আমরা যখন ক্লাস এইটে উঠলাম সে বছরটা শেষ আর হতেই চায় না। পর্ষদ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিল যে সে বছর থেকে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর নয়, এপ্রিল থেকে মার্চ এই হবে পঠন বৎসর৷ সেই বদলের জন্য আমাদেরই ভুগতে হল - টানা একবছর তিনমাস, একই ক্লাসে। জীববিদ্যার সবথেকে আকর্ষনীয় অধ্যায় 'হরমোন' - শেষের দিকে সে রোমাঞ্চ আর রইল না কারণ পিউবার্টির এই মোক্ষম সময়ে সেই বই এর হরমোন আমাদের শরীরে প্রভাব বিস্তার করল ৷ ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমাদের ডানপিটে স্বভাবের জন্য অনেকেই বলতেন যে আমাদের নাকি লেজ গজিয়েছে ৷ অষ্টম শ্রেণির এই অতিরিক্ত তিনমাসে আরও অনেক কিছু গজালো ৷ শরীরে নানান রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়া অনুভূত হতে লাগল। স্কুলের খেলার মাঠ ছেড়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে যেখানে গ্রীষ্মেও পড়ন্ত বিকেল হয়ে যেত, সেখানে বাড়ি যাওয়ার সময় গার্লস স্কুলের সামনে তাদের ছুটির সময়ে স্বতঃপ্রণোদিত ডিউটির দ্বারা নির্ধারিত হতে থাকল ৷ নিজেদের আভ্যন্তরীণ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এরকম হঠাৎ অবনমনে নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হতে লাগল ৷ মূল্যবোধের গোড়ায় কেউ যেন কুঠারাঘাত করছে। 'কেউ যেন'- টা আর কেউ না, স্বয়ং নিজে। পাপ বোধ জন্মাল ৷ কিন্তু ডারউইন ও ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী সেসব ছাপিয়ে আমরা কালের নিয়মানুসারে 'বড়' হলাম। এতদিনের সারল্য সদ্য গজানো দাড়ি গোঁফের অন্তরালে সুপ্ত হল । আমরা অনেক চেষ্টা করে আমাদের জৈবিক প্রবৃত্তির ক্রমবৃদ্ধি কে কিছুতেই প্রতিহত করতে পারলাম না ৷ আমরা 'পেকে' উঠলাম ৷
কি করে বুঝলাম ? প্রথমতঃ, বাবা মা এর শাসনের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম ৷ তাঁরা যেন জীবনের পরম শত্রু বলে মনে হতে লাগলো। দ্বিতীয়তঃ নির্ভীকভাবে মিথ্যে বলতে শিখলাম ৷ তৃতীয়তঃ যে শব্দগুলোকে গালাগালি বলে জেনে এসেছিলাম সেগুলোকে নানান জায়গায় ব্যবহার করা শুরু করলাম ৷ চতুর্থতঃ গার্লস স্কুলের ছুটির সময়ে সেখানে দাঁড়ানোর মধ্যে এক অদ্ভুত পৌরুষ ও অযাচিত প্রেম প্রেম ভাবের সঞ্চার হল । আর সবথেকে বড় কথা, সারা রাস্তার দেওয়ালে যত সিনেমার পোষ্টার থাকত তার মধ্যে নিম্নমানের অর্ধনগ্ন নারীদেহের ওপর কালো আলকাতরার পোঁচ দেওয়া পোষ্টারগুলো আমাদের আলাদা করে এক আমোঘ টানে সম্মোহিত করতে থাকল ৷
'নুন শো' শব্দটি আমাদের সংস্কৃতিতে এক অসাংস্কৃতিক শব্দ । এটাকে বিলিতি নুন শো এর সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না ৷ নুন শো যে কোনো হলের একটা অতিরিক্ত শো যাতে একটি রগরগে বড়দের সিনেমা দেখানো হত ৷ আর এতবড় ট্যুইন সিটিতে অনেক সিনেমা হল ছিল যাদের আলাদা করে দুর্নাম ছিল যে সারাবছর সব শোতেই তারা এই ধরনের সিনেমা দেখায় ৷ সেই সব হলে ঢোকার আগে সবারই মধ্যে কেমন একটা 'লুকিয়ে কোনো বড় অপরাধ করছি ' গোছের মনোভাব ধরা পড়ত ৷
- কি রে তুই বিড়ি সিসারেট খাচ্ছিস কবে থেকে?
- না এমনিতে খাই না ৷ কাকার পকেট থেকে খান চারেক ঝেড়ে রেখেছিলাম ৷ শিবানী কয়েকদিন করে চুম্বকের মতো টানছে তো ৷ তাই আগে থেকে একটু প্রস্তুতি নিয়ে রাখা... আমাকে অ্যাডাল্ট লাগছে কি না বল!
- লাগছে লাগছে... পলাশ টাকে আনতে পারলাম না ৷ ওই **** রিন্টু... ওর দাজিগোঁফ গজায় নি তাই নাকি ওর জন্য বাওয়াল হবে! কোনো মানে হয়!
- আরে ছাড়... কাল গিয়ে এমন সুন্দর করে গপ্পো বলে দেব না...!!
- এসব কি গপ্পো বলে হয় না কি!!! নিজে চোখে দেখতে হয়...
- বলিস না ভাই এরকম... চোখে দেখলেই চাখতে ইচ্ছে করে.... উফঃ নামটা কি দিয়েছে মাইরি... মচলতি জাওয়ানী... উচ্চারণ করলেই কেমন - ছলাৎ ছলাৎ করে...
উল্টোদিকের টিকিট কাউন্টারের ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে পিন্টু ৷ একি ওর চুল হাতের মুঠোয় ধরে ওটা কে? নিশ্চয়ই স্কুলের ছেলে বলে ধরা পড়েছে...
পিন্টু হাত তুলে দেখালো গোলাপী রঙের টিকিট কাটা হয়েছে ... কিন্তু তারপর ইশারা করে পালাতে বলছে কেন ?
ওরেব্বাপরে বাপ! এ তো অঙ্কের রমেশ স্যার ৷ তা উনিও তো আমাদের মতই.... ছিছি !!!! স্যার কি না এসব দেখেন... !!! আচ্ছা সে সব পরে ভাবা যাবে, আগে এখন চাচা আপন পরাণ বাঁচা !
সামনে যে বাস ছিল ঠাসা ভিড় কিন্তু কিছু করার নেই... নিজের মধ্যে একটা র্যাম্বো জেগে উঠল, আমি গেটের হাতল ধরে স্পাউডারম্যানের মত ঝুলে পড়লাম। এদিক ওদিক ঘুরে স্কুলের ছুটির সময় অনুপাতে বাড়ি ফিরলাম। খেলতে যাওয়ার মত মন ছিল না সেদিন আর। ব্যাপারটা বাবার কান অব্দি পৌঁছেছে কি না দেখতে একটু তাড়াতাড়ি পড়তে বসলাম ৷
বাবা ফিরলেন। সব কিছুই বেশ স্বাভাবিক ৷ আমাকে কিছু বললেন না।
পরদিন বেরোনোর আগে বাবা আর আমি খেতে বসেছি।
- কয়েকটা কথা বলার আছে তোমায়...
- ও...
- কাল যা করেছ ভুল করেছ৷ বন্ধুদের ও বলে দিও ৷ আর গতকাল তোমরা পালানোর সময় রমেশ স্যার তোমাদের দেখতে পেয়ে ধাওয়া করেন ৷ তোমাদের উদ্দেশ্য বুঝে পিলখানার মোড়ের পুলিশ অফিসারের সঙ্গে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলেন। তোমাদের যে বন্ধুটি টিকিট কেটেছিল রমেশ স্যার তাকে নিয়ে পুলিশের কাছে যান এবং জানতে চান যে এডাল্ট সিনেমার টিকিট স্কুলের ছাত্রদের স্কুল টাইমে কি করে বিক্রি করা হল। সিনেমা হলের মালিক বিপদে পড়েছেন সেই নিয়ে। যদি ভবিষ্যতে প্রয়োজন হয় পুলিশ তোমাকেও ডাকতে পারে, তুমি সেই দলে ছিলে ৷ সব সত্যি বলবে, নির্ভয়ে বলবে। আর যদি মনে করো যে কাল স্কুল পালিয়ে কাজটা ঠিক করেছো তা হলে আবার করো ৷ শুধু মনে রেখো বার বার রমেশ স্যার থাকবেন না তোমাদের বাঁচাতে।
গলা দিয়ে ভাত নামাতে কষ্ট হচ্ছিল। কলেজে না ওঠা পর্যন্ত, অ্যাডাল্ট না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের সিনেমা হলে ঢোকার সাহস ও অভিজ্ঞতা কোনোটাই ঝুলিতে আসে নি ৷ অনেকে গিয়েছে। আমি লোভ হলেও সামলে নিয়েছি ৷ বাবা নয় রমেশ স্যারের জন্য ৷
(কলকাতা শহরের বুকে আমার জানা শেষ এরকম যে হলটি ছিল তার ছবি রাখলাম। বাকি সবই শেষ বারের মত সিনেমা হল হয়ে উঠতে চেয়েছিল... মাল্টিপ্লেক্সের পপকর্নের বানে এই কর্ণের রথের ঢাকা চিরতরে মাটিতে বসে গিয়েছে ৷ মৃত্যু হয়েছে তাদের ৷ পুনর্জন্মে শপিং মল বা পার্কিং লট অথবা অন্য কোনো কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সে রূপান্তরিত হয়েছে , আমাদেরই হাত ধরে ৷)

.jpg)


No comments:
Post a Comment