Sunday, 13 December 2020

Chhayanat: A Virtual Natyamela: December 2020

পুরো পুজোটাই কেটে গেল, স্টেজ ব্যাপারটা বাদ রেখে। পারফর্মিং আর্ট বন্ধ। মাঝেমধ্যে কিছু অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছিল, ঠিক পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়, কারণ সেগুলো নাটক কম, সিনেমা বেশি। কড়াকড়ি শিথিল হতে হতে, অনেক মানুষ-কে হারাল পৃথিবী, যে ক্ষতি অপূরনীয়। আমি যখন লিখতে বসেছি, লীয়ারের নাম ভূমিকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গত হয়েছেন, গত হয়েছেন মনু মুখার্জী-ও। সৌমিত্রবাবু-র ভাবশিষ্য, দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় আমার পরম বন্ধু, এক্কেবারে ছেলেবেলার। তার দেওয়া পোস্টে জানতে পারলাম যে স্টেজ আবার খুলছে। ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২০ তে দুপুর বেলায় আছে ‘’অন্ধযুগ’ নাটকের শো, আকাদেমি তে। তার আগে জানলাম, আমার ছেলের কাছ থেকে যে ‘কে’ এর শো আছে জ্ঞানমঞ্চে, ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে। মন আনন্দে ভরে উঠেছিল, আবার নাটক হবে শুনে। শেষ নাটক দেখেছি, মার্চ মাসে । তারপর থেকে নাভিশ্বাস উঠে এসেছে, বারে বারে, দর্শকাসনে বসার জন্য। নাটক দেখার সেই স্পেল ছিল নাট্যোৎসবের। পরপর দেখেছিলাম বেশ কয়েকটি ভাল নাটক। তারপর মনে ধন্দ জেগেছিল, নাট্যোৎসব আবার হবে তো।

স্টেজে কিছু হুট করে শুরু হওয়ার আগে, অনলাইনে নাট্যোৎসব ঘোষিত হল ঃ


ছায়ানট – দ্য ভারচ্যুয়াল নাট্যমেলা। পয়লা ডিসেম্বর থেকে ৫-ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। আয়োজনে, ‘দশ-ইয়ারী’ থিয়েটার দল। গত কয়েক বছর আগে শুরু করেছেন দলটি, কলকাতায় এবং দ্রুততার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন নাট্যপ্রেমী মানুষদের মধ্যে। এর মূল কারণ হল, শুধু নিজেদের দল নয়, অন্যান্য  দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে, কোনো প্রতিযোগীতায় না গিয়ে, একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা, যেখানে মূলমন্ত্র হল, ‘কাজ করলে তবে না ভুল হবে, ভুল থেকে শিখি, যত ভুল করব তত বেশি শিখব’।

আমি অধীর আগ্রহে বসে ছিলাম, অনেকদিন পর নাটক দেখব বলে। এক তারিখে সন্ধ্যেবেলায় নাট্য মেলার শুরুতে কিছু কথাবার্তা তো থাকবেই। ডঃ ময়ূরী মিত্র প্রাণ ঢেলে বলে গেলেন অনেক কিছু। খুব জড়তা ছাড়াই। কিন্তু বড্ড দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল একটা সময়ে, কারণ আমরা এসেছি নাটক দেখতে। ‘দশ-ইয়ারী’ থিয়েটার দলের মূল কর্ণধার, সুচিতা রায়চৌধুরী, তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্যেই জানালেন সেদিনের নাটকের মূল ভাব সম্পর্কে। তাঁর নিজের লেখা নাটক। আমরা দেবদেবীদের নিয়ে পলিটিক্যাল স্যাটায়ার প্রথম দেখছি এরকম তো নয়, কিন্তু এই নাটক-টি সামান্য হলেও একটু অন্য ধরণের, যেটা না দেখলে বোঝা যাবে না। যাতে ভয়েস রেকর্ডিং ভালো হয়, তাই হয়ত একটু যাত্রার মত উচ্চ তানে বাঁধা। তবে মাঝে মাঝে যেন মেলোড্রামা আর ডায়ালগ, দুটোই এই যাত্রা-আঙ্গিকের চাহিদা প্রকাশ করে। দেখে  ফেলুন সময় করে ষোলো মিনিটের এই নাটক টি। নাকি ‘নাটিকা’ বলব!

লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=8FS_0-9_Nfs&feature=youtu.be

দ্বিতীয় দিন, ২ তারিখে ছিল নাটক “আমি সুরঞ্জন”। পঁচিশ মিনিটের ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। দেখানো হয়েছে, থুড়ি, শোনানো হয়েছে স্পষ্টতই ত্রিকোন প্রেমের অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিশেষ রূপে শ্লেষিত হয়েছে  অদ্ভুত মানসিক জটিলতা। শোনানো হয়েছে বললাম এই কারনে যে এটি আদ্যোপান্ত শ্রুতিনাটক এবং একটি নাট্যোৎসবে এটা একটা অভাবনীয় পাওনা। সানডে সাসপেন্স যেখান থেকে উৎসারিত আমরা সেই মেইন স্ট্রীম শ্রুতিনাটক কে ভুলতে বসেছি। শাঁওলী মিত্রের একক অভিনয় দেখেছিলাম ‘কথা অমৃত সমান’-এ । এখন আর পারেন না। ওটা শ্রুতি হিসেবেই অভিনীত হয়। তবে এই শ্রুতিতে একটা নতুন মনোগ্রাহী অংশ আনা হয়েছে। শ্রুতি যতক্ষণ চলেছে, নানা রকমের ক্লিপিং বা স্টিল শট দিয়ে না ভরিয়ে, রাখা হয়েছে স্টুডিওর র’ ভার্শান, যা অনলাইনে দর্শকদের অনেকটাই চরিত্রের সঙ্গে একাত্ব করে তুলবে। শিক্ষনীয়, শুধু শব্দ উচ্চারণ করে কি করে মনের ও শরীরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটাতে হয়।

 লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=0gvz3me-jO8&feature=youtu.be

তৃতীয় দিনে আবার বেহালা ‘ঘুমচোখ’- দলের তৈরী করা দুটি শ্রতি নাটকঃ প্রথম নাটক “একটি দিনের জন্য”। আধঘণ্টায় স্বপ্ন ছোঁয়া ও ভাঙার গল্প ‘কাপুরুষ” সিনেমার ধাঁচে। তবে হ্যাঁ, এই গল্পটা 'কাপুরুষ'-এর মত সীমিত মানুষের গল্প নয়, বেশির ভাগ মানুষের-ই মনে হবে, “আরে এ তো আমার গল্প! ওরা জানল কি করে!” সেদিনের থালায়, গুরুপাক এই ভোজনের পরে, শেষ চোদ্দ মিনিটের মধ্যে চাটনি, মিষ্টি ও পাঁপড়ের সম্ভার গোছানো হল দ্বিতীয় শ্রুতি নাটক, ‘হ্যামলেট’ নামক সেই ক্লাসিকের হাত ধরে। এটা ঠিক দেব সাহিত্য কুটিরের “শেক্সপীয়রের ট্র্যাজেডী” বই-এ যে রকম করে পুরো নাটকটিকে ছোট্ট করে লেখা আছে সে রকম। শুধু প্রাধান্য পেয়েছে হ্যামলেটের মৃত্যুর সময়ে যন্ত্রণা, যেমন আমারা দেখেছি শাহিদ কাপুরের ‘হায়দর’ সিনেমাটিতে। শুধু সব কিছুর মধ্যে এক একটি চরিত্র আলাদা আলাদা জায়গায় বসে রেকর্ডিং করে গিয়েছেন সেটা বড্ড প্রকট, আর এই নাটকে পর পর ছেলে-ভোলানো স্টিল ছবির স্লাইড শো না থাকলেই হাল হত। নাটক যতটা উঠছিল, তার উচ্চতাকে কমিয়ে আনে এই অবাঞ্ছিত ছবির সমাহার। অবাক হলাম ‘ঘুমচোখ’ শ্রুতি নাটক নিয়েই কাজ করে বিশেষ করে, বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গেও তাঁরা অনেক বছর ধরে যুক্ত, তবু কেন ওনারা এই ব্যাপআরে ঘুমিয়ে রইলেন, কেন তাঁদের চোখ খুলল না?

লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=Dm4Q0revH-I&feature=youtu.be

চতুর্থ দিনের জন্য সবাই অপেক্ষায় ছিলাম, কারণ দলের নাম একটু ভারী – ‘অনুযুগ’, আর নাটকের নাম 'যাত্রী'। দল রমরমিয়ে চলছে চব্বিশ বছর ধরে, আর কর্ণধার সজল চক্রবর্তীর লেখা ‘যাত্রী’-র বয়স ও প্রায় সমান। সমান চাহিদা আজও বাজারে এই নাটকটির। শহর-গ্রাম-মফঃস্বলের সীমানা ভেঙে সমস্ত শ্রেণির মানুষের কাছে এই দলের আর কোনো প্রযোজনা এত দীর্ঘস্থায়ী হয় নি বলে নিজেই দাবী করেছেন সজল বাবু, সেদিনের মুখবন্ধে। কেন, কি ব্যাপার, কি এমন আছে এই নাটকে – উত্তর খুঁজতে হলে দেখে ফেলুন। আমি বরং শেষ দিনের জন্য কি লিখব সেই নিয়ে ভাবতে বসি।

লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=RjaSzXYaxsE&feature=youtu.be

শেষ বলে ছক্কা – মনোজ মিত্র লিখতেনও সে রকম। ‘উমা’- তে তিনি নিজে বলে গিয়েছেন অঞ্জন দত্ত কে, “গল্পটা কিন্তু বলে যেতে হবে, একজন হলেও, বলে যেতে হবে।“ ঠিক সেরকম-ই এক দম্পতির গল্প বলা আছে তাঁর ‘আঁখিপল্লব’ নাটকে যেখানে আপাত স্বার্থপর দু জন মানুষ এক সঙ্গে থাকতে থাকতে, ঝগড়া করতে বুঝতেও পারেন না বাঁধনটা কত আঁট হয়ে গিয়েছে। ভাল পরিবেশন। সময় করে দেখে ফেলুন। আঁখিপল্লব ফেলার সুযোগ পাবেন না।

লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=_6yNDQ2B3q0&feature=youtu.be

সব থেকে ভাল ব্যাপার এই যে, ‘দশ ইয়ারী’ নাট্যদল এই কঠিন সময়ে তাঁদের সীমিত ক্ষমতা ও নাটক-কে টিঁকিয়ে রাখার জেদ নিয়ে এতগুলো দলকে একত্রিত করে গোটা একটা ভার্চ্যুয়াল নাট্যোৎসব করে সবাই কে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল...গল্পটা যে বলে যেতে হবে...!!!

নাটক কে কেউ থামাতে পারবে না। নাটক থামবে না। নাটক তো জীবনের…তাই…এটা বুঝতে ‘পিরানদেল্লো’ –কে, তাঁর যে ছয়টি চরিত্র, পরিচালক পাচ্ছিল না, তাঁদের একবার দেখতে, পড়তে‌ বুঝতে হবে। তবেই না ‘ভাবা’ প্র্যাকটিস হবে।

…ভাবলেই মানুষ আর সুখী থাকে না…বিপ্লব হয়...।।

No comments: