(ইংরেজীতে)
-আপনি কি পড়াবেন?
-তৃতীয় লেসন-এর গল্পটা…
-ওটা বেশ কঠিন…
-আমার আবার ওটাই পছন্দ।
- বেশ, শুরু করুন, তবে…
-কতক্ষণ সময় পাব? পড়ানোর জন্য?
-পনেরো মিনিট।
আমার এই নিয়ে রাজ্য সরকার পোষিত ইস্কুলে
চাকরী করার জন্য তৃতীয় ডাক। আগের দুই ডাকের প্রথমটিতে সারাদিন নানা সরকারী পদ্ধতি অনুসারে
নথি পেশ এবং অন্যান্য সব সমাধা হওয়ার শেষে জানতে পারলাম যে আগে থাকতেই নাকি সেখানে
অন্য আর এক জনের ‘খুঁটি’ বাঁধা ছিল। তখন আমি
নানা সংবাদ পত্রে লেখালিখি করে বেশ খানিকটা এগিয়ে পড়েছি। কিন্তু ওই জীবন ও তার মূল্যবোধের
সঙ্গে কিছুতেই খাপ খাচ্ছে না – সাংবাদিকের স্বাধীনতা টেঈলরমেড হলে যা হয় আর কি! সঙ্গে
আমার অতিকষ্টে যোগাড় করা খবর মাননীয় সাব-এডিটরের
দয়ায় একটু অদল বদল করে অন্যের নামে ছাপা হয়ে যাচ্ছে। কারণ, আমি ঠিক করে তৈলমর্দন করতে
পারছি না। উল্টোদিকে সিনগল-মল্ট পৌঁছোচ্ছে তৈলের বদলে। দেখতে পেলাম, অন্যদের কেরীয়ার
গ্রাফ কেমন হু হু করে আমাকে ছাপিয়ে চলে যাচ্ছে। ফ্রি-লান্সার হিসেবে একা সুদীপ-দার
আমাকে আগলে চলল। এছাড়া দেবিকার কাছ থেকে পেলাম
যথারীতি বাইরের জগতের সঙ্গে লড়ে যাওয়ার পাঠ। ১৯৯৭ সালের নভেম্বর মাস – হাতে দুটো চাকরী,
একদিকে কর্পোরেট মিডিয়া আর এক দিকে ছা-পোষা ইস্কুল মাস্টারী। খবরের কাগজে আমার নাম
সমেত খবর ছাপা হবে, এই বাই-লাইনে নিজের নাম দেখে দেখে এত হেজে গিয়েছি যে সেটা তখন আর
আলাদা করে কোনো অর্থ বা গুরুত্ব কোনোটাই রাখে
না। যা অর্থবহ তা হল কোনটা আমাকে ভাল রাখবে।
ছোটবেলায় একটা স্বপ্ন দেখতাম, যেমন সব ছোটরাই দেখে যে আসেপাশে বড়দের মত স্বাধীন কবে হব। বড় হতে হতে বুঝেছিলাম, ছোটরাই বরং সবথেকে বেশি স্বাধীন। যত বড় হব জীবন তত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পরাধীন তো বটেই, অজগরের মত ধীরে ধীরে আমাকে একটা মাংসপিণ্ডে পরিণত করলেও আশ্চর্য হব না। তাই তুল্যমূল্য বিচার করে দেখলাম, যে হয়ত অনেক কম বেতনের চাকরী, তবে একটা অন্য ভাললাগা আছে। বাবা-মা-দাদু সবাই শিক্ষক। তাই বংশানুক্রমে এই পেশার প্রতি আনুগত্যস্বরূপ সচেষ্ট হলাম। আমাকে এই ব্যাপারে কেউ জোর করে নি। বাবা বলেছিলেন
-
তুমি
যা ভাল বোঝ…।
ভেবে দেখলাম, বিকেল সাড়ে চারটের পরে
আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। ষাট বছর বয়েস পর্যন্ত চাকরী করতে পারব, অত্যধিক মানসিক চাপ ও
সংঘাত-কে ব্যতিরেকেই। সবথেকে বড় কথা দিনের এতটা সময় নিজের। সেই সময়ে আমি ফ্রি-লান্সিং
চালিয়ে যেতেই পারি। আর এই চাকরীতে কাউকে আমার কাজের আউটপুটের জন্য কৈফিয়ৎ দিতে হবে
না। না থাকবে টার্গেট না ডেডলাইন। সিলেবাস এমনিই শেষ হয়ে যাবে কারণ মানুষ কিছুর জন্য
সবটুকু উজাড় করে দিতে পারে, যখন তার মধ্যে সেই বিষয়ে দুটো জিনিস থাকে –প্রথমতঃ, সেই
কাজ-কে ভালবাসা আর দ্বিতীয়ত, সেই কাজে তার অপার স্বাধীনতা। দেখলাম, জীবন ও কাজ -- দুটোতেই
স্বাধীনতা দেয় এই পেশা। সিদ্ধান্ত নিলাম, সাংবাদিক নয়, শিক্ষকই হব, প্রধানত।
তারপর সেপ্টেম্বরে এই ডাক। একটাই ভরসা, টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র চাকরীটা মোটামুটি পেকে এসেছে, আর মাস দু-একের অপেক্ষা। তবুও স্বাধীনতার স্বাদ পেতে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। সেদিন মোট ক্যাণ্ডিডেট আমাকে নিয়ে বাঈশ জন। বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, নাম কালিবাবু, এসে সটান আমাকে বললেন,
-আপনার যা রেকর্ড দেখছি, তাতে আশেপাশে
কেউ নেই। শুধু ক্লাস-প্রেসেন্টেশন / ডেমোন্সট্রেশন আর পারসোনাল ইণ্টারভিউ- দুটো
যেন ভাল করে উতরে যায়, দেখবেন। মনে রাখবেন এখানে পুরোটাই কিন্তু ফেয়ার গেম। কোনো কারচুপি
নেই।
-আপনি মেথড ফলো করুন। হচ্ছে না…
আমি কোনো কথায় কর্ণপাত না করে আমার
মেথডেই পড়িয়ে চললাম।
মিনিট দশেক পরে বলা হল,
-ঠিক আছে…আর দরকার নেই।
আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম,
-
দশ
মিনিট হয়েছে। আমি কি আমার জন্য বরাদ্দ পনেরো মিনিটের আর পাঁচ মিনিট পেতে পারি?
সবাই
এ-ওর দিকে তাকিয়ে শেষে রাজি হলেন।
আমি
ছেলেদের আমার পড়ানো অংশ থেকে প্রশ্ন করতে থাকলাম। সব্বাই ঠিক উত্তর দিল। দুটো এম-সি-কিউ
লিখতে দিলাম। দু-তিন জন ছাড়া সকলেই ঠিক উত্তর ও লিখল।
আমার আগে
যাঁরা অত্যন্ত সহজ পাঠ পড়িয়ে গিয়েছেন, সেখান থেকে প্রশ্ন করতে ক্লাসের ছাত্ররা একটি
প্রশ্নের উত্তর-ও দিতে পারল না।
তখন আমি সিলেকশন কমিটিঢ় উদ্দেশ্যে বললাম,
-
আমি
শিক্ষক। আমার লক্ষ্য সার্থক শিক্ষাদান। যে ছাত্ররা শিক্ষালাভের আশায় উন্মুখ হয়ে ক্লাস
আলো করে আছে, তাদের আমি এমন ‘মেথড’-এ পড়াতে নারাজ, যে গোটা ক্লাসটাই অন্ধকারে ডুবে
যায়। আমার আগে যাঁরা মেথড ফলো করে পড়িয়েছেন, আমার বিশ্বাস তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষাদানে
ব্যর্থ হয়েছেন, এবং তা আমি আপনাদের সামনে প্রমান করে দিলাম। শিক্ষক হিসেবে আমার প্রাথমিক
কর্তব্য সফল শিক্ষাদান, তা সে যে মেথডেই হোক না কেন। ধন্যবাদ সকলকে আমাকে এই এক্সট্রা
সময়টুকু দেওয়ার জন্য।
কালিবাবু আমাকে এসে বললেন,
-
তুমি
আমার থেকে অনেক ছোট। তাই ‘তুমি’ করেই বলছি। এটা তুমি কি করলে। তুমি পুরো সিলেকশন কমিটি
কে চটিয়ে কেন দিলে, এভাবে? তুমি কি সত্যি-ই চাকরীটা করতে চাও না!
- না
স্যার, অবশ্যই চাই। কিন্তু আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে আমি করেছি। এবার সবটাই ওনাদের হাতে।
কি ঠিক কি ভুল ওনারা বিচার করুন।
পারসোনাল ইণ্টারভিউ-তেও তাই-ই হল। অনেক কিছু নিয়ে বিতর্ক। কিন্তু মাথা গিয়েছে চড়ে, দমবার পাত্র আমি নই।
সাংবাদিকতা আমাকে একটি বিষয়ে ভীষন
অনুশীলিত করেছিল। অনেক তাবড়-তাবড় মানুষের সামনে নির্ভিয়ে কথা বলতে, তাদের বিরোধীতা
করতে। তাদের কথার প্যাঁচেই তাদের ঘায়েল করতে। তাই বুক এর দুরুদুরু করে না, পা-ও কাঁপে
না, তিনি যে তালেবর-ই হন না কেন।
তাই লাগাতার চলল সেই রেশ…একনাগাড়ে।
এক্সপার্ট বললেন,
-এত অ্যারোগ্যান্স নিয়ে শিক্ষকতা করবেন কি করে?
-আমি ছাত্রদের পড়াব, শিক্ষকদের নয়। কারণ এখানে উপস্থিত সকল শিক্ষক আমার থেকেও অ্যারোগ্যান্ট, কারণ তাঁদের বিশ্বাস যে তাঁদের থেকে বেশি কেউ জানতে পারে না। তাই তাঁদের বিরোধীতা করলেই মনে হয় সেটা অ্যারোগ্যান্স। তাঁরা ওপেন মাঈন্ডেড নন কোনো স্বাস্থ্যকর আলোচনা বা বিতর্কের ক্ষেত্রে। ‘ইন্টারভিউ' শব্দের অর্থ ভাবের বিনিময়। আমি তাই-ই করার চেষ্টা করছি। ভুল বলে থাকলে মাফ করবেন। বলুন তো, এই কথাটা কেউ কোনো ক্যান্ডিডেট-কে জিজ্ঞেস করেন, “আচ্ছা আপনি চাকরীটা করবেন তো?” …আমরা এই বাইশজন আজ সব কাজ ছেড়ে এখানে সারাটা দিন খরচ করে কি জন্য এসেছি?
-আমাদের জানতে হয়, সরকারী ভাবে যে ক্যান্ডিডেট 'উইলিং' না 'আনউইলিং'।
-সেটাই বলছি, কেউ আনউইলিং হলে আসতেন না। এটা জিজ্ঞেস করা মানে তাঁদের সবাইকে বেশ ঘুরিয়ে অপমান করা...বলতে বাধ্য হচ্ছি সেই বোধের খুব অভাব আছে তাহলে...উচ্চশিক্ষিত হয়েও..।।
যখন ঘর থেকে বেরোলাম, কালিবাবু আমাকে এই মারেন তো সেই মারেন। জানি না, একজন অপরিচিত ব্যক্তি হটাৎ সকাল থেকে কেন আমাকে এত স্নেহ করে চলেছেন। আমি সবথেকে জরুরী দু’টো জায়গায় বাকি একুশ জন কে ছাপিয়ে কিছু করলাম বটে, কিন্তু যা করলাম, তাতে কোনো আশা রইল না আর। একুশজনের আট-দশ জনের মুখে এক অব্যক্ত আনন্দ ফুটে বেরোচ্ছে। ওদের মধ্যে যে কোনো একজন পাবে বটে, চাকরীটা। কিন্তু ভাবে নি, আমি এইভাবে ওয়াক ওভার দেব।
তবে বেশ মনে মনে আনন্দ পেলাম, ওই একুশ জনের সঙ্গে আরো পাঁচজনকেও ধুয়ে এসেছি। চাকরীটা না পেলেও সারাজীবন এই ইন্টারভিউ তাঁদের মনে থাকবে…যেমন আমার আছে, আজও।
নভেম্বরের শুরুর দিকে হঠাৎ একদিন আমাদের সালকিয়ার বাড়িতে ওই ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয় হাজির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে। বললেন,
-ভারতীয় ডাক ব্যবস্থার যা অবস্থা তাতে সবটুকু ভরসা করতে পারলাম না। ডাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদি দেরী হয়ে যায়, তাই তোমাকে হাতেও একটা পৌঁছে দিলাম।
ঠিক পরের দিনই অপ্রত্যাশিত ভাবে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-র প্রোবেশানারী অফার লেটার এল, স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে। উত্তেজনা ও মোহ পাশে রেখে নীল রক্তের ডাকে সাড়া দিলাম। পেরিয়ে গেল তেইশ বছর, এই ইস্কুলেই।
বাবা ঠিকই শেখান…সিস্টেমের সব খারাপ, এটা কখনই হতে পারে না। লাল ফিতের বজ্র-আঁটুনিতে ফস্কা গেরো-ও রয়েছে বই কি!

No comments:
Post a Comment