Saturday, 29 October 2022

ঝাউতলায় ঝঞ্ঝাবাৎ : দ্বিতীয় পর্ব : গঙ্গেশ দার বিদেশ যাত্রা


ঘটনা বিশেষ কিছু নয় ৷ গঙ্গেশ দা বিদেশে গিয়েছেন, মেয়ের কাছে। স্বাভাবিক সাধারণ ঘটনা৷ রিটায়ার্ড লোক ৷ স্ত্রী গত হয়েছেন বহু বছর পূর্বে ৷ তাই নিজের সন্তান সন্ততির কাছে চলে গেলে একা থাকতে হয় না। এই বয়সে শুধু নিজের জন্য রোজ বাজার করে, রান্না করে, একা একা থাকতে কারও ভাল লাগার কথা নয়। ঝাউতলার সবাই বেশ খুশি যে বাউন্ডুলে জীবনের চেয়ে এটা অনেক ভাল একটা পথ। ঝাউতলায় এই নিয়ে মাঝে মধ্যেই আলোচনা হয় ৷


কিন্তু গঙ্গেশ দা যাবার পর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ৷জগতে হোয়াটসঅ্যাপ বলে একটি ব্যাপার যে আছে তা শুধু ফোনে ইন্সটল করা আছে - ওই পর্যন্ত ই | চিরকালই এক রকম - খবর যা যতটুকু পাওয়ার উনি পেয়ে পড়ে ক্ষান্ত ৷ বাস্তবিক যদি কিছু করার থাকে, কেউ অসুস্থ হলে হাজির হওয়া, কারোর মৃত্যুতে শ্মশানযাত্রী হওয়া, নেমন্তন্নে উপস্থিত হওয়া, পিকনিকে চলে যাওয়া বা ঝাউতলায় চা সিঙ্গাড়া খাওয়া সব টাই হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে খবর পেয়ে এগিয়ে এসে দায়িত্ব সহকারে পালন করেন - কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে উত্তর ? না এটা আমরা ওনার থেকে কেউই আশা করতে পারিনা ৷ অনেক বার অনেক রকম ভাবে এই নিয়ে অপমান করার চেষ্টা করা হয়েছে। গায়ে মাখেন নি। আসলে উনি যে এসব পারেন না, তা কিন্তু নয়। যিনি কম্পিউটারে এম এস উইন্ডোজ ব্যবহার না করে সবাইকে উবুন্টু ব্যবহার করার জন্য সদা প্রচেষ্ট, তিনি সামান্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন না - এটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয, একেবারেই ৷ কিন্তু গঙ্গেশ দা যদি মনে করেন যে করবেন না, তাহলে কোই মাই কা লাল নেহি, যে ওনাকে দিয়ে সেটা করিয়ে নেবে ৷ আর ওনার সবথেকে বড় দুটি রোগ হল যে উনি এক জায়গায় স্থির হয়ে দু দণ্ড দাঁড়াতে পারেন না আর কথা না বলে থাকতে পারেন না। সেও আবার ফুল ভল্যুমে ৷

এ হেন গঙ্গেশ দার পক্ষে যে আমেরিকা খুব একটা সুখকরজায়্গা হবে না তাতে আমরা নিশ্চিত ৷ উনি বিদেশ যাচ্ছেন আমরা খুশি ৷ কিন্তু উনি নিজে কি খুশি? হাওড়ার শিবপুর থেকে সিয়াটেল শুনতেই ভাল, থাকার জন্য মোটেও ভাল না। চুনো মাছ পাওয়া যায় না ৷ ঝোল কাকে বলে জানে না ৷ কিছু বললেই নাকি ঝোপ ঝাড় জঙ্গল পশু প্রানী সব কুচো করে কেটে চিজ মাখিয়ে দুটো ফুলো ফুলো টোবলা হওয়া পাঁউরুটির মধ্যিখানে ঠেসে দিয়ে বার্গার বলে চালিয়ে দেয়। সে সামর্থ্য না থাকলে পাতি কাটা (স্লাইসড) পাঁউরুটির পাশগুলো কেটে ওই একই মালের ওপরে নিচে দিয়ে বলে স্যান্ডউইচ | আর রান্না বান্না করার ঝক্কি ঝামেলা নেই - সবটাই হয় সেদ্ধ করা, না হয় কাঁচা | আরে পাঁউরুটিই যদি খাবি বাসি কচি পাঁঠার ঝোলে ডুবিয়ে খা ! কোনোদিন বাসি লুচি দুধ-চায়ে ডুবিয়ে খেয়েছে?

ভাবতে পারা যায় যে সেই গঙ্গেশ দা কি না আমেরিকা গেছে ৷ যাবার আগে রাজকুমার দা বলেছিল যে,

- গঙ্গেশ দা আপনি স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলে পাঠাবেন ৷

- দেখ , আমাদের দেশের একটা সম্মান ও ঐতিহ্য আছে। ওরকম খালি গায়ে হাত তুলে লিবার্টি লিবার্টি বললেই হবে ! গান্ধিজি ওই জন্য হাত তোলেন নি ৷ খালি গা তো ! আর নেতাজি হাত তুলে দিল্লী চলো হাঁক পাড়ার সময়ে ফুল মিলিটারি ইউনিফর্মে ছিলেন। কারণ এনারা জানতেন খালি গায়ে ওভাবে হাত তোলাটা অশালীন ৷

- অশালীন কেন?

- তোমরা না অশালীন মানেই খুব খারাপ কিছু ধরে বসে থাক ৷ আমি কিন্তু সে সব বলি নি।

- তবে কি বলছেন সোজাসুজি বলুন না ...

আমি ধৈর্যচ্যুত হয়ে বললাম ৷
- তুই একটা মাস্টার, কত পড়িস লিখিস তোর মাথাতেও কুলোলো না ?

আমি চুপ করে গেলাম ৷ তাপস দা বলল
- আপনি ভ্যানতারা না কষে বলুন তো, কেন অশালীন ?

- আরে সহজ ব্যাপার - খালি গায়ে ওরকম হাত তুললে
বগলের গন্ধ বোরাবে না ! আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটা সেন্স অফ ডিসেন্সি ছিল ৷ ওদের সবটাই একটা লোক দেখানো ব্যাপার ৷
- এটা কি ঠিক বলছেন আপনি?

- না তো কি - আমাদের বাড়িতে ছোটবেলা থেকে দেখেছি জামাকাপড ছিঁড়ে ফেটে গেলে ওসব বাসনওয়ালাদের দিয়ে বিনিময়ে বাসনকোসন নেওয়া হত ৷ আর কিছু রেখে দেওয়া হত ন্যাতা ন্যাকড়া এসব করার জন্য। সে দিন কি একটা দোকানে গেলুম নাম - লে ভাইজ | গিয়ে দেখি রাজ্যের ছেঁড়া ফাটা ফুটো রঙচটা ক্যাম্বিসের মত কাপড়ের প্যানটুল ৷ পাশে লেখা free offer | আমি ভাবলাম ভেবে নাম বের করেছে বটে 'লে ভাইজ' মানে 'ভাই সকল নিয়ে যাও' ৷ তা বেছে টেছে একটা প্যান্টুল নিলাম ৷ ডান হাঁটুতে তিনটে বাঁ থাই এ দুটো ফুটো ৷ ও বাবা নিয়ে বেরোব কি- একটা ছেলে এসে ধাঁ করে আমার হাত থেকে ওটা কেড়ে নিয়ে বলল


- ডু ইউ লাইক দিস স্যার ?

- ভাই ছেঁড়া প্যান্টের আবার ভাল খারাপ..

- ইউ হ্যাভ এ ভেরি গুড সেন্স ওফ হিউমর স্যার..

- তোমার বুকে নাম যা লেখা তাতে তো তুমি চক্কোত্তি বাউন ৷ বাংলা বলতে পারো না?

- হ্যাঁ স্যার ৷

- এই ফুটো ফুটো প্যান্ট টা আমি নেব ৷ কাপড়টা মোটা কিন্তু নরম।

- হ্যাঁ স্যার এটা রিয়েল ডেনিম আর স্ট্রেচ | স্পেশাল এডিশন এটা শটগান জিনস | ডিস্কাউন্ট দিয়ে চার হাজার দুশো ৷

আমি তো শুনে থ মেরে গেছি ৷ ভাবছিলাম বাড়ির ন্যাতা করব ৷ গঙ্গেশ দা বলল ৷
- তবে যে লেখা free?

- ওটা স্যার তিনটে কিনলে একটা ৷

- তাহলে লে ভাইজ বলে লোক ঠকাচ্ছ কেন?

- লোক ঠকাব কেন স্যার লি ভাইস পৃথিবীর best jeans brand

- অ অ অ ... তা ভাই এমনি গোটা প্যান্ট নেই?

