Sunday, 4 October 2020

ম্যাস্টরমশাই: পর্ব ৩

সবেমাত্র ইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি।জীবনে এই প্রথম বাস্তবে একজন ইস্কুল শিক্ষক হওয়া। এর আগে হেন কাজ নেই যা করি নি। সে বেড়াতে যাওয়ার জন্য দরজায় দরজায় মোজা বিক্রি করা থেকে সাংবাদিকতা – সব রকমের অভিজ্ঞতা দিয়ে ঝুলি ভরে উঠছিল। কিন্তু একটা ব্যাপার কোনোদিন-ই ছাড়ি নি, সেটা হল শিক্ষাদান করা। প্রাইভেট টিঊশন অনেক পরে শুরু করেছিলাম, যখন নিতান্তই প্রয়োজন হল অর্থ উপার্জনের। তার আগে মোটামুটি আমি যখন থেকে ক্লাস নাইন, তখন থেকে নানা জন-কে আমি শেখাতাম, পড়াতাম। আমি যতটুকু জানি, ততটুকুই। উপলব্ধি করেছিলাম দু’টি বিষয় – প্রথমতঃ আমি খুব একটা ভাল ছাত্র কোনোদিনই ছিলাম না, কারণ আমাদের পরীক্ষা-ব্যবস্থা সেরকম প্রতিফলিত করে না। আর আমি যে ভাবতাম আমি খুব কম জানি, তা কিন্তু নয়। পড়াতে গিয়ে দেখলাম, আমাদের দেশে আমার থেকে কম জানার সংখ্যা আরো অনেক গুণ বেশি। আর দ্বিতীয় উপলব্ধি ছিল যে, অনেক তাবড় তাবড় জ্ঞানী-গুনীজন, খুব ইচ্ছে থাকলেও একটি বিষয়ে বিশেষ কায়দা করে উঠতে পারেন নি – তা হল ইংরেজী ভাষা। আমি বেশ কনফিডেন্স পেয়েছিলাম, যে আমার থেকে কম জানা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। নিজেকে এগোনোর জন্য অন্যের দুর্বলতার ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করলাম, নিজের অজান্তেই, ধীরে ধীরে। কিছুদিনের মধ্যেই এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূত হতে শুরু করল। যা ভেবে আমি বেলুড়ের বাড়িতে প্রথম কিছু নেহাত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের অবসর সময়ে পড়াতে শুরু করেছিলাম, যে আমার হাতে একটি শাসন-দণ্ড থাকবে, আমি হলাম গিয়ে কমাণ্ডার, পড়া না পারলেই শাস্তি – একটা হিটলারী আনন্দ এবং ‘শাস ভি কভি বহু থি’-এর মত এক জায়গার ফ্রাস্ট্রেশন অন্য কোথাও বের করে দেওয়ার পদ্ধতির নিপাট ব্যবস্থা – সেই আনন্দের সঙ্গে এর কোনো মিল ছিল না। এ আনন্দ যে কিছু পারে না বলে তার ধারণা, তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার অবিমিশ্র আনন্দ। আমার থেকে কম জানলেও তার চোখে-মুখে আমার প্রতি যে শ্রদ্ধা ফুটে উঠত তা আমার মত কিশোরের কাছে এক অমূল্য ধন। এই ব্যবস্থায় কোনো অর্থনৈতিক লেন-দেন ও ছিল না। তাই এই সম্পদ-কে আমি কোনোভাবেই কোনোদিন হারাতে তো চাই-ই নি। বরং আগলে রেখেছিলাম ব্যাঙের আধুলী-র মত। জানতাম না এই আধুলী-ই একদিন বাস্তবে সোনা হয়ে ফলবে।

আমার বাড়ির লোকজনও যে আমার রেজাল্ট দেখে আমার প্রতি খুব একটা ভরসা করতেন, তা নয়। বাড়ির ঠেলায় অনেক কায়দা করে ক্লাস এইট পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ইস্কুল থেকে এইট-পাশ সার্টিফিকেট নিয়ে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে একট মহামূল্যবান কার্ড করালাম, যার ভিত্তিতে নাকি আমার যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন সরকারী চাকরীর ডাক আসবে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল -- মানে আমি স্নাতক হলাম। কিন্তু সেই ততদিনে একটাও ডাক না আসার দরুণ সেই কার্ড স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল। একদিন হঠাৎ পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখি সেই কার্ড। আবার সব নথি-পত্র নিয়ে একটি একেবারে নিষ্কর্মা দিন কাটানোর ছুতোয় সেই কার্ড আপডেট করার জন্য পৌঁছালাম হাওড়া জেলার সংক্রান্ত দপ্তরে। বাড়িটির চেহারা জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়েছে। কিন্তু যুব সমাজের আশা যে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে তার প্রতিফলন দেখলাম দীর্ঘ লাইনে।

প্রায় আড়াই ঘন্টা ঠায় লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে পৌঁছালাম দপ্তরীর কাছে।

কাগজপত্র দেখে বললেন—

- কোথায় ছিলে হে? হঠাৎ আমাদের মনে পড়েছে না কি!

- না মানে আমার কাছে আপডেট করার মত সেরকম যোগ্যতা এতদিন ছিল না। গ্র্যাজুয়েট হয়েছি, তাই এলাম।

- অ অ অ অঃ…তা এর মাঝখানে যে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক পাশ দিলে, সেগুলো তোমার যোগ্যতার মধ্যে পড়ে না। শুধু ক্লাস এইট পাশটাই এক মনে হয়েছিল যে খুব বড় যোগ্যতা, না কি!

- না ঠিক তা নয়…ভেবেছিলাম বার বার আর আপনাদের বিরক্ত না করে একদম গ্র্যাজুয়েট হয়ে তারপর না হয় একসঙ্গে সবটাই আপডেট করিয়ে নেব। তার আগে তো ডাক এলেও চাকরী করার কোনো প্ল্যান ছিল না…তাই।

- তবে অতদিন আগে কার্ড করানোর দরকার কি ছিল বাবা! একেবারে গ্রাজুয়েট হওয়ার পরই করতে পারতে।

- তাতে তো লাইনে অনেক পিছিয়ে যেতাম।

- বাহ বাহ বেশ বলেছ। তবে কি না বলে রাখি লাইনে আর এগিয়ে গিয়ে কাজ নেই! এই নাও নতুন ফর্ম, নতুন করে আবার জমা দাও। তোমার কার্ড-টি এক্সপায়ার করে গেছে।

- বলেন কি? কেন?

- পাঁচ বছর অন্তর রি-নিউ করতে হয়, এক বছর গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া হয়। তুমি বাবা, সব পার করে ফেলেছ। আর কোনো রাস্তা নেই।

- কোনো রাস্তা নেই!!!

- না হে!...নেক্সট…!

আমি বিফল মনোরথে বাইরে এলাম। একটা সিগারেট খেয়ে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতেই আবার একগুঁয়েমী-টা চেপে বসল। নতুন ফর্ম জমা দিলাম না। সব লাইন পেরিয়ে ওই দপ্তরী ভদ্রলোক-কে দেখিয়ে দেখিয়ে ঠায় একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রায় আধঘন্টা পর আমাকে বললেন,

- কি ব্যাপার তুমি আবার ওরকম থামের মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? নতুন ফর্ম ভরে এনেছ? সব নথি প্রত্যয়িত করা আছে?

- ‘প্রত্যয়িত’…!!! সেটা কি স্যার??

- প্রত্যয়িত নকল, মানে অ্যাটেস্টেড ফটোকপি যাকে আবার জেরক্স বলে…দিন আ সছে… বাঙালীর ছেলে, বাংলাটা শিখে নাও। সব কাজ বাঙলায় হবে। ইংরেজী চলবে না।

- ও তাই বুঝি…না স্যার আমি আনি নি, নতুন ফর্ম ভরে…অ্যাটেস্টেড ফটোকপিও নেই আমার কাছে।

- তবে সব রেডী করে নিয়ে এস…যাও…

- স্যার আমি প্রস্তুত…

আমার ‘রেডি’-কে বাংলায় ‘প্রস্তুত’ অনুবাদের সংশাস্বরূপ এই প্রথম একটু উনি একটু অন্যরকম হাসলেন। বুঝলাম ভদ্রলোকের অনবদ্য সেন্স অফ হিউমর। আমি ও সেই সুযোগ নিতে ছাড়লাম না।

- স্যার আমার বিশ্বাস আপনি নিশ্চয়ই কোনো একটা উপায় আপনার ঝুলিতে আছে যেটার সাহায্যে আমার পুরোনো কার্ড-টা রাখা যাবে।

- তাই? বলছ…আছে?

- হ্যাঁ স্যার, আমার স্থির বিশ্বাস। আছে, থাকতেই হবে।

- তবে অপেক্ষা করতে হবে।

- নিশ্চয়ই।

সব কাজ সেরে, উনি আমাকে ডাকলেন।

- আমার ঝুলিতে থাকলেই হবে না। ঝুলি থেকে বের করার ক্ষমতা, অফিসারের…বুঝলে?

- ও ও ও আধিকারিকের…

ততক্ষণে বুঝেছি যে এই ধরণের বাং-রেজী মজা উনি বেশ পছন্দ করেন। তাই দেবতা এই পুষ্পাঞ্জলীতে পরম তুষ্ট হয়ে বললেন,

- চল, দেখি তোমার ‘আধিকারিক’ কি কন!

অফিসার চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে বেশ কয়েকবার জরিপ করে আমার যাবতীয় নথি দেখতে দেখতে শুনতে লাগলেন আমার সমস্যার কথা দপ্তরীর কাছ থেকে। তারপর অবশেষে এল সমাধান।

- আপনার কার্ড-টা বেশি নয়, মাস চারেক হল পার্মানেন্টলি এক্সপায়ার করেছে। একটা কাজ করুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট জোগাড় করুন। এমন কিছু ঘটান যেখানে আপনার অন্ততঃ তিনমাস বেডরেস্ট রেকমেন্ডেড থাকবে সাথে দু’মাস স্ট্রিক্ট রেস্ট্রিকশন। বুঝলেন?

- স্যার রিপোর্ট তো দিতে পারব না।

- জানি পারবেন না। আমি বলেছি কি রিপোর্টের কথা? যা বললাম তাই নিয়ে এসে সরাসরি আমার হাতে দিয়ে যাবেন। সাধুবাবু আপনাকে বাকিটা বুঝিয়ে দেবেন।

আমি কৃতজ্ঞতায় আল্পুত হয়ে বললাম,

- স্যার অনেক ধন্যবাদ।

- ও সব পরে হবে, আগে নিজের কার্ডটা ভেন্টিলেশন থেকে শিগগির বের করুন, ডাক আসতে চলেছে।

সাধুবাবু বেরিয়ে বললেন,

- কি হল বলত আমাদের আজ ? আমি তো নিজেকে চিনতে পারছি না, না স্যার কে। ওরকম তিরিক্ষি মেজাজের একটা লোক, এককথায় রাজি হয়ে তোমাকে ওনাকে সরাসরি কাগজ জমা দিতে বললেন।

- বোধ হয় আপনি নিজে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বলেই সম্ভব হল।

- …হুঁমমমম…কথাটা খুব মিথ্যে বল নি…আমি ও এরকম করি না সাধারণতঃ…আজ আমাদের কি যে হল!!!

- আপনারা আসলে এরকমই…

- কি করে বুঝলে?

- জানি স্যার, কারো ভালো করলে আমাদের সকলেরই ভাল লাগে। কিন্তু এমন কঠিন বাস্তব, যে ভাল করার ইচ্ছেটাই সকলের মধ্যে মরে গেছে…

- অনেক তেল দিয়েছ, এবার একখান পান খাওয়াও দেখি আমাকে…একশো বিশ জর্দা দিয়ে…

অ্যাক্সিডেন্টে ডান পা বিশ্রীভাবে ভেঙে বিছানা নিয়েছিলাম গত তিন মাস ধরে, এই মর্মে একটা মেডিকেল সর্টিফিকেট জোগাড় করা গেল।সব নিয়ে আবার গেলাম এক সপ্তাহ পরে।

সাধুবাবু বললেন,

-আরে এস ভায়া…তুমি তো ম্যাজিক জান দেখছি!

-কেন স্যার।

অফিসারের ঘরের দিকে ভুরু নাচিয়ে বললেন,

-উনি তো তোমাকে চোখে হারাচ্ছেন মনে হচ্ছে। এ ক’ দিনে অন্ততঃ দু বার আলাদা করে জিজ্ঞেস করেছেন, তুমি এসেছিলে কি না। তা আমি বললাম, স্যার আপনি তো ছোঁড়াকে সব আপনার হাতে সরাসরি দিতে বলেছেন। এলে তো আমি আপনার কাছেই নিয়ে আসব , না কি!

আমি খুব বোকা বোকা হাসলাম।

- তা সব গুছিয়ে এনেছ তো?

ঘাড় নেড়ে জানালাম যে, হ্যাঁ এনেছি।

- চল তবে…আর দেরী কেন!

অফিসারের ঘরের সামনে এসে সাধুবাবু পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে বললেন,

-আসব স্যার? সে ছোকরা এসেছে…অবশেষে…

-আসুন।

আমার দিকে তাকিয়ে অফিসার বললেন,

-কোথায় ছিলেন মশাই…সেই যে গেলেন…একটা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট জোগাড় করতে এত সময় লাগে?

-সরি স্যার, এরকম সার্টিফিকেট দিতে খুব একটা কেউ রাজী হচ্ছিলেন না তো, তাই একটু দেরী করে ফেলেছি।

রেগে গিয়ে প্রায় ভেঙচী কাটার সুরে বললেন,

-দেরী করে ফেলেছি!…আজ  বুধবার…জানেন!!!! সামনের সোমবার আমি চলে যাচ্ছি, ট্রান্সফার হয়ে? আমি চলে গেলে এই কাজ আর আপনার হবে না। অন্য কেউ করে দেবে না এই কাজ…আমি বলে তাই...

সাধুবাবু অবাক হয়ে বললেন,

-সে কি স্যার, আপনি ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছেন, কই আমাদের বলেন নি তো?

- আপনাদের বললে আমার ট্রান্সফার কি আটকে যাবে নাকি!

আমি মুখ নামিয়ে বসে রইলাম। কি বলব, কি করব ভেবে পেলাম না, কিছুতেই।

-কই দেখি কাগজ-পত্র যা এনেছেন…

সব দিলাম। পাকা চোখে সব দেখে সাধুবাবুকে বললেন,

- যা যা চাইছে সব করে দিন।

এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ইংরেজী অনার্সে এই জেলা থেকে মাত্র চব্বিশ জন আছে, যাঁদের মধ্যে আপনার রেকর্ড সব থেকে ভাল। একটাই খিঁচ, বি-এড নেই। জনা চারেকের আছে। আপনি যদি বাকি তিরিশ নম্বরে কিছু একটা আলাদা করে উঠতে পারেন, তাহলে একটা চান্স আছে বৈ-কি।

-স্যার ডাক আসবে নাকি?

-অনেকগুলো…স্কুল সার্ভিস কমিশন বসার আগে এক্সচেঞ্জ থেকে এই শেষ ডাক শিক্ষাদপ্তরের। ওরা চাইছে কমিশন বসার আগেই যত শিক্ষক পদ শূন্য পড়ে আছে, সেগুলো পূর্ণ করার।

-বলেন কি স্যার!

-হ্যাঁ…যদি ভাগ্যক্রমে লেগে যায়, আমাকে মিষ্টি খাইয়ে যাবেন। মনে রাখবেন, আজ থেকে তিরিশ বছর পর, আপনার রিটায়ার করার মুখে, লোকে আপনাকে দেখতে আসবে…

- নিশ্চয়ই খাওয়াব স্যার, মিষ্টি!...কিন্তু আমাকে লোকে দেখতে আসবে কেন, সেটা তো বুঝলাম না স্যার?

-তখন পার্মানেন্ট পোস্টে পড়ে থাকা সরকারী শিক্ষকের সংখ্যা হবে হাতে গোনা…আবার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে এই চাকরী…সে তো খড়ের গাদায় ছূঁচ খোঁজার মত হবে।আপনি তাঁদের মধ্যে একজন । বুঝলেন।

কার্ড-টা রিনিঊ করে যখন বেরোলাম, মনে হল যেন চাকরীটা কোথাও আমার জন্য গোকূলে বেড়ে অপেক্ষায় রয়েছে…

(চলবে)

No comments: