শিক্ষক হতে গেলে কি কি থাকা দরকার, এই নিয়ে একটি বহু প্রচলিত বাংলা দৈনিকের সাপ্তাহিক শিক্ষার পাতায় যখন লিখতে বসেছিলাম, বুঝেছিলাম যে সময় বদলে গিয়েছে। আমি নিজে পেশায় শিক্ষক, রাজ্য সরকার পোষিত অনামী এক বিদ্যালয়ের। আমার বাবা-ও তাই-ই ছিলেন। তবে সে সময় ছিল সত্যি-ই অন্য।শিক্ষকদের সমাজে এক অন্য সম্মান ছিল। এখন তা কোনো এক কারনে ক্ষয়ে গিয়েছে। পুরোনো মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়ত তার একটা বড় কারণ। এখন যেমন শিক্ষকসমাজের ওপর কেমন যেন সবার একটা চাপা গাত্রদাহ – এত ছুটি কেন, কয়েক ঘন্টা পড়িয়ে এত বেতন, কেন? শিক্ষকদের কেন সমাজ সেবামূলক নানান কাজে যোগ করা হচ্ছে না, ওঁদের তো তেমন কোনো কাজ নেই, ইত্যাদি নানা রকমের ব্যাপার। সবটাই কিন্তু ওপর ওপর জানা। বলার কথা তাই বলা। শিক্ষকদের ছোট করে বেশ আনন্দ আছে। দুর্বল জাত, এসবের উত্তর দিতে তাঁদের রুচিতে বাধে। তাই মার- কাটারী, চুন চুন কে…।
যে কোনো সরকারী কর্মচারী বছরে বাহান্নটি শনিবার সমেত সারা বছরে যত অন্যান্য ছুটি আছে সব ভোগ করেন। আর্ণড লিভ আছে সঙ্গে ট্রাভেল লিভ আলাঊএন্স ও পান অনেকেই। সমগ্র শিক্ষক–কুল প্রতি শনিবার নিজের কর্তব্যে অবিচলিত থাকেন। গ্রীষ্মাবকাশ, পুজোর ছুটি এবং অন্যান্য সব ছুটি মিলিয়ে সারা বছরে মোট পঁয়ষট্টি টি ছুটির বেশি কিছু নেই। পাঁচদিনের বেশি টানা বেড়াতে গেলে মিথ্যে কথা লিখে মেডিকেল লিভ নিতে হয়, কারণ অন্য কোনো রকম ছুটি, আমরা শিক্ষকরা, পাওয়ার যোগ্য বলে আইনে বা নিয়মে নেই।
একটি ক্লাস সামলে পড়ানো, একেবারে কিচ্ছু না জানা ছাত্রছাত্রীদের, যারা নিজের নাম পর্যন্ত ঠিক করে লিখতে পারে না, পড়তে পারা তো দূর, যথার্থ শিক্ষাদান খুব সহজ কাজ নয়। এরকম পর পর তিনটি ক্লাস করলে যে পরিমান শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা লাগে তা ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব নয়। খুব যে আরাম-দায়ক মজার ব্যাপার, তা কিন্তু আদপেই নয়। গত তেইশ বছরে যাঁরা আমার সামনে এই কথা বলেছেন, তাঁদেরকে একদিন একঘন্টার জন্য কাজটা করে দেখাতে অনুরোধ করেছি। কেউ এগিয়ে আসেন নি, শুধু বলার কথা বলে গিয়েছেন যে শিক্ষকরা পড়ান না, বা ভুল পদ্ধতিতে পড়ান। তবুও প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ একসময়ে নিরক্ষর ছাত্রছাত্রীদের গড়ে নিয়ে এই শিক্ষকরা কি করে নানা বৈতরণী পার করে দিচ্ছেন, গাভীর লেজ না ধরিয়েই, তা আশ্চর্যের ও অত্যন্ত গর্বের। হয়ত আমার সেই ‘ঠিক পদ্ধতি’ শিখতে চাওয়ার অনুরোধের ধরণে কোনো গোলমাল ছিল, তাই জ্ঞান দেওয়ার বাইরে গিয়ে কেউ-ই এগিয়ে আসেনি নি। খুব সন্দেহ আছে, এঁদের কতজন ‘ডিসলেক্সিয়া’ কথাটির সঙ্গে, ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’ সম্পর্কে পরিচিত। যদিও বা পরিচিতি থেকে থাকে তা ‘তারে জমিন পর’- এর আমির খানের দয়ায়। কিন্তু ওই ডিসলেক্সিয়া ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার-দের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে হিমশৈলের শিখরের ভগ্নাংশ মাত্র।
শিক্ষকদের বেতনের ব্যাপারে আমাদের স্বয়ং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই ভীষণ হিংসাকাতর। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার চেনা পরিচিত কোনো শিক্ষক অন্য কাউকে এই চাকরী গ্রহণে বাধা দেন নি। তখন গ্ল্যামারাস চাকরী করতে চেয়ে সেই দিকে চলে গিয়েছেন। আমাদের বেতন কাঠামো-কে করুণার চোখে দেখেছেন। ‘লাইফ ইজ সো বোরিং’ বলে নাক সিঁটকিয়েছেন। কেন -- এর উত্তর তাঁরাই দিতে পারবেন, যাঁরা আজ শিক্ষককুলের ওপর নেহাত-ই অকারণে শ্রদ্ধা হারিয়ে খড়্গহস্ত হয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। বিচ্ছিন্ন কিছু অবাঞ্ছনীয় ঘটনাকে সম্বল করে শিক্ষা-ব্যবস্থার মেরুদণ্ড-কে প্রতিনিয়ত আঘাত করলে সমগ্র জাতি কিন্তু একদিন পঙ্গু হয়ে পড়বেই পড়বে।
আমি যে সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে গত তেইশ বছর ধরে শিক্ষা দিয়ে চলেছি, সেটি আজ ছাত্রশূন্য। উলটো দিকের গলির মধ্যে প্রাইভেট ইংরেজী মাধ্যম বিদ্যালয়টিতে ছাত্রছাত্রী উপচে পড়ছে। প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। আমার মত দৈন্যদশাগ্রস্ত সরকার পোষিত বিদ্যালয় হাওড়া জেলার বুকে প্রায় বত্রিশ-টি। সরকারীভাবে কিছু চাইতে গেলে, কোনো রকম আলাদা উদ্যোগের বেশ অভাব লক্ষ্য করা যায়। আমি আমার চাকরী জীবনে কোনোদিন দেখলাম না যে কোনো স্তর থেকে এই বিদ্যালয় গুলিকে উন্নত করার জন্য কোনো আলোচনা হয়েছে, বা কেউ এসে বলেছেন, "কি দরকার বলুন। আমরা পাশে আছি"।
আম্ফানে ছাদ উড়ে চলে গিয়েছে, জানলা-দরজার পাল্লাও। সঙ্গে করোনা আবহে সব ছবি তুলে এস্টিমেট দিতে দিন দশেক দেরী হওয়ায় আমাদের বিদ্যালয়ের নাম আম্ফানে অর্থসাহায্য পাওয়ার তালিকা থেকেই বাদ। যে সমস্ত বড় ও নামী ইস্কুল সময়ে জমাই দেন নি, তাঁদেরটা ব্যাকডেটে দিব্যি জমা করার জন্য অফিস থেকে ফোন করে জমা দেওয়ার জন্য তাগাদা দেওয়া হচ্ছে রীতিমত। আগে রাগ হত, এখন হাসি পায়। ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্য জাতির রোগ’ মনে হয়।
শিক্ষক হিসেবে কিছু সরকারী ন্যায্য প্রাপ্য চেয়ে বসলেও কেরানী থেকে আধিকারীক সবার সাহায্যের বদলে মেলে তির্যক মন্তব্য, যার জন্য কোনো শিক্ষক বা তাঁর বহু কষ্টে অর্জিত বিদ্যা, কোনোটিই দায়ী নয়। ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর সাহেবের অফিসে গেলে মনে হবে, এত লেখাপড়া করাটাই মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ গল্প:
চাকরী করে সান্ধ্যকালীন এম-এ কোর্স (রেগুলার) শেষ করেছিলাম। তার ন্যায্য প্রাপ্য আদায় করতে যে সব কাগজ পত্র লাগত, নানা জায়গা থেকে, সে সব জোগাড় করতেই বছর খানেক কেটে গেল। অবশেষে জোগাড় যন্ত্র করে বিদ্যালয়ে জমা দিলাম সব। তিন বছর পরে ফাইল খুলে দেখলাম, আমার নথি পড়েই আছে, জেলা পরিদর্শকের দপ্তরে জমা-ই হয় নি। কারণ জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক মহাশয় জানালেন, কোনো এক সিনিয়র শিক্ষক বলেছেন, আমাদের বিদ্যালয়ে অনেক এম-এ এবং এম-এস-সি আছেন। আর এর থেকে বেশি দরকার নেই। সবে দু-দিনের ছোঁড়া, ও পাবে নাকি, স্কেল? অত্ত সোজা?
কোনো কথা না বাড়িয়ে সব আবার তৈরী করে প্রধান শিক্ষকের সহায়তায় নিজে নিজের ফাইল নিয়ে জমা করলাম জেলা পরিদর্শকের দপ্তরে। আবার মাস ছ’য়েক কেটে যাবার পর খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, ফাইলে বেশ কিছু নথী নেই। আমার মনে আছে আমি জমা দিয়েছিলাম। আবার দিলাম, কিছু না বলে। আবার অন্য নথী, যা আগের বার ছিল, তা এবারে নেই। চলল এভাবে আরো ছ’মাস। রফা হল শেষে, আমি যা পাব তার পাঁচ শতাংশ দান দেব। একদিন জেলা পরিদর্শক সাহেব ডেকে পাঠালেন।
ওনার ঘরে ঢুকে দেখলাম উনি চার পাঁচজন ব্যাক্তির সঙ্গে চা-বিস্কুট সহযোগে রসালাপে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অধৈর্য হয়ে বললাম।
--বসতে পারি?
না তাকিয়েই হাত দেখিয়ে বসতে বললেন। সবাই থেমে আমার দিকে তাকালেন।
--বলুন কি ব্যাপার।
--এই এম-এ-র স্কেলটার জন্য এসেছিলাম। একটু যদি দয়া করে দেখে ছেড়ে দেন, বড় উপকার হয়। অনেক দিন থেকে ঘুরছি।
--কোন ইস্কুল?
নাম বলতেই, অন্য যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন আমার দিকে আপাদ মস্তক তাকিয়ে বললেন,
--নতুন?
--না, বছর পাঁচেক হল।
--তোমাদের ইস্কুলে ক্লাস হয়? যত সব বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানো ছেলে তো জোটে…আর কটাই বা ছাত্র যে এম –এ স্কেল চাইছ?
ডি-আই সাহেব ও মৃদু হেসে বললেন,
--বলুন এবার, কি বলবেন, চাইতে লজ্জা করে না?
আমি তখন আর পারলাম না, ধৈর্য রাখতে, যা হয় হোক। আত্মসম্মান রখহার তাগিদে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হলাম। উনি হতে পারেন আধিকারিক, সরকারী চাকরী করেন। আর যিনি কপচাচ্ছিলেন উল্টোদিকের চেয়ারে বসে, তিনি আমার মতই একজন শিক্ষক মাত্র। আমি তো কোনো অন্যায় করি নি, যে অকারণে এত লেকচার শুনব!
--স্যার, বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমাদের বিদ্যালয়ে যে ধরণের ছেলেরা পড়তে আসে, তাতে তাদের কোনো মেধাবী ক্লাস এইটের ছাত্রই শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট। আমি লজ্জিত নই এই কারনে যে লজ্জা তাঁর হওয়া উচিত যিনি এই পদটিকে এম-এ পর্যন্ত অনুমোদন দান করে সরকারী টাকার অপব্যবহার করেছেন। অনেক এন-জি-ও আছে যাঁরা দশ জন পিছিয়ে পড়া ছাত্র দেখিয়ে লাখ-লাখ টাকা উপার্জন করছে। আমরা তো তবু শুধু মাইনে পাই। আমি গর্বিত যে এই সব খেদানো ছেলেদের ফি বছর কোনো প্রাইভেট টিউশন ছাড়াই আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মাধ্যমিক পাশ করিয়ে দেন এক্কেরে বিনি পয়সায়। আর রইল পড়ে ক্লাসের কথা,ভবিষ্যতে কোনোদিন শিক্ষক নেতা হলে আমি নিশ্চই একদিন হলেও আপনার অফিসে বসে স্কুল আওয়ারে নিজের ক্লাস কামাই করে, আপনার পয়সায় চা বিস্কুট খেতে খেতে, অন্য কোনো জুনিয়র শিক্ষক কে ক্লাস নেওয়ার শিক্ষা দান করে যাব। এ-ও তো শিক্ষা, তাই না? ঢেঁকি সগগে গিয়েও ধান ভাঙে!
সেই শিক্ষক নেতা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন,
-- হাঊ ডেয়ার ইউ! তোমার সাহস তো কম নয় হে ছোঁড়া! আমাকে অপমান করলে তুমি? জান আমি কে?
-- ইয়েস স্যার আই ডেয়ার…আপনি-ই শেখালেন নির্ভীক হতে, লাইন ক্রস করতে। অপমান আমি করি নি, চাই ও নি। আপনি যেচে নিলেন। নিজের সম্মান নিজে ধরে রাখতে পারলেন না। আমি বরং আমারটা ধরে রাখি! আর আপনি কে? শিক্ষক-মাত্র। সরকার আমাকে আর আপনাকে একই ভাবে পোষে, কারণ আমার ও আপনার। দু জনের স্কুলই ‘সরকার পোষিত’।
ডি-আই সাহেব আমাকে ধমকে বললেন,
-- আপনি ওভাবে কথা বলতে পারেন না।
-- স্যার, মার্জনা করবেন, কিন্তু উনি যখন প্রথম আমাকে বললেন, তখন কেন আমার সম্মান রক্ষার্থে এই কথাটা ওনাকে বলেন নি? ভেবে দেখবেন স্যার, একটু। ...আপনার অনুমোদন, এই নথি-তে সাক্ষর…
কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম।
দ্বিরুক্তি না করে খসখসিয়ে সবুজ কালি দিয়ে ঝপাঝপ সাক্ষর।
-- আমার সীল-টা বাইরে ডেস্কে দিইয়ে নিন, আমি বলে দিচ্ছি। এই গনেশ……!!!!!
হাঁক পাড়লেন স্বয়ং ডি-আই সাহেব।
(চলবে)

2 comments:
Besh hoyeche
Ki kando... Khub bhalo laglo
Post a Comment