Friday, 25 December 2020

যুযুৎসু-র প্যাঁচ


গতকালই শুনে এলাম, এক জায়গায় অফিসিয়াল কাজে গিয়ে, “ব্যাটা (আমার ‘কলচর’ নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, তাই আসল আসল শব্দ টা বদলে দিলাম) শুভেন্দু নাকি?” আমি ভাবলাম এই নামে হাজার একটা মানুষ থাকতে পারেন, তাই সরল বিশ্বাসে বক্তা কে জিজ্ঞেস করলাম “তিনি কে ভাই, আমি চিনি?” নেহাত আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট, নাহলে ওর বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ বলছিল আমাকে তুলো-ধোনা করে দিলে ওর শরীর জুড়োত। 
“তুমি জান না! ন্যাকামী হচ্ছে! এটা নতুন চলতি খিস্তি। বাজারে বললেই লোকে ক্ষেপে আগুন হয়ে যাচ্ছে”। 
বুঝলাম যে বাংলার সংস্কৃতি-তে ভদ্রলোক রাজনৈতিক অজাচার করে আমাদের ক্লাসিক্যাল ক্যারেক্টর, ‘বিভীষণ’-এ ভাগ বসিয়েছেন। আপাততঃ “ঘরের শত্রু বিভীষণ” না বলে রিপ্লেসমেন্টে “শুভেন্দু” বলে চালিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ক্লাসিকস রামায়ণ-মহাভারতে একমাত্র বিভীষণ-ই ঘরের শত্রু ছিলেন না। ধৃতরাষ্ট্রের শত-পুত্রের মধ্যে অন্যতম গুণনিধি যুযুৎসু কিন্তু পান্ডব পক্ষে যোগদান করেছিলেন এবং যুদ্ধ শেষে তিনি পিতা-মাতার কাছে ফিরত-ও এসেছিলেন। এক বিশেষ রকমের মল্লযুদ্ধে যুযুৎসু ছিলেন অপরাজেয় যা থেকে ‘যুযুৎসুর প্যাঁচ’ কথাটি এসেছে। এর অর্থ হল ‘যে প্যাঁচ আর ছাড়ানো যায় না।“ অনেকটা সলমন খানের ‘সুলতান’-এর শেষ প্যাঁচের মত –যা একবার দিলে আর ওঠা যায় না। 
যাক গিয়ে। যে কথা বলতে গিয়ে এত অতিরিক্ত কথা এসে গেল -- রামায়ণ-মহাভারত বা তার বিভিন্ন অংশ ও চরিত্র নিয়ে নানা রকমের নাটক হয়েই চলেছে অনেক আগে থেকেই। তবে আমার কাছে মনে রাখার মত ছিল শাঁওলী মিত্রের একক অভিনয়ে “কথা অমৃত সমান” আর কোভিডের আগে দেখা নান্দীকারের ‘পাঞ্চজন্য’। রাধা ও গান্ধারীর ভূমিকায় মা ও মেয়ে যথাক্রমে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও সোহিনী সেনগুপ্ত, অনবদ্য। কৃষ্ণ কি ধুরন্ধর ছিলেন, তাঁকে দেবতা থেকে মানুষ করে দেওয়ার প্রধান কারিগর গান্ধারী কিভাবে তাঁর ম্যাজিক্যাল আর মিথিক্যাল ক্যারিশমা-কে ইথেরিয়াল থেকে রিয়েল করে তুলেছেন দেখার মত। আর ‘উরুভঙ্গম’ আমি এখন-ও দেখে উঠতে পারি নি। 
‘মুখোমুখি’-র নতুন নাটক ‘অন্ধযুগ’ (ধরমবীর ভারতী লিখিত, প্রণতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুদিত ও পৌলমী চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত)  নাটক-টিও সেই অবয়বে গঠিত। আসলে দুর্যোধনের উরুভঙ্গের পর মহাভারতের গপ্প-টা ঠিক কি ছিল, কেউ ঠিক মনে রাখতে পারি না, ঠিক বাংলা বর্ণমালার শেষ দিকটার মত ‘…য-র-ল-ব-শ’ তারপর? তারপর হ-য-ব-র-ল। সেই বেড়াল কি করে আবার রুমালের আকার ফিরত পেল তা দেখতে হলে, জানতে হলে শিখতে হলে ‘অন্ধযুগ’ অবশ্যই দেখতে হবে। এতেও আমি যদি আপনাদের এই নাটকটি দেখার তিতিক্ষা গঠন করতে অসমর্থ হই, তবে একটু হাঈ-ভোল্টেজ দিয়ে দিই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, সৌমিত্র চট্টোপাধায়, এবং সেই সৌমিত্র চট্টোপাধায় যাঁর নামটুকুই যথেষ্ঠ,স্বয়ং তাঁর এই নাটকটি করার কথা ছিল। পারেন নি।আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আমার চোখে জল এল নাটক-টি দেখতে দেখতে হঠাৎ-ই যখন একটি সময়ে কৃষ্ণের চরিত্রে তাঁর আকাশবানীতে (ভুল করে রেডিও ভাববেন না)ভয়েস ওভারে ভাসল হল। ওফ, মার্ভেলাস। কোথায় দেবশঙ্কর হালদার (অশ্বত্থামা-র ভূমিকায়) কোথায় পৌলমী চট্টোপাধ্যায় (সৌমিত্রের কন্যা গান্ধারীর ভূমিকায়) কোথায় বাকি চরিত্রদের দাপুটে অভিনয়। সব ভাসিয়ে দিলেন শুধু কন্ঠ  দিয়ে অভিনয় করে।  সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-কে হারানোর পরে আজ এটাই বিলু দত্ত নিবেদিত শ্যামবাজার মুখমুখি-র প্রথম শো। পরের শো আজ  থেকে ঠিক একমাস পরে আকাদেমী-তেই ২৫ শে জানুয়ারী, ২০২১ তারিখে।
আমার বাল্যবন্ধু ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর ভাবশিষ্য দেবনাথ (চট্টোপাধায়,কাকতালীয় ভাবে) ছোট চরিত্র হলেও খুব গুরুত্বপূর্ন চরিত্র যুযুৎসু-র ভূমিকায় অভিনয় করে দেখিয়ে দিল ওর মধ্যে কি আগুন জ্বলছে। ওর অভিনয় দিয়ে ও বুঝিয়ে দেয়, নিঃশব্দে, “নাটক করব বলে ভাল চাকরি ছেড়েছি সবে তো দু’বছর…দেখাব আস্তে আস্তে কি হয়”। আমি-ও অপেক্ষায় আছি ওকে অনেক বড় জায়গায় দেখব বলে।
এরকম একটা নাটকে ছন্দপতন ঘটে যখন অত্যন্ত সীমিত সময়ের মধ্যে ‘যুধিষ্ঠির’ চরিত্রের আগমণ ঘটে। একদম মুখস্থ সংলাপ রোবোটের মত আওড়ে গেলেন। মনে হয় দর্শক আসনে থাকা অনেকেই ছিলেন যাঁদের হয়ত ঘন্টা খানেক সময় দিলে ওনার থেকে অনেক ভাল অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন। বেশ খারাপ লাগল যে এতটা দূর্বল অভিনয় অভিজ্ঞ নাট্য-পরিচালিকা হয়ে পৌলমী দেবী কেন লক্ষ্য করলেন না বা লক্ষ্য করেও কম্প্রোমাইজ করলেন। নাটক যা বলে আসছে, প্রতিটা চরিত্র নিয়ে দর্শকের মনের মধ্যে কিন্তু একটা ছবি আঁকা হয়ে যায়, তারপর যদি নিজেদেরই হাতে আঁকা সেই ছবির সঙ্গে অভিনয় চরিত্রের কোনো মিলই না থাকে, তবে দোষ কার! তবে ভিতরের কথা জানি না। হয়ত কোনো আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এরকম করতে বাধ্য হয়েছে দল। কিন্তু দর্শক বড় নির্মম। খারাপের কোনো অজুহাত তারা মানে না কারণ, টিকিটের দাম নেহাত কম নয়। আশা রাখি পরের শো গুলোতে এরকম হবে না।
কার্টেন কল-এ কোভিড পরিস্থিতিতে এত দর্শক-সমাগম দেখে পৌলমী দেবী অভিভূত। আমাদের ধন্যবাদ জানালেন। না বলে পারলাম না, যে আমরাও নাটকদেখনবাজ-রাও স্টেজ খুলতে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।
নাটক চলুক…ভাল হোক বা খারাপ…না হলে লিখব কি!!!! যদিও লিখে খাওয়া আমার পেশা নয়, নিতান্তই শখে…।

No comments: