Sunday, 31 May 2020

দাগ

আর আধঘন্টা…ব্যাস সাইকেল চালানো শেষ, সেদিনের মত। তারপর পড়তে বসতে হবে। দুপুরে সবাই যখন ঘুমোচ্ছিল, তখন একটুও শব্দ না করে সাইকেল টা বের করতে গিয়েছিলাম। বড়মামীমা-র ঘুম বড় সজাগ। বাইরের ঘরের তক্তবোসে শুয়ে দুপুরের বিশ্রাম নিতে নিতে মনে হয় স্বভাবতই চোখ না খুলে বলল,
- কে র‍্যা? 
- আমি…
- তুই ভর দুপুরে কি করছিস?
- এই যে ছিপ নিয়ে একটু মাছ ধরতে যাচ্ছি।
ডাহা মিথ্যে কথা বললাম।
- এই ঠা ঠা রোদ্দুরে বাইরে না বেরোলেই নয়? মা-কে বলে দিলে আর যখন মামার বাড়িতে আসতে দেবে না, তখন বুঝবি ঠ্যালা।
- একটু যাই? 
আমি জানি, মামীমা মা-কে কিচ্ছু বলবে না। আর সবসময়েই চায়, আমি এখানে এসে থাকি।
- যা…কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবি না আর গরম হলে চলে আসবি।
- আচ্ছা!!!
মাছ ধরতে ভালই লাগত আমার। কিন্তু আগের দিন ছিপে মাছের বদলে কি করে একটা জলঢোঁড়ার বাচ্চা বঁড়শি-তে গেঁথে গিয়েছিল কে জানে! এখন সেই ভয় কাটতে তো সময় লাগবে। তাই এখন সাইকেলের নেশাটা একটু বেশিই চেপে বসেছে।

বাখরাহাট বাজারের বড় রাস্তা থেকে  আদি-র দোকানের গা দিয়ে যে সরু রাস্তা-টা চলে গিয়েছে, তার কোনো নাম নেই। আদির দোকান থেকে কন্ট্রোল-ধার (রেশন দোকানের গ্রাম্য নাম) পেরিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে সেই ঘোষপাড়া পর্যন্ত। কিছুদিন আগেও পুরো রাস্তাটাই ইঁট দিয়ে বাঁধানো ছিল। সন্তোষ-দার কাছ থেকে দু সপ্তাহের কসরতে ঘোষপাড়ার মাঠে সাইকেল চালানো শিখেছিলাম। এমন ট্রেনিং যে একবারও পড়লাম না। প্রথম দু দিন শুধু সাইকেল নিয়ে হাঁটা, তারপর প্যাডেলে পা রেখে শুধু দাঁড়ানো, তারপর হাফ-প্যাডেল, তারপর সবথেকে কঠিন কাজ – সামনে দিয়ে পা- তুলে সাইকেলে চেপে বসা। শেষের-টা শেষ পর্যায়। 
- এটা যে পারে, বুইলি, পৃথিবীর সব কিছু সে পারে। 
সন্তোষ-দা কে তো আর ইস্কুলে যেতে হয় না, লেখাপড়ার বালাই নেই। তাই অনায়াসে বলে ফেলল। 

এবারেও যথারীতি ৭৫ নং বাস থেকে নেমে, মা-এর সঙ্গে যখন মন্টু-দার রিকশা-তে উঠলাম, তখন মন্টুদা তাড়ি খাওয়া ধরা ধরা গলায়, রিক্সার হ্যান্ডেলে প্রায় মুখ গুঁজে রিকশা চালাতে চালাতে বলল,

- এবার দেখ, বাবু, তুমি সাইকেল চালাবে বলে আমরা কি কইর‍্যাসি।

সত্যি-ই আমি দেখে আনন্দে কুল পেলাম না! দাঁত-বের করা, ইট বিছানো রাস্তা আর নেই। কালো পিচ দিয়ে মোড়া রাস্তা, পুরোটাই। জয়চন্ডীপুরের বুক চিরে চলে গিয়েছে। জাতে উঠল, তাহলে, জয়চন্ডীপুর গ্রাম। 

- আমাকে দু-টাকা কম দিলেও হবে।
মন্টুদা মা-কে বলল।
-কেন?
-আগে ইটের রাস্তায় টানতি বড় কষ্ট হত তো! এখন তো আর সেই ঝামেলি লাই! আরামে সালাতে পারি। 
- না, তুমি আগের ভাড়াই নিও। আমার বাপের বাড়ির রাস্তা পাকা হয়েছে। আমার-ও তো আনন্দ। বল!
-ত্যালে আর কি কই!
আমি মনে মনে কি যে খুশি হলাম। সত্যি-ই তো, মা তো ঠিকই করেছে। এমন একটা খবর যে দেয়, তাকে এটুকু পুরষ্কার তো দেওয়াই উচিত। রিক্সাটাই যিদি এমন গতিতে চলে, তা হলে সাইকেল না জানি উড়োজাহাজের মত উড়েই না যায়! মনে মনে ভাবতে ভাবতে মামার বাড়ি এসে গেল।

আদির দোকান ছাড়িয়ে বড় রাস্তাতে গেলেই চারিদিকে ছটোমামা-র বন্ধু-বান্ধব সব  ওঁৎ পেতে বসে আছে। একবার চাকায় হাওয়া দেওয়ার ছুতোয় একটুখানি দূরে রায়পুর মোড় থেকে এক চক্কর ঘুরে এসেছিলাম। ওফ, রাস্তা একেই বলে! যেন মাখন!

পরদিন, সক্কাল সক্কাল ছোটোমামার সঙ্গে বাজারে এসেই, ব্যাস!

-মিহির, ভাগনা কিন্তু সাইকেল নিয়ে কাল বড় রাস্তায় এয়েছিল। 

তবে ছোটোমামা-কে  যে আমি এতটাই ভালবাসি আর ভরসা করি, তার কারণ হল, কারোর সামনে আমকে কোনোদিন বকে না। যা হবে সব বাড়িতে ফিরে। বাজার থেকে বাড়িতে ফিরে সাইকেলের চাবি টা নিয়ে নিয়েছিল, সে বার। পুরো এক সপ্তাহ! তারপর বড়মামীমার মধ্যস্থতায় আবার কোনোরকমে সাইকেলের নাগাল পাওয়া গিয়েছিল। সেই থেকে আর বড় রাস্তায় যাওয়ার সাহস করি নি।

এইবারে আমাকে পায় কে! চুটিয়ে চালালাম সাইকেল। মাঝে মাঝে ছোটোমামা-ও দরকারে সাইকেল পেল না। বদলে শাস্তি স্বরূপ দশবার করে ১৩, ১৭ এর ১৯ এর নামতা লিখে দেখানো। তাও মেনে নিয়েছিলাম।

কন্ট্রোল-ধার থেকে একটু এগিয়ে খানিকটা চড়াই আছে। তারপর উতরাই-তে স্পিড তুললাম। এতটাই, যে প্যাডেলটা আর নেই মনে হল। কানের পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই হাওয়া। পুষ্পক রথে একমাত্র আমি…এখনকার এরোপ্লেন…

ম্যাঁ…হ্যা হ্যা হ্যা…

একটা ছাগল-ছানা দশ মিটার দূরে হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে সিদ্ধান্ত নিল, তার সমূহ বিপদে, ঠিক তখনই রাস্তা পেরোতে হবে। তার মা-এর কাছে যেতেই হবে। হিসেব করে সাঁ করে কাটাতে যাব, দেখলাম বাঁ-পায়ের প্যাডেলে সরু নাইলনের দড়ি জড়িয়ে গিয়েছে। আমি দেখতে পাই নি ছানা-টা দড়ি দিয়ে নারকেল গাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল। দড়ির টানে ছোট্ট ছানা-টা আমার সাইকেলের সামনের চাকার সামনে। আমি কিছু না করলে ও মরেই যাবে।।প্রাণপনে ব্রেক কষলাম। দু থেকে তিন সেকেন্ডের মধ্যে হাওয়ায় উড়তে উড়তে আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তার ওপরে। আঘাত যাতে কম হয় ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম, স্বাভাবিক প্রতিবর্তে। খুব লাভ কিছু হল না। ডানপাশের হাতের তালু, কনুই, কাঁধ, গাল,  ঘষে গেল নতুন পিচ বাঁধানো রাস্তার ওপর। ভীষণ যন্ত্রণায় হাত পা কাঁপছে। উঠতে পারলাম কোনো রকমে। দেখলাম, হাড় গোড় কিছু ভাঙেনি। ছাগলছানা-টার দুটো পা আর গলা বিশ্রীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে সেই সরু নাইলন দড়িতে। গিয়ে জট ছাড়ালাম, ছানাটা ছুটে তার মায়ের কাছে চলে গেল। 

সাইকেল-টার যা হাল হয়েছে তাতে কাল থেকে ছোটোমামা আরা আমকে সাইকেলে হাত দিতে দিলে হয়! সাইকেলের সিট-টা পুরো ঘাড় কাত করে বেঁকে গিয়েছে। হাত দিয়ে টেনে, ঠেলে, মেরে, পারলাম না। রাস্তার পাশে একটা আধলা ইট পড়ে ছিল ঠোকাঠুকি করে সোজা করা গেল। সাইকেল টাকে দাঁড় করানোর পরে দেখলাম, হ্যাণ্ডেলের-ও তথৈবচ অবস্থা। দু পায়ের ফাঁকে সামনের চাকাটা ঢুকিয়ে হ্যাণ্ডেল ধরে মোচড় দিয়ে ঠিক করতে পারলাম। অনেকটা রাস্তা এখনো বাড়ি পৌঁছাতে। হাঁটার শক্তি নেই। সাইকেল চালিয়ে ফিরতে হবে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ছাল উঠে ছড়ে গিয়ে সাদা দগদগে মাংস বেরিয়ে গিয়েছে। কনুই থেকে রক্ত ঝরছে। কাঁধের কাছে জামা ভিজে। গালে হাত দিতেই চিনচিনিয়ে উঠল। ডান হাতে হ্যান্ডেল ধরা অসম্ভব। বাঁ-হাতে ভর করে সাইকেলে চড়লাম। প্যাডেল করতে গিয়ে আবার বিপত্তি। প্যাডেলের আক্সেলটা এতোটাই বেঁকে গিয়েছে যে চেন-বক্সে আটকে যাচ্ছে। ঘুরছেই না। ছোটমামা কিছু বলে না বটে। কিন্তু সদ্য কয়েকসপ্তাহ আগে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সাইকেল-কে প্রায় নতুন করে ফেলা হয়েছিল। তারপর এই অবস্থায় নিজের সাইকেল যদি পায়, আমার সাইকেল চালানো জীবনের মত শেষ। সেই ভয়ের চোটেই বোধহয় আবার অনেকটা শক্তি ফিরে পেলাম। আধলা ইঁট টা দিয়ে ঠুকে ঠুকে মোটামুটি একটা চলনসই যায়গায় নিয়ে আসা গেল।

উঠোনের দরজা দিয়ে ঢুকতেই, বড় মামীমার হুঙ্কার,
- হ্যাঁ রে, মাছ ধরতে সাইকেল কোন কাজে লাগে! সেই কোন দুপুরে... ও মা গো! একি!!!! কি সব্বনেশে কান্ড। ও ছোড়দা (আমার ছোটোমামা-কে এই নামেই ডাকত বড়মামীমা), এস দেখে যাও তোমার গুণধর ভাগনা কি কান্ড করে এসেছে। আমরা তোমার দিদি কে কি জবাব দেব, এখন।
- সে রকম কিছু হয় নি গো মামীমা। একটু ডেটল টেটল লাগিয়ে দাও, ঠিক হয়ে যাব।
তখনো আমি সাইকেল ধরে তুলে সিঁড়ি দিয়ে দালানে রাখার চেষ্টা করছি, যাতে ছোটোমামা আবার না সাইকেলে চাবি দিয়ে দেয়। 
ছোটোমামা এসে এক দণ্ড দেখল। আমার হাত থেকে সাইকেলটা ছাড়িয়ে ফেলে আমাকে পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে বাইরের ঘরের বড় তক্তবোসে শোয়ালো। মামাতো বড় বোনকে বলল,
- বুবলা, অনেকটা গরম জল নিয়ে আয়, আগে। সঙ্গে পরিষ্কার সাদা কাপড় আর ডেটল। 
মামাতো ছোটবোন শিউলির কাজ হল একটু দূরে থাকা হেবোকাকা নামে এক কম্পাঊন্ডারকে খবর দেওয়া, টিটেনাসের জন্য।
ছোটোমামা আর বড়-মামীমা দু জনে মিলে আমাকে, আমার ক্ষত পরিষ্কার করতে লাগল। দু জনেই বলতে লাগল, এমন কিছু হয় নি, ও রকম একটু হয়। ছোট-মামা বলল,
-আমি যে রকম তোদের ভূতের গল্প বলি, সে রকম করে বল দেখি, ঠিক কি কি হয়েছিল! নিজের এমন হাল করলি কি করে?
একটা ছাগল ছানাকে বাঁচাতে গিয়ে এই কাণ্ড শুনে তো ছোটোমামা হেসেই বাঁচে না। আর বলল, 
- ভাগ্য ভাল তোর, একটাও হাড় ভাঙ্গেনি, এই রকম ‘হাড়কিউলিস’-এর মত চেহারা নিয়েও। তবে কাঁধ-টা একটু বেশিই ছড়েছে। আর গালে যদি দাগ-টা থেকে যায়, তাহলে বিয়ে দেওয়া-টা মুশকিলের হবে। কি বল, বৌদি? 

আমি-ও হেসে ফেললাম। ভাবলাম, যাক বাবা! সাইকালে আর চালাতে দেবে না, এরকম তো কিছুবলে নি! মন-টা খুশিতে ভরে গেল। এত বড় অপরাধেও কোনো শাস্তি পেলাম না। একেই বলে, 
মামার বাড়ি ভারী মজা/ কিল-চড় নাই

-হপ্তা দুই লাগবে, এখন। মারকিউরোক্রোম আনিয়ে নাও, মিহির। তা হলেই হবে। 
কম্পাউণ্ডার হেবোকাকা টিটেনাস, আন্টিবায়োটিক আর দু-দিনের ঘুমের ওষুধ দিয়ে চলে গেলেন।

সপ্তাহ তিনেক পরে বাবা আমাকে আনতে এলেন। অনেকদিন ইস্কুল কামাই হয়ে গিয়েছে। গরমের ছুটি সেই কবে শেষ হয়ে গিয়েছে। বড়মামীমা বাবা-কে বলল, 
- জামাইবাবু, কাঁধের-টা সারতে সময় লাগবে। গালের দাগটা মেলাতেও...দেখা যাক।
ছোটমামা আমাকে সাইকেলের চাবিটা হাতে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল,
-যাঃ...এক চক্কর মেরে আয়।
আমি বুঝতে পারলাম না, কি বলতে চাইছে। মজা করছে না কি। 
- কি হল, যা! ভীতু না কি!

আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবা শুধু অল্প হেসে, ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন।
আমি চাবিটা ছোটোমামার হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে ছুটলাম সাইকেলের দিকে। 

ডান কাঁধের দাগ-টা রয়ে গিয়েছে, এখনও। সাইকেল-টা আর নেই। ঠিক সেখানেই একটা অন্য সাইকেল রাখা থাকে এখন।

...আর নেই ছোটমামাও...

অবসরে...

বেশ কিছুদিন ধরেই খানিকটা লেখা পাচ্ছে, যেমন ক্ষিদে আর পটি দু’টোই পায়। কিন্তু কি খাব আর কি খেলে পেট পরিষ্কার হবে তা নিয়ে অনেকটা ধন্দে ছিলাম। শেষে ভাবলাম, দেওয়াল নোংরা করি – কৈশোরের ইস্কুলের টয়লেটের নয়, নিজের বাড়ির-ও নয়, ফেসবুকের...যেখানে এক্কেবারে স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম, যা ইচ্ছে লেখার জন্য বা লোক-কে পড়ানোর বা দেখানোর জন্য। সবথেকে বড় মজা হচ্ছে, এখানে কোনো শাস্তি নেই, না আছে বাজে কথা বললে মার খাওয়ার ভয়। ডেমোক্রেসী বাবা, বুইলে কি না! এককালে খুব তিতিবিরক্ত হয়ে ফেসবুক ছেড়ে চলে যাই। আবার ফিরেছি প্রায় বছর আষ্টেক পরে। খুব কিছু বদলায় নি। শুধু প্রত্যেকের বিরক্তির মাত্রার ব্যক্তিগত অধিকার-কে সম্মান জানাতে জটিল হয়েছে প্রাইভেসী সেটিংস, শুধু ‘লাইক’ আর ‘আনলাইক’-বাটন এর সমস্যার সমাধান ঘটেছে অনেক ধরনের অনুভূতির আলাদা আলাদা স্মাইলি-দিয়ে, আর সংযোজিত হয়েছে  একরাশ সোশাল নেটওয়ার্কিং ইন্টারলিঙ্কের বাড়তি সুবিধাগুচ্ছ। একটা ব্যাপার বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সকলেই কিছু না কিছু বলতে চায়। পড়ার, দ্যাখার, শোনার ধৈর্য খুব কম, ফলে সুচিন্তিত গভীর মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গীর আদান-প্রদানে মনে হয় খুব বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসে স্থৈর্য অনেকটা বেড়েছে বলেই হয়ত এখানে টিঁকে গেলাম, দ্বিতীয়বার এসে। খুব চুপ করে বসে পাতা স্ক্রোল করে দেখতে দেখতে এক এক সময়ে হ হীনম্মন্যতায় ভুগি না যে তা নয়, কারন আমি ফেসবুক না থাকলে জানতেই পারতাম না হয়ত, আমি যাদের বহু বছর ধরে চিনি বা জানি বলে বুক ঠুকে দাবী করি, তারা আসলে সত্যিই কি কি জানে, কি কি পারে। 

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কোনোদিন ভেবেছিলেন যে তিনি নোবেল পেয়ে ‘বিশ্বকবি’ হয়ে যাবেন? ফেসবুক তো তখন ছিল না। কার হাত ধরে তবে রবীন্দ্রনাথ বর্ডার পেরোলেন? রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভাবনাকে সাগরপারে লন্ডনে ইংরেজদের দরবারে পৌঁছে দিলেন সেখানে প্রিন্টিং টেকনোলজি শিখতে যাওয়া সুকুমার রায় স্বয়ং, ঠিক যেমন করে শ্রী রামকৃষ্ণ ‘পরমহংস’ হয়েছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে হিন্দুত্ববাদ নামক আদি ও মহান দর্শনের সার্থক প্রচারের মাধ্যমে। (এখানে আবার ভাবার অবকাশ রেখে গেলাম যে আমি কি আসলে কোনো রাজনীতির রঙ-এ দেওয়াল রাঙাতে এসেছি কি না)। সুকুমারের উদ্যোগে তাঁর লণ্ডনের বাসায় মাঝে মাঝেই সাহিত্যসভা হত, যেখানে প্রথম তাঁর হাত ধরেই রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ। ইংরেজরা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ইংরেজী ভাষার ওপর দখলে মুগ্ধ হয়ে মজে যান নি, কারণ তিনি যে খুব সুন্দর ইংরেজী লিখতেন তা আদপেই নয়। তাঁরা মুগ্ধ হলেন রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ধারায় যা সুকুমার নিজে তাদের সামনে মেলে ধরলেন। এর পরের গল্প সকলের জানা ও চেনা। তা নিয়ে অনেকটা টাইপ করা বাতুলতা মাত্র। 

হ্যাঁ, আমি যা বলতে চাইছি, যে জোরালো মাধ্যম লাগে, কোনো কিছু ভাল বা খারাপ কে সকলের কাছে উন্মুক্ত করে মেলে ধরার জন্য। আর সেই মাধ্যমের সদব্যবহার করার মধ্যেই আমাদের নিজেদের প্রত্যেকের দায়িত্বজ্ঞানের সচেতনতার মাত্রা বোঝা যায়। আমি ঠিক গুগল করে এখনো জানতে পারি নি যে, ‘সোশ্যাল মিডিয়া পলিউশন’ নামে কোনো কিছু আছে কি না, বা সেটাই ‘সাইবার ক্রাইম’ নামে চলে কি না। তবে সেই দিন আসন্ন যে আমাদের সুস্থ বুদ্ধিবৃত্তির শ্বাস নিতে ভীষণ অসুবিধা হতে পারে। রোজ সকালে একগাদা অনভিপ্রেত রং-বেরঙের ‘সুপ্রভাত’ বা রাত্রে অপ্রত্যাশিত  ‘শুভরাত্রি’-র তাড়নায় আমরা 'ভেন্টিলেশন'-এও চলে যেতে পারি।

আমার জীবনে যে পরম বন্ধুর হাত ধরে বাস্তব-সাগরে চোখ বন্ধ করে নির্দ্বিধায় ঝাঁপ দিয়েছিলাম, সে ও তার মেয়ে কিছুদিন আগে তাদের বাড়িতে সংবিগ্ন পক্ষীকুলের সেই চিরকালীন মাতৃসুলভ যত্নে ব্যস্ত ছিল। পেয়েছিলাম কিছু ছবি, ফেসবুকে।
বলেছিলাম পাখিদের হাঁক-ডাক রেকর্ড করে ধরে রাখতে এবং আমাকে পাঠাতে, ‘বাদশাহী আংটি’র বনবিহারীর মত, যাতে তাদের অনুপস্থিতিতেও অনুপস্থিতি টের না পাই। পাঠিয়েও ছিল, কিন্তু আমাকে বলেছিল এক অমোঘ সত্য, আমিও যা মাঝে মাঝে ভুলতে বসি আধুনিক সোশ্যাল মিডিয়ার চক্করে, “মানুষের নিজের চোখ-কান-মন, এই তিন-কে ছাপিয়ে এখনো কোনো বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি কোনো মেমরী কার্ড তৈরী করতে পারে নি”।

ছবিগুলো রেখেছিলাম। কিন্তু তার পাঠানো পাখির ডাক আমি আর শুনি-ও নি। না বুঝতে দিয়েই মুছে দিয়েছি...
বরং কয়েকদিন অপেক্ষা করি, কবে সত্যি শুনতে পাব।

Saturday, 30 May 2020

ঝাউতলায় ঝঞ্ঝাবাত্: প্রথম পর্ব

জ্যোতির্ময় কে যত বলি, ওরে চুপ করশুনতে দেও সেই অতনু-র গল্পে যুক্তি খুঁজবেই।

অতনু হল গিয়ে আমাদের ঝাউতলার টেনিদা। এমন সব গল্প আছে না, ওর ঝুলিতে যে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসের আশেপাশে পৌঁছানো সবাই কিন্তু মোহিত হয়ে শোনে। আর সে সব শুধু গল্প-কথা নয়। কি যেন বলে ইংরেজীতে -- বেসড অন র‍্যিল স্টোরিজ

