Monday, 31 October 2022

"শিক্ষকরা বাড়িতে বসে বসে মাইনে পায়..."

 

"শিক্ষকরাই হল গিয়ে যত নষ্টের গোড়া...সব বাড়িতে বসে বসে মাইনে পায়..."

অশিক্ষিত পথ-চলতি মানুষের মুখে তা ও মানায় এ কথা। কিন্তু সমাজের উচ্চ শিক্ষিত মানুষ, প্রতিষ্ঠিত লেখক, যখন রিসার্চের সঙ্গে নিজের কল্পিত ধারণাকে মিশিয়ে দিয়ে সেই সাঙ্ঘাতিক ভ্রান্ত ধারণাকে চরম সত্য বলে উপলব্ধ করাতে চান, তখন সমাজ ক্রমে তমশাবৃত হতে থাকে ৷

শিক্ষকদের প্রতি সমাজ কোডিড পরিস্থিতি থেকে খুব হিংসা-প্রবণ হয়ে পড়েছেন, তাঁদের চাকরির নিরাপত্তার জন্য। কোডিডের আগেই এই শিক্ষকরা বড়ই করুনার পাত্র ছিলেন - আহা গো! ক' টাকাই বা মাইনে পায়! জল ও বাতাসের মত ডি- এ সরকারী কর্মচারীদের সাথে সাথে শিক্ষকদেরও ফান্ডামেন্টাল রাইট ৷ কিন্তু তা থেকে অন্যায় ভাবে বঞ্চিত হলে তা নিয়ে বলতে গেলে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যখন বলে বসেন " ঘেউ ঘেউ করবেন না" তখন সবাই তাঁর মতই এই শ্রেণিকে একই রকম চোখে দেখবে সেটাই স্বাভাবিক ৷ ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট আত্মীয় বন্ধুদের কাছেও প্রোফাইল খুব একটা হাই ছিল না। কিন্তু কোভিড শুরু হতেই চিত্র গেল পালটে। একেবারে উলট পুরাণ - সব ব্যাটাকে ছেড়ে ল্যাজকাটাকে ধর।

প্রেস মিডিয়া যে ব্যবসা করে - এ আজ অতি সাধারণ মানুষের কাছেও অজানা নয়। কিন্তু সমাজে শিক্ষকদের দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে বার বার ভুল কিছু ধারণাকে ইনজেক্ট করতে থাকলে তার ফল কিন্তু খুব ভাল হয় না।

একটি প্রবন্ধ আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল গত ২৪ শে আগস্ট ২০২২ তারিখের সম্পাদকের পাতায়। তার কিছু অংশ বেশ ভুল ধারণায় সম্পৃক্ত৷ আমি প্রতিবাদে চিঠি লিখি ৷ আনন্দবাজার পত্রিকা চিরকালই ভুল সংশোধনের ব্যাপারে অতি উন্নাসিক ৷ তাঁরা বাংলা ভাষার এত বড় তালেবর যে বানান বিকৃত করে প্যারালাল ভাষা -অভিধান চালান ৷তাই আর ছাপেন নি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে দু'- এক জন হলেও জানার প্রয়োজন আছে বোধ করে আমার নিজের মাধ্যমে জানানোর এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা... সময় করে পড়ে দেখুন ৷ আর যখন তখন যেখানে সেখানে শিক্ষকদের হেয় প্রতিপন্ন করা বন্ধ করুন ও কেউ সেরকম করলে রুখে দাঁড়ান ৷


প্রকাশিত প্রবন্ধের কপির লিঙ্ক্: ভবিষ্য‍‍ত অন্ধকার




আমার লেখা অপ্রকাশিত চিঠি :

মাননীয় সম্পাদক সমীপে 

আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় 24 শে অগাস্ট, 2022  তারিখে নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলাশীর্ষক যে  প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছেতা নি:সন্দেহে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ৷ আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের সমস্ত স্তরে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে দুর্নিবার কর্মশীতলতা ও শিথিলতা তৈরী হয়েছে তা সত্যই ভয়াবহ৷ এই বিষয়টিকে যুক্তি সম্বলিত তথ্যের উপস্থাপনার মাধ্যমে লেখিকা তাঁর বক্তব্যকে যেভাবে পরিস্ফুট করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেনতা কৃতিত্বের দাবী রাখে এবং এটি তাঁর পাঠকদের মধ্যে এক অবশ্যম্ভাবী সচেতনতার নিশ্চিত দাগ ফেলে যেতে সমর্থ হবে বলে আমার বিশ্বাস ৷ আর সেখানেই আশঙ্কা৷

এমন সুন্দর তথ্য সম্বলিত সমাজ-সচেতন লেখার মধ্যে শিক্ষকদের সম্পর্কে অংশটুকুর কোনো সাযুজ্য নেই ৷ এগুলি শিক্ষকদের সম্পর্কে লেখিকার মনগড়া কথা যা সম্পর্কে তিনি কোনো তথ্য বা যুক্তির ধার ধারেন নি শুধুমাত্র নিজের একটি ধারণার কথা চাপিয়ে দিয়েছেন ৷ ফলে বাকি বৃহত্তর অংশের যুক্তির প্রভাবে এই অংশটুকুও পাঠকের কাছে তথ্য ব্যাতিরেকেও সত্য হিসাবে প্রতিভাত হতে পারে - সেই আশঙ্কা থেকেই এই চিঠির উদ্রেক ৷

বাস্তবে প্রবল অতিমারীতে যখন কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট দূরের কথাকোনো ভাড়ার গাড়িও যে কোনো মূল্যে রাস্তায় নামতে নারাজসেই সময়ে বিদ্যালয় শিক্ষার স্বার্থেশিশুদের স্বার্থেসরকারী নির্দেশ অনুসারে সমস্ত শিক্ষক পালা করেসমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করেজীবন হাতে নিয়ে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন জরুরী কাজে নিয়মিত উপস্থিত থেকেছেন ৷ আমি একজন শিক্ষককে চিনি যিনি একদিনে দশহাজার টাকা গাড়িভাড়া দিয়ে একশো কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে নিজের কর্মস্থলে উপস্থিত থেকে নিজের কর্মনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন ৷ আমার স্থির বিশ্বাস এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে যা আমরা জানিনা এবং সেই সমস্ত শিক্ষকরা প্রচারের আলোয় তাঁদের এই প্রাথমিক কর্তব্য কে আলাদা করে কৃতিত্ব হিসেবে উপস্থাপিত করতে চাননি লেখিকা চাইলে এই গূঢ় তথ্য অনায়াসে নিজেদের এলাকার সরকারী স্কুল থেকে পেতে পারতেন ৷ সাথে শিক্ষকদের উপস্থিতির দৈনিক রিপোর্ট বিদ্যালয় জেলা পরিদর্শকদের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে রোজকার পাঠানো তথ্যের সত্যতা যাচাই এর জন্য  আচমকা নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শনে এসেছেন বিদ্যালয় পরিদর্শকের দপ্তর থেকে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তর থেকে পৃথকভাবে লেখিকা বা যে কোনো মানুষ অনায়াসে এই তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন

সুতরাং অতিমারীর সময়ে টানা দুবছর ধরে কোনো শিক্ষক বাড়িতে বসে বসে বেতন গ্রহণ করেছেন এ কথা সর্বৈব মিথ্যাঅকারণ অপপ্রচার ও অনভিপ্রেত কুৎসা৷ বরং যখন খোদ অডিও ভিস্যুয়াল মিডিয়ার তারকারাও  বাড়িতে বসে কাজ করেছেনশিক্ষকদের বিদ্যালয়ে আসতে হয়েছে, নিয়মিতসরকারী নির্দেশ মেনে৷

মিডিয়া প্রচার করেছে দু বছর ধরে শিক্ষায়তনগুলি বন্ধ ছিল অবশ্যই বন্ধ ছিল ৷ বন্ধ ছিল শিক্ষার্থীদের জন্যশিক্ষকদের জন্য নয় ওই সময়ে বিদ্যালযে আসার জন্য অগুন্তি শিক্ষক কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন ৷ তাঁদের মধ্যে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন ৷ "বিদ্যালয় বন্ধ " আর "বিদ্যালয়ে পঠন পাঠন বন্ধ " দুই বাক্যাংশের প্রয়োগমূলক অর্থ নিরূপণ করলে আকাশ পাতাল তফাৎ পাওয়া যাবে সমস্ত অতিমারী - আক্রান্ত সময় জুড়ে "বিদ্যালয়ে পঠন পাঠন বন্ধ " ছিল; "বিদ্যালয় বন্ধ " ছিল না কখনও -  |

এই সময়ে আক্রান্ত চিকিৎসক-নার্সস্বাস্থ্য কর্মীদের দৈনিক তথ্য মিডিয়া প্রচার করে গিয়েছে ৷ কিন্তু শিক্ষকদের সম্পর্কে কোনো প্রচার ছিল না I মিডিয়া ব্যস্ত ছিল অপপ্রচারে যেস্কুল বন্ধ ৷ স্কুলে সরাসরি ক্লাস রুম ভিত্তিক পঠন-পাঠন বন্ধ ছিল ঠিকই ৷ কিন্তু স্কুলের অফিসতার পরিচালনা ? স্কুলে ভর্তি ? মিড ডে মিল দেওয়ার সময় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বাড়িতে পাঠিয়েতার উত্তরপত্র সংগ্রহ ও মূল্যায়ন করাসেই সমস্ত পাঠ ও পরীক্ষার হার্ডকপিতে নথিভুক্তি ? এ সব ভূতে এসে করে দিয়ে গেলগিনেস বুক অফ ওয়র্ল্ড রেকর্ডস এ পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদের নাম আছে কারণসারা পৃথিবীতে কোনো রাজ্য অধিকৃত একটি বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে এত সংখ্যক শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য নিজেদের নাম নথিভুক্ত করে না   ২০২০ ও ২০২১ -- পর পর দুই বার মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা যে মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হলসেই সব নম্বর তারা আকাশ থেকে পড়ে পায় নি তারা নিয়মিত পড়েছেপরীক্ষা দিয়েছে সেই পরীক্ষার নিয়মিত ও যথাযথ মূল্যায়ণ হয়েছে ৷ সেই পাওয়া নম্বর বোর্ডে পাঠানো হয়েছে ৷ তার ভিত্তিতে মাধ্যমিক পাশ করেছে ছাত্রছাত্রীরা৷ অন্য সকলের সঙ্গেওই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ারাও যাদের মধ্যে অনেকেই নিম্নবর্ণেরযাদের কথা লেখিকা উল্লেখ করেছেন এই বলে যে তারা শিক্ষকদের সঠিক যত্ন থেকে বঞ্চিত৷

উল্টে এই শিক্ষাক্ষেত্র যেন কখনো থমকে না যায়সে জন্য সদা জাগ্রত ছিলেন শিক্ষকরা৷ আর এই বিশাল কর্মকাণ্ড নিউ নর্মালে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে হয় না ৷ শিক্ষকদের সম্পর্কে জনমানসে উদ্দেশ্য প্রনোদিত ভাবে স্কুল বন্ধ মানে শিক্ষকরা বাড়িতে বসে আছেনকাজকর্ম কিছুই করতে হচ্ছেনা - এই ভ্রম সৃষ্টি করা হয়েছে  মাত্র ৷

কেউ সে সব কথা সেদিনও বলেননিআজও বলেন না৷ বাজারের দোকানীরা যেমনটি জানতেনমাননীয়া লেখিকাও সে কারণেই তেমনটিই জেনেছেন ৷ শিশুস্বাস্থ্য সম্পর্কে লিখতে বসে বেরিয়ে পড়েছে শিক্ষককুলের প্রতি অকারণ ক্ষোভ -- যেবসে বসে মাইনে পাওয়া কে শিক্ষকরা অভ্যাসে পরিণত করেছেন ৷

তিনি লিখছেন, "শিক্ষকরাও বাড়ি বসে মাইনে পাওয়ার ব্যবস্থায় এতই আহ্লাদিত হলেন যেমল রেস্তরাঁ পুজো মেলা খুলে গেলেও স্কুল খোলার চেষ্টাই করলেন না"

ভেবে দেখুন তোমল রেস্তোরাঁ পুজো মেলাএমনকি মদের দোকান - এগুলিকে খোলা কার হাতে ছিলসরকারের হাতে ৷ ঠিক সেরকম ভাবেই স্কুল খোলার দায়িত্বও সরকারের হাতেই ছিল 'স্কুল খোলাকথাটির অর্থ যদি শিক্ষার্থীদের ধরে বলা হয়সে ক্ষেত্রেও লেখিকা এড়িয়ে গিয়েছেন শিক্ষকদের তীব্র প্রতিবাদকে যেখানে মল রেস্তোরাঁ পুজো মেলা মদের দোকান -এগুলিকে খোলার সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয় খোলার দাবী শিক্ষকমহলের সর্বস্তর থেকে তোলা হয় ৷ বিভিন্ন শিক্ষক মঞ্চ থেকে রাজনৈতিক রং ছাড়া ডেপুটেশন দেওয়া হয় শিক্ষাদপ্তরগুলিতে যে অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাঙ্গন উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক ৷

প্রসঙ্গতলেখিকা ও পাঠকদের হয়ত মনে আছে যে সেই কঠিন সময়ে একটি বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিলের মাসিক খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী স্কুল থেকে দেওয়ার সময়ে কিছু অভিভাবক ভুল করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেই সব সামগ্রী নিতে উপস্থিত হনযা সরকারী বিজ্ঞপ্তির বিরোধী৷ অত্যধিক দাবদাহে সেই ভুল করে চলে আসা শিক্ষার্থীরা যাতে না অসুস্থ হয়ে পড়েতাই বিদ্যালয় প্রধান অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে সেই সব শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের মধ্যে বসতে অনুমতি দেন ৷ ফলস্বরূপ সেই বিদ্যালয় প্রধানের শাস্তিমূলক ট্রান্সফার হয় ৷ কেউ ভেবে দেখল না যে শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসা বিদ্যালয় প্রধান বা অন্য কোনো শিক্ষকের হাতে ছিল না ফলতঃ তারা যখন অনেক দূর থেকে চলেই এসেছেসন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের যাতে কোনো কষ্ট না হয় সেটা নিশ্চিত করাই ওই বিদ্যালয় প্রধানের ও সহশিক্ষকদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল৷

এই ঘটনাই যথেষ্ট সাক্ষ্ বহন করে যা সেই অভিশপ্ত দুই বছরে কিভাবে শিক্ষকরা নিজেদের প্রাণ ও জীবিকা পণ করে ছাত্রস্বার্থে নিরন্তর নিঃশব্দে কাজ করে গিয়েছেন ৷ যে গুরুতর অভিযোগ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এখানে আনা হয়েছে সেখানে সরকারী শিক্ষাদপ্তরের নির্দেশগুলিই যথেষ্ট রেফারেন্স হতে পারত এভাবে শিক্ষকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে৷

লেখিকা আরো লিখেছেন যে:

"কিছু শিক্ষক আজও বিশ্বাস করেননিম্নবর্ণের প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের শিক্ষা গ্রহণ করার মানসিক ক্ষমতা নেই তাদের কাছে অনলাইন শিক্ষা পৌঁছল কি নাতা নিয়ে কে মাথা ঘামায়?"

 উত্তরে জানাইএ সব মাননীয়া লেখিকার কল্পনাপ্রসূত ৷  প্রত্যেকটি শিক্ষক আজ চিন্তিত যেযে দেশে পুষ্টিকর খাদ্য পাওয়ার আশায় অভিভাবকরা বিদ্যালয় প্রধানের কাছে দরবার করে অনুরোধ রাখেনযে বিদ্যালয় বন্ধ থাকলে তাঁদের সন্তানরা খেতে পাবে না তাই বিদ্যালয় যেন ছাত্রছাত্রীদের জন্য বন্ধ না হয়সে দেশে অনলাইন শিক্ষার খরচ কিভাবে কে বহন করবে ? যে দেশে মিড ডে মিলে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মাথাপিছু সাত টাকা পঁয়তাল্লিশ পয়সার খাবার প্রতিদিন বরাদ্দ হয়সেখানে শিক্ষার্থীর বর্ণ বা মানসিক ক্ষমতা নয়আর্থিক ক্ষমতাই প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠিসেক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষা সত্যিই বাস্তবে এক অবাস্তব সমাধান ৷

যে সমস্ত শিক্ষকরা নিরন্তর বিশাল সংখ্যক পিছিয়ে পড়া প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে চলেছেনতাঁদের জানাই স্যালুট ৷ আর মাননীয় লেখিকাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদকারণ ওনার লেখায় ওইটুকু ত্রুটি না থাকলেআমি এতটা লেখার সুযোগ পেতাম না ৷ সমাজে শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে এভাবে ছেলেখেলা করলে ভবিষ্যৎ কিন্তু সত্যিই অন্ধকার৷ একদিন কিন্তু সমাজের মেরুদণ্ড সোজা রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বেশিক্ষককুলকে এভাবে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করলে ৷ এর মধ্যে কোনো গৌরব নেই ৷ সোশ্যাল মিডিয়া বা টিভিতে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য তাই এমন ব্রেকিং নিউজ বানাবেন না যাতে আপনার নিজের বাড়ির শিক্ষাভিজাত পঞ্চমজনু শিক্ষকহীন প্রজন্মের একজন ভাঙাচোরা মানুষ হয়

ধন্যবাদান্তে,

আর্য চ্যাটাজী 

হাওড়া

 

 

Saturday, 29 October 2022

ঝাউতলায় ঝঞ্ঝাবাৎ : দ্বিতীয় পর্ব : গঙ্গেশ দার বিদেশ যাত্রা


ঘটনা বিশেষ কিছু নয় ৷ গঙ্গেশ দা বিদেশে গিয়েছেন, মেয়ের কাছে। স্বাভাবিক সাধারণ ঘটনা৷ রিটায়ার্ড লোক ৷ স্ত্রী গত হয়েছেন বহু বছর পূর্বে ৷ তাই নিজের সন্তান সন্ততির কাছে চলে গেলে একা থাকতে হয় না। এই বয়সে শুধু নিজের জন্য রোজ বাজার করে, রান্না করে, একা একা থাকতে কারও ভাল লাগার কথা নয়। ঝাউতলার সবাই বেশ খুশি যে বাউন্ডুলে জীবনের চেয়ে এটা অনেক ভাল একটা পথ। ঝাউতলায় এই নিয়ে মাঝে মধ্যেই আলোচনা হয় ৷


কিন্তু গঙ্গেশ দা যাবার পর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ৷জগতে হোয়াটসঅ্যাপ বলে একটি ব্যাপার যে আছে তা শুধু ফোনে ইন্সটল করা আছে - ওই পর্যন্ত ই | চিরকালই এক রকম - খবর যা যতটুকু পাওয়ার উনি পেয়ে পড়ে ক্ষান্ত ৷ বাস্তবিক যদি কিছু করার থাকে, কেউ অসুস্থ হলে হাজির হওয়া, কারোর মৃত্যুতে শ্মশানযাত্রী হওয়া, নেমন্তন্নে উপস্থিত হওয়া, পিকনিকে চলে যাওয়া বা ঝাউতলায় চা সিঙ্গাড়া খাওয়া সব টাই হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে খবর পেয়ে এগিয়ে এসে দায়িত্ব সহকারে পালন করেন - কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে উত্তর ? না এটা আমরা ওনার থেকে কেউই আশা করতে পারিনা ৷ অনেক বার অনেক রকম ভাবে এই নিয়ে অপমান করার চেষ্টা করা হয়েছে। গায়ে মাখেন নি। আসলে উনি যে এসব পারেন না, তা কিন্তু নয়। যিনি কম্পিউটারে এম এস উইন্ডোজ ব্যবহার না করে সবাইকে উবুন্টু ব্যবহার করার জন্য সদা প্রচেষ্ট, তিনি সামান্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন না - এটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয, একেবারেই ৷ কিন্তু গঙ্গেশ দা যদি মনে করেন যে করবেন না, তাহলে কোই মাই কা লাল নেহি, যে ওনাকে দিয়ে সেটা করিয়ে নেবে ৷ আর ওনার সবথেকে বড় দুটি রোগ হল যে উনি এক জায়গায় স্থির হয়ে দু দণ্ড দাঁড়াতে পারেন না আর কথা না বলে থাকতে পারেন না। সেও আবার ফুল ভল্যুমে ৷

এ হেন গঙ্গেশ দার পক্ষে যে আমেরিকা খুব একটা সুখকরজায়্গা হবে না তাতে আমরা নিশ্চিত ৷ উনি বিদেশ যাচ্ছেন আমরা খুশি ৷ কিন্তু উনি নিজে কি খুশি? হাওড়ার শিবপুর থেকে সিয়াটেল শুনতেই ভাল, থাকার জন্য মোটেও ভাল না। চুনো মাছ পাওয়া যায় না ৷ ঝোল কাকে বলে জানে না ৷ কিছু বললেই নাকি ঝোপ ঝাড় জঙ্গল পশু প্রানী সব কুচো করে কেটে চিজ মাখিয়ে দুটো ফুলো ফুলো টোবলা হওয়া পাঁউরুটির মধ্যিখানে ঠেসে দিয়ে বার্গার বলে চালিয়ে দেয়। সে সামর্থ্য না থাকলে পাতি কাটা (স্লাইসড) পাঁউরুটির পাশগুলো কেটে ওই একই মালের ওপরে নিচে দিয়ে বলে স্যান্ডউইচ | আর রান্না বান্না করার ঝক্কি ঝামেলা নেই - সবটাই হয় সেদ্ধ করা, না হয় কাঁচা | আরে পাঁউরুটিই যদি খাবি বাসি কচি পাঁঠার ঝোলে ডুবিয়ে খা ! কোনোদিন বাসি লুচি দুধ-চায়ে ডুবিয়ে খেয়েছে?

ভাবতে পারা যায় যে সেই গঙ্গেশ দা কি না আমেরিকা গেছে ৷ যাবার আগে রাজকুমার দা বলেছিল যে,

- গঙ্গেশ দা আপনি স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলে পাঠাবেন ৷

- দেখ , আমাদের দেশের একটা সম্মান ও ঐতিহ্য আছে। ওরকম খালি গায়ে হাত তুলে লিবার্টি লিবার্টি বললেই হবে ! গান্ধিজি ওই জন্য হাত তোলেন নি ৷ খালি গা তো ! আর নেতাজি হাত তুলে দিল্লী চলো হাঁক পাড়ার সময়ে ফুল মিলিটারি ইউনিফর্মে ছিলেন। কারণ এনারা জানতেন খালি গায়ে ওভাবে হাত তোলাটা অশালীন ৷

- অশালীন কেন?

- তোমরা না অশালীন মানেই খুব খারাপ কিছু ধরে বসে থাক ৷ আমি কিন্তু সে সব বলি নি।

- তবে কি বলছেন সোজাসুজি বলুন না ...

আমি ধৈর্যচ্যুত হয়ে বললাম ৷
- তুই একটা মাস্টার, কত পড়িস লিখিস তোর মাথাতেও কুলোলো না ?

আমি চুপ করে গেলাম ৷ তাপস দা বলল
- আপনি ভ্যানতারা না কষে বলুন তো, কেন অশালীন ?

- আরে সহজ ব্যাপার - খালি গায়ে ওরকম হাত তুললে
বগলের গন্ধ বোরাবে না ! আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটা সেন্স অফ ডিসেন্সি ছিল ৷ ওদের সবটাই একটা লোক দেখানো ব্যাপার ৷
- এটা কি ঠিক বলছেন আপনি?

- না তো কি - আমাদের বাড়িতে ছোটবেলা থেকে দেখেছি জামাকাপড ছিঁড়ে ফেটে গেলে ওসব বাসনওয়ালাদের দিয়ে বিনিময়ে বাসনকোসন নেওয়া হত ৷ আর কিছু রেখে দেওয়া হত ন্যাতা ন্যাকড়া এসব করার জন্য। সে দিন কি একটা দোকানে গেলুম নাম - লে ভাইজ | গিয়ে দেখি রাজ্যের ছেঁড়া ফাটা ফুটো রঙচটা ক্যাম্বিসের মত কাপড়ের প্যানটুল ৷ পাশে লেখা free offer | আমি ভাবলাম ভেবে নাম বের করেছে বটে 'লে ভাইজ' মানে 'ভাই সকল নিয়ে যাও' ৷ তা বেছে টেছে একটা প্যান্টুল নিলাম ৷ ডান হাঁটুতে তিনটে বাঁ থাই এ দুটো ফুটো ৷ ও বাবা নিয়ে বেরোব কি- একটা ছেলে এসে ধাঁ করে আমার হাত থেকে ওটা কেড়ে নিয়ে বলল


- ডু ইউ লাইক দিস স্যার ?

- ভাই ছেঁড়া প্যান্টের আবার ভাল খারাপ..

- ইউ হ্যাভ এ ভেরি গুড সেন্স ওফ হিউমর স্যার..

- তোমার বুকে নাম যা লেখা তাতে তো তুমি চক্কোত্তি বাউন ৷ বাংলা বলতে পারো না?

- হ্যাঁ স্যার ৷

- এই ফুটো ফুটো প্যান্ট টা আমি নেব ৷ কাপড়টা মোটা কিন্তু নরম।

- হ্যাঁ স্যার এটা রিয়েল ডেনিম আর স্ট্রেচ | স্পেশাল এডিশন এটা শটগান জিনস | ডিস্কাউন্ট দিয়ে চার হাজার দুশো ৷

আমি তো শুনে থ মেরে গেছি ৷ ভাবছিলাম বাড়ির ন্যাতা করব ৷ গঙ্গেশ দা বলল ৷
- তবে যে লেখা free?

- ওটা স্যার তিনটে কিনলে একটা ৷

- তাহলে লে ভাইজ বলে লোক ঠকাচ্ছ কেন?

- লোক ঠকাব কেন স্যার লি ভাইস পৃথিবীর best jeans brand

- অ অ অ ... তা ভাই এমনি গোটা প্যান্ট নেই?

- হ্যাঁ স্যার আছে তো ৷ দাম ও কম ৷ টু থাউজ্যান্ড ফাইভ হানড্রেড আফটার ডিস্কাউন্ট৷ আর দুটোর সঙ্গে দুটো ফ্রি ৷

- আমি শুধু ফ্রি টা নিতে পারিনা ?

- কি যে বলেন স্যার !!


মানে কি দাঁড়াল? ভাব ! আস্ত গোটা নতুন ইস্তিরি করা প্যান্টুলের দাম ছেঁড়া ফাটা রঙ চটা প্যান্টুলের থেকে অনেকটা কম ৷ একটা অত্ত বড় দেশ কিন্তু বুদ্ধি দেখ! টাইটানিক বানালি কিন্তু প্রথম টিরিপেই জলের তলায় ৷ও দেশের স্ট্যাচু অব লিবার্টির সঙ্গে ছবি তুলে পাঠালে আমাদের লজ্জা ৷ তার থেকে আমাদের কাগে পায়রায় হেগে দেওয়া গান্ধীর টাক মাথাওয়ালা স্ট্যাচু আমার কাছে অনেক বেশি অ্যাক্সেপ্টেবল ৷ পয়সা থাকলেই হয়না - আকবর শাজাহানের মত টেস্ট থাকতে হয় ৷ বগল তুলে লিবার্টি হয় না। বুইলে !

রাজকুমার দা চুপ ৷

আমরা সন্দেহ করছিলাম যে এ হেন গঙ্গেশ দা এরোপ্লেনে চড়ে বিদেশ গেলেন ৷ ফলে কি কি ঘটতে পারে ৷




প্রথমে উঠে এল যে মারাত্মক বিষয়টি যে আমেরিকা গামী কোনো ফ্লাইট কোথাও ইমারজেন্সি ল্যান্ডিং করেছে কি না, সেই রকমের খবরে চোখ রাখা ৷ কারণ গঙ্গেশ দা অতক্ষণ এক ভাবে সীটে বসে থাকতে পারবেন না ৷ হোস্ট ও হস্টেস দের মাথা চিবিয়ে খেয়ে পাইলটের কাছে পৌঁছে যখন তাঁকে রিয়েলাইজ করাবেন যে জীবনে প্লেন চালানো সাইকেল চালানোর থেকেও সহজ এবং উনি পাইলট হয়ে জীবনে এমন কিস্যু গর্ব করার মত করেন নি, তখন আর পাইলট যে সেই প্লেন চালাতে চাইবেন না সেটাই স্বাভাবিক ৷ হয় গঙ্গেশ দা না হয় উনি - দুজনের একজনকে নামতেই হবে। না হলে ফ্লাইট যাবে না।

আর দ্বিতীয় যে সম্ভাবনা তাপস দার মাথায় এল তা হল, কথা বলার লোক না পেয়ে রাগে দুঃখে ফ্রাশট্রেশনে গঙ্গেশ দা না কি কাউকে কিছু না জানিয়ে মাঝ পথে ফ্লাইট থেকে নেমে হাঁটা দিতে পারেন, যে দিকে দু চোখ যায় ৷

প্রশ্ন উঠল একি ৭২ নং রুটের বাস নাকি যে যেখানে খুশি চলন্ত অবস্থাতেও তা থেকে নেমে যাওয়া যায়!এটা বিমান। পাসপোর্ট ভিসা অনেক ঝামেলা| এক একটা দেশে এমন কড়াকড়ি যে পুলিশ যদি একবার ধরে , উদ্ধার করার লোক পর্যন্ত পাবে না ৷ এটা হিন্দি সিনেমা নয়, যে কেউ গিয়ে হাঙ্গামা মাচিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবে ৷ আরও অনেক টেকনিক্যাল জাটিলতা আছে ৷ যেখানে সেখানে হল্ট হল বলে নেমে পড়ে চলে গেলাম - এরকম হয় না।

কিন্তু তাপস দার ওই এক কথা,

- গঙ্গেশ দা সব পারে, তোমাদের কোনো আইডিয়া নেই ৷

পুজোর আগে গঙ্গেশ দা তাপসদার মুখে চুনকালি লেপে দিয়ে আবার ফিরে এসেছেন ৷ কিন্তু শিবপুরের পাড়া থেকে নড়ানো যাচ্ছে না। কিছুতেই ঝাউতলায় পাওয়া যাচ্ছে না।

অপেক্ষায় আছি , বাগে পেলে ঝুলি থেকে  কিছু যদি টেনে বের করা যায় ৷

Tuesday, 25 October 2022

"স্মৃতিকল্পদ্রুম":


আমাদের বাড়িতে বেশ কিছু পুরোনো বাংলা পুঁথি ছিল ৷ বাবা সাধারণ সালকের ইস্কুলের মাস্টার মশাই হলেও তাঁর জ্ঞানের পরিধি উপলব্ধি করতে হলে সেই পুঁথিগুলো নিয়ে গত ১৫ বছর ধরে তা উদ্ধার করে একটি বই ছাপতে উদ্যোগী হয়েছেন ৷ " এবং মুশায়েরা" এই বই টি প্রকাশ করতে রাজি হয়েছে। দ্বিতীয় প্রুফ রিডিং চলছে ৷ প্রকাশক একান্ত অনুরোধ করেছেন আর কিছু যোগ না করতে, কারণ বিষয় এমন জটিল , আর তার content ও যে কম্পোজার এডিট করতে চান না।

বাবার বর্তমান বয়স ৮৮ | বয়সের ভারে ন্যুব্জ... একমাত্র আশা জীবিত অবস্থায় ওনার লেখা বইটির প্রকাশটুকু দেখে যাওয়া...

রাখলাম বইটির শেষ অংশ থেকে খানিকটা,আমাদের বাড়ির পুঁথির কিছু ছবি আর সংস্কৃত গ্রন্থাগারের কিছু অমূল্য সম্পদের ছবি, যা নিয়ে কাজ করার মানুষও দুষ্প্রাপ্য হচ্ছে ধীরে ধীরে....

বাবার পক্ষ থেকে আলাদা করে ধন্যবাদ শ্রী কমল ঘোষ মণ্ডল মহাশয়-কে যাঁর সাহায্য ছাড়া এই কাজ হয়ে ওঠা অসম্ভব ছিল।

আর বাকি থাকে আশীষ কাকুর কথা (বাবার ছাত্র ও লেখক শ্রী আশীষ মুখোপাধ্যায়) যিনি প্রথম বুঝ্তে পারেন যে বাবা-কে দিয়ে কাজটা না করিয়ে নিলে, এটা চিরতরে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।


শেষকথা

বাক্যের পরিশেষে নিবেদনঃ


অনুমান করি যে বাংলা বাক্যের বিচিত্র ব্যবহারে মূল সংস্কৃত গ্রন্থের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা আছে স্মৃতি নিবন্ধের এই অনুবাদ, ভাবানুবাদ, কোথাও বা আক্ষরিক অনুবাদের অনুবাদ প্রায়শই মূলের সংস্কৃতের অনুরণন৷ ভাষান্তর বা অনুবাদে তা হওয়াই স্বাভাবিক যেহেতু সংস্কৃত ও বাংলার বংশ কুলজি এক, যদিও সংস্কৃতে পদ বসাবার রীতি সুনির্দ্দিষ্ট নয়, তুলনায় বাংলায় তা নির্দ্দিষ্ট অনেকখানি 'স্মৃতিকল্পদ্রুম -এর মূল সংস্কৃত পুঁথি থাকলে তা আমাদের অজানা এই স্মৃতি নিবন্ধ প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি বিষয়ে নানা প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থের বক্তব্য বা মতের একটি সংকলনও হতে পারে (নানা স্মৃতিকারের মতের উল্লেখ, 'পূর্বপক্ষ '  'উত্তরপক্ষ ' রীতিতে তাদের স্থাপন আমরা লক্ষ করেছি আগেই) আমরা রঘুনন্দনের 'মলিম্লুচতত্ত্ব'-এর পুঁথি এবং প্রায়শ্চিত, অশৌচ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে দু'তিনটি অন্য পুঁথির কিছু কিছু অংশ পাঠ করতে গিয়ে দেখি যে বক্তব্যে মিল থাকায় সেখানেও সংস্কৃত নানা বাক্যের গঠন, বড়ো বা ছোট বা ভাঙ্গা ক্ষুদ্র বাক্যের ব্যবহার আমাদের আলোচ্য 'স্মৃতিকল্পদ্রুম'-এর বাংলা বাক্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়, বক্তব্যের উপস্থাপনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া কিন্তু আমাদের আলোচ্য রাধাব‌‍ল্লভের 'স্মৃতিকল্পদ্রুম" নিবন্ধের বাংলা ভাষার প্রকৃতিকে আড়ষ্ট বা ছায়াবৃত করতে পারেনি বরং ভাষান্তর পেয়ে বাংলা গদ্যে তা সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্য ও স্ফুর্তি এনেছে

 "স্মৃতিকল্পদ্রুম"-এর গদ্য ব্যবহারিক গদ্য, প্রয়োজনের গদ্য এর লক্ষ্য যা ই হোক, এর বাংলা গদ্য ভাষা যথেষ্ট মূল্য পাবার যোগ্য উপেক্ষা যা পেয়েছে তা আমাদের অজ্ঞতা ও অনবধানতার জন্য পণ্ডিতেরা বলছেন স্মৃতি, জ্যোতিষ, ন্যায়, চিকিতসা ইতাদি বিষয়ে ১৭শ -১৮শ শতব্দীতে লেখা গ্রন্থের পুঁথি খোঁজ করলে অনেক পাওয়া যাবে অর্থাৎ এ-সব উপলক্ষে বাংলা গদ্যের চর্চার অভাব ছিল না সেকালে কেবল মিশনারিদের বা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্যোগে বাংলা গদ্যের পরিকল্পিত ধারাবাহিক চর্চা সেক্ষেত্রে ছিল না  পরন্তু কলেজের প্রকাশিত গদ্য গ্রন্থে সাহিত্য গুণ যা ছিল তার কারণ সেগুলি ছিল প্রধানতঃ কোনো সাহিত্য গ্রন্থের অনুবাদ  স্মৃতিকল্পদ্রুম ইত্যাদি মধ্যযুগের বাংলা গদ্যগ্রন্থ ছিল শ্রেণি বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ প্রয়োজনের গদ্য ৷ সাহিত্য রচনা তাদের লক্ষ্য নয়, মুদ্রনের আশীর্বাদ ও তারা পায় নি ৷ প্রবল বাংলা কাব্যধারার প্রতিস্পর্ধী স্বতন্ত্র সাহিত্য ধারার বিচিত্র শক্তি তারা নানা কারনে প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি ৷ ঐ কালপর্বে রাজনৈতিক পটবদল, দুর্ভিক্ষ, অরাজকতা ইত্যাদি তার কারণ হতে পারে ৷ কিন্তু রামরাম, মৃত্যুঞ্জয় রামমোহনেরা (সতেরো বছর বয়সেই রামমোহন মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে একটি গ্রন্থ লেখেন ) আকাশ থেকে পড়েন নি, হঠাৎ তাঁদের দ্বারা বাংলা গদ্য আবিষ্কৃত হয়নি বরং তাঁদের লেখায় স্মৃতিকল্পদ্রুম -এর স্বচ্ছতা স্বাচ্ছন্দ সর্বত্র কোথায় !