে আটখানা তারা৷ সবথেকে ভয় পেয়েছি আমরা সবাই এক বিশাল কুঁদো হুলোকে দেখে ৷ শরীরের দৈর্ঘ্য ফুট দেড়েক হবে। যে গাম্ভীর্য ও দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছিল তাতে ওই দিনের বেলাতেই সে খাঁচাতে থাকা সত্ত্বেও আমাদের বুক শুকিয়ে যাচ্ছিল। তার ইতিবৃও নিয়ে খোঁজ নিতে জানা গেল যে উহা বিক্রির জন্য নহে ৷ জীবনে এই প্রথম নিজের ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করলাম যে শীতলা মাতার এই বিশেষ বাহনকে কেন বাঘের মত প্রাণীরও গুরুজন অর্থাৎ 'মাসী' বলা হয়৷
তবে কুকুরগুলো যেভাবে সব ভেঙেচুরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল আদর খাবে বলে তাতে ওদের এই বন্দীদশায় বেশ মন খারাপ হয়ে গেল ৷
যাওয়া আসার পথে একটা জায়গায় দেখলাম দিগন্তবিস্তৃত যতদূর চোখ যায় শুধুই গাড়ি ৷ প্রথমে ভেবেছিলাম স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড | গাড়ির চেহারা দেখে ভাবলাম সেকেন্ডস এর মার্কেট ৷ তারপর দেখলাম বড় বড় করে এক জায়গায় লেখা Emirates Parking l বিস্ময় আর বিস্ময় ৷ কেউ ভাবতেও পারবে না যে বছর তিরিশ আগে এই শহরের সেভাবে কোনো অস্তিত্বই ছিল না। কেউ পুঁছতোও না সেভাবে ৷
ফিরে এসে আমরা সবাইকে বললাম
- মিস করলে কিন্তু...
তাতে উত্তর এল
- দুটো বাজে... কিন্তু এখনও স্নান খাওয়া কোনোটাই হয় নি।
বুঝলাম সবাই desert safari র প্রত্যাশায় মশগুল হয়ে আছে ৷
এখানে কেন জানি না এত গরম হওয়া সত্ত্বেও বেলায় বেলায় বেশ খিদে হয়। সকালের অতগুলো ইডলি যে পেটের কোথায় গিয়ে সেঁধিয়েছে কে জানে! দুপুরে লাঞ্চে ছিল সাউথ ইন্ডিয়ান রাইস অ্যান্ড চিকেন উইথ এরিয়েটেড লাবান ৷ খেয়ে উঠে ঢেকুর তুলতে তুলতে দেখলাম তখনও হাতে আধঘন্টা আছে ৷ ব্যাকপ্যাকে নেওয়ার জন্য ঠান্ডা জলের ব্যবস্থা করে ও ক্যামেরা এবং মোবাইলের ব্যাটারীতে ঠিকঠাক চার্জ আছে কি না দেখে নিয়ে ভাবলাম যে এরপর যদি না এখুনি খাওয়া অনবদ্য দক্ষিণ ভারতীয় মুরগীর আত্মার স্মৃতিতে শোক পালনের উদ্দেশ্যে চোখ বন্ধ করে মিনিট কুড়ির শবাসন না করি তাহলে নেহাতই ব্যাপারটা অমানবিক হয়ে যাবে।
সঙ্গে শরীরের সমস্ত এনার্জি কে প্রস্তুতও করতে হবে ৷ যা শুনেছি তাতে এখানকার desert safari এক অনন্য ও অনবদ্য অভিজ্ঞতা ৷ ফলে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে, জুতো মোজা পরা ছাড়া, মিনিট কুড়ির দিবানিদ্রায় মগ্ন হলাম ৷
(চলবে...)
Local Desert Video Link