Monday, 17 August 2020

শর্ট-ফিল্মে চতুষ্পদঃ #lockdownshortfilms

 

চলচ্চিত্রের দু’টো ফর্ম লকডাউনে দারুণ ট্রেন্ডিং। কারণ অকাজের বাজারে হাতে অনেক সময় আছে এরকম মানুষের অভাব নেই, টাকা-পয়সা-ব্যবসা-চাকরী না থাকলেও।বাড়িতে খাবার না থাকলেও, ডেটা প্যাক আছে। তাই এই সময়ে একটা নতুন মোড় নিয়েছে এন্টারটেইনমেন্ট। আমি সেটা ভাল না খারাপ সেই প্রশ্নে যাচ্ছি না। আমি নিজেই সিনেমা খুবই কম দেখেছি গত কয়েক মাসে। গিলেছি ওয়েব সিরিজ আর শর্ট ফিল্ম। বাংলা শর্ট ফিল্ম দেখার কারণ বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব চেনা-পরিচিতদের সেই বৃত্তে থাকার জন্য। বাকি আর খুব একটা কিছু দেখে উঠতে পারি নি। কারণ গত বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকটা পড়াশোনা বাকি পড়ে গিয়েছিল বাস্তব দৌড়দৌড়ির চাপে।

করোনা পরিস্থিতিতে আবার শর্টফিল্ম-ও তার ধরণ বদলেছে। শুটিং-টাই বাড়িতে বসে। পুরোটা এডিটিং নির্ভর। সবার একা একা অভিনয়ের (একক অভিনয় নয় কিন্তু) মালা গেঁথে তৈরী হচ্ছে ছোট ছোট গোড়ের মালা।

আমি যখন বেলুড়ে থাকতাম, আমার থেকে কয়েকবছরের ছোট, কিন্তু মন-মানসিকতায় মেলে, এরকম একজন বন্ধুর নাম বলতে বললে ‘নানু’-র, যার পোশাকি নাম দেবনাথ চ্যাটার্জী, কথা মনে পড়েই যায়। অনেক বছর যোগাযোগ নেই। আমার ফেসবুকে প্রত্যাবর্তনের পর পরস্পর কে খুঁজে কথা বলে ফেললাম। যোগাযোগ না থাকলেও ও কি করে, কোথায় থাকে সবটাই খবর রাখতাম অন্যদের মাধ্যমে। বছর বারো আগে একবার মিনিবাসে দেখা হয়েছিল। তখনো কলকাতা ব্যাট্রারী চালিত স্কুটির কথা খুব একটা জানে না। কিন্তু নানু সেই বিষয়ে ছিল বিশেষজ্ঞ এবং একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোম্পানী তে চাকরি করত। সঙ্গে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিল। বিদেশেও ঘুরে চলে এসেছে, ততদিনে, অভিনয়ের টানে। কিন্তু আজকালকার যুগে কেউ নাটক করবে বলে চাকরী ছাড়ে! নানু ছাড়ল। জানতে পেরে আমি আর কিছু না পারি, নানুর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত করলাম। কেন তা ব্যাখ্যা করে বোঝনো সম্ভব নয়।

আবার যোগাযোগ হওয়ার পর, করোনা পরিস্থিতিতে যখন মোটামুট সকলের নাভীশ্বাস উঠতে আরম্ভ করেছে চারিদিকে দেখলাম বহুল প্রচার চলল, ‘মাস্কবাদী’ বলে একটি শর্ট ফিল্মের। পরিচালক সুজন নীল মুখার্জী। নানু-ও তাতে আছে। নীল স্টেজে দারুণ। বহুবার দেখেছি। কিন্তু নীল-কে আমার ব্যক্তিগতভাবে অভিনেতার থেকে অনেক বেশি পছন্দ হয় পরিচালক হিসেবে। স্টেজে এমন এমন ভিস্যুয়ালস তৈরী করেন যা মনে দাগ কেটে যায়। তাই ‘মাস্কবাদী’ নিয়ে অনেকটা আশা তৈরী হল। পোস্টার-টাও দৃষ্টি কাড়ে। কোনো বলিউড সিনেমার থেকে কম নয়।

রিলিজের দিন, লিঙ্কের জন্য হাঁ করে বসে। পেলাম অবশেষে। দেখলাম এবং যারপরনাই আশাহত হলাম। স্যাটায়ার বানাতে গিয়ে গোটা একখান আয়রণি। পাঁচে মেরে কেটে দুই দেওয়া যায়। ডায়লগ অনেক হল, ঠিক গাঁথা হল না। সব কেমন ছড়িয়ে গেল।এত সিম্বলিজম আর ইনুএণ্ডো নিয়ে বড় চাপ।তালগোল পাকানো একটা পিণ্ড, হজম করতেই পারলাম না, এতটাই অ্যাবস্ট্র্যাকট। তারমধ্যে নানু-র অংশটুকু ভালই। সকলেরই। শুধু ওই - কিছুতেই মূলস্রোতে এসে মিশলোনা কেউ-ই, সবাই অববাহিকার পলিমাটি হয়েই রয়ে গেল।বিশেষ কিছু বললাম না। নানু-কে। মনে কষ্ট পাবে হয়ত, আর বলতেও পারবে না কাউকে। তাই। ক্ষেত্রবিশেষে চেপে যাওয়াই ভাল। সত্যি বলার অনেক বিপত্তি।  তার পর হঠাৎ একদিন একটা লিঙ্ক পাঠালো। কিসের বলল না, শুধু বলল ‘দেখিস’। দেখতে গিয়ে বুঝলাম বাড়িতে তৈরী করা শর্ট ফিল্ম আর তাতে যা ডায়ালগ, সোজা-সাপটা, গভীর। কেটে কেটে নুন দিয়ে দিচ্ছে ক্ষত-য়। জুলিয়াস সীজারে অ্যান্টনীর স্পিচ-এর মত। গল্প পরিস্থিতি-প্রেক্ষিত সব আলাদা হওয়া সত্ত্বেও একই মান ও উচ্চতায় পৌঁছে দিল আমার অনুভূতিগুলোকে। শেষ যখন হল, মনে মনে বললাম, ‘শাবাশ বন্ধু, শাবাশ!দারুণ হয়েছে চাটুজ্জে’। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, নানু তেমন নামকরা কেউকেটা নয়। তাই এ-টার না আছে প্রচার, না পায় কলকে।

আপনারা দেখে বলুন, আমি কি কিছু বাড়িয়ে বলছি, নাকিঃ

লিঙ্কঃ  https://youtu.be/og3tr47zNWQ

 

এর পর আবার অপেক্ষা করে রইলাম আর একটা হেভি ওয়েট শর্ট-ফিল্ম রিলিজের জন্য। সৌজন্যে আমার বহু পুরোনো বন্ধু তাজু (দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত) ও ভ্রার্তৃপ্রতিম দেবাঞ্জন বসু। এটার নাম আর পোস্টার দেখেই বোঝা যাবে হাই-কমেডি। নাম- ‘অজ্ঞাতবাঁশ’। পরিচালক হলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় নাট্যকর্মী ও দাপুটে অভিনেতা সোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়। এটা আবার এমনি নয়, রীতিমত টিকিট কেটে দেখতে হবে, mycinemahall app থেকে। খুব খুশি হলাম এই ব্যবস্থায়। মানুষ সবই যদি ফ্রি তে পায়, একটা ইন্ডাস্ট্রির বড় ক্ষতি। amazon prime বা অন্যান্য জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মে তো কত ছবি আর সিরিজ রিলিজড হচ্ছে। তা দেখতে গিয়ে আমরা নেহাত কম পয়সা দিচ্ছি না। তবে আমাদের টলিউড আর বাঙলা থিয়েটার কি দোষ করল! আরো খুশি হলাম দেখে, যে mycinemahall থেকে যে অর্থ আয় হবে সবটাই সাহায্য হিসেবে দেওয়া হবে কলেজ স্ট্রিটে যাঁদের বই-ব্যবসা আম্ফান-ঝড় উড়িয়ে নিয়ে চলে গিয়েছে। খানিকটা স্ব-উদ্যোগেই প্রচার চালিয়ে গেলাম।

তারপর একদিন আমি আর আমার ছেলে খুব সাজিয়ে গুছিয়ে দেখতে বসলাম, ‘অজ্ঞাতবাঁশ’। আধুনিক মোড়কে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর কাণ্ডকারখানা। হিউমর আর স্যাটায়ার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। টেনে আলাদা করা যাচ্ছে না। সকলের অভিনয় বাড়িতে বসেই, দারুণ। কিন্তু গোল পাকল সেখানেই, যে সোহন বাবুর ব্র্যাণ্ড অনুযায়ী উচ্চতা ছুঁল না। কিছু কিছু জায়গায় এতটাই সস্তা ঠেকল, যে মনে হল, এটার কি খুব দরকার ছিল? একশ টাকার বিনিময়ে যা দেখলাম, তাতে আমার ছেলে বলল, ঠিক আছে, কিন্তু এটা ঠিক একশ টাকা দেওয়ার মত ছিল না! আমার ছেলেদের জেনারেশনের একটা সুবিধা/অসুবিধা আছে -- যা মনে আসে, সপাটে বলে দেয়। তা শুনে কার কেমন লাগল, খুব একটা তোয়াক্কা করে না (যদিও আমার এই অনুভূতি একান্তই ব্যক্তিগত এবং ভুল ও হতে পারে)। আমি সেইজন্য আজকাল এই প্রজন্মের দৃষ্টিকোন থেকে অনেক কিছু দেখার চেষ্টা করে থাকি এবং অনেক ক্ষেত্রে উপকৃত হই। তাই ‘অজ্ঞাতবাঁশ’ কে পাঁচের মধ্যে দুই-এর বেশি দেওয়া গেল না।

 

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ইংরেজী সাহিত্য-সিনেমা-গান আমাকে আস্তে আস্তে গিলছে। আলাপ হল বাবার বিদেশ থেকে সদ্য দেশে ফেরা বন্ধুর ছেলে সঞ্জীব (মিত্র)-এর সঙ্গে। আমার থেকে বছর দু-একের বড়। সালকিয়ায় বাবুডাঙ্গার মোড়ের কাছেই বিশাল বাড়ি। সঙ্গে সিনেমা আর গানের অসাধারণ কালেকশন। বন্ধুত্ব গভীরতা লাভ করল অচিরেই। ওদের বাড়িতে প্রথম খেলাম স্যান্ডউইচ, পর্ক। শিখলাম কেক বানাতে। বার-বি-কিউ কেমন হয়, তা উপলব্ধি করতে করতে একটা ভিন্ন বন্ধু-বৃত্ত তৈরী হল যেখানে আমি-ই একমাত্র বাংলা মিডিয়াম। বেশির ভাগ-ই ডন বস্কো। তাতে আমার বা বাকি সবার বয়েই গেল। দারুণ বন্ধু হলাম আমরা সবাই। সঞ্জীব দের বাড়িতে আড্ডা-আলোচনা-গান-ডাম্ব শারাদ-ফুটো হওয়া ডার্ট বোর্ড-স্পেক্ট্রাম ১২৮কে মেমব্রেন কমপিউটারে ম্যানিক মাইনার বা প্যাকম্যান খেলা -হুজ লাইন ইস ঈট এনিওয়ে, আরক্যুল পোয়ারো, শার্লক হোম সিরিজ আরো অনেক কিছুর বাইরে দু’টো জিনিস আমাদের কাছে আলাদা মানে রাখত, এক, কাকুর বকুনির আড়ালে ভালবাসা, আর দুই, কাকীমার হাতে রান্না নানা রকম পদ। আমি জানি না আজও কোনো বাড়িতে অতগুলো ছেলের রোজ হুজ্জুতি পাকানোর অপার-অসীম অধিকার ওই বয়সে থাকবে কি না, নিত্যনতুন খাবার সমেত। খাবার মানে কিন্তু চা-বিস্কুট নয়। রীতিমত তরিজুত করে খাবারের ব্যবস্থা। এরকম নয়, যে ওনারা খুব বড়লোক ছিলেন, আমাদের মতই সাদামাটা।কিন্তু অত বড় মনের মানুষ আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। এক দিনও যায় নি, যে দশ মিনিটের জন্য ওই বাড়িতে গিয়েছি, অথচ কাকীমা আমাদের কিছু খেতে দেন নি। তাই সবাই ভিড় করতাম সেখানে। আলাপ হল সঞ্জীবের মাধ্যমে নীলাঞ্জন, পিয়াস, স্বয়ম্ভূ, দীপক, জাগতার, সৌমেন, আরও অনেকের সঙ্গে। শিখতে থাকলাম রোজ, সবার কাছ থেকে, অনেক কিছু। তারপর বাস্তবের স্রোতে অনেকে অনেক দিকে চলে গেল। জীবনের প্রাইওরিটিজ বদলে গেল। সঞ্জীব আর পিয়াসের সঙ্গে সবকিছু পেরিয়ে যোগাযোগ থেকেই গেল, কোনো না কোনো ভাবে।

গত দু-সপ্তাহ আগে, পিয়াসের প্রোফাইলে দেখতে পেলাম তার লেখা স্ক্রিপ্ট-এ একটা লক ডাউন শর্টফিল্ম রিলিজ হতে চলেছে - “টাইম”। দেখলাম। আঠাশ মিনিটের এই শর্টফিল্ম। কিন্তু আমার ‘টাইম’ হাই প্রোফাইল ‘মাস্কবাদী’ বা 'অজ্ঞাতবাঁশ' এর থেকে বেশিই ভাল লাগল। কারণ, এই ছোট গল্প অনেক-টা বাংলার বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) বা ইংরেজীর এডগার এলেন পো-এর ছায়ায় বাঁধা। প্রথম তিন মিনিটের টাইটেল স্কোর-এ সিনিয়র আর জুনিয়র দেশিকন, দুই সঙ্গীত শিল্পী মিলে, যা করলেন, তাতেই ফিল্ম-টার একটা আলাদা উচ্চতা বাঁধা হয়ে গেল। যে যার বাড়িতে বসে, হাওড়া-পুনে-আমস্টারডাম সব জায়গা থেকে স্কুল-ফ্রেণ্ডস কি তা বুঝিয়ে দিলেন বাকিটাতে। ডায়ালগ কিছু কিছু জায়গায় একঘেয়ে হয়ে উঠছিল, আর প্রফেসর পিয়াসের চা-গুলতে গুলতে ফিলোজফাইজ করা, একটু বেশি ক্যামেরা- কনসাস হয়ে গিয়েছে। ডন বস্কো স্কুলের শেষ ছোঁয়া টুকু আমার মনে হয়েছে সিম্বল মাত্র – প্যান স্কুল-লাইফ-নস্ট্যালজিয়া। এই গল্পটার বাস্তব মাত্রানুসারে বা পরিপ্রেক্ষিতে তফাত থাকতেই পারে, কিন্তু স্কুলের বন্ধুত্বের জায়গা থেকে বেশ চিরকালীন। করোনার থাবা জীবনে অনেকটা ক্ষতের আঁচড় কাটলেও, স্কুলের বন্ধুত্বের উষ্ণতা সেটা পেরিয়ে একটা কসমিক রেডিয়েশনের মত। এই সুরক্ষা বলয় মনের মধ্যে এক অদ্ভূত মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করে বৈ কি! ধন্যবাদ সৌগত মজুমদার কে, পরিচালক হিসেবে এমন একটি অনুভূতি কে স্ক্রিনস্থ করে পরিচালনা করার জন্য। অনেক আশীর্বাদ আর ফুল মার্কস ক্ষুদে দেশিকন-কে। পাঁচে সব ভুলচুক মিলিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে পাশে সরিয়ে, স্বঘোষিত বিচারক হিসেবে ‘টাইম’-কে পাঁচে সাড়ে তিন দিলে কিন্তু আমার দিকে ভার্চুয়ালী পচা ডিম ছুঁড়বেন না, প্লিজ!

লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=siTb1rt3qjY

 

 

 

3 comments:

AT said...

ছবি দুটোও দেখলাম। অজ্ঞাতবাঁশটা দেখা হয় নি সময় ম্যাচ করে নি তাই। তাই ওটা ছাড়া বাকিগুলোর মূল্যায়ন উচিতমনে হলো।

AT said...

ছবি দুটোও দেখলাম। অজ্ঞাতবাঁশটা দেখা হয় নি সময় ম্যাচ করে নি তাই। তাই ওটা ছাড়া বাকিগুলোর মূল্যায়ন উচিতমনে হলো।

AT said...

ছবি দুটোও দেখলাম। অজ্ঞাতবাঁশটা দেখা হয় নি সময় ম্যাচ করে নি তাই। তাই ওটা ছাড়া বাকিগুলোর মূল্যায়ন উচিতমনে হলো।