পরের দিন সকালে ওঠার কোনো তাড়া নেই ৷ ওখানকার সময় সাড়ে আটটায় হেলতে দুলতে উঠলাম ৷ রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকার পথেই সুবাসে আধা সম্মোহিত হয়ে গেলাম - রাঁধুনী রত্নাকর নামে দক্ষিণ ভারতীয় এক ব্যক্তি কি একটা রেঁধেছে৷ ওর হাতে জাদু আছে। সেইই আমাদের প্রাত:রাশ বানিয়ে খাওয়ালো ৷ পেট ভরে খেয়েদেয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম যে সেদিন কি প্ল্যান | আইটেনারারী অরিন্দম - চৈতালীর ৷ যেদিন থেকে আমরা ওখানে যাব বলে স্থির হয়েছিল, সেদিন থেকে প্রতিদিনের প্রত্যেক বেলার প্ল্যান ওরাই করে রেখেছে ৷ কোনো বেলা যেন নষ্ট না হয়। আর তার মাঝখানে মাঝখানে হেভি ট্র্যাভেলের পরদিন একবেলা পুরোপুরি রেস্ট ৷
অনলাইনে অরিন্দম টিকিট কেটেই রেখেছিল। তাই পৌঁছানোর পর গিয়ে টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে আর কাটতে হল না। কাউন্টারে মোবাইলে টিকিটের QR Code স্ক্যান করে রিস্ট ব্যান্ড দিয়ে দিল প্রত্যেককে ৷ অরিন্দম আর চৈতালী গেল না। কথা হল ওদের সঙ্গে আবার বিকেলবেলায় আমরা দেখা করব দুবাই মলে ।
ভেতরে কি আছে তার আগে বলে রাখা দরকার যে পুরো শহরের রাস্তাঘাট চোখ ধাঁধানো। আকাশচুম্বী ইমারতগুলোর প্রত্যেকটির একটি পৃথক আর্কিটেকচারাল বিশেষত্ব আছে । সেই বিশেষত্বের মধ্যে আছে শিল্পবোধ । দৃশ্যত সেগুলো এতটাই সুন্দর যে মনের মধ্যে ছাপ ফেলে যায়। আমরা কলকাতার স্কাইলাইনে একটা ফর্টি টু বানিয়েছি, তাতেই গল্পের শেষ নেই ৷ আর সেখানে, ওই দেশে মরুভূমির বুকে কত শত যে ফর্টি টু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। অরিন্দম-চৈতালী- ছোটুরা যে পাড়ায় থাকে তার পাশের পাড়াতেই একটা বাড়ি নজর কেড়েছিল - বাড়িটা পাতাসমেত একটা গোটা আনারসের মত আকৃতির। কি অদ্ভূত!
ঠিক সেরকমই অদ্ভূত লাগল যখন একটা লম্বাটে শোয়ানো ডিমের আকৃতির অট্টালিকার পাশে এসে নামলাম আমরা চারজন, ছোটু বুম ইন্দ্রানী আর আমি । বাড়িটার পেটটা আবার ফাঁকা - যেন একটা মোটা থেকে সরু হয়ে যাওয়া নলকে কেউ ওভাল শেপ - এ এনে জুড়ে দিয়েছে ৷ স্টীল কালারের বিল্ডিংটার সারা গায়ে অজস্র নকশা। লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে ওগুলো সব আরবী অক্ষর । আমরা ভিতরে প্রবেশ করে বুঝতে পারলাম যে ওই অক্ষরগুলোই আসলে স্কাইলাইট বা জানলা ৷ বাড়িটা ৭৭ মিটার উঁচু ৷ ফেঙ শ্যুই আদলে তৈরী স্ট্রাকচারে কোনো পিলার নেই। আছে শুধু ইন্টারসেক্টিং বিমস৷
আমরা রিস্টব্যাণ্ড স্ক্যান করে প্রবেশ করলাম ভবিষ্যতে ... 2071 সালে পৃথিবী কেমন হবে, দুবাই শহর কেমন হবে! একটা ভার্চুয়াল স্পেস ক্রাফটে উঠে পাড়ি দিলাম ৷ জনা পঁচিশেক যাত্রী ৷ পৃথিবী ছেড়ে সাতশ' কিলোমিটার উচ্চতায় মহাকাশে গিয়ে আবার ফিরৎ এলাম ৷
যে ভার্চুয়াল স্পেসক্রাফ্ট - এ আমরা উঠেছিলাম ওটা আসলে একটা বিশাল লিফট ৷
স্পেসক্রাফটের ছুতোয় আমাদের বিল্ডিঙের একদম ওপরে, পাঁচতলায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল। প্রত্যেকটা দরজা খুললেই একজন করে গাইড ৷ দেখলাম ও জানলাম সেখানে নানারকমের ভবিষ্যতের কল্পনায় তৈরী করা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে ৷ বেশিরভাগটাই জাগতিক ভূগোল ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত ৷ বারংবার ফিরে এসেছে যে প্রকৃতিরক্ষা, বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের রক্ষার স্বার্থে বিজ্ঞানের ব্যবহারই একমাত্র মানুষের অস্তিত্ব ও প্রগতিকে ধরে রাখতে পারে ৷ স্যাম্পেল হিসেবে দেখানো হয়েছে আমাজন কে ৷
স্পেসক্রাফটের ছুতোয় আমাদের বিল্ডিঙের একদম ওপরে, পাঁচতলায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল। প্রত্যেকটা দরজা খুললেই একজন করে গাইড ৷ দেখলাম ও জানলাম সেখানে নানারকমের ভবিষ্যতের কল্পনায় তৈরী করা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে ৷ বেশিরভাগটাই জাগতিক ভূগোল ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত ৷ বারংবার ফিরে এসেছে যে প্রকৃতিরক্ষা, বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের রক্ষার স্বার্থে বিজ্ঞানের ব্যবহারই একমাত্র মানুষের অস্তিত্ব ও প্রগতিকে ধরে রাখতে পারে ৷ স্যাম্পেল হিসেবে দেখানো হয়েছে আমাজন কে ৷
এই আলোচনা সাপেক্ষে উল্লেখ্য যে দুবাই এর রাজা লক্ষ্যস্থির করেছেন যে দুবাই এমিরেটকে আগামী পনেরো বছরের মধ্যে এমন গাছগাছালীতে ঢেকে দেওয়া হবে যে সেখানে মরুভূমি বলে আর কিছু থাকবে না।
আমাদের দেশে যখন মানুষ সভ্যতার বিস্তারের উদ্দেশ্যে জলাজঙ্গল উজাড় করে দিয়ে বোকা কালিদাস হতে ব্যস্ত, তখন অন্যদিকে মরুভূমিকে সবুজ করার উদ্যোগ নিচ্ছে মানুষ ৷ বলা বাহুল্য যে ভারতে যমুনা নদীকে নর্দমায় পরিনত করার ফল ভোগ করছে রাজধানী ৷ বিপাশাকে নষ্ট করার ফল পাঞ্জাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ৷ লঙ্কা ৩০০ টাকা কেজি, টমেটো, ১০০ টাকা | আগামী কয়েক মাসে সারা উত্তর ভারত টের পাবে নিজেদের কালিদাসিপনার ৷ এই তো সবে শুরু ; কলকাতা ও তার আশেপাশে পুকুর জলাশয় বুজিয়ে দেওয়া, গঙ্গা নদীর পলিউশন রিপোর্ট, প্রজেক্ট, পেপার পাবলিশ ও পাবলিক না হতে দেওয়ার পাপ আমরা যা ভুগব তার একশো গুণ বেশি ভুগবে আমাদের সন্তানসন্ততিরা৷ নেতারা শুধু ইনসটাগ্রামে চারাগাছ পুঁতবেন আর থানাতে পার্টি অফিসে ফোন করে প্রমোটারীর জন্য তাদের অতিবৃদ্ধপিতামহের বয়সী বট-অশ্বত্থ-পলাশ কেটে সাবাড় করার নির্দেশ দেবেন। কিন্তু তাও ভোট পাবেন, জিতবেন ৷ ঔদ্ধত্যের অন্ধত্বে সম্মোহিত অবস্থায় গাছ ও মানুষ একই ভাবে কাটবেন এবং বলবেন - না পোষালে চলে যান, অন্য কোথাও ৷ কলকাতা কে লন্ডন কেন, বিশ্বের সেরা শহর বানানো যেত, যদি একজন নেতাও সত্যিই মানুষের জন্য ভাবত৷
যাক গিয়ে... শূন্যে থুতু ছেটালে নিজের গায়েই এসে পড়বে ৷ বিষয়ে ফিরি |
MOFT এর পরের তলাতেই প্রকৃতির সাথে সাথে তৈরী করা হয়েছে একটি ডি-এন -এ লাইব্রেরী বা ভল্ট অফ লাইফ। আমরা সাই-ফাই সিনেমায় যেমন দেখি, তেমন ৷ সমান সাইজের ক্রিস্টাল সিলিন্ডারে বন্দী আছে ২৪০০ লাইফ-ফর্মের স্পেসিমেন৷ চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সৌন্দর্য আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়ার যুগ্ম অভিঘাত থেকে বেরিয়ে এলে শোনা যায় গাইড -ধ্বনিত যাবতীয় তথ্য, এই লাইব্রেরী সম্পর্কে৷ সুপার ফ্লাক্স টেকনোলজিতে তৈরী এই লাইব্রেরীর মনমুগ্ধকর তথ্যাবলী নিচের লিঙ্কে পাবেন:
তার পাশেই আছে ইকো সিস্টেম সিম্যুলেটর ল্যাব - যেখানে পরীক্ষা নীরিক্ষা করা হয় যে নতুন প্রজাতির আবির্ভাব কিভাবে পরিবেশে পরিবর্তন আনতে পারে ৷
এরপর আমরা প্রবেশ করলাম 'আল ওয়াহা' -তে যার বাংলা হল 'মরুদ্যান' ৷ সেখানে মন আর শরীরকে ডিজিটাল আওতার বাইরে নিয়ে গিয়ে সব কিছুর উপশম করা। সবার খুব পছন্দ হল জায়গাটা কারণ সেখানে শোয়া পর্যন্ত যায় আর কতক্ষণ শুয়ে থাকবে, তার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই ৷ শরীরের ক্লান্তি দূর করতে সবাই একটু ওখানে শুয়ে জিরিয়ে নিল ৷
আল ওয়াহা তে আর আছে উইশ পুল৷ ঘাস বা কার্পেটের মত নরম একটা সারফেসে হাঁটা যায়৷ প্রতিবার পায়ের চাপে একটা করে আলোক তরঙ্গ বর্তনীর মত তৈরী হয়। সেখানে ভবিষ্যতের জন্য উইশ করা হয়। বেশ মজার ব্যাপার ৷ পুকুরের জলে ঢিল মারলে যেমন ঢেউ খেলে যায়, অনেকটা সেরকম ৷
আল ওয়াহা তে আর আছে উইশ পুল৷ ঘাস বা কার্পেটের মত নরম একটা সারফেসে হাঁটা যায়৷ প্রতিবার পায়ের চাপে একটা করে আলোক তরঙ্গ বর্তনীর মত তৈরী হয়। সেখানে ভবিষ্যতের জন্য উইশ করা হয়। বেশ মজার ব্যাপার ৷ পুকুরের জলে ঢিল মারলে যেমন ঢেউ খেলে যায়, অনেকটা সেরকম ৷
এছাড়া আমাদের চোখ-কান- নাক ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে আরাম দেওয়ার জন্য আছে অনেকগুলো সেনসরি রুম৷ মজার আরামদায়ক খেলা সব ৷
সবথেকে ইন্টারেস্টিং অংশ হল দ্বিতীয় তলের 'টুমরো টুডে' | এর বাংলা কি হবে জানি না - কালকের আজ, আজকের কাল, আজকাল - তবে সে যাইই হোক না কেন, মনে বিস্ময় জাগায় ৷
অডি র তৈরী ড্রাইভারলেস মোটর গাড়ির মডেল, স্পোকলেস বাইক/সাইকেল, ওয়ান সিটার ড্রোন, সোলার এনার্জি কনসেন্ট্রেটর ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। সবথেকে ভিড় যেখানে ছিল সেটা হল এক কোণে একটা হিউম্যান স্ক্যানার যেটার সামনে দাঁড়ালে কাউকে আপাত স্ক্যান করে তার সম্পর্কে কিছু বলবে, মেশিনটি |
অডি র তৈরী ড্রাইভারলেস মোটর গাড়ির মডেল, স্পোকলেস বাইক/সাইকেল, ওয়ান সিটার ড্রোন, সোলার এনার্জি কনসেন্ট্রেটর ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। সবথেকে ভিড় যেখানে ছিল সেটা হল এক কোণে একটা হিউম্যান স্ক্যানার যেটার সামনে দাঁড়ালে কাউকে আপাত স্ক্যান করে তার সম্পর্কে কিছু বলবে, মেশিনটি |
আমাকে স্ক্যান করে আমার সম্পর্কে মেশিনটি যা বলল, তাতে মেশিনটি আমার পরিবারের সবার বিশ্বাস -বল-ভরসা এক নিমেষে জয় করে নিল --
আমার সর্ম্পকে সে বলল -
You are a regular troublemaker.
এরপর বুমের পালা ৷ বুমকে স্ক্যান করে মেশিনটি বলল:
You should see a doctor immediately because you are pregnant.
সারা হল জুড়ে হাসির রোল ৷
তবে ছোটুর ধারনা হল যে কিছু একটা সমস্যা তো বুমকে নিয়ে হচ্ছে ৷ এয়ার পোর্টে ইমিগ্রেশনের পর কে নাকি বুমকে বলেছেন
"Welcome to Dubai Miss Chattopadyay" আর তারপরে ভুল স্বীকার করে sorry ও বলেন নি।
তবে বুম ব্যাপারটাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে খুব স্পোটিংলি নিল আর নিজেই সেটা নিয়ে এমন মজা করতে লাগল যে আমরা ওকে এই নিয়ে রাগানোর বিশেষ সুযোগ পেলাম না।
তবে এটা ঠিক যে মেশিনটা যে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিল তা ফেসবুকে চলতি গেমগুলোর থেকে খুব বেশি উন্নত মানের বলে মনে হল না।
আমরা ঢুকেছিলাম বেলা বারোটার একটু আগে। সব শেষ করে আবার গ্রাউণ্ড ফ্লোরে লবিতে যখন এলাম তখন প্রায় আড়াইটে ৷ স্যুভেনির শপে খানিকটা ঘোরা হল। Self-lit calligraphy book আর customized perfumes তৈরীর ব্যবস্থা দেখে আবার অবাক হলাম।
বুম আর ছোটুর সব দেখে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল ৷ তার বিক্ষিপ্ত কিন্তু স্থির প্রতিফলন ঘটছিল পেটে | সেই অস্থিরতাকে স্থির করতে লবিতে বসে আইসক্রিম খেল ওরা। আমি যে এক কামড় প্রসাদ পেলাম তা থেকে, তাতে মনে হল সত্যিই একটা কাটা হিমসাগর আম ফ্রিজ থেকে বের করে খাচ্ছি ৷
(চলবে... )








No comments:
Post a Comment