Thursday, 30 July 2020
বন্ধু হে, কোন সুখে....খুঁজেছি তোমারি দু'চোখে, ক্রান্তি-কে শান্তি-কে...
Friday, 24 July 2020
On-অর্গল
Thursday, 23 July 2020
পুনশ্চ
Wednesday, 22 July 2020
Bloodline
Tuesday, 21 July 2020
Necropolis
Monday, 20 July 2020
কাটা-ছড়া
Saturday, 18 July 2020
চল, রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন
-
আমি বাড়ি যাব
না কিছুতেই।
-
তোর পায়ে পড়ি,
লক্ষ্মী, ভাইটি আমার, চল আমার সঙ্গে! আর কোনোদিন বকবো না তোকে এরকম করে।
দু- ভাই। একজনের বয়েস বছর বারো আর একজন বছর চোদ্দ্য় পা দিয়েছে বলে মনে হল।
রেসকোর্সের পাশ দিয়ে বাড়ি ফেরার
সময়ে হঠাৎ কিছু ছবি তুলতে ইচ্ছে হল, প্রকৃতির রূপ দেখে। নামলাম। যে ট্রামলাইন দিয়ে
আগে খিদিরপুরের দিকে ট্রাম যেত, এখন আর যায় না। লাইন-টা পড়ে আছে মরচে ধরে। নিজেদের
লুকিয়ে রাখার চেষ্টায় আছে যেন, সদ্য বর্ষায় গজানো ঘাসের আড়ালে। ওদের রূপ দেখে মনে হচ্ছে
ভয় পাচ্ছে, যদি সৌন্দর্য্যায়নের জোয়ারে, গতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে শহরের মানুষ যদি একদিন
এই প্রাচীন ধ্রূপদী ঐতিহ্য কে লুপ্ত করে দেওয়ার চেষ্টা করে! তখন হয়ত ওদের আমার তোলা
এই আধমড়া মৃত্যু শয্যার ছবি কোথাও একটা কাজে লেগে যাবে! দুটো লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
ছবি তুলতে গিয়ে বড্ড ফাঁকা লাগল। সমান্তরাল লাইন দু’টো সেই যে দূরে গিয়ে একটা বিন্দুতে
মিশে গিয়েছে, ফ্রেম টাই কেমন একঘেয়ে। একটু দূরে একটা গাধা বাঁধা আছে। কিন্তু সেটাকে
টেনে তো আর লাইনের ওপরে তোলা যাবে না। তাই অপেক্ষায় রইলাম কোনো অচেনা পথিকের।
অবশেষে, পাওয়া গেল। একটি ছেলে
হেঁটে আসছে। পিছনে আর একজন। সামনের ছেলেটিকে ইশারায় বললাম, লাইনের মাঝখানে দাঁড়াতে।
ছবি তুললাম। এগিয়ে গেলাম। দেখালাম ওকে ছবি, কেমন হল।
-
মুছে দিন স্যর।।ছবিটা…
-
কেন কি হয়েছে?
আর একবার তুলব? তোমার পছন্দ হয় নি, বুঝি!
- না…আমি চাই না…কিচ্ছু চাই না…দেখুন না আমার ওপর রাগ করে আমার ভাই কিছুতেই আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরতে চাইছে না।
চেয়ে দেখলাম পিছনের ছেলেটা পাশেই
রাখা ভাঙা পাইপের ওপর বসে পড়েছে। গেলাম ওর কাছে।
-কি রে কি হয়েছে তোর?
উত্তর পেলাম, যেখান থেকে গল্প
শুরু হয়েছিল।
জিজ্ঞেস করলাম,
-
কি করেছ তুমি
ওকে?
-
খুব বাজে ভাবে
বকে ফেলেছি…বলছি আমি সরি, কিছুতেই শুনছে না।
-
বাড়ি কোথায় তোমাদের?
কে কে আছেন বাড়িতে?
-
আমাদের কেউ নেই।
বাবা মা-ও নেই। আমার সব কিছু এই ছোটভাই কে ঘিরে। খিদিরপুরে ফ্যান্সি মার্কেটের গায়ে
একটা জায়গায় থাকি। ফুটপাতে।
-
সকাল থেকে কিছু
খেয়েছ দু’জনে?
-
নাহ!
হাতে ঝোলানো থলি থেকে একটা ছোট
প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করল। দেখলাম চারটে রসগোল্লা আছে তাতে।
-
কাল যা রোজগার
করেছিলাম, তা থেকে যতটুকু বেঁচে ছিল তাই দিয়ে ওর জন্য আর আমার জন্য দু’টো করে রসগোল্লা
কিনেছিলাম। দেখুন কিছুতেই খেতেও চাইছে না।
-
এতে তোমাদের পেট
ভরে যাবে?
-
হ্যাঁ, রসগোল্লার
রস টা রেখে দেব, রাতে ক্ষিদে পেলে একটু মুড়িতে মেখে খেয়ে নেব তখন। ভালই লাগে নোনতা-নোনতা-র
সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি। কিন্তু ও কিছুতেই খাচ্ছে না, দেখুন…আমি যে কি করি!!!
আমি ছোট ভাই এর মাথায় হাত বুলিয়ে
দিলাম।
-
দেখ, তোর দাদা
তোকে কত ভালবাসে! কি হয়েছে তোর? কেন এরকম করছিস! খেয়ে নে একটু!
কান্নায় ভেঙে পড়ল ছেলেটি।
-
বাজে ছেলে ও…কাল
দোকানের সামনে মোটা মত ভুঁড়িওয়ালা লোকটার সঙ্গে কি সব কথা বলছিল। আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম,
ওকে ডেকে আনব বলে। ওরা দু জনে কথা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে। তারপর ও আমাকে দেখতে পেল, ওই লোকটাও। আমাকে ও জিজ্ঞেস করল,
-
কি রে তুই এখানে
কি করছিস?
-
তোকে ডাকতে এসেছি,
আমার একা একা ভাল লাগে না।
মোটা লোকটা ওকে বলল,
-
এ তো আমাদের সব
কথা শুনে ফেলেছে রে।
…বলে আমার কাছে এল আর বলল,
-
আর করবি এরকম?
-
হ্যাঁ করব! কেন? আমার দরকার
হলে আমার দাদাকে আমি ডাকতে আসতেই পারি।
শুনেই লোকটা ভীষণ রেগে গিয়ে
সকলের সামনে আমাকে রাস্তায় ফেলে মারতে লাগল। আমার গায়ে হাতে পায়ে মেরে দাগ করে দিয়েছে। দেখবে?
জামা তুলে দেখালো। দেখলাম আমি। কালশিটে। সব জায়গায়।
একটা পোড়ার দাগ ও আছে হাতে। জিজ্ঞেস করলাম, -- এটা কি করে হল?
-
ভাত রাঁধতে রাঁধতে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হাঁড়ির কানায় ঠেকে গিয়ে হয়েছে। …কিন্তু ওই লোকটা বাজে, আর ও-ও বাজে!
একদম বাজে। আমি কিছুতেই যাব না আর ওর সঙ্গে।
-
ওর সঙ্গে না গেলে,
তোকে দেখবে কে, খাবি কি?
সপাটে উত্তর এল,
-
আমি একাই যথেষ্ট…চুরি
টুরি কিছু একটা করে নেব ঠিক।
বড় ছেলেটি বলে উঠল,
-
আমি ওই মোটা লোকটার
সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখব না। তুই দেখিস! একটু খেয়ে নে, আর আমার সঙ্গে চল, প্লিজ!
এসব চুরি-টুরি করার কথা কেন বলছিস!
আগুন ঠিকরে বেরোল ছোট ছেলেটির
চোখ দিয়ে, যেন ভস্ম-ই করে দেবে বড় ভাই কে।
-
কেন জানিস না তুই?
-
আমি তো কোনোদিন
চুরি করি নি।
-
যাচ্ছিলি তো…
বুঝলাম, সবটা। থামিয়ে দিলাম দু জনকেই। বললাম,
-
দাদা যখন ভুল
বুঝতে পেরেছে ক্ষমা তো করে দে এবার… দেখ তোর জন্য খায় ও নি সকাল থেকে। এবার তুই খেয়ে
নে। আর চুরি করবি, এসব কি কথা! নিজেকে এমন করে তৈরী কর যাতে এসব খারাপ ভাবনা ভাবতে
না হয়। নে এবার খেয়ে নে।
বড় ভাই সুযোগ বুঝে প্যাকেট থেকে
একটা রসগোল্লা বের করে ওকে খাওয়াতে লাগল। নাকের জলে চোখের জলে মিশিয়ে ছেলেটি গোগ্রাসে
গিলতে লাগল খাবার। বুঝলাম, অনেকটা অভিমান আর কান্না জমেছিল। সব বেরিয়ে গিয়েছে।
-
কি রে, ভাল খেতে?
জিজ্ঞেস করলাম।
একমুখ হাসি!
- দেখ আমি তো এখন
চলে যাব। আর দেখাও হবে না কোনো দিন। তুই দাদাকে দেখবি, ওর যত্ন নিবি। সঙ্গে শাসন-ও করবি।
কি রে, পারবি তো?
আবার একগাল হেসে ঘাড় নাড়ল, যে
ও পারবে।
-
যা…এবার বাড়ি
যা। কতক্ষণ লাগবে বাড়ি যেতে?
-
কুড়ি পঁচিশ মিনিট।
লক্ষ্য করলাম এতক্ষণে, কারোর
পায়ে জুতো নেই।
-
কি রে তোদের পায়ে
জুতো নেই কেন?
-
নেই তাই। আমাদের
খালি পা-ই ভাল।
কিছু বলতে পারলাম না সেরকম।
পকেট থেকে শুধু দু’শোটা টাকা বের করে দু’জনের হাতে দিলাম।
-
আজকের দিন-টা
অন্তত ভাল করে কাটা
কোনো কথা না বলে দু’টো উজ্জ্বল
মুখ চলতে থাকল আমাকে ফেলে, ট্রাম লাইন ধরে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। অস্তমিত সূর্যের আলোয় দুই কিশোরের সিল্যুয়েট।
চোখ আর মন এক হল। আমাদের ইস্কুলে
যে ছেলেগুলো একবেলা মিড-ডে মিল পেটপুরে খাবে বলে পড়ার নাম করে আসে, তারা সবাই, আর এই দুই
ভাই, ট্রামলাইনের ট্র্যাক দুটো ওই দূরে যেখানে
বিন্দুতে গিয়ে মিশেছে, সেখানে এক হয়ে যাবে…


