আমরা আমাদের গাইড কমলা সিং-জি কে ফলো করতে করতে একটা গলির মত জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। পরপর অনেক ঘর, এক সারে আর আমরা সেই ঘরগুলোর করিডোরে দাঁড়িয়ে।
কমলা সিং-জি বলে চললেন:
“এখানে পয়:প্রণালীর (নালা/নর্দমা) যে স্ট্রাকচার দেখছেন তা কিন্তু নতুন। ‘নতুন’ এই অর্থে নয় যে সিমেন্ট দিয়ে তা করা হয়েছে বলে। ‘নতুন’ এজন্য বলছি যে তখন এখানে যেসব ঘর ছিল তার চারপাশে কোন দেওয়াল ছিল না। ছিল শুধু ‘পিলার’ বা স্তম্ভ। এবার যদি পিলার থাকে তাহলে ছাদ-ও তো থাকবে নাকি। তার মানে এই ঘরগুলি ঢাকা ছিল ছাদ দিয়ে। তাহলে ছাদঢাকা জায়গায় পয়:প্রণালীর প্রশ্ন আসে কোত্থেকে, কারণ জল বের করার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আর দেওয়াল-ই বা কোথা থেকে এল?
আসলে কালচক্রে এই স্থানটি বারংবার্, ছ’বার, পুনর্গঠিত হয়। তখন নতুন যুগে দেয়াল তৈরির জন্য নিচের ঘরের ওপরে কাঠামো বানাতে হল। আর এই করিডরের পুরোটাই, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অব্দি, ঢাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। তবে দেখা গেছে যে যতবার বানানো হয়েছিল, ততবার একই উপকরণ দিয়ে এই ছাদ বানানো হয়েছিল।
ঘরের দেওয়ালের গায়ে যে ছিদ্র দেখছেন, নতুন ইট ওই পর্যন্তই পাওয়া গিয়েছে। যখন নতুন স্তর গঠনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হল, পুরনো অংশটি চলে গেল নিচের স্তরে, মাটির ভিতরে। আর ওই কোণের দিকে যে লাইন দেখা যাচ্ছে, সেটা কিন্তু পুরনোই। এখান থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, এই বিহারটি দু’টি তলা বিশিষ্ট, বা দ্বিতল। উপরেরটা তো ভেঙেই গেছে। ইতিহাসে তো তিন তলা থেকে ছয় তলা – সবটার কথাই শোনা যায়। কিন্তু তার প্রমাণ? প্রমাণ কই? পুরোটাই তো কাল্পনিক! তবে এখানে অন্তত দুটো তলা যে ছিল তা আমরা স্বচক্ষে দেখতেই পাচ্ছি।” আসলে ইতিহসের গল্পের সঙ্গে আর্কিওলজিক্যাল ফাইন্ডিং এর বেশ অনেক ফারাক নালন্দার ক্ষেত্রে দেখা যায়।
এই কথা বলে করিডোরে ঘুরতে ঘুরতে কমলা সিং-জি আমাদের সোজা একটি কামরার মধ্যে ডেকে নিয়ে এলেন।
“এবারে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে রয়েছে হোস্টেল। পৃথিবীর প্রথম রেসিডেন্সিয়াল ইউনিভার্সিটিতে এই সেই স্থান, যেখানে হোস্টেল অবস্থিত ছিল। আরো অন্যান্য জায়গাতেও বেশকিছু হোস্টেল ছিল। তবে এটাই সবথেকে পুরোনো। এখানে একজন বিদ্যার্থীর জন্য একটা গোটা ঘর দেওয়া হত। Single Occupancy| প্রত্যেকটি কামরা-র বাইরের দেওয়ালে যে গর্ত দেখতে পাচ্ছেন, তা ছিল ওনাদের পোস্ট বক্স বা লেটার বক্স। এর ফ্রেমটা সিমেন্ট দিয়ে রিকনস্ট্রাকট করা হয়েছে বটে. কিন্তু আগে ছিল কাঠের ফ্রেম। সেই ফ্রেম নষ্ট হয়ে গেছে। আর এই দিকে (ঘরের উল্টোদিকের জান্লাহীন দেওয়াল দেখিয়ে) নিজেদের ব্যক্তিগত জিনিস রাখার জন্য স্থান আর একটা স্থানে আপনারা যাকে বলেন কুলুঙ্গি।” ঘরের মধ্যে দেওয়ালে বাইরের লেটারব্ক্সের মত একটা আরও বেশি বড় একটা গর্ত। তাতে জ্বলত প্রদীপ। সেই আলোই ছিল একমাত্র ভরসা। মশালের চল কিন্তু ঘরের মধ্যে ছিল না।”
সবাই ঘর থেকে চলে যাবার পরে, একা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। অনুভব করতে লাগলাম কারা এখানে থাকতেন, ঐ করিডোর দিয়ে কারা হেঁটে যেতেন!
গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং, শীলভদ্র, হিউ-এন্-সাং…
আমি সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
গায়ে কাঁটা দিল।
(চলবে)




No comments:
Post a Comment