তবে,সত্যি বলতে কি, অতনু কে বাদ দিলে আমাদের সকলের সারাবছর ধরে নানান ছুতোয় খাওয়া দাওয়ার অংশটা বাদই চলে যেত। এই যে পুজোর ক'দিন পাড়ার বেশির ভাগের বাড়িতেই  হাঁড়ি চড়ে নাকোনো বেলাতেই, এর পুরোভাগে অতনু ছাড়া আর কেউ নেই। কার দায় পড়েছে, নবমীর দিন কয়েক শো লোক পাঁঠার মাংস কব্জি ডুবিয়ে খাবে বলে আর মুখে দিলেই গলে গেল বলে সাধু অতনু না বলে ভাববে যে দুশো তিরিশ টাকা জন প্রতি, একটু বেশিই নিয়েছে পুজো কমিটি আর সেই জন্য ভোর চারটের সময়ে মাংসর দোকানে গিয়ে লাইন দিয়ে বেস্ট কোয়ালিটি মাটন কিনে আনবে!

অথবা, আমরা সকলে মিলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করতে ইচ্ছুক, এবং আমাদের মধ্যে কেউ খাওয়াতে ইচ্ছুক এটা শুনলেই অতনু আর অসীম সবসময়ে ব্যাগ নিয়ে প্রস্তুত, তাদের দৈনন্দিন জীবনের সব কাজ সেরেও। আমাদের কোনো কাজই থাকে না, শুধু খাওয়া আর অনাবিল আনন্দ উপভোগ করা ছাড়া। এরকম মনের মানুষদের বন্ধু হিসেবে পাওয়া আজকালকার সময়ে পরম সৌভাগ্যের

এ রকম মন আছে বলেই আমরাও এই বয়সে এসেও ঠাট্টা-ইয়ার্কি করি অতনু কে নিয়ে। ও কিছু মনে করে না, আমরা যখন বারে বারে রসিয়ে, তারিয়ে ওরই বলা গল্পের স্বাদ ওরই সামনে উপভোগ করি

গতবারে তখন দূর্গাপুজো আসন্ন। বছর পাঁচেক আগের দূর্গাপুজোর একটা ছবি নিয়ে একদিন রাত্রে ঝাউতলার সবাইকে দেখাচ্ছিলাম। সেবারের মহাষ্টমীর সকালে তোলা ছবি। আমাদের পাড়ার জনা পনেরো বিভিন্ন বয়েসের ব্যক্তি একসাথে ধুতি-পাঞ্জাবীতে। এদের সকলের মধ্য একটা বিষয় সাধারণ -- ছবিতে দৃশ্যমান সক্কলের সেলুনের খরচ নিতান্তই অল্প, কারণ ন'মাসে ছ'মাসে একবার গেলেই চলে, আর কারো কারো একেবারেই নেই। দাড়ি-গোঁফ কামাতে গেলে আলাদা কথা, কিন্তু মাথার চুলের জন্য প্রায় কোনো খরচ-ই নেই। ছবিটা দেখে সকলে পাঁচ-বছর-আগে আর এখন -- সেই তুলনামূলক আলোচনায় চলে গেল, প্রত্যেক-কে ধরে ধরে, সুজয়-দা, বাবলু-দা, সন্দীপন-দা ইত্যাদি ইত্যাদি। সন্দীপন-দা সেবছর ঐ খাতায় সবেই নাম লিখিয়েছেন, সৌজন্য, পাড়ার লৌহ-মিশ্রিত হার্ড ওয়াটারে নিয়মিত গোসল। অতনু-ও সৌভাগ্যক্রমে সেই বিশেষ দলভুক্ত। ছবিতে বছর পাঁচেক আগে মাথার পিছনে খানিকটা ছিল। এবারে দেখা গেল প্রায় নেই বললেই চলে।যেহেতু অতনু তখন সামনে আড্ডায় উপস্থিত,আর যায় কোথায়!

যথারীতি জ্যোতির্ময়,

-কই, অতনু দেখি?

অতনু ঘাড় ঘুরিয়ে মাথার পিছনের দিকটা জ্যোতির্ময়ের দিকে বাড়িয়ে হাতে জ্বলন্ত বড় গোল্ডফ্লেকে একটা সুখটান দিয়ে মৃদুমন্দ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললঃ

- দেখতে পাবি না, আজই কেটেছি তো! সাড়ে সাতশো টাকা দিয়ে, পার্ক স্ট্রীট হাবিব'স-এ

- , তাই বল...রাজবস্ত্র অতি সূক্ষ্ম, কেস!

এ হেন উক্তি ও প্রত্যুক্তির পর কি কৌতুহল আর ধরে রাখা যায়! আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, কারণ আমাদের দৌড় রাস্তার উল্টোদিকে তিরিশ টাকার রামবিলাস-দার সেলুন, আমরা কায়দা করে মাঝে মাঝে যেটাকে স্যালোঁ বলে থাকি, কল্পনায় জাতে উঠব বলে

ঝাঁপিয়ে পড়ে দেখে আমার আধো-আলো-ছায়ার মায়াতে যা মনে হল তা হল, আমাদের এই পাড়ার মাঠটা একসময়ে ফ্লাই-অ্যাশে ভর্তি ছিল। মাটি কিনে এনে যখন সেটাকে একটা সম্পূর্ণ মাঠের রূপ দেওয়া হল, তখন যখন মাঠের এক কোনায় ঘাস গজানো শুরু হয়েছিল। অতনুর হাবিব'স-ফিরৎ-সাড়ে-সাতশো-টাকার চুল অনেকটা সেরকম। মাথার পিছনে চুলের নিচের দিকের লাইনে একটা হালকা অঙ্কের সেকেন্ড ব্র্যাকেটের পারফেক্ট ভাঁজ আছে, অনেকটা আক্সয়-কুমার স্টাইলে। কিন্তু সামনে-টা মরুভূমি, আনুপম খের। ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে হলে পোস্ট-রিটায়ারমেন্ট বিবাহিত অন্দ্রে আগাসি

আবার জ্যোতির্ময়ের বাক্যবান,

- তুই একাই কাটলি, না কি পুরো ফ্যামিলি তোর সঙ্গে ফ্রি ছিল?

এই ধরণের গা-জ্বালানো মন্তব্য অতনুর গা সওয়া তো হয়েই গিয়েছে, উলটে ওর লজিক্যাল ডিফেন্স মেকানিজম এতোটাই জোরালো, যে আমরাও অবাক হয়ে শিখি, প্রত্যেকবার। উত্তর এল,

- না রে ভাই, হেয়ার ডাই-ও করিয়েছি, ন্যাচারাল বারগান্ডি। রাতে বুঝতে পারবি না। দিনের আলোয় দেখিস। সঙ্গে জানবি, যাদের মাথায় চুল ভর্তি তাদের চুলে কাজ করা অনেক সহজ। কোনো সূক্ষ্ম কাজ করতে হয় না। আমার মত চুলে কাজ করা খুব চাপের। এদিক থেকে ওদিক হলেই ব্যাস! আর কিন্তু মেক আপ দেওয়ার জায়গা নেই

আমরা জীবনে প্রথম  বুঝতে পারলাম, খানিকটা হলেও, যে অতনুর চুল আর কৈলাসের গুহা, বা খাজুরাহোর পাহাড়ে খুব একটা পার্থক্য নেই। আর চুল কাটা কোনো চিরকালীন, অমর স্থাপত্য-ভাষ্কর্য শিল্পের থেকে কম নয়। নাপিত বলে যাদের হেয় করা হয়, তা একেবারেই উচিত নয়। বা বড়জোর তাদের ক্ষৌরকার বলে যেটুকু সম্মান দেওয়া হয়, তা-ও ঠিক যথেষ্ট নয়। আর সবথেকে বড় কথা শিল্পী থাকলেই হল না, রসদ তো চাই। হাবিবস- ই হোক আর যে-ই হোক সারা বছরে অতনুর মাথার চুলের মত বড় রসদ কটাই বা তাদের কাছে আসে, নিজের ঐ উচ্চমানের শিল্পকর্মকে বিকশিত করার জন্য!

আমরা অতনুর মাথায় সেই অনবদ্য শিল্পকর্ম চাক্ষুস করার পর এমন বুঁদ হয়ে গেলাম যে সেদিনের মত ঝাউতলার রাতের আড্ডা শেষ হয়ে গেল। নিজেদেরকে হঠাৎ খুব খেলো মনে হতে লাগল। মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এত শিল্পকর্মের মধ্যে কোথাও একটু ন্যূনতম শরীকও তো হতে পারতাম! জীবনে তেমন করলাম-টা কি!

অতনু কিন্তু কোনোদিন-ই এই হাসি-তামাশা নিয়ে কিছু মনে করে নি। তবে কে যে নজর দিল, জানি না! এখন তো আর সেভাবে আড্ডা হয় না। করোনার প্রকোপে আমাদের আড্ডা-শিল্পও চরম সঙ্কটে। ভিডিও কন-কল যতই থাকুক, ওভাবে কি আর ঝাউতলা হয়!

আবার কবে আমরা যে একজায়গায় জড় হয়ে হাসি-মজা-ঠাট্টা করব, অতনু-অসীমের নেতৃত্বে পেট পুরে খাব, সেই অপেক্ষায় আছি

যা আর ফেরত আসবে না তা হল, আমাদের প্রিয় ঐ ঝাউগাছটি। বারো বছর আগে রোপন করার সময় থেকেই আমাদের সকলকে সে একটা ঝাউতলা বলে প্রাকৃতিক ক্লাব উপহার দিয়েছিল, জীবনের অনেক অক্সিজেন সমেত। আম্ফান/উম্পুন তাকে কেড়ে নিয়েছে, চিরতরে...এখনো মরদেহ পড়ে আছে তার, ওখানেই। যাতায়াতের সুবিধার্থে তার কিছু  অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। শেষকৃত্য কিভাবে করা হবে, আমরা কেউ-ই জানি না। দেখলেই মন বড় ভারী হয়ে আসে...

তবে একটা কথা সত্যি যে সেই গাছ যতই শুষ্কঙ কাষ্ঠ্ঙ তিষ্ঠতি অগ্রে বলা হোক না কেন্, আমাদের মন খারাপের থেরাপী কিন্তু অসীম আর অতনু-র হাতেই... আশা রাখি, ওই গাছও একদিন প্রাণ ফিরে পাবে... আমাদের কালিদাস তো অতনু-ই: নীরস তরুবর পুরস ভাগে শুকনো কাঠে এ ভাবেই রসের সঞ্চার হয়্...

যারা আমাদের দেহ্-মনে তরতাজা রেখেছে তাদের প্রতি এই লেখা উত্সর্গ করলাম্।

(আশা রাখি, নিছক মজা হিসেবেই সবাই এই মধুর স্মৃতি-রোমন্থন কে গ্রহণ করবেন। আর অতনু-ও কিছু মনে করবে না। আমি সকলের, বিশেষতঃ অতনু আর জ্যোতির্ময়ের, নাম বদলে অনায়াসে এই গল্প জমিয়ে লিখতে পারতাম, কিন্তু তাতে গল্পটা থাকত বটে, তার প্রাণ থাকত না। ধন্যবাদ অতনু-কে আর ঝাউতলার বাকি সবাইকে।)

***এটা লেখার জন্য বিশেষ প্ররোচনায়ঃ অসীম

 

Saturday, 23 May 2020

Angry Wolf

Exasperated by the incessant onsalugth of Mother Nature on life, an artist in desperado in acute dearth of the basic resources, burns matchsticks to replace charcoal and a page in his diary is filled with the strokes of ashes of the burnt carbon on their tips expressing his pent-up anguish...
Courtsey: Saptashwa Mukherjee

Smile though your heart is aching...

One of my favourite quotations has been "Life goes on and that is progress" by Charles Spencer Chaplin. He had used this dialogue in 'Limelight', one of his handful straight serious movies with dialogue released in the year of 1952, bagging Academy awards for 'best original background score'. The famous song 'Smile' he had composed, had been used in 'Modern Times' as its theme music and background score all through and still is remade by vocal stars of global fame and repute including the infamous Soul star Seal and all-time pop legend Michael Jackson.
My son, a fan of this all-time acting legend has been trying his hands in basic digital artwork leaving his pencils, for sketching due to lock-down state of things when getting the right paper is a fancy...so this is what he has created on his smartphone today with the tip of his fingers only and is deeply contended with his own performance that  at least he can do the basics now....Thus he names this digital sketch "Modern Smile" -- an apt lashing satire with the present global and national backdrop.
So courtsey: Rhito Chattopadhyay

Friday, 22 May 2020

হোল্ড অন, হোল্ডার

হঠাৎ ফেসবুকে কয়েকটা ছবির সমাহার। সালকিয়া বেনারস রোডের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে রাস্তা বন্ধ। যথারীতি জল থৈ থৈ, প্রায় হাঁটুজল। আম্ফানের ভূমিকার কবলে পড়ে বিকেল চারটে নাগাদ, আটকে আম্বুল্যান্স। আমার মানুষ হওয়ার জীবনশৈলীর শিক্ষার পিছনে যে কয়েকজন দারুণ মানুষের হাত আছে, তাদের একজনের ছবি সামনে থেকে, হাসিমুখে। সেই স্মিত হাসি, একইরকম আছে। 
ফ্ল্যাশ-ব্যাকঃ-
মানুষ কালো না জানলে সাদা বোঝে না। তাই কালো কেমন আর তারপর সাদা কে সম্মান জানিয়ে জীবন আঁকড়ে কি ভাবে চলা যায়, সেই পথ চলতে শেখানো এক দমকা হাওয়া ছিল 'হোল্ডার'।

 পাড়ায় আলো নেই তিন দিন হয়ে গেলো। চার বন্ধু মিলে বারোয়ারীতলায় বিড়ি খাচ্ছিলাম। এক কাকীমা পুকুরের জল নিতে এসে স্বগতোক্তি করে চলে গেলেন যে আর পারা যাচ্ছে না। হোল্ডার হঠাৎ বিড়ি ফেলে প্যান্টের পিছন হাত দিয়ে ঝেড়ে বলল "চ' তো দেখি, পথ অবরোধ করি'। ফুচান চিরকালই সাবধান প্রকৃতির একটু ভীতু মানুষ। তোতলাতে তোতলাতে বলল 'কি সব বলছিস, মার ধোর খাবি না কি'! কে কার কথা শোনে, যেমন বলা তেমন কাজ। হোল্ডার আর আমি মিলে উল্টোদিকের অয়েল মিলের গায়ে রাখা একটা ঠেলা নিয়ে রাস্তায় আড়াআড়ি রেখে দিয়ে মুদির দোকানের চাতালে বসে আবার বিড়ি ধরালাম। রাস্তায় যে-ই সেই ঠেলা সরাতে গেল, শুধু চারজনে সমস্বরে তার উদ্দেশ্যে হুঙ্কার-- 'ওই ওই ওই ওই, কে বে!!!' ব্যাস, আবার ময়দান ফাঁকা। ঠ্যালা সরানোর সাহস আর কারো হয় না। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্যাম-জট। পাড়ার বড়রা এসে হাল ধরলেন। জনা পঞ্চাশ লোক জমে গেল। কারেন্টের লাইন না সারালে অবরোধ বহাল থাকবে। আমরা চারজনে কিন্তু ওই পঞ্চাশজনের কেউ ছিলাম না। পুলিস এল। বড়রা বললেন সি-ই-এস-সি আসুক আগে তারপর অবরোধ তোলার কথা ভাবা যাবে। অবরোধের জেরে সালকিয়া চৌরাস্তা থমকে গিয়েছে কি না দেখার জন্য আমরা সান্ধ্যকালীন হাঁটা দিলাম। গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ --- পুরো জিলিপির প্যাঁচ। ওই জট ছাড়াতে রাত্তির গড়িয়ে যাবে। হোল্ডার দেখি সোজা কাঁধে তিন-তারা পুলিশের দিকে ধাবমান। গিয়ে বলল, 'স্যার এভাবে কি করে চলবে?' উনি বললেন, 'কি করব!'
- মেরে তুলে দিন না স্যার।
- হ্যাঁ সেই করতে গিয়ে পাবলিকের মার আমরা খাই, না কি।
- আমরা স্যার কতক্ষণ ধরে আটকে আছি!
- সি-ই-এস-সি এসে লাইন ঠিক করার কথা না দিলে আটকেই থাকবে। যাও তো এখান থেকে!
- কিছু করা যাবে না স্যার????!!!!
- আরে **** না রে, কিছু করা যাবে না...যাবি না কি!
হোল্ডার আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখ মারল। আমরা ফিরে এলাম। কামিনী ইস্কুল লেনের মোড়ে তখন লোকে লোকারণ্য।  আমরা পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। আমাদের হাতে গরম ডালপুরী। বারোয়ারীতলায়  খেতে খেতে হোল্ডার বলল,'আজ মাঝরাতের মধ্যে কারেন্ট চলে আসবে'। 

------
আজ যখন ফেসবুকে ছবিগুলো দেখলাম, সেখানে দেখলাম রাজনৈতিক ভাবাবেগের 'লাইক' আর 'কমেন্ট'- এ ভরে গিয়েছে। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের যুব নেতা হিসেবে সমিত ঘোষ আজ বিশেষ পরিচিত ও সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। তাই আজ তার সাকরেদরা সমিতের নেতৃত্বে রাস্তায় এই দারুণ ঝড়ে পড়ে থাকা গাছকে হাঁটুজলে ডুবে  সরিয়ে আম্বুল্যান্স যেতে দেওয়ার মত মানবিক কাজকেও রাজনীতির রঙে রাঙিয়ে ভোটব্যাংক সুনিশ্চিত করতে চায়।

....আর আমি ভাবি, যারা রাঙাচ্ছে, তারা সমিতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সব রঙের ঊর্দ্ধে সেই পরম মানবিক বন্ধু 'হোল্ডার'- কে কতটুকুই বা চেনে আর জানে....!

Tuesday, 12 May 2020

'মাস্কবাদী'-আমার চোখে...


লকডাউনে ফেসবুকে হঠাৎ দেখলাম সুজন মুখার্জী, মানে নীলের নাটকের গ্রুপ 'চেতনা' 'মাস্কবাদী' নামে একটা কিছু তাদের ইউ-টিউব চ্যানেলে উপস্থাপন করতে চলেছে। খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। লেকটাউন 'সংসৃতি' আয়োজিত নাট্যোৎসব শেষ হতে না হতেই লক -ডাউনের প্রকোপে শহর তথা সারা পৃথিবী ন্যূব্জ হয়ে পড়ল। সেই থেকে নাটক দেখার পাট চুকেছে। তবে টিভিতে আর ইনস্টাগ্রাম-এ অনেক অনেক প্রয়াস চোখে পড়ল। মনে গাঁথল না। মাঝখানে বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ অভিনীত, ড্যানী বয়েল নির্দেশিত  'ফ্রাংকেনস্টাইন' দেখে এমন অভিভূত হয়ে গেলাম যে কোনো কিছুই আর দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। সেখানে 'মাস্কবাদী'-র ঝাঁ-চকচকে বিজ্ঞাপন অনেকটা টাটকা দমকা বাতাসের মত লাগল। 
সুজনের অভিনয় ভাল। তবে আরো ভাল ওর কম্পোজ করা ভিস্যুয়ালস। স্টেজে এমন এমন আবহ তৈরী করে তা স্বপ্নের মত, মনে হয় যেন এর থেকে ভাল হতে পারত না। 
'মাস্কবাদী' যেহেতু একটা স্টেজ-ব্যতিরেকে প্রয়াস, আমার প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেল। কারণ স্টেজের থেকে ক্যামেরার স্বাধীনতার গন্ডী অনেক বেশি বিস্তৃত।
কিছুদিন পরেই আবার একটা নতুন প্রকাশ-- আমার এক্কেবারে ছোটবেলার বেলুড়ের পাড়ার বন্ধু নানু ওরফে দেবনাথ চ্যাটার্জী 'চেতনা'-র সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, একেবারে চাকরী বাকরী ছেড়ে দিয়ে। এটা অনেকটা দারুন একটা ডার্ক চকোলেট ওয়েট পেসট্রী-র ওপর একটা চেরী বসানো গারনিশিং, আমার 'মাস্কবাদী' নিয়ে আকাশচুম্বী প্রত্যাশায়।
সময় এল, ছ'টা বাজল...এখনো কুমীর এল না....কিছুতেই ইউ-টিউবে লিংক পাওয়া যায় না...অবশেষে কিছুক্ষণ পরে পেলাম। 
শুরু হল। আমার মাথার জিব লকলক করছে ক্ষিদেয়..
কিন্তু যা প্রত্যাশা ছিল সে তুলনায় সে রকম কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, একটা সলিড পাঞ্চ-এর জন্য, যেটা মাথায় ঘুর ঘুর করবে, মানুষ হিসেবে আমাকে আর আমার বিবেক বোধ কে অস্থির করে তুলবে.... কিন্তু হল না। 
ঝপাঝপ জাম্পকাট, শব্দের লেজ দিয়ে নতুন শব্দের মুখ বানিয়ে একটার সাথে আর এক ব্যক্তি বা পরিস্থিতির যোগসূত্র স্থাপন করে চলা, সবই আশানুরূপ গন্ডীর মধ্যে রইল। কিছুতেই অতিক্রম করল না। ন'মিনিট তেইশ সেকেন্ডের মধ্যে, আসলে কি বক্তব্য সেটা খুব কনফিউসিং। পুরো ব্যাপারটা এতটাই সিমবল-সমৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে যে কিসের সিমবল সেটাই বোঝা দায়। ফলে স্যাটায়ার-টা বারবার তৈরী হতে হতেও হল না, না পৌঁছাল একটা মনে রাখার মত ক্লাইম্যাক্সে। 
'মাস্কবাদী'-র প্রতিপাদ্য বিষয় তার বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইনে যতটা স্পষ্ট, মূল উপস্থাপনার শেষে তার জগাখিচুড়ী। দানাই বাঁধতে পারল না উপজীব্য বিষয়টা। 
পরিচালক-কে দোষ দিয়ে লাভ নেই কারণ এ-ও তো হতে পারে যে নিতান্ত সাধারণ দর্শক হিসেবে, 'মাস্কবাদী' বোঝার মত সূক্ষ্ম চেতনা থেকে ঈশ্বর আমাকে বঞ্চিত করেছেন।
আশাকরি পরের বার 'চেতনা'-র যে কোনো প্রয়াস আমার স্বাভাবিক সাধারণ প্রত্যাশা কে হতাশ করবে না।
এ তো গেল আমার মতামত। আপনি নিজেই দেখে বিচার করুন না, দেখুন না আপনার কেমন লাগে!!!

ইউ-টিউব লিংকঃ 
https://youtu.be/ubVw4poSvdk