Friday, 21 October 2022

বুড়িমার চকোলেট বোমা



সিগারেট খেতে শেখার মতই চকোলেট বোম হাতে করে ধরে জ্বালিয়ে লক্ষ্য অনুসারে ছুঁড়ে ফেলার মধ্যে একটা বড় হয়ে ওঠার মত প্রচ্ছন্ন বীরত্ব ছিল ৷ এখন সময় বদলেছে ৷ ছেলেরা বড় হয় হেলমেট ছাড়া বাইকের পিছনে বান্ধবীকে বসিয়ে আলোর গতিবেগে তাকে চালিয়ে; মেয়েরা বড় হয় ট্যাটু ও নেইল আর্টের মাঝখানে ধরা সিগারেটে |

পুজোর ছুটিতে শেষ উৎসব কালিপুজো আর ভাইফোঁটা। বেলুড় পাবলিক লাইব্রেরীর গায়ের গলিতে তখন যে বাড়িতে থাকতাম সেখানে আমাদের নিজস্ব বিরাট বাগান ছিল ৷ বুড়িমার বাজি, বিশেষতঃ চকোলেট বোম আর অন্যান্য শব্দবাজি সবে বিখ্যাত হতে শুরু করেছে ৷ বেলুড় বাজারে গার্লস স্কুলের পিছনের দিকের গেটের ঠিক উল্টো হাতে বুড়িমার দোকান | সারাবছর খুব একটা যে চলত তা নয় ৷ তবে কালিপুজোর আগে সেখানে হট্টমেলা | ভিড়ভাট্টা হওয়ার আগে সকাল সকাল গিয়ে বাজি কেনার রেওয়াজ ছিল। বেশি আগে কিনলে সেঁতিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৷ তাই দিনের দিন কেনা হত। বাড়ি থেকে একটা ফর্দ করে নিয়ে যাওয়া হত, মুদিখানার মত ৷ সেটা করার সময়েই একটা চাপা লড়াই চলত কিভাবে শব্দবাজির পরিমাণ কোনোক্রমে বাড়িয়ে নেওয়া যায়! কিন্তু বাবার তীক্ষ্ণ ও অভিজ্ঞ দৃষ্টি এড়িয়ে তা প্রায় অসম্ভব ছিল। একমাত্র উপায় ছিল যদি বাবা উল্টোদিকের দোকানে গুড়ের বাতাসা কিনতে যেতেন, তখন...

বুড়িমা তখন নিজে দোকানে বসতেন...

- ও বুড়িমা এক বাক্স চকলেট দাও না গো... এত বাজি কিনলাম... ওইটুকুই তো ফ্রি তে চাইছি, বল! 
- ওরকম হয় না বাবা...
আবার কিছুক্ষণ পরে,
- ও বুড়ি মা দাও না, বাবা এসে পড়লে আর চাইতে পারবো না....
- তোর মত পুঁটকে ছোঁড়াকে চকলেট দেওয়া যাবে না... যা দিকিনি... এই একে দু বাক্স ফুলঝুরি দিয়ে দে তো...

কিইইই! বোমার বদলে ফুলঝুরি! দুধের বদলে পিটুলি গোলা! নাকের বদলে নরুণ! নো চান্স... মেরে মর্দাঙ্গি কো ললকার দিয়া! 

- তোমার না পোষালে দিওনা...কিন্তু ফুলঝুরি আমার চাই না...আর বাবা এলে ও সব সাপবাজি মাপবাজি বাদ দিয়ে দেব ৷ 
- না না বাদ দিতে হবে না... আসলে কি জানিস, দিতে ভয় করে... কি থেকে কি হয়!
- আআআচ্ছাআ! বাহ ভারি মজা তো! যে চকলেটগুলো পয়সা দিয়ে কিনলাম সেগুলোতে তোমার ভয় করল না, কিন্তু ফ্রি টা দিতেই যত ভয় তোমার! 
- বাঃ ছেলে!!  তোর বুদ্ধি আছে দেকচি...তোকে একবাক্স চকলেটই দিলাম... অ্যাই এর ব্যাগে একটা চকলেট দিয়ে দিবি দাম ধরবি না! আর তুমিও সাবধানে ফাটাবে... সলতের অর্ধেক পুড়ে নিবে গেলে ধারে কাছে যাবে না। কালই একজনের চোখ বাজে রকমের জখম হয়েছে ৷ ভয় কি আর এমনি পাই গো নাতি! তুমি বুঝবে না... আমার বাজি আনন্দের, উৎসবের .. কারও জীবনে তা নিয়ে দুঃখ নেমে আসুক আমি চাইনা ৷ ভেজাল বাজি আমি তৈরী করিনা। তাতে খুব বিপদ... কিন্তু আসল টাটকা বাজির খ্যামতা অনেক... তাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেললে চলবে না.. তাই খুব ভয় করে...

সব শুনলাম ৷ বুঝলাম ও ৷ তাও আমার সারা গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল ৷ যেন ব্রহ্মাস্ত্র আমার হাতের মুঠোয়। এই সেই মন্ত্র:পূত অস্ত্র যা নিক্ষেপ করলে আর ফিরৎ নেওয়া যায় না। ধ্বংস অনিবার্য। জে- বি ইন্ডাস্ট্রির মাঠ থেকে কাল সন্ধেয় কালুয়া দা তিনটে বুড়িমার চকোলেটের সলতে এক করে আগুন দিয়ে তার ওপর টিনের কৌটো চাপা দিয়ে দিয়েছিল ৷ সেই কৌটো কেষ্ট জেঠুদের চারতলা বাড়ি ছাপিয়ে চলে গিয়েছিল ৷ আমার হাতে এখন সেই বোমা মোট পাঁচ প্যাকেট ৷ এখানে বেশি ফাটাব না। কালিপুজোর পরদিনই তো ভাইফোঁটায় মামার বাড়ি যাব, ওখানে সবাইকে দেখাব যে হাতে করে চকলেট বোম আমি কেমন ফাটাতে শিখে গিয়েছি। 

আমার মামারবাড়ি বাখরাহাটের পাশের গ্রাম জয়চণ্ডীপুরে ৷ কাছেই বিখ্যাত থান বড় কাছারি ৷ আবার সেখান থেকে আমতলার দিকে যেতে গেলে পথে পড়ে বিদ্যানগর কলেজ ৷ আমার মা সেখানে যখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন ডঃ প্রণব মুখোপাধ্যায় কে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন কিছুদিন ৷ ওখানেই আমাদের মাননীয় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির শিক্ষকতার জীবন শুরু ৷

এহেন মামার বাড়িতে আমার দাদামশায় একসময়ে চাউলখোলার জমিদার ছিলেন ৷ জমিদারি চলে গেলেও সামাজিক দাপট ও মানসম্মান বেশ ছিল। ফলে কালিপুজোর সময়ে একটা ধামায় করে বাজি আসত৷ বুবুপিসি নামে একজন মুসলিম মহিলা মামার বাড়ির নানা কাজে সকাল থেকে লেগে থাকত ৷ তার ছেলেমেয়েরাও আসত ৷ নানান ফাই মরমাশ খাটত ৷ সেই বুবুপিসির বড় ছেলে কোনো এক বাজির কারখানায় কাজ করত ৷ আমাদের উপহার স্বরূপ ওই একধামা বাজি প্রত্যেক বারে পাঠাত। এক ধামা বাজি - মানে বুঝতে পারছ? সারাদিন ধরে ফাটিয়েও শেষ করতে পারতাম না। লঙ্কা পটকা -ধানি লঙ্কা - আমড়া বোম ফাটিয়ে ফাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম ৷ সন্ধের বাজি পোড়ানো শেষ হত বুড়িমার চকলেটের কয়েকটা দিয়ে ৷

ভাইফোঁটার দিন পাঁঠার মাংসর দোকানে বড়মামা আমাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে যখন মাছ কিনতে যেত, কেউ না কেউ এসে ঠিক পিঠ চাপড়ে বলত -
- কাল রাতে আওয়াজেই বুইচি মিহিরের ভাগনা এইচে ৷

নিজেকে তখন অর্জুন মনে হত - তার গান্ডীবের ছিলার টানের শব্দে ধরিত্রী যেমন কেঁপে উঠে জানান দিত, তেমন ৷

----


এখন পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর পরে আমি আমার সন্তানের হাতে তুলে দিতে চাই না কোনো রকমের বাজি... তখন ধ্বংস যে ভাবে টানতো, এখন রক্ষা ও সৃষ্টির তাগিদ তার তিনগুণ... তাই ইচ্ছে হয় অনেক আলো জ্বালাই, অনেক... শিক্ষার আলো, জ্ঞানের আলো, মঞ্চের আলো, ছবির আলো...কিন্তু সময় ও সামর্থ্য - দুই-ই বড় কম... এ তো আর গুপিবাঘার রাজকন্যে নয় যে কম পড়লেই রাজা মশায় ব্যবস্থা করে দেবেন! 

একটা ওয়েব সিরিজের সংলাপ বেশ মনে ধরেছে, তাই লিখেও রেখেছিলাম ভূত চতুর্দশীর প্রাক্কালে আমার হাবিজাবি লেখার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে প্রশংসা কুড়োব বলে -


" আলো বাড়ছে; কিন্তু ভূতেরা কমে নাই.... সংখ্যায় বাড়িতেছে"... 

সাবধান! 
তারা বোমা ফাটায় বিভেদের, বিদ্বেষের, ধর্মের নামে রাজনীতির আড়ালে ৷ চীনদেশ থেকে ছড়ানো অতিমারীর নিরাময় ঘটায় বাসন কোসন কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে ৷ 
আর চীনদেশেরই তৈরী সস্তার আলোয় ঢেকে যায় চাঁদনী চকের বাজার ৷ 

বুড়িমার কারখানা জানে চকলেট বোম তৈরী করে অলক্ষ্মী আর দূর করা যাবে না ৷ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কোভিড... তার নিরাময় অসম্ভব ৷ 

তাই বুড়িমার মত মানুষরা আর নেই৷ নেই সেই চকলেট -ও৷







No comments: