Sunday, 31 May 2020

অবসরে...

বেশ কিছুদিন ধরেই খানিকটা লেখা পাচ্ছে, যেমন ক্ষিদে আর পটি দু’টোই পায়। কিন্তু কি খাব আর কি খেলে পেট পরিষ্কার হবে তা নিয়ে অনেকটা ধন্দে ছিলাম। শেষে ভাবলাম, দেওয়াল নোংরা করি – কৈশোরের ইস্কুলের টয়লেটের নয়, নিজের বাড়ির-ও নয়, ফেসবুকের...যেখানে এক্কেবারে স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম, যা ইচ্ছে লেখার জন্য বা লোক-কে পড়ানোর বা দেখানোর জন্য। সবথেকে বড় মজা হচ্ছে, এখানে কোনো শাস্তি নেই, না আছে বাজে কথা বললে মার খাওয়ার ভয়। ডেমোক্রেসী বাবা, বুইলে কি না! এককালে খুব তিতিবিরক্ত হয়ে ফেসবুক ছেড়ে চলে যাই। আবার ফিরেছি প্রায় বছর আষ্টেক পরে। খুব কিছু বদলায় নি। শুধু প্রত্যেকের বিরক্তির মাত্রার ব্যক্তিগত অধিকার-কে সম্মান জানাতে জটিল হয়েছে প্রাইভেসী সেটিংস, শুধু ‘লাইক’ আর ‘আনলাইক’-বাটন এর সমস্যার সমাধান ঘটেছে অনেক ধরনের অনুভূতির আলাদা আলাদা স্মাইলি-দিয়ে, আর সংযোজিত হয়েছে  একরাশ সোশাল নেটওয়ার্কিং ইন্টারলিঙ্কের বাড়তি সুবিধাগুচ্ছ। একটা ব্যাপার বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সকলেই কিছু না কিছু বলতে চায়। পড়ার, দ্যাখার, শোনার ধৈর্য খুব কম, ফলে সুচিন্তিত গভীর মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গীর আদান-প্রদানে মনে হয় খুব বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসে স্থৈর্য অনেকটা বেড়েছে বলেই হয়ত এখানে টিঁকে গেলাম, দ্বিতীয়বার এসে। খুব চুপ করে বসে পাতা স্ক্রোল করে দেখতে দেখতে এক এক সময়ে হ হীনম্মন্যতায় ভুগি না যে তা নয়, কারন আমি ফেসবুক না থাকলে জানতেই পারতাম না হয়ত, আমি যাদের বহু বছর ধরে চিনি বা জানি বলে বুক ঠুকে দাবী করি, তারা আসলে সত্যিই কি কি জানে, কি কি পারে। 

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কোনোদিন ভেবেছিলেন যে তিনি নোবেল পেয়ে ‘বিশ্বকবি’ হয়ে যাবেন? ফেসবুক তো তখন ছিল না। কার হাত ধরে তবে রবীন্দ্রনাথ বর্ডার পেরোলেন? রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভাবনাকে সাগরপারে লন্ডনে ইংরেজদের দরবারে পৌঁছে দিলেন সেখানে প্রিন্টিং টেকনোলজি শিখতে যাওয়া সুকুমার রায় স্বয়ং, ঠিক যেমন করে শ্রী রামকৃষ্ণ ‘পরমহংস’ হয়েছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে হিন্দুত্ববাদ নামক আদি ও মহান দর্শনের সার্থক প্রচারের মাধ্যমে। (এখানে আবার ভাবার অবকাশ রেখে গেলাম যে আমি কি আসলে কোনো রাজনীতির রঙ-এ দেওয়াল রাঙাতে এসেছি কি না)। সুকুমারের উদ্যোগে তাঁর লণ্ডনের বাসায় মাঝে মাঝেই সাহিত্যসভা হত, যেখানে প্রথম তাঁর হাত ধরেই রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ। ইংরেজরা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ইংরেজী ভাষার ওপর দখলে মুগ্ধ হয়ে মজে যান নি, কারণ তিনি যে খুব সুন্দর ইংরেজী লিখতেন তা আদপেই নয়। তাঁরা মুগ্ধ হলেন রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ধারায় যা সুকুমার নিজে তাদের সামনে মেলে ধরলেন। এর পরের গল্প সকলের জানা ও চেনা। তা নিয়ে অনেকটা টাইপ করা বাতুলতা মাত্র। 

হ্যাঁ, আমি যা বলতে চাইছি, যে জোরালো মাধ্যম লাগে, কোনো কিছু ভাল বা খারাপ কে সকলের কাছে উন্মুক্ত করে মেলে ধরার জন্য। আর সেই মাধ্যমের সদব্যবহার করার মধ্যেই আমাদের নিজেদের প্রত্যেকের দায়িত্বজ্ঞানের সচেতনতার মাত্রা বোঝা যায়। আমি ঠিক গুগল করে এখনো জানতে পারি নি যে, ‘সোশ্যাল মিডিয়া পলিউশন’ নামে কোনো কিছু আছে কি না, বা সেটাই ‘সাইবার ক্রাইম’ নামে চলে কি না। তবে সেই দিন আসন্ন যে আমাদের সুস্থ বুদ্ধিবৃত্তির শ্বাস নিতে ভীষণ অসুবিধা হতে পারে। রোজ সকালে একগাদা অনভিপ্রেত রং-বেরঙের ‘সুপ্রভাত’ বা রাত্রে অপ্রত্যাশিত  ‘শুভরাত্রি’-র তাড়নায় আমরা 'ভেন্টিলেশন'-এও চলে যেতে পারি।

আমার জীবনে যে পরম বন্ধুর হাত ধরে বাস্তব-সাগরে চোখ বন্ধ করে নির্দ্বিধায় ঝাঁপ দিয়েছিলাম, সে ও তার মেয়ে কিছুদিন আগে তাদের বাড়িতে সংবিগ্ন পক্ষীকুলের সেই চিরকালীন মাতৃসুলভ যত্নে ব্যস্ত ছিল। পেয়েছিলাম কিছু ছবি, ফেসবুকে।
বলেছিলাম পাখিদের হাঁক-ডাক রেকর্ড করে ধরে রাখতে এবং আমাকে পাঠাতে, ‘বাদশাহী আংটি’র বনবিহারীর মত, যাতে তাদের অনুপস্থিতিতেও অনুপস্থিতি টের না পাই। পাঠিয়েও ছিল, কিন্তু আমাকে বলেছিল এক অমোঘ সত্য, আমিও যা মাঝে মাঝে ভুলতে বসি আধুনিক সোশ্যাল মিডিয়ার চক্করে, “মানুষের নিজের চোখ-কান-মন, এই তিন-কে ছাপিয়ে এখনো কোনো বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি কোনো মেমরী কার্ড তৈরী করতে পারে নি”।

ছবিগুলো রেখেছিলাম। কিন্তু তার পাঠানো পাখির ডাক আমি আর শুনি-ও নি। না বুঝতে দিয়েই মুছে দিয়েছি...
বরং কয়েকদিন অপেক্ষা করি, কবে সত্যি শুনতে পাব।

No comments: