আর আধঘন্টা…ব্যাস সাইকেল চালানো শেষ, সেদিনের মত। তারপর পড়তে বসতে হবে। দুপুরে সবাই যখন ঘুমোচ্ছিল, তখন একটুও শব্দ না করে সাইকেল টা বের করতে গিয়েছিলাম। বড়মামীমা-র ঘুম বড় সজাগ। বাইরের ঘরের তক্তবোসে শুয়ে দুপুরের বিশ্রাম নিতে নিতে মনে হয় স্বভাবতই চোখ না খুলে বলল,
- কে র্যা?
- আমি…
- তুই ভর দুপুরে কি করছিস?
- এই যে ছিপ নিয়ে একটু মাছ ধরতে যাচ্ছি।
ডাহা মিথ্যে কথা বললাম।
- এই ঠা ঠা রোদ্দুরে বাইরে না বেরোলেই নয়? মা-কে বলে দিলে আর যখন মামার বাড়িতে আসতে দেবে না, তখন বুঝবি ঠ্যালা।
- একটু যাই?
আমি জানি, মামীমা মা-কে কিচ্ছু বলবে না। আর সবসময়েই চায়, আমি এখানে এসে থাকি।
- যা…কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবি না আর গরম হলে চলে আসবি।
- আচ্ছা!!!
মাছ ধরতে ভালই লাগত আমার। কিন্তু আগের দিন ছিপে মাছের বদলে কি করে একটা জলঢোঁড়ার বাচ্চা বঁড়শি-তে গেঁথে গিয়েছিল কে জানে! এখন সেই ভয় কাটতে তো সময় লাগবে। তাই এখন সাইকেলের নেশাটা একটু বেশিই চেপে বসেছে।
বাখরাহাট বাজারের বড় রাস্তা থেকে আদি-র দোকানের গা দিয়ে যে সরু রাস্তা-টা চলে গিয়েছে, তার কোনো নাম নেই। আদির দোকান থেকে কন্ট্রোল-ধার (রেশন দোকানের গ্রাম্য নাম) পেরিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে সেই ঘোষপাড়া পর্যন্ত। কিছুদিন আগেও পুরো রাস্তাটাই ইঁট দিয়ে বাঁধানো ছিল। সন্তোষ-দার কাছ থেকে দু সপ্তাহের কসরতে ঘোষপাড়ার মাঠে সাইকেল চালানো শিখেছিলাম। এমন ট্রেনিং যে একবারও পড়লাম না। প্রথম দু দিন শুধু সাইকেল নিয়ে হাঁটা, তারপর প্যাডেলে পা রেখে শুধু দাঁড়ানো, তারপর হাফ-প্যাডেল, তারপর সবথেকে কঠিন কাজ – সামনে দিয়ে পা- তুলে সাইকেলে চেপে বসা। শেষের-টা শেষ পর্যায়।
- এটা যে পারে, বুইলি, পৃথিবীর সব কিছু সে পারে।
সন্তোষ-দা কে তো আর ইস্কুলে যেতে হয় না, লেখাপড়ার বালাই নেই। তাই অনায়াসে বলে ফেলল।
এবারেও যথারীতি ৭৫ নং বাস থেকে নেমে, মা-এর সঙ্গে যখন মন্টু-দার রিকশা-তে উঠলাম, তখন মন্টুদা তাড়ি খাওয়া ধরা ধরা গলায়, রিক্সার হ্যান্ডেলে প্রায় মুখ গুঁজে রিকশা চালাতে চালাতে বলল,
- এবার দেখ, বাবু, তুমি সাইকেল চালাবে বলে আমরা কি কইর্যাসি।
সত্যি-ই আমি দেখে আনন্দে কুল পেলাম না! দাঁত-বের করা, ইট বিছানো রাস্তা আর নেই। কালো পিচ দিয়ে মোড়া রাস্তা, পুরোটাই। জয়চন্ডীপুরের বুক চিরে চলে গিয়েছে। জাতে উঠল, তাহলে, জয়চন্ডীপুর গ্রাম।
- আমাকে দু-টাকা কম দিলেও হবে।
মন্টুদা মা-কে বলল।
-কেন?
-আগে ইটের রাস্তায় টানতি বড় কষ্ট হত তো! এখন তো আর সেই ঝামেলি লাই! আরামে সালাতে পারি।
- না, তুমি আগের ভাড়াই নিও। আমার বাপের বাড়ির রাস্তা পাকা হয়েছে। আমার-ও তো আনন্দ। বল!
-ত্যালে আর কি কই!
আমি মনে মনে কি যে খুশি হলাম। সত্যি-ই তো, মা তো ঠিকই করেছে। এমন একটা খবর যে দেয়, তাকে এটুকু পুরষ্কার তো দেওয়াই উচিত। রিক্সাটাই যিদি এমন গতিতে চলে, তা হলে সাইকেল না জানি উড়োজাহাজের মত উড়েই না যায়! মনে মনে ভাবতে ভাবতে মামার বাড়ি এসে গেল।
আদির দোকান ছাড়িয়ে বড় রাস্তাতে গেলেই চারিদিকে ছটোমামা-র বন্ধু-বান্ধব সব ওঁৎ পেতে বসে আছে। একবার চাকায় হাওয়া দেওয়ার ছুতোয় একটুখানি দূরে রায়পুর মোড় থেকে এক চক্কর ঘুরে এসেছিলাম। ওফ, রাস্তা একেই বলে! যেন মাখন!
পরদিন, সক্কাল সক্কাল ছোটোমামার সঙ্গে বাজারে এসেই, ব্যাস!
-মিহির, ভাগনা কিন্তু সাইকেল নিয়ে কাল বড় রাস্তায় এয়েছিল।
তবে ছোটোমামা-কে যে আমি এতটাই ভালবাসি আর ভরসা করি, তার কারণ হল, কারোর সামনে আমকে কোনোদিন বকে না। যা হবে সব বাড়িতে ফিরে। বাজার থেকে বাড়িতে ফিরে সাইকেলের চাবি টা নিয়ে নিয়েছিল, সে বার। পুরো এক সপ্তাহ! তারপর বড়মামীমার মধ্যস্থতায় আবার কোনোরকমে সাইকেলের নাগাল পাওয়া গিয়েছিল। সেই থেকে আর বড় রাস্তায় যাওয়ার সাহস করি নি।
এইবারে আমাকে পায় কে! চুটিয়ে চালালাম সাইকেল। মাঝে মাঝে ছোটোমামা-ও দরকারে সাইকেল পেল না। বদলে শাস্তি স্বরূপ দশবার করে ১৩, ১৭ এর ১৯ এর নামতা লিখে দেখানো। তাও মেনে নিয়েছিলাম।
কন্ট্রোল-ধার থেকে একটু এগিয়ে খানিকটা চড়াই আছে। তারপর উতরাই-তে স্পিড তুললাম। এতটাই, যে প্যাডেলটা আর নেই মনে হল। কানের পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই হাওয়া। পুষ্পক রথে একমাত্র আমি…এখনকার এরোপ্লেন…
ম্যাঁ…হ্যা হ্যা হ্যা…
একটা ছাগল-ছানা দশ মিটার দূরে হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে সিদ্ধান্ত নিল, তার সমূহ বিপদে, ঠিক তখনই রাস্তা পেরোতে হবে। তার মা-এর কাছে যেতেই হবে। হিসেব করে সাঁ করে কাটাতে যাব, দেখলাম বাঁ-পায়ের প্যাডেলে সরু নাইলনের দড়ি জড়িয়ে গিয়েছে। আমি দেখতে পাই নি ছানা-টা দড়ি দিয়ে নারকেল গাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল। দড়ির টানে ছোট্ট ছানা-টা আমার সাইকেলের সামনের চাকার সামনে। আমি কিছু না করলে ও মরেই যাবে।।প্রাণপনে ব্রেক কষলাম। দু থেকে তিন সেকেন্ডের মধ্যে হাওয়ায় উড়তে উড়তে আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তার ওপরে। আঘাত যাতে কম হয় ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম, স্বাভাবিক প্রতিবর্তে। খুব লাভ কিছু হল না। ডানপাশের হাতের তালু, কনুই, কাঁধ, গাল, ঘষে গেল নতুন পিচ বাঁধানো রাস্তার ওপর। ভীষণ যন্ত্রণায় হাত পা কাঁপছে। উঠতে পারলাম কোনো রকমে। দেখলাম, হাড় গোড় কিছু ভাঙেনি। ছাগলছানা-টার দুটো পা আর গলা বিশ্রীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে সেই সরু নাইলন দড়িতে। গিয়ে জট ছাড়ালাম, ছানাটা ছুটে তার মায়ের কাছে চলে গেল।
সাইকেল-টার যা হাল হয়েছে তাতে কাল থেকে ছোটোমামা আরা আমকে সাইকেলে হাত দিতে দিলে হয়! সাইকেলের সিট-টা পুরো ঘাড় কাত করে বেঁকে গিয়েছে। হাত দিয়ে টেনে, ঠেলে, মেরে, পারলাম না। রাস্তার পাশে একটা আধলা ইট পড়ে ছিল ঠোকাঠুকি করে সোজা করা গেল। সাইকেল টাকে দাঁড় করানোর পরে দেখলাম, হ্যাণ্ডেলের-ও তথৈবচ অবস্থা। দু পায়ের ফাঁকে সামনের চাকাটা ঢুকিয়ে হ্যাণ্ডেল ধরে মোচড় দিয়ে ঠিক করতে পারলাম। অনেকটা রাস্তা এখনো বাড়ি পৌঁছাতে। হাঁটার শক্তি নেই। সাইকেল চালিয়ে ফিরতে হবে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ছাল উঠে ছড়ে গিয়ে সাদা দগদগে মাংস বেরিয়ে গিয়েছে। কনুই থেকে রক্ত ঝরছে। কাঁধের কাছে জামা ভিজে। গালে হাত দিতেই চিনচিনিয়ে উঠল। ডান হাতে হ্যান্ডেল ধরা অসম্ভব। বাঁ-হাতে ভর করে সাইকেলে চড়লাম। প্যাডেল করতে গিয়ে আবার বিপত্তি। প্যাডেলের আক্সেলটা এতোটাই বেঁকে গিয়েছে যে চেন-বক্সে আটকে যাচ্ছে। ঘুরছেই না। ছোটমামা কিছু বলে না বটে। কিন্তু সদ্য কয়েকসপ্তাহ আগে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সাইকেল-কে প্রায় নতুন করে ফেলা হয়েছিল। তারপর এই অবস্থায় নিজের সাইকেল যদি পায়, আমার সাইকেল চালানো জীবনের মত শেষ। সেই ভয়ের চোটেই বোধহয় আবার অনেকটা শক্তি ফিরে পেলাম। আধলা ইঁট টা দিয়ে ঠুকে ঠুকে মোটামুটি একটা চলনসই যায়গায় নিয়ে আসা গেল।
উঠোনের দরজা দিয়ে ঢুকতেই, বড় মামীমার হুঙ্কার,
- হ্যাঁ রে, মাছ ধরতে সাইকেল কোন কাজে লাগে! সেই কোন দুপুরে... ও মা গো! একি!!!! কি সব্বনেশে কান্ড। ও ছোড়দা (আমার ছোটোমামা-কে এই নামেই ডাকত বড়মামীমা), এস দেখে যাও তোমার গুণধর ভাগনা কি কান্ড করে এসেছে। আমরা তোমার দিদি কে কি জবাব দেব, এখন।
- সে রকম কিছু হয় নি গো মামীমা। একটু ডেটল টেটল লাগিয়ে দাও, ঠিক হয়ে যাব।
তখনো আমি সাইকেল ধরে তুলে সিঁড়ি দিয়ে দালানে রাখার চেষ্টা করছি, যাতে ছোটোমামা আবার না সাইকেলে চাবি দিয়ে দেয়।
ছোটোমামা এসে এক দণ্ড দেখল। আমার হাত থেকে সাইকেলটা ছাড়িয়ে ফেলে আমাকে পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে বাইরের ঘরের বড় তক্তবোসে শোয়ালো। মামাতো বড় বোনকে বলল,
- বুবলা, অনেকটা গরম জল নিয়ে আয়, আগে। সঙ্গে পরিষ্কার সাদা কাপড় আর ডেটল।
মামাতো ছোটবোন শিউলির কাজ হল একটু দূরে থাকা হেবোকাকা নামে এক কম্পাঊন্ডারকে খবর দেওয়া, টিটেনাসের জন্য।
ছোটোমামা আর বড়-মামীমা দু জনে মিলে আমাকে, আমার ক্ষত পরিষ্কার করতে লাগল। দু জনেই বলতে লাগল, এমন কিছু হয় নি, ও রকম একটু হয়। ছোট-মামা বলল,
-আমি যে রকম তোদের ভূতের গল্প বলি, সে রকম করে বল দেখি, ঠিক কি কি হয়েছিল! নিজের এমন হাল করলি কি করে?
একটা ছাগল ছানাকে বাঁচাতে গিয়ে এই কাণ্ড শুনে তো ছোটোমামা হেসেই বাঁচে না। আর বলল,
- ভাগ্য ভাল তোর, একটাও হাড় ভাঙ্গেনি, এই রকম ‘হাড়কিউলিস’-এর মত চেহারা নিয়েও। তবে কাঁধ-টা একটু বেশিই ছড়েছে। আর গালে যদি দাগ-টা থেকে যায়, তাহলে বিয়ে দেওয়া-টা মুশকিলের হবে। কি বল, বৌদি?
আমি-ও হেসে ফেললাম। ভাবলাম, যাক বাবা! সাইকালে আর চালাতে দেবে না, এরকম তো কিছুবলে নি! মন-টা খুশিতে ভরে গেল। এত বড় অপরাধেও কোনো শাস্তি পেলাম না। একেই বলে,
মামার বাড়ি ভারী মজা/ কিল-চড় নাই
-হপ্তা দুই লাগবে, এখন। মারকিউরোক্রোম আনিয়ে নাও, মিহির। তা হলেই হবে।
কম্পাউণ্ডার হেবোকাকা টিটেনাস, আন্টিবায়োটিক আর দু-দিনের ঘুমের ওষুধ দিয়ে চলে গেলেন।
সপ্তাহ তিনেক পরে বাবা আমাকে আনতে এলেন। অনেকদিন ইস্কুল কামাই হয়ে গিয়েছে। গরমের ছুটি সেই কবে শেষ হয়ে গিয়েছে। বড়মামীমা বাবা-কে বলল,
- জামাইবাবু, কাঁধের-টা সারতে সময় লাগবে। গালের দাগটা মেলাতেও...দেখা যাক।
ছোটমামা আমাকে সাইকেলের চাবিটা হাতে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল,
-যাঃ...এক চক্কর মেরে আয়।
আমি বুঝতে পারলাম না, কি বলতে চাইছে। মজা করছে না কি।
- কি হল, যা! ভীতু না কি!
আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবা শুধু অল্প হেসে, ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন।
আমি চাবিটা ছোটোমামার হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে ছুটলাম সাইকেলের দিকে।
ডান কাঁধের দাগ-টা রয়ে গিয়েছে, এখনও। সাইকেল-টা আর নেই। ঠিক সেখানেই একটা অন্য সাইকেল রাখা থাকে এখন।
...আর নেই ছোটমামাও...
No comments:
Post a Comment