'নটধা' সেখানে মহামতি ভীষ্মের মত ৷ প্রায় সত্তর বছরের ওপর কাজ করে চলেছে এই দল। নটধা নাটকের রঙ্গমঞ্চে যে লাইমলাইট কেড়ে নেয় তা কিন্তু অনেক কলকাতায় জন্মানো বিখ্যাত দলের থেকে জোরালো। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ নটধা প্রযোজিত নাটক 'মহাভারত ২'। নাটককার – শিব মুখোপাধ্যায়। শিব মুখোপাধ্যায় বহুদিন ধরেই নটধা তথা হাওড়ার উজ্জ্বল ও সম্মানীয় নাট্যব্যক্তিত্ব৷ তাঁকে ব্যাতিরেকে হাওড়ার নাট্যসমাজ এগিয়ে চলবে, এ অকল্পনীয়। শিববাবুর বয়সজনিত অক্ষমতার কারণে এখন দলকে টেনে নিযে চলেছেন তাঁর যোগ্য উত্তরসুরী ও সুপুত্র অর্ণ মুখোপাধ্যায়। অর্ণ অত্যন্ত বলিষ্ঠ একজন অভিনেতা। মঞ্চে এবং পর্দায় ৷পর্দায় বিভিন্ন জায়গায় আগে তাকে দেখে এসেছি ৷ মঞ্চে সেদিনই প্রথম দেখলাম ৷
'মহাভারত ২' নাটকটি দেখতে গিয়ে প্রথমেই মনে হয়েছিল মহাভারতের বিভিন্ন অংশ নিয়ে তো প্রচুর নাটক আমরা দেখেছি। সুতরাং নতুন করে আর কী দেখব। কিন্তু রুদ্ধশ্বাস আড়াই ঘণ্টায় সত্যি বলতে সময় পাইনি যে নিজের ঐ নাটকটির সাথে একাত্ম হওয়া থেকে বেরিয়ে আসবো। বহুদিন পর এরকম টানটান একটা নাটক তার অভিনয়ের বলে আমাকে মুগ্ধ করেছে। 'মুগ্ধ' শব্দটিই সচেতনভাবে ব্যবহার করলাম কারণ এরকম বলিষ্ঠ অভিনয় আমি গত দু'বছরে একাডেমির মঞ্চে দেখিনি সত্যিই।
মহাভারতের অনেক গল্প নাটক রূপে মঞ্চস্থ হয়েছে। তবে শিব মুখোপাধ্যায় রচিত এই নাটক আসলে দুর্যোধনের দৃষ্টিকোণ থেকে ৷ দুর্যোধনকে আমরা ভিলেন বলেই মোটা দাগে দাগিয়ে দিয়েছি ৷ কিন্তু তাঁর মধ্যে ক্রিমিনাল সাইকোলজির অধিবাস কোন মূল্যবোধ থেকে চাড়া দিয়েছে তা আমাদের কাছে প্রায় অজানা৷ সেই অজানা অন্ধকারে আলোকপাত করেছে নাটকটি৷এই নাটকে ভিলেনই হিরো৷ তার ট্র্যাজিক ফ্ল থাকা সত্ত্বেও ৷ সে যেন প্যারাডাইস লস্ট এর সেটান বা মেঘনাদ বধ কাব্যের ইন্দ্রজিত৷ অর্ণ মুখোপাধ্যায় এই চরিত্রে অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়েছে যে সত্যিই ক্ষমতার পূজারী | রাজনীতিই তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান | সত্য মিথ্যা আপেক্ষিক ৷ পান্ডবরা অলৌকিক ক্ষমতার কৃপাপ্রার্থী ৷ দুর্যোধন স্বমহিমায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অজেয় ৷
দ্রৌপদীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সোহিনী সরকার৷ কিছুদিন আগে নটধা তাঁকে দলভুক্ত করেছে ৷ আর কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করলো রুদ্ররূপ - - নটধার বর্তমান অফিসিয়াল চীফ। মন কেড়ে নেওয়ার মত অভিনেতা। দুর্যোধনের ভূমিকায় অর্ন অনবদ্য৷ চোখ সরানো যায় না ৷ ওরকম ভাবে একা কোনো অভিনেতা মঞ্চের অন্য সব চরিত্র, আলো, আবহ – সবটা অনায়াস প্রয়াসে নিজের পকেটে ভরে ফেলতে পারে – তা অভাবনীয়। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আর সমস্ত দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো নাটকটিকে চেটেপুটে খেয়েছে ৷ এমনকি হাততালি দিতেও ভুলে গেছে। সবাই সম্মোহিত, অর্ন - রূদ্র - কৌশিক দা- সোহিনীর অভিনয়ের চতুষ্কোণ ইন্দ্রজালে ৷ আর এই মোহময় মায়াজাল বুননের কারিগর সবাই হলেও, প্রধান কারিগর কিন্তু অর্ণ ৷ পাশাপাশি শকুনি ও ধৃতরাষ্ট্রের চরিত্রে কৌশিক চট্টোপাধ্যায় অতুলনীয় ৷ লখনউ - এর বিরিয়ানীর পারফেক্ট সিদ্ধ হওয়া মাটনের মত।
যদি বলা হয় নাটকটিতে ভুল কি ছিলো তাহলে যাঁরা এই নাটকটা দেখেছেন এবং ভবিষ্যতে দেখবেন তাঁরা একমত হবেন, যুধিষ্ঠিরের মত চরিত্র বলিষ্ঠ চরিত্র তুলনায় বড়ই দুর্বল ৷ অভিমুন্য ও তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁদের সম্যক উন্নতির প্রয়োজন আছে ৷ যেখানে নাটকে নকুল-সহদেব বাকি পান্ডবদের চরিত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছেন সেখানে নজর দেওয়া প্রয়োজন৷ তবে ভীমসেনও দুর্দান্ত। যুধিষ্ঠিরের দৃশ্য থাকলেই দর্শকদের মনে ,'আবার ইনি .. কেন!' এই মনোভাব একবারেই কাম্য নয় ৷ ওনার উপস্থিতি নাটকের উচ্চতাকে অকারণে বারবার কমিয়ে দিচ্ছে ৷ সিরিয়াস ডায়ালগ কমিক রিলিফ হয়ে উঠছে। উনি দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুরোনো সদস্য হলেও, এই চরিত্রে ঠিক খাপ খাচ্ছেন না।
অন্ধ সম্রাট ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কৌশিক চট্টোপাধ্যায়৷ পোড় খাওয়া বর্ষীয়ান অভিনেতা৷ মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর সিংহাসন আঁকড়ে ধরার দৃশ্য থেকে প্রত্যেকের অভিনয়শৈলী বিষয়ে শেখার আছে।
এই নাটকটি সম্পূর্ণ দেখার পরে যে মুগ্ধতা আমার মনে সৃষ্টি হয়েছিল, তার অনুরণন তারপর দু'তিন দিন পর্যন্ত ছিল ৷ কৃষ্ণ ও দুর্যোধনের সম্মুখ বাগযুদ্ধ এক অবিস্মরণীর অভিজ্ঞতা। দৃশ্যটি অর্ণর ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে আপলোড করা আছে দেখলাম ৷ কিন্তু হলে বসে সামনাসামনি যে সম্মোহন সৃষ্ট হয়েছিল, ভিডিও টি তার ধারেকাছেও নেই। সোহিনী সরকারের কাছ থেকে যতটা আশা করা গিয়েছিল তা পূর্ণ হতে পারত, যদি অর্ণ আর কৌশিক বাবু ওনার পরে না আসতেন ৷ সোহিনী নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বলিষ্ঠ অভিনেত্রী এবং যথেষ্ট ভাল অভিনয় করেছেন। কিন্তু ঘটনা হলো বাকি অনেক অভিনেতা অনেক ক্ষেত্রেই সোহিনীর অভিনয়কে ছাপিয়ে চলে গেছেন।
এই নাটকের সব থেকে বড় পাওনা হল নাটকটির সিনোগ্রাফি ও কস্টিউম ৷ সিনোগ্রাফির মধ্যে যে সমস্ত আসবাবপত্র, সিংহাসন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলির ডিজাইন উন্নত ও আধুনিক ৷ কস্টিউমের মধ্যেও আধুনিকতার ছোঁয়া প্রতিভাত ৷ আমরা যাকে রাজকীয় বা রয়্যাল বলি তাকে যে আধুনিকতার মোড়কে মুড়ে এইভাবে নতুন কিছু সৃষ্টি করা যায় তা না চাক্ষুষ করলে বিশ্বাস হয় না।
এই গল্পের উপস্থাপনা যা খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে সেখান থেকে এইটুকু বলতে দ্বিধা নেই যে আমি যদি সুযোগ পাই নাটকটি আবারদেখার জন্য, তাহলে আবার যাব ৷ কারণ মহাভারতের এত সুন্দর উপস্থাপনা নাট্যমঞ্চে আমি খুব কমই দেখেছি। তবে এটা মনে করা ভুল হবে যে নাটকটি সম্পর্কে আমার এই ভূয়সী প্রশংসা শুধুমাত্র আমি হাওড়াবাসি ও নটধা হাওড়ার দল বলে। নাটকের সমালোচনার মধ্যে এই আত্মীয়তার কোনো স্থান নেই। তবে এইটুকু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই একজন হাওড়াবাসী হিসেবে এটা ভেবে গর্ব হয় এরকম একটা মনোগ্রাহী নাটক এই জেলার কিছু নতুন নতুন উঠে আসা ছেলেমেয়েরা করে দেখাতে পেরেছে। খুব ভুল না করে থাকলে এই দলের অনেকেই ভবিষ্যতের বাংলা থিয়েটারের মূল কাণ্ডারী হয়ে উঠবেন ৷ নাট্যকার শিব মুখোপাধ্যায় কে সশ্রদ্ধ প্রণাম ও পরিচালক অর্ণকে একরাশ উষ্ণ শুভেচ্ছা !
অনেক কিছু লেখা বাকি রয়ে গেল…




No comments:
Post a Comment