- হ্যাঁ স্যার আছে তো ৷ দাম ও কম ৷ টু থাউজ্যান্ড ফাইভ হানড্রেড আফটার ডিস্কাউন্ট৷ আর দুটোর সঙ্গে দুটো ফ্রি ৷

- আমি শুধু ফ্রি টা নিতে পারিনা ?

- কি যে বলেন স্যার !!


মানে কি দাঁড়াল? ভাব ! আস্ত গোটা নতুন ইস্তিরি করা প্যান্টুলের দাম ছেঁড়া ফাটা রঙ চটা প্যান্টুলের থেকে অনেকটা কম ৷ একটা অত্ত বড় দেশ কিন্তু বুদ্ধি দেখ! টাইটানিক বানালি কিন্তু প্রথম টিরিপেই জলের তলায় ৷ও দেশের স্ট্যাচু অব লিবার্টির সঙ্গে ছবি তুলে পাঠালে আমাদের লজ্জা ৷ তার থেকে আমাদের কাগে পায়রায় হেগে দেওয়া গান্ধীর টাক মাথাওয়ালা স্ট্যাচু আমার কাছে অনেক বেশি অ্যাক্সেপ্টেবল ৷ পয়সা থাকলেই হয়না - আকবর শাজাহানের মত টেস্ট থাকতে হয় ৷ বগল তুলে লিবার্টি হয় না। বুইলে !

রাজকুমার দা চুপ ৷

আমরা সন্দেহ করছিলাম যে এ হেন গঙ্গেশ দা এরোপ্লেনে চড়ে বিদেশ গেলেন ৷ ফলে কি কি ঘটতে পারে ৷




প্রথমে উঠে এল যে মারাত্মক বিষয়টি যে আমেরিকা গামী কোনো ফ্লাইট কোথাও ইমারজেন্সি ল্যান্ডিং করেছে কি না, সেই রকমের খবরে চোখ রাখা ৷ কারণ গঙ্গেশ দা অতক্ষণ এক ভাবে সীটে বসে থাকতে পারবেন না ৷ হোস্ট ও হস্টেস দের মাথা চিবিয়ে খেয়ে পাইলটের কাছে পৌঁছে যখন তাঁকে রিয়েলাইজ করাবেন যে জীবনে প্লেন চালানো সাইকেল চালানোর থেকেও সহজ এবং উনি পাইলট হয়ে জীবনে এমন কিস্যু গর্ব করার মত করেন নি, তখন আর পাইলট যে সেই প্লেন চালাতে চাইবেন না সেটাই স্বাভাবিক ৷ হয় গঙ্গেশ দা না হয় উনি - দুজনের একজনকে নামতেই হবে। না হলে ফ্লাইট যাবে না।

আর দ্বিতীয় যে সম্ভাবনা তাপস দার মাথায় এল তা হল, কথা বলার লোক না পেয়ে রাগে দুঃখে ফ্রাশট্রেশনে গঙ্গেশ দা না কি কাউকে কিছু না জানিয়ে মাঝ পথে ফ্লাইট থেকে নেমে হাঁটা দিতে পারেন, যে দিকে দু চোখ যায় ৷

প্রশ্ন উঠল একি ৭২ নং রুটের বাস নাকি যে যেখানে খুশি চলন্ত অবস্থাতেও তা থেকে নেমে যাওয়া যায়!এটা বিমান। পাসপোর্ট ভিসা অনেক ঝামেলা| এক একটা দেশে এমন কড়াকড়ি যে পুলিশ যদি একবার ধরে , উদ্ধার করার লোক পর্যন্ত পাবে না ৷ এটা হিন্দি সিনেমা নয়, যে কেউ গিয়ে হাঙ্গামা মাচিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবে ৷ আরও অনেক টেকনিক্যাল জাটিলতা আছে ৷ যেখানে সেখানে হল্ট হল বলে নেমে পড়ে চলে গেলাম - এরকম হয় না।

কিন্তু তাপস দার ওই এক কথা,

- গঙ্গেশ দা সব পারে, তোমাদের কোনো আইডিয়া নেই ৷

পুজোর আগে গঙ্গেশ দা তাপসদার মুখে চুনকালি লেপে দিয়ে আবার ফিরে এসেছেন ৷ কিন্তু শিবপুরের পাড়া থেকে নড়ানো যাচ্ছে না। কিছুতেই ঝাউতলায় পাওয়া যাচ্ছে না।

অপেক্ষায় আছি , বাগে পেলে ঝুলি থেকে  কিছু যদি টেনে বের করা যায় ৷

No comments: