Tuesday, 18 August 2020

২২ শে শ্রাবণঃ নায়ক রবীন্দ্রনাথ

আগের বার 'চারুকলা'-র মাননীয়া সম্পাদিকা কে বলেছিলাম যে একটু সময় পেলে ছড়ার বদলে আরো ভাল কিছু একটা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। গতবারের বিষয় ছিল 'প্রকৃতি'। যা ইচ্ছে একটা দাঁড় করিয়ে দেওয়াই যায়। দিয়েওছিলাম। সে দিন লাঞ্চ সেরে পটাপট কতগুলো লাইন পরপর এমন ভর করল, যে দেখলাম একটা গুছিয়ে স্যাটায়ার হয়ে গিয়েছে। আলাদা করে কোনো রিসার্চ ওয়ার্ক করতে হয় নি। পাঁচ তারিখে দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের পর জানতে চাইলাম, পরের সংখ্যা-র বিষয় কি। হোয়াটসঅ্যাপে ওনার ছোট্ট উত্তরঃ "রবীন্দ্রনাথ--২২ শে শ্রাবণ"। ব্যাস আমার আক্কেল গুড়ুম। প্রথম প্রতিবর্ত ক্রিয়া -- সেরেছে রে! কি লিখব! কিছুই তো সেভাবে জানি না। 


কিছু মানুষ আছেন যাঁদের সৃষ্টি নিয়ে চর্চা রোজ করা উচিত কিন্তু তাঁদের নিয়ে কিছু বলতে বা লিখতে গেলে আমার হাত পা কাঁপে। ব্রহ্মাণ্ড যেমন সীমা ও অন্তহীন, এঁরাও তাই। আর রবীন্দ্রনাথ যা করে গিয়েছেন, যে মাত্রায়, আর যে বিস্তারে, সে সম্পর্কে আলোচনা করতে যাওয়া মানেই এক বিসম প্রচেষ্টা। তবু কিছু কথা মাথায় এল। আপনাদের সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিই।


একটা সময় ছিল। প্রত্যেক ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে 'চন্দ্রবিন্দু' নিজেদের স্টেজ শো করত। আর সেই শো গুলোতে চন্দ্রিল যথারীতি মানব জীবন-কে আরো কাছ থেকে দেখার বাসনায় প্রথমে হলের গেটে দাঁড়িয়ে টিকিট দেখে সবাইকে হলে ঢুকতে দিতেন। আর তারপরে পর্দা ওঠার আগে, এক মুখবন্ধ করে সকলকে এমন চমকে দিতেন, যে মনে হত, “বলে যান ভাই...পুরো পয়সা আপনাদের গান শোনার আগেই উসুল!” এমনিতেই দুর্ধর্ষ বক্তা উনি, ইউটিউবের দাক্ষিন্যে দেখেছেন সবাই নিশ্চয়ই। যখনকার কথা বলছি, তখন ওনাকে পাওয়া এত সহজ ছিল না। যাই হোক, ওনার চোখা চোখা স্ল্যাপস্টিক স্যাটায়ার মনের ওপর সপাসপ আঘাত হানলেও সে বেদনা অট্টহাসির আড়ালে সমাহিত। অপেক্ষা পরেরটার জন্য। উনি কিন্তু স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান নন। তক্ষুণি রান্না করা খোরাক পরিবেশন করেন। পুরো হাতে গরম, মনে-ও। দর্শক প্রশ্ন করতে পারতেন। তা একবার প্রশ্ন এল, “ আচ্ছা, যখন লেখেন, আপনাদের থিম টা কি থাকে? মানে কি ভেবে লেখেন?" চন্দ্রিল বললেন, গান লিখতে গিয়ে উনি একটা কথা বুঝেছেন "বাঙালী দু-টো জিনিস হেব্বি খায়। যে কোনো মোড়কে চোখ বন্ধ করে বেচে দেওয়া যায়...মারকাটারি হিট হবেই -- ব্যর্থ প্রেম আর সিপিএম"। আমি জানি না ঠিক, যে উনি সেদিন ‘ব্যর্থ’ শব্দটিকে ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়ে কমোন নিয়ে ব্যবহার করেছিলেন কি না। কিন্তু দেখুন, কি সহজে এই কথার অভিঘাত আমাদের মহান স্রষ্টাদের সৃষ্টিগুলোকে ব্যাখ্যা করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ-ও বাদ যান না। ভাবুন না, আপনি '২২ শে শ্রাবণ' সিনেমা টি প্রথম বার দেখার পর জানতে পারেন যে, ওটা একটা মারাত্মক থ্রিলার, সিরিয়াল কিলিং নিয়ে। যা আশা করে গিয়েছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কও নেই। অথচ জিনিষটা বেচা হল আদ্যন্ত রবি ঠাকুরের মোড়কে। কৌতূহল মানুষকে দেদার হল-মুখী করে দিল। শুধু নামেই আদ্ধেক বাজি মাত। আর " ওরা কাজ করে" কবিতা নিয়ে হায়ার সেকেণ্ডারী পড়ার সময়ে তো ভেবেই বসেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের থেকে বড় বামপন্থী বোধ হয় পৃথিবীতে আর নেই। তখন কে মার্কস আর কে লেনিন...! কাউকেই চিনি না, জানি না। ‘বামপন্থা’ কি, তা খায় না গায়ে মাখে, তা আমাদের প্রজন্মের বাংলা মিডিয়ামে পড়া নব্বই শতাংশ ছাত্রছাত্রী প্রথম জেনেছিল, রবীন্দ্রনাথের 'ওরা কাজ করে'-র হাত ধরে, ভোটবাক্স আর ইস্কুল চত্তরে এস-এফ-আই এর অকারণ দখলদারীর চেষ্টা চাক্ষুষ করার বাইরে। বলে রাখি, এই আলোচনায় রাজনীতির ভ্যাপসা গন্ধ যদি খুঁজে পান কেউ, প্রচার বা অপপ্রচার বলে মনে যদি করেন কেউ, আজকের রাজনৈতিক বাতাবরণে, তাঁকে শতকোটি ধন্যবাদ কারণ তাঁর হাত ধরেই এ হেন সময়েও চন্দ্রিলের সেদিনের ভবিষ্যদ্বাণী কি নিদারুণ ভাবে ফলে যায়!  সি-পি-এম তাই না থেকেও থেকে যায়, যদিও এর সঙ্গে আসল ‘বামপন্থা’-র কোনো সম্বন্ধ নেই। পুরোমাত্রায় ‘আকাশের গায়ে না কি টক টক গন্ধ’-কেস।


এইবার আসি ব্যর্থ প্রেমে। ‘২২শে শ্রাবণ’ সিনেমাটির শেষ দৃশ্য, বলাই বাহুল্য, ক্লাইম্যাক্স-ও।  সুইসাইডে উদ্যত খলনায়ক আউড়ে চলেছেন ‘শেষের কবিতা’-র শেষ অংশ থেকে। দর্শক তাতেই জমে ক্ষীর। কারণ, প্রত্যেক মানুষের জীবনের শেষ মূহূর্তে ফুটে ওঠে তার মননে, যে সে তার আদ্যন্ত জীবদ্দশায় কি কি পারে নি। কি কি পেরেছে তা নিয়ে মানুষ নিজের মধ্যে কনফিডেন্স তৈরী করে বাঁচার জন্য। মৃত্যুকালে সেই কনফিডেন্সের প্রয়োজন ফুরোয়। তখন সে, যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন, নিজের মধ্যে ব্যর্থতার এক চরম রোম্যান্টিক চিত্র আঁকতে শুরু করে নিজের কাছেই। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই। মৃত্যু যে কোনো ব্যাখ্যা মানে না। তাই ব্যাখ্যা-বিহীন রোম্যান্সের গন্ধ নিয়ে মহাপ্রস্থানে দোষ কি! ব্যর্থতার ব্যাখ্যা ততক্ষণই, যতক্ষণ মানুষ সব ঠিক-ভুল জেনেও সেই ব্যর্থতার মধ্যেও আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি খোঁজে। ব্যর্থ প্রেমের সঠিক দলিল হিসেবে তাই ‘শেষের কবিতা’ চিরকালীন, অবিনশ্বর। 


শেক্সপিয়র প্রথম যখন নাটক-কে নিদারুন কমার্শিয়ালাইজ করতে ব্যস্ত, নিজের পেটের তাগিদে, তখন থেকে এই পীর বাবাজি একটা মারাত্মক জিনিস আবিষ্কার করেন – দর্শক কাঁদতে বড় ভালবাসে। ভাবলে বোঝা যায় যে সহজেই যে আমরা সবাই সাধারণভাবে একটু দুঃখবিলাসী বটে। সেই দুঃখ-কষ্ট কে যদি এমন করে পরিবেশন করা যায়, যে দর্শক সেখানে নিজেকে খুঁজে পাবে, তার যদি মনে হয় – আরে, এ তো আমার গল্প টাই বলছে, আমার দুঃখ-কষ্ট ঠিক এরকম-ই তো – তাহলে সেই পরিবেশন সুপার ডুপার হিট। শেক্সপীয়রের ট্র্যাজেডি তাই কমেডি গুলোর থেকে অনেক বেশি বিখ্যাত। প্রেম-ভালবাসা মানুষের কাছে তখনই সার্থক যখন তার মধ্যে হৃদয় নিংড়ানো বেদনা থাকে। ্সেই বেদনার অভিঘাত বড় মারাত্মক। বারংবার আমরা সেই গল্পে ফিরি, যেখানে প্রেমের বলি চড়িয়ে দিয়ে এক মারাত্মক দুঃখে নিমজ্জিত হওয়া যায়। এই বলি প্রদত্ত-তেই মানুষের মনে প্রেম থাকে শাশ্বত, চিরন্তন ও চিরনূতন। না আছে হাড়িকাঠ, না, রক্ত। শুধু আছে নিঃশব্দ অপার বেদনা। যেখানে প্রেমের বিনিময়ে, রক্তারক্তি, মৃত্যু, সেখানে প্রেমের জয়লাভ হয় বটে, কিন্তু তা কখনই মুক্ত হতে পারে না। পার্থিব বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায়। আর ছাড়ানো যায় না। তাই বলি-ই এক পথ যার মাধ্যমে প্রেম স্বর্গীয় হয়ে ওঠে।আর নিজের বলিদানের মধ্যে এক দর্প না থাকলে ঠিক জমে না। রবীন্দ্রনাথও সেকথা দিব্বি বুঝেছিলেন, যে লোকে কি খাবে।প্রেমের বলি চড়ানোর বাইরেও আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা দের একটা সামাজিক আতসকাচের নিচে ফেলে দেখতে অভ্যস্ত। সঙ্গে একটা সামাজিক বাঁধন-ও আছে, যে ফরম্যাট থেকে বেরোলে আবার মুশকিল।ভেবে দেখুন। নারী স্বাধীনতার এই যুগে যদি কেউ রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা' থেকে নিচের অংশ পড়ে বসে, আর তার মনে চিরন্তন প্রেমের উদ্রেক হবে কি? সে কি আর মন খুলে কোনো আধুনিকা-কে ভালবাসতে পারবে? 


যোগমায়া বললেন, "তুমি যখন তর্ক কর তখন বুঝতে পারি, তুমি অনেক বই পড়া মেয়ে, তোমার মত ভাবতেও পারি নে, কথা কইতেও পারি নে। শুধু তাই নয়, কাজের বেলাতেও এত শক্ত হতে পারিনে। কিন্তু তর্কের ফাঁকের মধ্যে দিয়েও যে তোমাকে দেখেছি, মা। সেদিন বারোটা রাত তখন হবে -- দেখলুম তোমার ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরে গিয়ে দেখি তোমার টেবিলের ওপর নুয়ে পড়ে দুই হাতের মধ্যে মুখ রেখে তুমি কাঁদছ। এতো ফিলোজফি পড়া মেয়ে নয়। একবার ভাবলুম, সান্ত্বনা দিয়ে আসি; তারপরে ভাবলুম, সব মেয়েকেই কাঁদবার দিনে কেঁদে নিতে হবে, চাপা দিতে যাওয়া কিছু নয়। একথা খুব জানি, তুমি সৃষ্টি করতে চাও না, ভালবাসতে চাও। মন প্রাণ দিয়ে সেবা না করতে পারলে বাঁচবে কি করে। তাই তো বলি, ওকে কাছে না পেলে তোমার চলবে না। বিয়ে করব না বলে হঠাৎ পণ করে বোসো না। একবার তোমার মনে জেদ চাপলে তোমাকে সোজা করা যায় না, তাই ভয় করি।"


আধুনিকা কে পেতে হলে মনে রাখতে হবে যে প্রেম ব্যর্থ হতে পারে, কারণ, 

"তোমাকে দেখে আমার অনেকবার মনে হয়েছে, অনেক পড়ে অনেক ভেবে তোমাদের মন বেশি সূক্ষ্ম হয়ে গেছে; তোমরা ভিতরে ভিতরে যে-সব ভাব গড়ে তুলছ আমাদের সংসারটা তার উপযুক্ত নয়।... আমাদের আমলে মনের মোটা মোটা ভাবগুলো নিয়ে সংসারে সুখদুঃখ যথেষ্ট ছিল, সমস্যা কিছু কম ছিল না। আজ তোমরা এতই বাড়িয়ে তুলছ, কিছুই সহজ রাখলে না"।


তবে কি প্রেম এমন মানুষের সঙ্গেই হওয়া উচিত যাঁর অনুভূতি সুক্ষ্ম নয়? মোটেই নয়। অনুভূতি শিক্ষা মানে না, প্রেমের বিষয়ে, না মানে যুক্তি-তক্কো। তাই লাবণ্য উত্তরে বলে ওঠে সেই অমোঘ সত্যি, যা প্রেম তাকে এনে দিয়েছে-

"আজ হঠাৎ দেখলুম, আমি ও ভালবাসতে পারি। আমার জীবনে এমন অসম্ভব যে সম্ভব হল এই আমার ঢের হয়েছে। মনে হয়, এতদিন ছায়া ছিলুম, এখন সত্যি হয়েছি।এর চেয়ে আর কি চাই।"


প্রেম আমাদের সমাজে কি বয়ে আনে? এক সামাজিক আইডেন্টিটি। প্রেমের অদ্ভূত চরিত্র। একাধারে তা চায়, সব্বাই জানুক, আবার অন্যদিকে নিহিত থাকে তা নিয়ে সামাজিক লজ্জার একটা বড় আশঙ্কা। আমাদের সমাজ আজও একবিংশ শতকের এক কুড়ি পার করার পরেও মোবাইলে বিশ্বজয় করেছে বটে, কিন্তু 'প্রেম' বিষয়ে বিশেষ ঔদার্য্য দেখিয়ে উঠতে পারে নি। হত্যা ও প্রেম পৃথক ভাবে দুটোই ক্রাইম। দু’টোর ক্ষেত্রেই তাই আই-পি-সি নিয়ে কাটাছেঁড়া করা যায়, কাজটা বা অনুভূতিটা আইনি না বে-আইনি।আরে প্রেমের আবার আইনি বে-আইনি, বৈধ আর অবৈধ! ভালই তো বাসছে রে বাবা, মানুষ মানুষকে। অকারণে দেশের জিডিপি-র পঁচাত্তর শতাংশ ব্যয় করে মানুষ মারার কল তো ফাঁদছে না! সেই বজ্র-আঁটুনী, ফস্কা গেরোর কালো হাত থেকে রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য নিজের প্রেম কে টিঁকিয়ে রাখতে চায়। সে তাই ছায়া থেকে সত্যিতে রূপান্তরীত হওয়ার পরেও প্রেম-কে সামাজিক স্বীকৃতীর নামে বিবাহের রূপ দিতে নারাজ। সে আকুতিভরে বলে ওঠে, "আমাকে বিয়ে করতে বোলো না, কর্তামা।" কারণ বিবাহ নিবিড় ও অসীম প্রেম-কে কোথাও বেঁধে ফেলে হত্যা করে। সে সামাজিক বন্ধন বড় অন্ধকার। আর "অন্ধকারের ভয়, অন্ধকারের দুঃখ, অসহ্য, কেন না অস্পষ্ট।"

বরং,

"প্রহরের পর প্রহর যায়, কেউ আসে না। ঠিক মনের কথাটি বলার লগ্ন যে উত্তীর্ণ হয়ে গেল! এর পর যখন কেউ আসবে, তখন কথা জুটবে না, তখন সংশয় আসবে মনে, তখন তান্ডবনৃত্যোন্মত্ত দেবতার মাভৈঃ-রব আকাশে মিলিয়ে যাবে। বৎসরের পর বৎসর নীরবে চলে যায়, তার মধ্যে বানী একদিন বিশেষ প্রহরে হঠাৎ মানুষের দ্বারে এসে আঘাত করে। সেই সময়ে দ্বার খোলবার চাবিটি যদি না পাওয়া গেল তবে কোনোদিনই ঠিক কথাটি অকুণ্ঠিত স্বরে বলবার দৈবশক্তি আর জোটে না। যে দিন সেই বানী আসে সে দিন সমস্ত পৃথিবীকে ডেকে খবর দিতে ইচ্ছে করে -- শোনো তোমরা, আমি ভালবাসি। আমি ভালবাসি এই কথাটি অপরিচিত-সিন্ধুপার-গামী পাখির মত কত দিন থেকে কত দূর থেকে আসছে। সেই কথাটির জন্যই আমার প্রাণে আমার ইষ্টদেবতা এতদিন অপেক্ষা করছিলেন। স্পর্শ করল আজ সেই কথাটি -- আমার সমস্ত জীবন, আমার সমস্ত জগৎ সত্য হয়ে উঠল। বালিশের মধ্যে মুখ লুকিয়ে লাবণ্য আজ কাকে এমন করে বলতে লাগল -- সত্য, সত্য, এত সত্য আর কিছু নেই।"



কিন্তু সেই প্রেমে ঔদার্যের কেন এত অভাব? সে প্রশ্নের উত্তর-ও লাবণ্য দিয়েছেঃ-

"দেখো মিতা, মেয়েদের ভাললাগা তার আদরের জিনিসকে আপন অন্দরমহলে একলা নিজেরই করে রাখে, ভিড়ের লোকের কোনো খবরই রাখে না। সে যত দাম দিতে পারে সব দিয়ে ফেলে, অন্য পাঁচজনের সঙ্গে মিলিয়ে বাজার যাচাই করতে তার মন নেই।" 


তবু কেন লাবণ্যর প্রেম সার্থক হল না?

'যে অঙ্কুরতা বড় হতে উঠতে পারত অথচ যেটাকে চেপে দিয়েছে, বাড়তে দেয় নি...এতদিনে সে ওর সমস্ত জীবনকে অধিকার করে সফল করতে পারত। কিন্তু সেদিন ওর ছিল জ্ঞানের গর্ব, বিদ্যার একনিষ্ঠ সাধনা, উদ্ধত স্বাতন্ত্র্যবোধ। সেদিন আপন বাপের মুগ্ধতা দেখে ভালবাসাকে দুর্বলতা বলে মনে মনে ধিককার দিয়েছে। ভালোবাসা আজ তার শোধ নিল, অভিমান হল ধূলিসাৎ।'


লাবণ্য তাই চায় নি যে একই মানুষ 'তাদের মধ্যে এক জন সৃষ্টিকর্তার আদরে তৈরী, আর একজন তোমার অনাদরে গড়া' - এই বিভেদ তৈরী হোক।তাই সে অনায়াসে বলে ফেলে অমিতর বুকে মাথা রেখে, বিদায় বেলায় বেদনার সকল মায়া কাটিয়ে নিজের প্রেম কে চিরন্তন নির্মোহ করে, "তোমার সঙ্গে আমার যে অন্তরের সম্বন্ধ তা নিয়ে তোমার লেশমাত্র দায় নেই। আমি রাগ করে বলছি নে, আমার সমস্ত ভালবাসা দিয়েই বলছি, আমাকে তুমি আঙটি দিও না, কোনো চিহ্ন রাখবার কিছু দরকার নেই। আমার প্রেম থাক নিরঞ্জন; বাইরের রেখা, বাইরের ছায়া তাতে পড়বে না।"


তবে বিবাহে কি ভালবাসা থাকেই না?

"রূপক দিয়েই বলতে হবে...কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল -- প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালবাসা সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়। আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।"


'২২শে শ্রাবণ' ছবিতে না আছেন রবি ঠাকুর না আছে শেষের কবিতার প্রেমের গল্প। কিন্তু আছে সেই চিরন্তন সত্যের জয়গান, যেখানে একজন অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষ, মানুষের ভিড়ে মিশতে না পারার তাগিদে শেষে নিজেকে উৎসর্গ করে মহানির্বানের পথে যাত্রা করেন। বলি প্রদত্ত করেন নিজের চরম উন্নাসিকতা-কে, মেলাতে না পেরে। স্কেল-টা সহজ, বি-ফ্ল্যাট। ধরার চেষ্টা করুন, সেই মহাজাগতিক বিদায়ের স্তুতি-কে।


"কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।

তারি রথ নিত্যই উধাও

জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদস্পন্দন, 

চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।

ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল

জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল --

তুলে নিল দ্রুতরথে

দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে

তোমা হতে বহু-দূরে।

মনে হয়, অজস্র মৃত্যুরে 

পার হয়ে আসিলাম

আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়-

রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়

আমার পুরো নাম

ফিরিবার পথ নাহি; 

দূর হতে দেখ চাহি

পারিবে না চিনিতে আমায়।

হে বন্ধু, বিদায়।"



শেষ দৃশ্যে অত রক্ত আর নায়কের স্বতঃস্ফূর্ত বলিদান দেখে আমার কি মনে পড়ল বলুন তো!  বোলপুর থেকে খানিকটা গেলেই পীঠস্থান কঙ্কালীতলা। সেখানে একটা হাড়িকাঠ আছে দেখলেই হাড় হিম হয়ে আসে, মনে হয় কে যেন বলছেঃ

“রাজরক্ত চাই তোর দয়াময়ী; জগতপালিনী মাতা…রাজরক্ত আছে দেহে। এই রক্ত দিব…এই রক্তে শেষ মিটে যেন অনন্ত পিপাসা তোর, রক্ততৃষাতুরা…”।


তাই চন্দ্রিলের ‘ব্যর্থ প্রেম’-এর তত্ত্ব মিলুক বা না মিলুক, দিনের শেষে নায়ক কিন্তু রবীন্দ্রনাথ-ই রয়ে গেলেন। ‘ঠাকুর’-ই বটে, আমাদের সকলের মনের...



 


চিত্রগ্রহণ ও হাড়িকাঠ বিষয়ে উদ্ধৃতির সৌজন্যেঃ তিস্তা নাগ, বেঙ্গালুরু

No comments: